banner

রবিবার, ০৫ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 599 বার পঠিত

 

“সত্যিকারের মা” আবার কি !



তাসলিমা শাম্মী


” তোমার জানাশুনা কেউ যদি মা হতে চায় আমাদের গল্পটা বইলো । গর্ভধারিণী হতে চাইলে না ,মা হতে চাইলে । বুঝছো ? আমার নাম্বারটা রাখো । বাসায় আসো একদিন সময় করে , গল্প হবে অনেক । কর্ণফুলী নদীর ওপাড়ে যেখান থেকে সবুজের শুরু , কয়েক মিনিট গেলেই আমাদের বাড়িটা। একদম রাস্তার পাশেই , সড়ক থেকে দেখা যায় “।

একজন সত্যিকারের মা র সাথে কথা হচ্ছিল। ”সত্যিকারের মা “ আবার কি ! সেই গল্পটাই শুনতে আমার ভীষণ ইচ্ছে করছিল উনার নিজের মুখে। তাই এক ছুটির দিনের বিকেলে আমি শহরের বিচ্ছিরি রকমের কোলাহল আর কালো ধোঁয়া পার হয়ে কর্ণফুলী ব্রিজটার ওপাশে সবুজে মোড়ানো ধান ক্ষেতের মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে থাকা একতলা বাড়িটায় গিয়ে কড়া নাড়লাম।

” আমিতো শুধু মা হতে চেয়েছিলাম। খুব সাধারণ আর দশজন মেয়ের মতই মাতৃত্বের অনুভূতির স্বাদ পেতে চেয়েছিলাম। বান্ধবী আর কলিগদের দেখে দেখে আমার খুব ইচ্ছে করত প্রথম অনুভব করতে কেমন লাগে “আমি মা হতে চলেছি”!
তারপর থেকে প্রতিটা দিন, প্রতিটা সপ্তাহ গুনে গুনে নিজের ভিতরে আরেকটা প্রাণের অস্তিত্ব অনুভব করতে, সুখ সুখ সেই অসুখটাকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে নয়মাস ধরে উপভোগ করতে চেয়েছিলাম। নয়মাস পর একদিন মৃত্যু যন্ত্রণার খুব কাছাকাছি গিয়ে স্বর্গীয় সুখ নিয়ে তীব্র চিৎকারে আকাশ বাতাস ফাটিয়ে জন্ম দিতে চেয়েছিলাম আমার ভিতরের ছোট্ট আরেকটা আমি কে। তারপর তো অবাক হবার পালা আমার , কিভাবে আমার রক্ত মাংস দিয়ে আমারই ভিতরে গড়ে উঠা সেই ‘আমিটা’ ভিন্ন এক নিজস্ব স্বত্বা নিয়ে সম্পূর্ণ একজন মানুষ হয়ে উঠছে আমি সেটা অবাক হয়ে হয়ে দেখব !!

কিন্তু না। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে ছিল অন্যরকম। দীর্ঘ দশবছর ধরে ছোটাছুটি করার পর এই দেশের এবং পার্শ্ববর্তি দেশের নামকরা সব স্পেশালিষ্ট রা যখন আমাকে আর আমার স্বামী মাসুমকে গম্ভীর মুখে কনফার্ম করে দিল যে আমি আর কোনদিনই মা হতে পারবো না তখন আমার মনে হয়েছিল এই পৃথিবীতে থেকেই বা আর লাভ কি যদি নিজের নিজস্ব কিছু পৃথিবীটাকে দিয়ে যেতে না পারি!! সেদিন যখন আমি আমার মা কে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলাম তখন মা আমাকে স্বান্তনা দিতে দিতে বলেছিল, “গর্ভধারিণী হওয়া কিন্তু সহজ মা হবার চেয়ে!! গর্ভধারিণী অনেকে ইচ্ছে করলেই হতে পারে কিন্তু মা সবাই হতে পারেনা রে “।

আমি মা র কথার ইঙ্গিতটা ধরতে ঠিকই পেরেছিলাম সেদিন। খুব রাগ হয়েছিল মা র উপর আমার। মা কে আমার হিংসা হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, আমার মা তো অনুভব করতে ঠিকই পেরেছিল সেই স্বর্গীয় অনুভুতিটুকু তাই আমার মনের ব্যাথা কিভাবে বুঝবে ?

আমার সেই শুন্যতার দিনগুলোতে আমার স্বামী মাসুম ছিল নির্বিকার! সন্তান নাই বলে যে মানুষের একটা দুঃখ থাকতে পারে সেই জিনিসটা মাসুমের জানা ছিল না! শুধু আমিই একা কেঁদে মরতাম। শুধু মাসুম না , ওর মা , ভাই, বোন কারোই কোন মাথাব্যাথা ছিল না আমার এসব ছোটাছুটি আর কান্নাকাটি নিয়ে!!
আমি এর ওর কাছ থেকে তথ্য যোগাড় করে করে দেশ বিদেশের ডাক্তার খুঁজে বের করছি, এই টেস্ট সেই টেস্ট করছি, অলিগলি খুঁজে ঝাড়ফুঁক করা পানি এনে খাচ্ছি কিন্তু আমার শ্বশুর বাড়ির একটা মানুষও আমাকে বাঁধা না দিলেও এসব ব্যাপারে কোন ধরনের আগ্রহ দেখায়নি।
আমার স্কুল টিচার শাশুড়ি বরং বিভিন্ন ভাবে আমাকে বুঝাতে চাইতেন এটাকে তেমন সিরিয়াস ভাবে নেবার কিছু নাই। কি আশ্চর্য !! মা হতে না পারাটা সিরিয়াস কিছু না !! আমার দেবর পিয়াল দেশী বিদেশী প্রচুর পুরষ্কার পাওয়া একজন মেধাবী ফটোগ্রাফার , সে আমাকে এই ব্যাপারটা নিয়ে বিচ্ছিরি রকমের খেপাত !! একমাত্র ননদ রিমি , যাকে আমি বোনের মত আদর করি সে আমার কান্না দেখে বলত আমি নাকি দুঃখ বিলাস করতে ভালবাসি !! অসহ্য লাগত আমার এই পুরা পরিবারটাকে!!

এমনিতেই বিয়ের পর থেকে আমি অনেক ধরনের অস্বাভাবিক ব্যাপার লক্ষ্য করতাম এই বাড়িতে। ষোল বছর আগে আমার বিয়ের পরপর একদিন মা মানে আমার শাশুড়িকে চুপিচুপি বলেছিলাম, ” মা , আমার পিয়াল কে কেমন জানি অন্যরকম লাগে “। মা একদম স্বাভাবিক ভাবেই জবাব দিল, ‘ অন্যরকম কেন লাগবে বৌমা! সেও তোমার আমার মত মানুষ ‘। আমি মা কে জোর দিয়ে বুঝাতে চাইলাম যে পিয়াল আমার উনার মত বা মাসুমের মত নরমাল নয়। মা আমার কথা পাত্তাই দিলেন না!! খুব স্বাভাবিক ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বল্ল, ‘ তুমি নরমাল তো? আমারতো মনে হয় তোমারি মন নরমাল না’!! কি অপমান !! সেদিনের পর থেকে আমি পিয়ালকে নিয়ে কোন ধরনের কথা বলা বাদ দিয়েছিলাম । তারপর আসি রিমির কথায়। রিমি, আমার একমাত্র ননদ। খুব মেধাবী ছাত্রী। একদিন অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, রিমির ডান কানের লতিতে একটা গভীর ক্ষত! আমি চুল বেঁধে দিতে দিতে রিমিকে জিজ্ঞেস করলাম, ” রিমি , তোর কান কে খাইছে রে”? রিমি হাত নেড়ে গল্প বলার মত করে আমাকে বলে, ‘ ভাবি জান ! আমার জন্মের পর আমাকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দেয়া হয় , তখন কাক এসে মাংসের টুকরা মনে করে ঠুকরে আমার কান খেয়ে ফেলে ‘ !!
কি অসভ্যরে বাবা !! শাঁকচুন্নি একটা ! আমি মনে মনে ভাবলাম !! বেয়াদবের পরিবার !! দূর! আর কোন আগ্রহ নাই এদের নিয়ে আমার , আমি মরছি আমার চিন্তায় তখন। একটা বাচ্চার জন্য আমার মন প্রাণে তখন মরুভূমির হাহাকার !!
দীর্ঘ দশবছর ধরে চিকিৎসা করার পর যেদিন আমি আর মাসুম ভারতের বিখ্যাত এক ডাক্তারের কাছ থেকে নিরাশ হয়ে দেশে ফিরে আসলাম , ঘরের সবাই সেদিন আমাকে কাউন্সিলিং করা শুরু করল । আমার তখন দুনিয়াদারি অসহ্য লাগছিল। চোখের সামনে আমাকে সহানুভূতি দেখানো মানুষগুলোকে অমানুষের মতোই লাগছিল। ততদিনে পিয়াল দেশের অনেক নামকরা একজন ফটোগ্রাফার , রিমি ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়, মা রিটায়ার্ড করে একটা এন জি ও তে সময় দিচ্ছিল ।

সেদিন আমি শোবার ঘরের বাতি নিভিয়ে অন্ধকারে কাঁদছিলাম । মাসুম কে বলছিলাম, ” মাসুম আমি কি আল্লাহর কাছে বেশী কিছু চেয়েছিলাম? একটা বাচ্চাইতো চেয়েছিলাম ! মা হতে চেয়েছিলাম “। আমি আঝোরে কাঁদছিলাম।

মাসুম আমাকে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, ‘ তোমাকে আজকে এমন একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিব যাকে গর্ভবতী হতে না পারার অপরাধে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল । কিন্তু উনি আজকে একজন সত্যিকারের মা , তিন তিনজন সফল সন্তানের গর্বিত মা ‘। আমি অবাক হয়েছিলাম, মাসুম কি শোকে দুক্ষে পাগল হয়ে গেল নাকি! কি বলে এসব!!

আমাকে হাত ধরে টেনে মাসুম বসার ঘরে আনল। ঘরের সবাই তখন সেখানে বসে টিভি দেখছিল । আমি তখন অন্য কাউকে খুঁজছিলাম। মাসুম আমার শাশুড়ি মা কে দেখিয়ে দিয়ে বল্ল, দেখ উনিই সেই মা ।
মাসুম সবার সামনেই আমাকে বলা শুরু করল , ‘ খুব ছোট বেলায় আমার মা বাবা এক্সিডেন্টে মারা যাবার পর আমি চাচা চাচির কাছে অযন্তে অবহেলায় বড় হতে থাকি , আমার এই মা কে তখন উনার স্বামী ত্যাগ করেছেন । মা উনার বাবার দেয়া এই বাড়িটায় উনার বৃদ্ধ মা কে নিয়ে থাকেন আর একটা স্কুলে চাকরি করেন । আমাকে মা দত্তক নিয়ে আমার মা হলেন। আমার বয়স যখন পাঁচ , একদিন মা খবর পেলেন এক পরিবার তাদের সদ্য জন্ম নেয়া একটা বাচ্চাকে হাসপাতালে ফেলে চলে গেছে কারণ বাচ্চাটা তৃতীয় লিঙ্গ নিয়ে জন্মেছে। আমার মা সেদিন সেই বাচ্চার মা হয়ে তাকে বাসায় নিয়ে আসলেন , বাচ্চাটার কি অপরাধ ছিল বল? তারপর এক শীতের ভোরে বাসের জন্য অপেক্ষা করার সময়ে ডাস্টবিনের ময়লার ভিতরে একজন মানবশিশুর কান্না শুনতে পেয়ে মা তাকেও বুকে টেনে নেয়। সেদিন কাঁক ফেলে দেয়া রক্তমাখা নবজাতকটার কান ঠুকরে খাওয়া শুরু করে দিয়েছিল। তুমি নিশ্চয় সবই বুঝতে পারছ! পুরো গল্পটাই এখন তোমার চোখের সামনে ‘।

সেদিন থেকে আমার নতুন করে জন্ম হল। আমি চোখ ভরা অপরাধবোধ নিয়ে ওদের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। আমার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছিল। রিমি শয়তানটা চিমটা দিয়ে বলছিল ,” ইশ ! কি ঢং ! আমি কি মিথ্যে গল্প বলেছিলাম “? আমি মা কে জড়িয়ে ধরেছিলাম প্রচন্ড অপরাধবোধ নিয়ে !! এমন একজন মা কিভাবে আমার চোখে পড়ল না এতগুলো বছর !! আমি কাঁদতে কাঁদতে অপূর্ব সুন্দর এই পরিবারটাকে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছি। ফটোগ্রাফারটা তখন আমার বোকার মতন কাঁদার ছবি তুলছিল একটার পর একটা।

আমি এখন দুই দুইটা বাচ্চার মা। এত ব্যস্ত থাকি ওদের নিয়ে আর বইলো না । তোমার চেনা জানা যদি কেউ আমার মত মা হতে চায় তাদেরকে আমাদের গল্পটা বইলো। বলবা ,” গর্ভধারন অনেকেই করতে পারে,সত্যিকারের মা হতে সবাই পারেনা।

সন্তানহীন মানুষ যেমন আছে এই পৃথিবীতে , মা বাবাহীন অসংখ্য সন্তানও রয়েছে আমাদের আশেপাশে। তাদের মা বাবা হতে পারাটা আরো আনন্দের , আরো তৃপ্তির। সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয় ব্যালেন্স করার জন্যই এই ব্যবস্থা করে রেখেছেন ” !!

[Courtesy : Taslima Shammi]

Facebook Comments