banner

শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 401 বার পঠিত

 

কালো মেয়ের কিছু কথা

কালো মেয়ের কিছু কথা


আঞ্জুমান আরা


ছোটবেলার কথা। গায়ের রঙ কালো ছিল বলে অনেকেই অনেক কিছু বলত যেমন, তোর বাপের অনেক যৌতুক দিতে হবে । তুই সেজে কি করবি। তুইতো কালো।
মনের মধ্যে একটা চাপা কষ্ট নিয়ে দিন কাটত। নিজেকে খুব ছোট ও মূল্যহীন মন হত। সেজন্য সাজতে লজ্জা হত। লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছি অনেক।

বলে রাখি আমি ছোটবেলাটা বেশী কাটিয়েছি গ্রামে। মাাথার মধ্যে শুধু বিয়ে যৌতূক এসব ঢুকোনো হয়েছিল। শুধু আব্বা বলতেন ভালো করে পড়াশুনা করো।
বাঙ্গালী মেয়ে হিসেবে আরো কিছু নেগেটিভ কথা শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। যেমন; মেয়ে মানুষের বুদ্ধি কম। মেয়েদের কথা বাদ দাও। মেয়েদের চাকরি করার দরকার নাই। মেয়েলি কান্না থামাও। মেয়েলি স্বভাব বদলাও। মেয়েটি কালো আরেকটি দেখ। মেয়েটি মাল ইত্যাদি।
এসমস্ত কথা কিন্তু শিক্ষিত ব্যক্তিদের মুখেও শুনেছি। যাদেরকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনি ও জানি।
ছোটবেলায় আমি মানুষের ওসব নেগেটিভ কথা বিশ্বাস করতাম আবার আব্বার কথাও শুনতাম। এজন্য মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনার ফাঁকেফাঁকে গায়ে হলুদ মাখতাম। তখন বাজারে কাঁচা হলুদ পাওয়া যেত।
কাঁচা হলুদে গায়ের বর্নের কোন উন্নতি না হলেও পরীক্ষার রেজাল্ট ভাল হওয়া শুরু করল।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাশ করার পর দেখলাম আমার স্কুল, কলেজ, আনার্স, মাস্টার্স সহ চারটা ফাস্ট ক্লাস হয়ে গেছে।। তারমধ্যে একটাতে আবার ফার্সক্লাস ফার্স্ট। নিজের বায়োডাটায় নিজেই মুগ্ধ।
চারদিক থেকে চাকরির অফার আসা শুরু করল। দরখাস্ত করা ছাড়াই। কোনটা ছেড়ে কোনটা ধরি আবস্থা। বিসিএস টাও পাশ করে ফেললাম।

বিয়ে? সেটা থেকে বাঁচতে মিথ্যা কথা বলতে হয়েছে আমাকে। বলেছি এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে। আসলে হয়নি। কারন বিয়ের বাজারেও আমার কদর বেড়ে গিয়েছিল।
একসময় যারা আমার গায়ের বর্ন নিয়ে কানাঘুষা করত তাদের সুরও বদলে যেতে থাকল। আমিও আমার জীবন উপভোগ করতে শুরু করলাম। সুদর্শন মেধাবী আর্মি অফিসার স্বামী সন্তানসহ আমার চাকরি জীবন।

আসলে মেয়েদের গায়ের বর্ণই কি সব? আমার কাছে জীবনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ, প্রবল ইচ্ছাশক্তি সেইলক্ষে কঠোর পরিশ্রম আর সাথে প্রচন্ড আত্ববিশ্বাসই নারীর আসল বর্ণ। যা নারীর মর্যাদা বাড়ায়। এই শক্তি যৌতুক কেউ হার মানায়। নারীর নির্যাতন কমায়। মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখায়। নিন্দুকের মাথানত করতে শেখায়।
এখন দেখছি ফর্সা মেয়েদের অনেকেই ঘরের চৌকাঠ পেরুতে পারেনি আর আমি পৃথিবীর আনাচে কানাচে চষে বেড়াই। আর সেই সুন্দরীরা অনেকেই আবার শশুড় শাশুড়ি ও স্বামী দ্বারাও নির্যাতিত হতে শুনি। যা সত্যি কষ্টকর।
এখন মনে হয় নারীর প্রতি এসব নেগেটিভ ধারণা আসলে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত পুরুষরা বেশি করে কারন সে যা দেখে এসেছে তার পিতামাতার কাছ থেকে তাই তার জীবনে প্রয়োগ করে। এরা নারী জাতিকে সন্মান করতে শেখে নি, শিখেছে কিভাবে প্রভু হতে হয়।
সে ভুলে যায় সে কোন মায়ের গর্ভে জন্ম গ্রহন করেছিল। সে নির্যাতক খাতায় নাম লেখায় নিজের অজান্তেই। সমাজ যদি পুরুষ শাসিত না হয়ে নারী শাসিত হত তাহলে কিন্তু নারীরাও একি খাতায় নাম লিখাতো। নারী হত তখন নির্যাতক।
কিন্তু আমাদের সমাজে এখনো অনেক নারী নিকৃষ্ট জীবনযাপন করে। শুধুমাত্র ভক্তি ও দায়বদ্ধতার কারনে। বিনিময়ে সে কিছুই পায় না। তারপরেও সে মাটি আঁকড়ে পরে থাকে। কারণ তার তো যাওয়ার কোন জায়গা নেই। কারন সে পরনির্ভরশীল। সেইসাথে যোগ হয় মানসিক নির্যাতন।
নারীর মুক্তি তখনই যখন সে আত্বনির্ভরশীল হবে। নিজের আত্ববিশ্বাস বাড়িয়ে নিজের মত প্রকাশ করতে পারবে। নিজের অধিকারর আদায় করতে পারবে। দেশ তার লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণে সঠিক আইন প্রয়োগ করবে। আর যতদিন তা না হয় ততদিন নারী প্রভুভক্ত হয়ে থাকবে পুরুষের কাছে।
আপনি যদি বাবা মা হন তাহলে আপনার সন্তানকে কি শিক্ষা দিচ্ছেন তা ভেবে দেখুন।
আপনার দেয়া সঠিক শিক্ষার উপরই নির্ভর করবে আপনার সন্তান কি ধরণের ধারণা ও আচরণ করবে অন্যের প্রতি। তাকে ছেলেমানুষ মেয়েমানুষ নাকি মানুষ বানাবেন, তার দায়িত্ব কিন্তু আপনার আমার সকলের।
সকলের মঙ্গল কামনায়

আঞ্জু, লন্ডন।

Facebook Comments