banner

রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 845 বার পঠিত

 

ছোট ছোট ত্যাগ জীবনকে করে তোলে স্বপ্নিল (পর্ব -৫)

আফরোজা হাসান


শ্বশুর বাড়ির সবাই দুষ্টুমি করে অন্তরাকে ডাকে বহুরূপী গিরগিটি নামে। অবশ্য নামটা যথার্থই। কারণ বহুরুপী গিরগিটি যেমন যখন যে গাছে বাস করে সে গাছের সঙ্গে রঙ মিলিয়ে নিজের রঙ বদলায়, যাতে কেউ গাছ থেকে তাকে আলাদা করতে না পারে। অন্তরা তেমনি এই বহুরূপী গিরগিটি স্বভাবের কারণেই পরিবারের মধ্যমণিতে পরিণত হয়েছে। পরিবারের প্রতিটা সদস্যর সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনাতে তাদের পাশে থাকতে চেষ্টা করে সে। সবাইকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসে, আর তাই সে ভালোবাসা দ্বিগুণ রূপে ফিরে আসে সবসময় তার কাছে। কষ্ট-ব্যথা যে পায়না পরিবারের কাছ থেকে তা অবশ্য না কিন্তু সেগুলোকে মনে ধরে বসে থাকে না কখনোই অন্তরা। অন্তরার যুক্তি হচ্ছে, “একটা কিছুকে আঁকড়ে ধরে থেকে মানুষ কেন জীবনের সুখ-শান্তিকে নষ্ট করবে? এমন বোকামো কখনোই কারো করা উচিত নয়। কারণ জীবন হচ্ছে গতির নাম। শারীরিক ও মানসিক গতিশীলতা বাঁধাপ্রাপ্ত হতে পারে এমন সবকিছুকে তাই যথাসাধ্য এড়িয়ে যেতে হবে।” রান্নাঘরে ঢুকে মেঝো জা যাবিনকে মুখ ভার করে কাজ করতে দেখে অন্তরা দুষ্টুমির ছলে বলল, শুনতে পাচ্ছো কি ঝিঁঝিঁ পোকার আনন্দমুখর গান? ভুলে যাও না তবে অকারণ এই মান-অভিমান। তাকিয়ে যদি দেখ জোনাকির আলো বিচ্ছুরণ, মুহুর্তে মনের বিষাদ তোমার করে নেবে হরণ।

-যাবিন হেসে বলল, উফ ভাবী! তুমি আর তোমার কাব্য। অবশ্য সুখী মানুষেরা এমন সব পরিস্থিতিতেই ছন্দ মিলিয়ে ফেলতে পারে।

-অন্তরা চোখ বড় বড় করে বলল, সেকি তুমি দুঃখী মানুষে এই তথ্য তো জানা ছিল না আমার। তা হঠাৎ তোমার দুঃখী মানুষ হবার রহস্য কি?

-তোমার সামনেই তো তোমার দেবর আমাকে কত কথা শোনালো।

-তুমি তো জানোই যে ব্যবসার কারণে সাকিব অনেক চিন্তা-অস্থিরতা মধ্যে আছে।

-ক্ষোভ ঝরে পড়লো যাবিনের কণ্ঠে, ভাবী চিন্তা-অস্থিরতার সময় করা মানুষের আচরণই কিন্তু বলে দেয় তার মনে কার অবস্থান কোথায়।

-তুমি সংসারের টুকটাক মনোমালিন্যকে এই সংজ্ঞা দিয়ে বিবেচনা করলে কিন্তু জটিলটা বেড়ে যাবে জীবনের। সব সংজ্ঞা সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

-হুম…তুমি তো এমন বলবেই, কারণ ভাইয়া কখনোই তোমার সাথে মিস বিহেব করেন না।

-করেন না কথাটা কিন্তু ঠিক না যাবিন। সঠিক কথা হচ্ছে আমি সবসময় চেষ্টা করি এমন সবকিছু এড়িয়ে চলতে যাতে তোমার ভাইয়া বিরক্ত হতে পারেন। নয়তো তোমার ভাইয়াও কখনো মনোরম উদ্যান, শোভিত জনপদ, অঝোর জলপ্রপাত, আবার কখনো ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভুমিকম্প, আগ্নেয়পাত।

-হেসে, তোমার এসব দুষ্টু দুষ্টু কথা শুনলে মেজাজ ঠাণ্ডা হয়ে যায়।

-হেসে, আলহামদুলিল্লাহ! তাহলে হয়ে যেতে দাও মেজাজকে ঠাণ্ডা।

-কিছুক্ষন চুপ থেকে যাবিন বলল, ভাবী ভাইয়া কি সত্যিই রাগ করে তোমার সাথে? মনে কষ্ট দিয়ে কথা বলে?

-হেসে, জানো সেদিন একটা মজার তথ্য জানলাম। আমরা কষ্ট পাই না বরং তৈরি করি। আমাদেরকে কেউ কষ্ট দেয়না, আমরাই কষ্ট টেনে নেই নিজের উপর।

-সেটা কিভাবে?

-সেটা এভাবে যে কোনো ঘটনা বা কথা তোমাকে কতটা বিচলিত করবে, সেটা নির্ভর করে তুমি ঘটনা বা কথাকে কীভাবে দেখছো বা গ্রহণ করছো তার ওপর। অর্থাৎ, তোমার দৃষ্টিভঙ্গির উপর। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন-মানুষ কষ্ট পায় না, কষ্ট তৈরি করে। আর কে কেমন কষ্ট তৈরি করবে সেটা তার বেড়ে ওঠা পরিবেশ, শিক্ষা, কোয়ালিটি অব ইনফরমেশন, বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে। তুমি এই কথাগুলো নিজের সাথে মিলিয়ে দেখো তাহলেই বুঝতে পারবে।

-কিন্তু সাকিব আমার সাথে মিস বিহেব করেছে বলেই আমি কষ্ট পেয়েছি। অকারণে কষ্ট তৈরি করিনি।

-হেসে, এই যে যুক্তিটা দিলে এটা কিন্তু কষ্ট তৈরিতে আরো সহায়তা করছে।

– এতো না পেঁচিয়ে তুমি বরং আমাকে বুঝিয়ে বলো।

– অন্তরা হেসে বলল, এই যেমন দেখো সাকিব তোমার স্বভাব আর অভ্যাস নিয়ে কিছু কথা বলেছে। মিথ্যা বা ভুল কিছু কিন্তু বলেনি। তুমি যা করো সেসবই বলেছে। তুমি যদি মেনে নিতে তাহলে মান-অভিমানের প্রশ্নই উঠত না। কিন্তু তুমি মেনে না নিয়ে উল্টো রাগ করেছো। তোমাকে বোঝে না, সম্মান করে না, যথেষ্ট ভালোবাসে না ইত্যাদি ইত্যাদি নানা কথা ভাবছো। অথচ সাকিব কিন্তু এসবের কিছুই বলেনি, এই প্রতিটি চিন্তা তোমার নিজের তৈরি করা। তোমার কল্পনাপ্রসূত এসব চিন্তাই তোমার মনে কষ্টের তৈরি করছে নতুন নতুন।

– লাজুক হেসে,আমি সত্যিই তো এসব ভাবছি। তুমি বুঝলে কি করে?

– হেসে, গবেষকরা তো আর শুধু শুধু বলেননি যে, মানুষ কোনো একটি ঘটনা বা কথাকে কেন্দ্র করে নেতিবাচক চিন্তা করতে করতে পাহাড়সমান কষ্ট তৈরি করে ফেলে। আর যে সকল চিন্তা তৈরি করে তার বেশির ভাগ চিন্তাই বাস্তব না। অথচ এমন অর্থহীন বা অবাস্তব চিন্তা করে সে নিজেকে কষ্ট দিয়ে জীবনকে নষ্ট করে, ধ্বংস করে। এমন ভুল করো না যাবিন। সংসার জীবনটাও একটা পরীক্ষা আর নিজেই নিজের পরীক্ষাকে জটিল করে কি লাভ বলো। নিজের ভুলকে মেনে নেবার মাঝে কিংবা হঠাৎ করে ফেলা স্বামীর কোন ভুল আচরণকে ক্ষমা করে দেবার মাঝে তো হেরে যাবার কিছু নেই।
তাছাড়া এতে তো তুমিই বেশি লাভবান হবে তাই না?

– কিন্তু নিজেকে যে সবসময় নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনা। বিশেষ করে যখন আমার অপছন্দনীয় কিছু করে তখন।

– তোমাকে সবসময় যে কথাটা মনে রাখতে হবে সেটা হচ্ছে, জগতে তোমার ইচ্ছা মতো কেউই চলবে না। কারণ তোমার নিয়ন্ত্রণে কেউ নেই। তোমার নিয়ন্ত্রণে আছো শুধু তুমি নিজে। আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই দেখবে সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

– (হেসে) নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার কোন ম্যাজিক ওয়ার্ড নেই তোমার ভাবী?

– আলহামদুলিল্লাহ! অবশ্যই আছে, ম্যাজিক ওয়ার্ডটি হচ্ছে-

ছোট ছোট ত্যাগ জীবনকে করে বিকশিত

ভুল বোঝাবুঝির দ্বারা দাম্পত্য হয়না আশাহত

সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম জিনিসের প্রতি হলে অনুরক্ত

হতাশার ঘেরাটোপে মন হবে আসক্ত

সংসারটাকে করতে চাইলে দুর্লভ কোন ভাস্কর্য্য

অর্জন করতে হবে যে গুণ তার নাম ধৈর্য্য।

চলবে….

পর্ব-৪

Facebook Comments