banner

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 455 বার পঠিত

 

শিশুর চারপাশঃ প্রয়োজন একটু সচেতনতা

স্কুলে পড়ার সময় সমাজবিজ্ঞানে পরিবেশ কাকে বলে পড়েছি। সে সংজ্ঞায় বলা ছিল পরিবেশ বলতে আমাদের বাড়িঘর, মানুষজন, আলো-বাতাস-পানি, রাস্তাঘাট, গাছপালা, পশু-পাখি, কীটপতঙ্গ, মশা-মাছি সবকিছু বোঝায়। আমাদের সুস্বাস্থ্য এই পরিবেশের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। ঠিক তেমনি একজন শিশুর সুরক্ষা কিন্তু একইভাবে নির্ভরশীল তা নবজাতক হোক আর বড় শিশুই হোক না কেন।
শাহনাজের কথাই ধরা যাক। তার তিন মেয়ে। বাসা-বাড়িতে কাজ করে। থাকে সরকারি কলোনির এক প্রান্তে এক ছোট্ট খুপরিতে। দশটি পরিবার একসাথে গাদাগাদি করে থাকে। নোংরা স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে তার তিন শিশুকন্যা বড় হচ্ছে। একে তো অপুষ্টির শিকার তার ওপর নোংরা পুঁতিগন্ধময় পরিবেশের কারণে বাচ্চাদের রোগবালাই লেগেই থাকে। শাহনাজ অনেক চেষ্টা করে তার বাচ্চাদের সুস্থ রাখতে কিন্তু এর জন্য যতটা না তার অভাব দায়ী তার চেয়ে বেশি দায়ী চারপাশের পরিবেশ।
শাহজাদপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম পোতা-জিরার মকবুলের কথাই ধরা যাক। পোতাজিরা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সে তার নিয়মিত যাওয়া-আসা করতে হয়। কারণ তার ৬ বছরের ছেলে। প্রায়ই ডায়রিয়া, পেটখারাপ, চুলকানির কারণে হাসপাতালে তার এই আসা-যাওয়া। গরুর দুধ বিক্রি করে সে ভালোই আয় করে। নিয়মিত দুধ খাওয়ায় সে বাচ্চাকে। তারপরও এই অবস্থা। ডাক্তার পরামর্শ দিলেন যে, বাড়ির পরিবেশ পরিষ্কার রাখতে হবে। বিশুদ্ধ পানি তা যত দূর থেকেই হোক আনার ব্যবস্থা করতে হবে। বাচ্চাকে নোংরা, ধুলাবালি থেকে কীভাবে দূরে রাখা যায় তার শিক্ষা দিতে হবে ইত্যাদি নানা বিষয় ডাক্তার পালন করতে বললেন। মকবুল পরের ৩ সপ্তাহ কঠোরভাবে ডাক্তারের অনুশাসন মেনে চললেন। মকবুল লক্ষ্য করল যে তার ছেলে আর অসুস্থ হচ্ছে না।
আশপাশের পরিবেশ যদি নোংরা হয় তাহলে কোনভাবেই স্বাস্থ্য ঠিক রাখা যায় না। শিশুর ক্ষেত্রে এ কথাটি শতভাগ প্রযোজ্য কারণ একটি শিশু যখন স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেয় তখন সে থাকে একটি সুস্থ-সবল-নিরোগ একটি শিশু। পৃথিবীতে আবির্ভাবের পরই শুরু হয়ে যায় তার সংগ্রামী পথচলা। কারণ নবজাতকের চারপাশে ওঁত পেতে থাকে জীবাণু নামক শকুনেরা। এসব জীবাণুরা সামান্যতম সুযোগটুকুও হেলায় হারায় না। সোজা আক্রান্ত করে মাত্র ভূমিষ্ঠ হওয়া আদম সন্তানকে।
শিশুর স্বাস্থ্যের ওপর পরিবেশের কী প্রভাব তা অনুধাবন করতে হলে জানতে হবে শিশুর থাকার ঘরটি কেমন? পর্যাপ্ত আলো-বাতাস সে ঘরে প্রবেশের ব্যবস্থা আছে কিনা? কেমন পানি পান করে? শিশু যে শৌচাগার ব্যবহার করে তার কি অবস্থা? শৌচাগার ব্যবহারের পর দুই হাত সাবান দিয়ে ভালোমতো পরিষ্কার করে কিনা? বাড়ির ময়লা-আবর্জনা কোথায় ফেলা হয়? বাড়ির আশপাশে বদ্ধ ডোবা, জলাশয় আছে কিনা? এসব বাইরের বিষয় ছাড়াও আরও কিছু বিষয় জানতে হবে যেমন শিশুর পরিবারের সদস্যদের লেখাপড়া কতদূর? তাদের চিন্তা-ভাবনা কোন পর্যায়ের? কুসংস্কার বিশ্বাস করেন কিনা? করলে কতটুকু করেন? স্বাস্থ্য  রক্ষার নিয়মগুলো মেনে চলেন কিনা? শিশুর প্রতি মা, পরিবার, সমাজ কতটুকু যত্নবান?
এসব বিষয়গুলোর উপর নির্ভর করে শিশুর আশপাশের পরিবেশ কেমন হবে। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। ঢাকা শহরের গুলশানের মতো অভিজাত এলাকার একটি ক্লিনিকে একটি শিশুর জন্ম হয়। বাবা পদস্থ সরকারি চাকুরে। বাসা-বাড়ির অবস্থাও ভালো। কিন্তু জন্মের ৪ দিনের মাথায় শিশুটির জন্ডিস ধরা পড়ে। বাবা-মা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। ডাক্তার পরামর্শ দেন প্রতিদিন শিশুকে রোদ পোহানোর। বাবা-মা ভেবে পান না এত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার পরও কীভাবে বাবু সোনাটার জন্ডিস হলো। আসলে আমাদের চারপাশের পানি-বাতাস, খাবার, মশামাছি, কীটপতঙ্গ প্রভৃতি দ্বারা রোগের জীবাণু শরীরে প্রবেশ করতে পারে।
শিশু যে ঘরে থাকে সে ঘরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস আসতে দিতে হবে। তাহলে ঘরটি স্যাঁতস্যাঁতে থাকবে না। ভালো ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা করতে হবে যেন ঘরের ভিতরের গরম বাতাস বেরিয়ে যেতে পারে। মুক্ত বাতাস স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী। সূর্যের আলোতে রোগ-জীবাণু বাঁচতে পারে না। অল্প জায়গার মধ্যে গাদাগাদি করে থাকলে সকলের স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর এ অবস্থায় কারো সংক্রামক রোগ হলে তো কথাই নেই। এক্ষেত্রে ঘরের শিশুটির রোগাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
512_185c10b4e20b46cf7504c60eae760860
বিশুদ্ধ পানির অপর নাম জীবন। কথাটি আবালবৃদ্ধবনিতা থেকে শুরু করে শিশু সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। দূষিত পানি নানা রোগ ছড়ায়। একটু গরম পড়লেই পত্রিকায় দেখা যায় আইসিডিডিআরবি’র হাসপাতালে ডায়রিয়া আক্রান্ত শিশুদের ভিড়। যত্রতত্র পানি পান করার ফলে টাইফয়েড, কলেরা, ডায়রিয়া, আমাশয় প্রভৃতি রোগের জীবাণু পানির সাহায্যে ছড়িয়ে পড়ে। সেজন্য শিশুর খাবার পানি যেন বিশুদ্ধ হয় সে ব্যাপারে বিশেষভাবে মনোযোগ দিতে হবে।
বাড়ির চারপাশে যেন অবাঞ্ছিত ঝোপঝাড় গড়ে উঠতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে  হবে। কোথাও যেন পানি দীর্ঘদিন ধরে জমে না থাকে সেটাও নজর দিতে হবে। কারণ সেগুলো একটা সময় পরে গিয়ে মশক প্রজনন কেন্দ্রে রূপান্তরিত হবে। বাসার পায়খানাটি যথাসম্ভব পরিষ্কার রাখতে হবে। শিশুটি যেন সঠিকভাবে পায়খানা ব্যবহার করতে পারে সে বিষয়ে সচেতন হতে হবে। বাড়ির রান্নাঘর থেকে শুরু করে প্রতিটি ঘরে যেন ধুলাবালি জমতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। শিশুর হাত ধোয়ার অভ্যাসটি একেবারে মনের ভেতর গেঁথে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যেন এরপর যে কোন কিছু খাবার পূর্বে হাত- ধোয়ার বিষয়টি সে নিজে নিজেই বুঝতে পারে।
শিশুর চারপাশটা সুন্দর, পরিচ্ছন্ন পরিপাটি করে তোলার দায়িত্ব কিন্তু শিশুর নিজের নয়। এ দায়িত্ব ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তথা সকলের। কারণ জাতির অনাগত ভবিষ্যতেরা যেন রোগাক্রান্ত হয়ে অকালেই ঝরে না পড়ে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। সুন্দর পরিবেশ থেকে সুস্থ মানসিকতার শিশু বেড়ে উঠবে। এক সময় তারা বড় হয়ে নেতৃত্ব দেবে দেশ, জাতিকে পৌঁছে দেবে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে এটা সকলের কামনা।
(শিশু ও নারী উন্নয়নে যোগাযোগ কার্যক্রম নিবন্ধ)
Facebook Comments