জাহেদ উদ্দীন মোহাম্মদ
আমার নানার দুই মেয়ে। আমার মা আর এক খালা। মা থাকে চট্টগ্রামে আর খালা টেকনাফে।
মা বলে, আমরা জমজ দু’ভাই নাকি খালার কলিজার টুকরা। আমাদের কারো জ্বর হলে খালার পরান যায়-যায় অবস্থা। তিনি পড়ি-মরি করে আমাদের বাড়ী ছুটে আসতো। তাছাড়া, আমাদের কাছে খালা মানে অবাধ একখানি স্বাধীনতা আর অসীম আনন্দ।
এখন আমরা শৈশব হারিয়ে কৈশোরের শেষ পথে । খালারও বিয়ে হয়ে গেছে। বিয়ের পর খালা আমাদের বাড়ীতে এলেই বাবা “বার্মাইয়ার বৌ” বলে খালাকে খেপাত আর বাসায় রীতিমত আগুন জ্বেলে বাবা হাসতে হাসতে অফিসে চলে যেত।
তারপর খালার চোখের পানি আর নাকের সিন্নিতে বাসায় জলোচ্ছাস বয়ে যেত । খালা ভাত খায় না। কথা বলে না। বাবার কোন শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত এক রুমে গিয়ে রুদ্রমুর্তি ধরে বসে থাকত।
বাবার একটা কঠিন শাস্তি হোক, এটা আমরাও চাইতাম। কিন্তু বড়দের বিচার কে করে, জানতাম না। আমরা ছিলাম খালা-অন্ত:প্রান। কথিত আছে, খালার বিয়ের দিন আমরা দু’ভাই খালার বিয়ের শাড়ীর-কোনা ধরে, মা-মা বলে এতো এতো কেঁদেছি যে,খালু পর্যন্ত দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিল; শেষ পর্যন্ত দুই সন্তানের মা বৌ হিসাবে তাঁর কপালে জুটলো কিনা।
আমরা খালার রাগ ভাঙানোর জন্য, খাওয়ানোর জন্য এতো টানাটানি করি; খালার রাগ কোনভাবেই কমে না। আমরা ছোটবেলার মতো খালার গালের দুইদিকে দু’ভাই গাল লাগিয়ে ভাব দিই; বিনিময়ে খালা আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, কিন্তু রাগ ছাড়ে না।
মা একদম চুপচাপ। খালাকে কিছু বলছে না।
আমরা দুপুর পর্যন্ত না খেয়ে আছি।
তারপর, বাবা অফিস ছেড়ে দুপুরে বাসায় খেতে এলো আর দুইবোন মিলে বাবাকে সে কি তুলাধুনা!
-তুমি কি পেয়েছ? আমার বোনকে মুখে যাই আসে, তাই বলবে! তোমাকে অনেক সহ্য করেছি। আর করবো না।
-দেখ বুবু, দুলাভাই তোর বাসায় এলে যখন তখন অপমান করে। সরাসরি আসতে না করে দিলেই তো পারে। তোদের বাড়ী আর আসবো না।
বাবার সামনে দুই বোনের অগ্নিমুর্তি আর বজ্রবর্ষন দেখে আমরা দুইভাই ইঁদুর ছানার মতো কাপঁতে থাকি। একটু আনন্দ যে পাই না, তা কিন্তু নয়। অথচ কি আশ্চায্য! বাবা দাঁত দেখিয়ে হাসতে থাকে।
-দ্যাখ, দোষ সব তোদের। এবার দ্যাখ, কি রকম এক অমানুষের সাথে তোরা আমাকে বিয়ে দিয়েছিস! – খালাকে উদ্দেশ্য করে মা কাঁদো কাদোঁ গলায় বলে।
মনে হলো,মা নাক টেনে একটু সিন্নি ফেলল।
-চল বুবু। তোকে বাড়ী নিয়ে যাবো। এই বদলোকের সাথে আর সংসার করতে হবে না। চল বাড়ী যাই।
-চল, আগে আমরা ভাত খেয়ে নিই। তারপর দুবোন মিলে শলা-পরামর্শ করে ঠিক করবো কিভাবে তোর দুলাভাইকে শায়েস্তা করা যায়?
তারপর ছহি-ছালামতে সকলে মিলে আমাদের দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়।
আমরা রাতে কি হয়, দেখার অপেক্ষায় থাকি।
ওমা! একি! রাতের বেলা দেখি মা-খালা-বাবা ঠাট্টা-মশকরায় মেতে আছে। দুপুরে ঝড়-তুফানের কোন রেশ কোথাও নাই!
এই হলো আমার খালা; বয়স বাড়লেও এখনো শিশুর মতো সহজ-সরল। আমাদের জন্য সর্বদা অন্তরে লালন করা যানকবুল এক ভালোবাসা।
বিগত আট-দশ বছরে আমরা আরো দ্রুত বড় হয়ে গেছি। আমার ছোট জন থিতু হলো আমেরিকা আর আমি দেশে । একটা চাকুরী করি। বিয়েও করেছি।
কিছুদিন পর পর নতুন বৌকে নিয়ে টেকনাফে বেড়াতে যাবার জন্য খালা জোরাজুরি করে। ফোনে কান্নাকাটি করে। আমি সময় পাই না।খালার অনুযোগের শেষ নাই।
-তোরা বড়লোক হয়ে গেছিস। আমি গরীব বলে দেখতে পারিস না। তোর আপন মা নই বলে অবহেলা করছিস!
আরো কত কত কথা!
আমার খালু বড়লোক। দিলদরিয়া মানুষ। বাবার সাথে খুব ভাব। খালুর ১০টি ইলিশের বড় বোট আছে। বাৎসরিক হিসাবে আমাদের বাড়ীতে যত মাছ লাগত, সব মাছ খালু লোক দিয়ে চট্টগ্রাম পাঠিয়ে দিতো।
বাবার জন্য রুপচান্দা শুটকি, মা’র জন্য বড় ইলিশ আর আমাদের জন্য রকমারী সামুদ্রিক মাছ।
আর এইসব মাছ খেয়ে-দেয়ে, বাবা সুযোগ পেলেই খালাকে “জাইল্যার বৌ” বলে খোচাঁত। শুনে খালাও হাসে, বাবাও হাসে। আমরাও হাসি।
গত কয়েক সিজন হতে খালার এক ধরনের মন্দা চলছিল। বছর-দুই আগে অপয়া এক ঘুর্নিঝড়ের কবলে পড়ে আমার খালুর ১০টি ইলিশ বোটই সাগরে তলিয়ে গেছে। এখন সকালের রাজা বিকালের ফকির।
এইবার বিয়ের তৃতীয় বার্ষিকীতে খালাকে চমকে দেয়ার প্লান করি। সেই মোতাবেক শুক্রবারের এক সকালে খালার বাসার দরজায় আমরা স্বামী-স্ত্রী হাজির।
খালা-খালু যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলো। আমাদেরকে খালা অনেকক্ষন বুকের সাথে লেপ্টে রাখে। খুশিতে ঝরঝর করে কেদেঁ দিলো।
আমরা হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা করে শাহপরীর দ্বীপ সী-বীচে রওয়ানা দিলাম।
বিয়ের পর খালার বাড়ী এইবার আমার প্রথম যাওয়া। সেই হিসাবে নতুন বৌয়ের জমজমাট খাওয়ার বিরাট আয়োজন। দুপুরে আর রাতের খাওয়ার আয়োজনে কি ছিলো না; সেটাই ভাবছি। মাছের মধ্যে সাগরের এক কেজি ওজনের লবস্টার হতে শুরু করে বিরল প্রজাতির দশাসই লাক্ষা মাছের রোস্ট; বন মোরগের মাংস হতে শুরু করে টেকনাফের পাহাড়ী ছাগহরিনের মাংস বাদ যায়নি।
তারপরও খালার আফসোসের শেষ নেই।
রাতে ভাগিনা-বৌ আংটি আর দামী শাড়ী উপহার পেলো।
আমি পেলাম ১সেট কোর্ট-পেন্টের রেমন্ড কাপড়। খালা তাঁর বোন-দুলাভাইয়ের জন্যও নতুন কাপড় চোপড় দিলো। উপহার দিতে পারার খুশিতে খালা-খালুর চোখ-মুখ চিকচিক করছিল।
আমরা খালার বাড়ীতে স্বপ্নের মতো একটি রাত কাটলাম। দুপুরের চট্টগ্রাম ফিরব; তাই একটু সকাল সকাল টেকনাফ পৌরসভা মার্কেটে গেলাম, উদ্দেশ্য মুলত উইন্ডো শপিং। পছন্দ হলে টিকিটীকি কিছু শপিং করবো।
খালার বাড়ী হতে এক কিলোমিটারের মতো দুরত্ব। শপিং শেষে ফেরার পথে এক স্বর্নের দোকানে ঢুকি। দোকানের তালাঝুলা আলমিরার এক কোনে একটা নেকলেসে আমাদের চোখ আটকে গেলো।
যেমন ডিজাইন তেমন মনকাড়া। নেকলস েমুক্তার পুতি আর ছোট ছোট স্বর্নরেনুর ঝুলন্ত মায়াময় দুলুনি।
-ভাবী, এটা খুবই আনকমন নেকলেস; স্বনার্কার বলল।
-দেখে তো পুরানো বলে মনে হয়, আমি বললাম।
-ঠিকই ধরেছেন। আমাদের দোকানের বিরল জিনিস সংগ্রহে গুরুত্ব দেয়। এটা খুব খানদানী ও আনকমন ডিজাইন। আমরা গতকাল সংগ্রহ করেছি। আপনি বললে,একটু ওয়াশ করে দেবো। তখন মনে হবে একদম নতুন- স্বনার্কার বলল।
ডিজাইনটা খুবই বিরলও বটে। মনে হলো আগেকার জমিদার বা সৌখিন লোকজন ব্যবহার করতো। আমাদের খুব পছন্দ হলো। ওজন সোয়া এক ভরি। দরদাম করে নেকলেসটা কিনে ফেললাম।
চট্টগ্রাম ফিরতে বেশ রাত হলো।
পরদিন খালার দেয়া বিভিন্ন উপহার মা’কে দেখাই। আমার স্ত্রী খালার অবিশ্বাস্য আদর-আপ্যায়নের কথা বারবার বলছিল।
-ও ঐরকম, ভাগিনাদের জন্য প্রান দিয়ে ফেলে।
-এমন আদর কোন খালা করতে পারে? আমার তো এখনো বিশ্বাসই হচ্ছে না।
তারপর মায়ের জন্য কেনা সারপ্রাইজ গিফট নেকলেসটা মা’র হাতে দিলাম। মা নেকলেচটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষন আবেগরুদ্ধ হয়ে বসে রইলেন। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন।
-এটা কোত্থেকেকিনেছিস,বাবা?
-কেন মা? তোমার পছন্দ হয়নি?
-না বাবা। ঠিক তা নয়।
আমার স্ত্রী কাপড় পাল্টাতে ওর রুমে চলে গেল।
-বাবা, তোর খালা কি নেকলেসটা দেখেছে?
-না মা, আমরা কেবলমাত্র গাড়ীতে উঠার একটু আগে কিনেছি। দেখানোর সময় পাইনি।
-ও, আচ্ছা।
-কেন মা? কোন সমস্যা ?
মা কেমন জানি আনমনা হয়ে গেলেন। মনে হলো মা কিছু একটা বলতে ইতস্তত করছেন। একবার ডানে-বায়ে তাকালেন।
ফিসফিস করে বললেন, এটা তোর খালার নেকলেস,বাবা।
-কি!!!
এ যেন, প্রচন্ড হাসিখুশির কোন শিশুর মুখে হঠাৎ কালি মেখে দেয়া বিহবলতা…
আমার পুরো পৃথিবীটা দুলছে।
থমকে আছে চারপাশের বাতাস । অদৃশ্য শাসনে যেন স্থির হয়ে আছে, খানিক আগের উড়াউড়ি করা জানালায় পর্দা।
নিষ্ঠুর এক নীরবতা আমাদের গিলতে থাকে।