banner

সোমবার, ০৬ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 376 বার পঠিত

 

অনলাইনে নারী ও শিশুর সুরক্ষা নিয়ে প্রচার দরকার

বয়সে কিশোরী সপ্তম শ্রেণির ছাত্রীর টিকটকে ভিডিও বানানোর শখ। তাকে এই জগতে তারকা বানানোর লোভ দেখান কয়েকজন তরুণ। নানাবাড়ি যাওয়ার কথা বলে কিশোরী বাড়ি থেকে বেরোয়। এরপর গণধর্ষণের শিকার হয় সে। এরপর মেয়েটি ভর্তি হয়ে এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি)। এই কিশোরীই শুধু না, ইন্টারনেট দুনিয়ায় দ্রুত জনপ্রিয় হতে বা তারকা হতে গিয়ে কিশোরীরা অপরাধের শিকার হচ্ছে। টিকটক, লাইকির মতো ভিডিও প্রকাশের অ্যাপ কিংবা বিগোর মতো লাইভ ভিডিওর অ্যাপে দ্রুত তারকা হওয়ার ইচ্ছা থাকে কমবয়সী অনেক ছেলেমেয়ের। লাখ লাখ অনুসারী, লাইকের আশায় অনেকেই এসব মাধ্যমে যায়। আর এর সুযোগ নেয় অপরাধীরা। এখন নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার অন্যতম মাধ্যম হয়েছে অনলাইন দুনিয়া।

প্রায় দুই বছর আগে ইউনিসেফের জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের ৩২ শতাংশ শিশু অনলাইন সহিংসতা, অনলাইনে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও ডিজিটাল উৎপীড়নের শিকার হওয়ার মতো বিপদের মুখে রয়েছে। সেখানে ৬৩ শতাংশ ছেলে এবং ৪৮ শতাংশ মেয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। এ ছাড়া বলা হয়, ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৭০ শতাংশ ছেলে ও ৪৪ শতাংশ মেয়ে অনলাইনে অপরিচিত মানুষের বন্ধুত্বের অনুরোধ গ্রহণ করে।

প্রথম আলো ও বেসরকারি সংগঠন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ গত বছরের ২১ থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত অনলাইনে সহিংসতার মাত্রা বুঝতে অনলাইনে একটি জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে দেখা যায়, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারকারীদের মধ্যে প্রায় ৫৩ শতাংশ নারী কখনো না কখনো অনলাইনে হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল সেন্টার ফর মিসিং অ্যান্ড এক্সপ্লয়টেড চিলড্রেনের (এনসিএমইসি) তথ্য অনুযায়ী, শিশুদের দিয়ে যৌন-দৃশ্যে কাজ করানো, তাদের যৌন নিপীড়নের ছবি ও ভিডিও ধারণ এবং তা আদান–প্রদানের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম।

নারী ও শিশুর প্রতি সাইবার বুলিং এখন অন্যতম সমস্যা বলে জানান ইউনিসেফের শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ শাবনাজ জাহেরিন। তিনি বলেন, অনলাইনে নিরাপত্তার বিষয়গুলো অনেকেই জানে না। সে কারণেই তারা বিভিন্ন সময়ে প্রতারণা ও অপরাধের শিকার হয়। দেখা যায়, অনেকে সরাসরি যেগুলো করতে সাহস পেত না, তা অনলাইনের মাধ্যমে করছে। অনলাইন সহিংসতায় মেয়েদের ক্ষেত্রে যৌন হয়রানির অভিযোগই বেশি।

শাবনাজ জাহেরিন ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম মেনে চলা এবং নিজের নিরাপত্তার বিষয় মাথায় রাখার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, অপরিচিত কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব করা, দেখা করা, ব্যক্তিগত তথ্য ও ছবি শেয়ার করা—এ বিষয়গুলো করা যাবে না। অনলাইনে সুরক্ষিত থাকতে হলে কী করতে হবে, সেসব নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা দরকার। কেউ হয়রানি বা অপরাধের শিকার হলে কোথায় অভিযোগ করা যায়, সেগুলো নিয়েও সরকারকে প্রচারণা চালাতে হবে। ভুক্তভোগী সবার পক্ষে সব সময় পুলিশের কাছে যাওয়া হয়তো সম্ভব না। সে ক্ষেত্রে অভিযোগ করার উপায়গুলো সহজ করে দিতে হবে। বিচার-প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রেও যেন দীর্ঘসূত্রতা না হয়। সরকারের ডিজিটাল উন্নয়নের যেমন প্রচারণা আছে, পাশাপাশি অনলাইনে সুরক্ষিত থাকার বিষয়ে তেমন প্রচারণা চালাতে হবে। শিক্ষকেরাও যেন ক্লাস শেষে এসব নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন।

‘প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা নারীদের স্বাবলম্বী দেখতে চাচ্ছি এবং এটা সম্ভব। কিন্তু নারীদের জন্য সে পরিবেশ তৈরি করতে হবে,’ বললেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ফারহানা এ রহমান। তিনি আরও যোগ করলেন, ছোট থেকে কঠোর পরিবেশে মেয়ে শিশুকে বড় করা হয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে তাদের আর কিছু জানা বা বোঝার সুযোগ খুব কম দেওয়া হয়। কিন্তু সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ছোট থেকেই মেয়েদের মেশার সুযোগ দিতে হবে। তখন নিজেরাই মানুষ সম্পর্কেও ধারণা পাবে। নয়তো নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আটকে রেখে বড় করলে এই মেয়েরা যখন হঠাৎ হাতে প্রযুক্তি পায়, তখন তার জন্য ভালো–মন্দ বোঝা সম্ভব হয় না। সে অনেক ফাঁদে পড়ে যায়। অনলাইনে নারীরা নানান বিষয়ে প্রতারিত হচ্ছে। তাই ছোট থেকেই সব বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে।

সাইবার বুলিং বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির কাজ করে আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার পেয়েছে সাদাত রহমান। নিজেদের তৈরি সাইবার টিনস নামের অ্যাপের মাধ্যমে সাইবার বুলিংয়ের ভুক্তভোগীদের সহায়তা করার চেষ্টা করে। নড়াইল জেলা-ভিত্তিক কাজই বেশি করেন সাদাত রহমানেরা। নিজেদের একটি কেসের উদাহরণ দিয়ে সাদাত প্রথম আলোকে বলে, নবম শ্রেণির এক মেয়ের ফেসবুক বন্ধুদের সঙ্গে বেশি যোগাযোগ ছিল। অন্য জেলার এক ছেলের সঙ্গে তার অনেক সখ্য হয়। একপর্যায়ে ছেলেটি তার কাছ থেকে বিপদের কথা বলে কিছু টাকা নেয়। পরে ছেলেটি যোগাযোগই বন্ধ করে দেয়।

সাদাত জানায়, এসব ছাড়াও ব্ল্যাকমেলিংয়ের ঘটনা অনেক ঘটে। ব্যক্তিগত ছবি ছড়িয়ে দেওয়া, ভুয়া অ্যাকাউন্ট খোলার মতো অপরাধের শিকার হয় কিশোরীরা। নিজেদের অভিজ্ঞতার থেকে সাদাতের পরামর্শ, অনলাইনে এমন একটা জায়গা, যেখানে সবকিছুই তৃতীয় পক্ষের কাছে তথ্য চলে যায়। এখানে কখনোই ব্যক্তিগত কোনও তথ্য শেয়ার করা উচিত না। অপরিচিত কারও সঙ্গে শুধু অনলাইন বন্ধু হতে গিয়ে নিজের স্কুলের নাম পর্যন্তও জানানো উচিত না।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাইবার অপরাধ তদন্ত বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বললেন, ‘প্রযুক্তির অনেক উন্নয়ন হয়েছে। দেশে এখন টিকটক, লাইকি, নানা অ্যাপের ব্যবহার জনপ্রিয়। এসব ব্যবহার করে অনেক অপরাধের শিকার হওয়ার অনেক অভিযোগ পাচ্ছি আমরা। এ ধরনের অ্যাপ ব্যবহারের মাধ্যমে কিছু সামাজিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এ বিষয়ে পুলিশ অবগত, আমরা চেষ্টা করছি মানুষকে সচেতন করতে। ইন্টারনেটের ব্যবহার যেন ভালো হয়। ভালো কাজে যেন এটা ব্যবহার করতে পারি।’

Facebook Comments