banner

বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 823 বার পঠিত

 

সুখস্মৃতি


রেহনুমা বিনত আনিস


কিছু গন্ধ, কিছু স্বাদ, কিছু স্পর্শ, কিছু মূহূর্ত আবছা অস্পষ্ট অশরীরি স্মৃতি হয়ে ঘুরে বেড়ায় ব্যাস্ত মনের আনাচে কানাচে। অবসরের মূহূর্তে হঠাৎ দুষ্ট শিশুর মত মনের দরজায় এক ঝলক উঁকি দিয়ে পালায়। কিন্তু মন তাকে কিছুতেই হারাতে চায়না, পিছু ধাওয়া করে। কখনো জীবনের ব্যাস্ততা তাকে ফিরিয়ে আনে বাস্তবতায়, কখনো স্মৃতির সাথে চলে লুকোচুরি খেলা, আর কখনো নাছোড়বান্দা মন স্মৃতির পিছু ধাওয়া করে পৌঁছে যায় সেই সোনালী বন্দরে যেখান থেকে জাহাজ ছাড়বেনা আর কোনদিন। কিন্তু সৈকতে বসে মিষ্টি রোদে একটু হাওয়ার পরশ, এক পশলা বৃষ্টি পটে আঁকা ছবির মত তাকে মুগ্ধ করে দিয়ে যায়, এটাই প্রাপ্তি।
এমনই এক স্মৃতির পিছু ধাওয়া করছিলাম গত সাত বছর। আমার স্মৃতির শেলফগুলোতে থরে থরে সাজানো জ্ঞানীদের জ্ঞানের পসরা। নিজের নেই বলে অন্যের জ্ঞানের আলোয় নিজেকে উদ্ভাসিত করতে লজ্জা করিনি কখনো।

বইগুলোর একেকটার একেক স্বাদ, একেক গন্ধ, একেক মর্ম – ভালো লাগায় ভরপুর অনুভূতির সৃষ্টি করত দিনরাত। তখন পর্যন্ত আমার বিচরণক্ষেত্র সীমিত ছিলো বিজ্ঞান, ইতিহাস, ধর্ম, জীবনী এবং বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের বিখ্যাত গ্রন্থগুলোর মাঝে। সাহিত্যের মাঝে ভালো লাগত গোয়েন্দা কাহিনী, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, ভ্রমণ ও অ্যাডভেঞ্চার। একদিন, আমাদের হেডমিস্ট্রেস – যিনি অংক টিচার হিসেবেই সুপরিচিত – তাঁর কন্যা রাকা আপু আমার সাথে নানান বিষয়ে আলাপ হবার পর বললেন, ‘এই বয়সে কি সব কঠিন কঠিন জিনিস পড় তুমি!’ আমাকে ভিন্ন স্বাদের কিছু বইয়ের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে ওনার সংগ্রহ থেকে কিছু বই পড়তে দিলেন আপু। অনেকটা ঐতিহাসিক ধাঁচে লেখা হওয়ায় প্রথমেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম Prisoner of Zenda বইটির ওপর। একে একে শেষ করলাম আরো কয়েকটি বই। অবশেষে বাকী রইলো একটা। বইটা দেখে এমন আহামরি কিছু মনে হয়নি। পরদিন আপুদের বাসায় দাওয়াত, পরিকল্পনা ছিলো বইগুলো ফিরিয়ে দিয়ে আরো কিছু নিয়ে আসব। কিন্তু না পড়ে বই ফিরিয়ে দেয়া আমার ধাতে সয়না, মনের ভেতর খুঁতখুঁত করতে থাকে না জানি বইটাতে কি অমূল্য জ্ঞান ছিলো, সেটি আহরণের সুযোগ আমি হারিয়ে ফেললাম। আবার browse করে পড়াও আমার মত অপদার্থের দ্বারা হয়না। মনের ভেতর খচখচ করে কোন শব্দ বা কোন লাইন বাদ দিলে যদি মর্মার্থটাই বাদ পড়ে যায়! পড়ার প্রতি এই গন্ডমূর্খের মত মানসিকতার কারণে জীবনে অনেক অখাদ্যই আদ্যোপান্ত গিলে খেয়েছি। কিন্তু অনেক অসাধারন কিছুও খুঁজে পেয়েছি।
যোহরের নামাজ পড়ে বইটা নিয়ে বসলাম। তারপর শুধু নামাজ ছাড়া আর কোন বিরতির কথা মনে পড়েনা। রাত জেগে বই পড়া ছিলো নিত্যনৈমিত্তিক। কিন্তু সেই প্রথম সারা রাত জেগে পড়া। তারপর বই শেষ করে ফজর নামাজ পড়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা। যাক, লেখিকা হবার স্বপ্ন নিয়ে পথ চলা বোকা মেয়েটা অবশেষে সুখী হবার পথ খুঁজে পেলো!
সে ২৮/২৯ বছর আগের ঘটনা। সাত বছর আগে ক্যানাডা আসার পর থেকে বইটার কথা খুব মনে পড়তে থাকে। কারণ বইয়ের লেখিকা ক্যানাডিয়ান, পটভূমি ক্যানাডা। কিন্তু বইয়ের নাম, লেখকের নাম, নায়িকার নাম, নায়কের নাম কিছুই মনে নেই, মনে আছে শুধু নায়িকার বান্ধবীর নাম আর গল্পটা। বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বললাম, বুঝলাম বইটা এমন বিখ্যাত নয় যে গল্পের সার বললে কেউ বলতে পারবে বইটার নাম কি। কেন যেন মনে হচ্ছিলো লেখিকা তিনিই যিনি Anne of the Green Gables লিখে বিখ্যাত হয়েছেন। কিন্তু সেদিকেও বেশী দূর অগ্রসর হতে পারলাম না। কারণ যাচাই করার মত যথেষ্ট তথ্য আমার স্মৃতিতে সংরক্ষিত নেই।
আজ হঠাৎ মনে হোল তারাটার নাম দিয়ে গুগলে সার্চ দিলে কেমন হয়? গল্পটার খুব হৃদয়স্পর্শী একটি দৃশ্য ছিলো – ছোটবেলা থেকে একসাথে বেড়ে ওঠা দু’টি ছেলেমেয়ে, ছেলেটি লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছে অনেক দূরে, আর কোনদিন ফিরবে কি’না ঠিক নেই; সে মেয়েটিকে বলল, ‘আকাশ আমার সবচেয়ে প্রিয় তারা Lyre নক্ষত্রমন্ডলীর সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র Vega. এই তারাটির দিকে তাকালেই আমি তোমার কথা স্মরণ করব’। ভেগার সাথে সংশ্লিষ্ট কল্পকাহিনীমতে নায়িকা এবং নায়ক আকাশে এক নদী তারা (মিল্কি ওয়ে/ আকাশগঙ্গা) দ্বারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। ফলে তারাটির তাৎপর্য এখানে কেবল এর ঔজ্জ্বল্যে সীমাবদ্ধ নয়।
দিলাম ‘Vega of the Lyre in Fiction’ লিখে সার্চ। সাথে সাথে বেরিয়ে এলো আমার স্মৃতি থেকে একটি সবুজ পত্র! বইটির নাম Emily’s Quest! অবশেষে আমার quest সমাপ্ত হোল। বেঁচে থাকো বাবা গুগল! আমি কল্পনাও করতে পারিনা এর প্রতিষ্ঠাতারা কতখানি মেধা এবং অধ্যাবসায়ের অধিকারী, ভাবতেই পারিনা গুগলের আগের যুগে মানুষ কিভাবে তথ্যের অনুসন্ধান করত!
এই বিজয়ে আরেকটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। আমার বিয়ের সময় আমার দাদা এক অদ্ভুত উপহার দিয়েছিলো। এক বিরাট বাক্স, এর ভেতর থেকে ক্রমান্বয়ে বের হতে রইলো আরো অনেক অনেকগুলো বাক্স। সবার শেষে বেরোল ছোট্ট একটা বাক্স। অনেক কুচি করা কাগজের মাঝে একটা বড় কাগজে লেখা, ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন’। দাদা বলল, ‘দেখ তো বাক্সের ভেতর আর কিছু খুঁজে পাও কি’না!’ বাক্সের নীচে পাওয়া গেল একটা ল্যামিনেট করা চেক, ৫০,০০০ টাকা! দাদার অব্যবহিত ছোটবোন দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন প্রচন্ড মেধাবী, ব্যাক্তিত্বসম্পন্না। সবার ধারণা আমি দেখতে তাঁর মত। যদিও তিনি ছিলেন রত্ন, আমি ছাই, কিন্তু চেহারায় মিল থাকার ফলে দাদার ছিলো আমার প্রতি বিশেষ দুর্বলতা। পরিবারের বড় সন্তানের বড় সন্তান হওয়াটা এখানে বোনাস।
ঘটনাটা এজন্য বললাম, টাকাটা বড় ব্যাপার না, চেহারাটা পাওয়ার ব্যাপারেও আমার কোন হাত নেই, কিন্তু ভালোবাসা একটা অমূল্য সম্পদ, সেটা যেভাবেই পাওয়া যাক না কেন। এই বইটার নাম জেনে আমার কোন লাভক্ষতি নেই, কিন্তু স্মৃতির পেছনে পিছু ধাওয়া করে যে সময়টুকু কেটেছে সুখস্মৃতি রোমন্থন করে সেটাই অমূল্য। কারণ আজকের এই ঘটনাটাই হয়ে উঠবে আগামী দিনের জন্য আরেক সুখস্মৃতি!

Facebook Comments