banner

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 602 বার পঠিত

 

আপনার শিশু কি কনভার্সন ডিসঅর্ডারে ভুগছে?

কেস হিস্ট্রি-এক

দশ বছরের মার্জিয়া প্রতিবছর পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করছে। লেখাপড়ায় ভালো, তাই সবার কাছে যথেষ্ট আদর-স্নেহ পায়। কিন্তু এ বছর বার্ষিক পরীক্ষার আগে হঠাৎ করে বারবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। অসুস্থতার কারণে তাঁর পড়াশোনা হচ্ছে না। শারীরিক অবস্থার কারণে প্রথম স্থান ধরে রাখা নিয়ে মার্জিয়া ভীষণভাবে চিন্তিত। বিভিন্ন ডাক্তারি পরীক্ষায় তাঁর কোনো শারীরিক সমস্যা পাওয়া যায়নি। ডাক্তার জানালেন, তাঁর কনভার্সন ডিসঅর্ডার হয়েছে।

কেস হিস্ট্রি-দুই

সিলভিয়া ১৪ বছরের প্রাণবন্ত মেয়ে। হঠাৎ তার হাত-পা অবশ হয়ে যাচ্ছে। সে হাতে-পায়ে শক্তি পাচ্ছে না। তাকেও ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হলো। মার্জিয়ার মতো সিলভিয়ারও শারীরিক পরীক্ষায় কোনো রোগ ধরা পড়েনি। তবে ডাক্তার জানালেন, এটি কনভার্সন ডিসঅর্ডার। ডাক্তারের পরামর্শে তাকে সাইকোথেরাপির জন্য আনা হলে কয়েক সপ্তাহের সাইকোথেরাপি শেষে সিলভিয়া সম্পূর্ণ ভালো হয়ে ওঠে।

অনেক শিশু মার্জিয়া ও সিলভিয়ার মতো বিভিন্ন লক্ষণ নিয়ে কনভার্সন ডিসঅর্ডারে ভুগছে। যথেষ্ট সচেতনতার অভাবে তাঁরা সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছে না। ফলে তাদের লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটছে। এর প্রভাবে পরবর্তী জীবনেও নানা ধরনের শারীরিক ও আবেগীয় জটিলতা তৈরি হচ্ছে। কনভার্সন ডিসঅর্ডার সম্পর্কে সচেতন হলে শিশুর সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ দেওয়া সম্ভব হবে। জেনে নিই কনভার্সন ডিসঅর্ডার বিষয়ে।

লক্ষণ

কনভার্সন ডিসঅর্ডারের উপসর্গ দেখলে মনে হবে, নিউরোলজিক্যাল কোনো সমস্যা হয়েছে। হয় সে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সংবেদন করতে পারছে না, নয়তো শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নাড়াতে পারছে না বা শক্তি পাচ্ছে না। আবার খিঁচুনি বা সংজ্ঞা হারানোর মতো উপসর্গ দেখা দেয় কনভার্সন ডিসঅর্ডারে। ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সংবেদন করতে না পারার মধ্যে রয়েছে-চোখে দেখতে না পাওয়া বা ঝাপসা দেখা, কানে না শোনা, ত্বকে স্পর্শের অনুভূতি না পাওয়া বা কম বা বেশি পাওয়া, শরীরে কোনো অংশে ব্যথা অনুভব করা ইত্যাদি।

ক্রিয়াগত বা শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সঞ্চালনগত সমস্যার মধ্যে রয়েছে-সম্পূর্ণ বা আংশিক প্যারালাইসিসের মতো উপসর্গগুলো, লেখার সময় হাত কাঁপা বা আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া, কোনো মাংসপেশির স্পন্দন, খিঁচুনি, হাঁটতে অসুবিধা, বাকশক্তি কাজ না করা বা ফিসফিস করে কথা বলা, মূর্ছা যাওয়া ইত্যাদি।
কেন হয়

মানসিক কোনো চাপ বা দ্বন্দ্ব প্রকাশ করতে বা সেগুলো দূর করতে না পারলে মনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। যখন এই মানসিক প্রতিক্রিয়াগুলো প্রকাশও করতে পারে না আবার সহ্যও করতে পারে না, তখন শারীরিক লক্ষণ হিসেবে সেগুলো প্রকাশ পায়। এটিকেই কনভার্সন ডিসঅর্ডার বলে। শিশুরা তাদের আবেগ-অনুভূতি ও মতামত প্রকাশ করতে না পারায় শিশু-কিশোরদের মধ্যে এই রোগ বেশি দেখা দেয়। ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা কনভার্সন ডিসঅর্ডারে বেশি আক্রান্ত হয়।

বিশ্লেষণ

মার্জিয়ার মনের ভেতরে প্রথম স্থান হারানোর তীব্র ভয় জন্ম নেয়। কিন্তু মার্জিয়া ভয়টি স্বীকার করে না। কারণ সে প্রথম স্থান পাবে না, তা ভাবতেও পারে না। সে মনে করে, প্রথম স্থান না পেলে পরিবারে তাঁর কোনো গুরুত্ব থাকবে না। ভয়টি স্বীকার না করায় সে তা প্রকাশও করতে পারে না। মনের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব একাকী সামলাতে না পেরে শারীরিক উপসর্গ হিসেবে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তবে এর কিছুই তাঁর সচেতন মন জানে না। অর্থাৎ সে এগুলো ইচ্ছা করে করছে না।

চিকিৎসা

শারীরিক কারণ খুঁজে না পেয়ে অনেকে মনে করেন, এটি জিন-ভূতের আছর। ফলে শিশুটির ওপর কবিরাজি চিকিৎসা চলে। যা কখনো কখনো রোগের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় বা নতুন কোনো রোগের সৃষ্টি করে। অথচ কনভার্সন ডিসঅর্ডারের প্রধান চিকিৎসা হলো সাইকোথেরাপি। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে এর সঙ্গে ওষুধের চিকিৎসা গ্রহণ করতে হয়। সাইকোথেরাপিতে বিভিন্ন সাইকোলজিক্যাল পদ্ধতির মাধ্যমে রোগীর বা শিশুর ভেতরের না-বলা কথাগুলো অত্যন্ত দক্ষতা ও যত্নের সঙ্গে শোনা হয়। শিশু বা কিশোরীটির অন্তর্দ্বন্দ্বগুলো নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলা হয় ও তা নিরসন করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা হয়। সাইকোথেরাপিতে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট শিশুটির প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি পেইনগুলো খুঁজে বের করেন এবং সেগুলো কমানোর জন্য মা-বাবার সঙ্গে কথা বলেন। এভাবে শিশুটির সঙ্গে সরাসরি ও মা-বাবার মাধ্যমে দেওয়া চিকিৎসার মাধ্যমে শিশুটি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে পারে।

লেখক- তানজির আহমেদ তুষার। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ও সহকারী অধ্যাপক,রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

Facebook Comments