banner

বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 463 বার পঠিত

আমি ছিলাম আইএস নেতার বাঙালি বধূ

তানিয়া জয়া

আমরা জন্ম উত্তর লন্ডনে, ১৯৮৩ সালে। বেড়ে উঠেছিলাম এক বাংলাদেশী-বাঙালি পরিবারে। আমি মনেপ্রাণে ইংরেজ হতে চাইতাম; কিন্তু পরিবার থেকে চাপ ছিল একজন ‘গুড মুসলিম গার্ল’ হয়ে ওঠার, পশ্চিমা সমাজের সঙ্গে মিশে না যাওয়ার। এই টানাপোড়েনে আমার পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে যাচ্ছিল। যখন নিজের বাবা-মায়ের ওপর আস্থা রাখা যায় না, তখন আর কারো কর্তৃত্বই মেনে নেওয়া কঠিন।
আমার বয়স যখন ১৭, আমরা পূর্ব লন্ডনে গিয়ে থিতু হই। সেখানে আমার নতুন নতুন বন্ধুত্ব তৈরি হয়; কিন্তু তারা সবাই ছিল রক্ষণশীল, ধার্মিক তরুণী। আমার ‘অতি পশ্চিমা’ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তারা তিরস্কার করতো। আমার এক কাজিন, আমার ওপর যে তরুণীর প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই উগ্রপন্থায় জড়িয়ে যায়। সে আমাকে খেলাফত সম্পর্কে শিক্ষা দিত। তখন আমি অনলাইনে সৌদিআরব থেকে প্রচারিত ইসলামী ফতোয়া সম্পর্কে ব্যাপক পড়াশোনা করতাম। আমার ধারণা ছিল যে, আমি ‘সত্যের সন্ধান’ করছি।

২০০৩ সালে লন্ডনে আমি ইরাক যুদ্ধবিরোধী মিছিলে যোগ দেই। তখন কিছু তরুণ আমার হাতে এক ফালি কাগজ গুঁজে দেয়। সেখানে একটি ‘মুসলিম ডেটিং’ ওয়েবসাইটের ঠিকানা লেখা ছিল। ওই সাইটে গিয়েই জন জর্জেলাসের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। সে ছিল ইসলাম ধর্মান্তরিত আমেরিকান নাগরিক। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে। একাধিক ভাষা জানে এবং দেখতে বেশ স্মার্ট। আমি তার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠি। জন আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে প্রথম যেবার লন্ডন এলো, সেবারই আমরা বিয়ে করে ফেলি। আমি জানতাম, রক্ষণশীল পরিবার ছাড়তে হলে এটাই একমাত্র সুযোগ। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আমি জনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাই এবং আরও কিছুদিনের মধ্যে পুত্র সন্তানের মা হই। ততদিনে জন আরও বেশি উগ্রপন্থার দিকে ঝুঁকছে। আর আমি নেকাব পরা ছেড়ে দিয়েছি এবং আরও বেশি স্বাধীন হওয়ার চেষ্টা করছি।

২০০৬ সালে একটি ইসরাইলপন্থী লবিয়িং গ্রুপের ওয়েবসাইট হ্যাকিংয়ের দায়ে অভিযুক্ত হয় জন। বিচারে জন জর্জেলাস তিন বছরের কারাদণ্ড হয়। কিন্তু আমি তখনও অর্থনৈতিকভাবে তার প্রতি নির্ভরশীল ছিলাম এবং তখনো বুঝতে পারিনি যে এক নিবর্তনমূলক বিয়ের জালে আটকা পড়েছি।

কারাগারে ভালো ব্যবহারের জন্য জন খানিকটা আগেই মুক্তি পায়। আমরা তিন সন্তানসহ যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রথমে মিশর এবং তারপর ইস্তাম্বুল চলে যাই। জন একবার বলেছিল বটে, সে সিরিয়া যেতে চায়। কিন্তু আমি গোঁ ধরেছিলাম যে, আমার সন্তানদের যুদ্ধ কবলিত কোনো এলাকায় নিয়ে যাব না। ইস্তাম্বুলে থাকার ব্যয় যখন আমরা বহন করতে পারছিলাম না, তখন জন ও তার যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত পরিবার আমাকে অন্য প্রস্তাব দেয়। বলে যে, তুরস্কের মধ্যেই আন্তাকিয়া চলে যাওয়া ভালো হবে, সেখানে জীবনযাত্রার ব্যয় কম। যদিও বাস্তবে আমাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সিরিয়া সীমান্তে।

দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে সর্বশেষ মধ্যরাতে যখন আমরা একটি বাসে উঠি, আমার ধারণা ছিল না আসলেই কী ঘটতে যাচ্ছে। আমি তখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্তা। বাস দেখে বরং স্বস্তি হয়েছিল যে তিন সন্তানসহ বসতে পারবো এবং ঘুমিয়ে নেওয়া যাবে। সূর্য ওঠার পর যখন ঘুম ভাঙলো, আমাদের বাস একটি সিরিয় চেকপোস্টে দাঁড়ানো। জন আমাকে সতর্ক করে দিল, যাতে কোনো নাটকীয়তা তৈরির চেষ্টা না করি।

সিরিয়ায় গিয়ে যত দ্রুত সম্ভব একটি টেলিফোন খুঁজে নিয়েছিলাম এবং জনের মাকে ফোন করে বলেছিলাম যে তার পুত্র আমাদের মিথ্যা বলেছে। ফোনের এই পাশে আমি চিৎকার করে কাঁদছিলাম এবং আমার শাশুড়িকে বলছিলাম তিনি যেন শিগগিরই এফবিআই এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ওই এজেন্ট কয়েক বছর ধরে জনের গতিবিধি নজরদারির দায়িত্বে ছিলেন। তিনি আমাকে পরবর্তীতে ফোনে বলেন- আমি যদি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসতে পারি, তাহলে আমাকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনে যোগ দেওয়ার দায়ে অভিযুক্ত করা হবে না।

সিরিয়ায় আমরা পাইপ-ওয়াটার পেতাম না। বাড়ির ওপরের ওয়াটার-ট্যাঙ্ক গোলা লেগে ফুটো হয়ে গিয়েছিল। অপুষ্টিতে ভুগছিলাম; যেমন আমি, তেমনই শিশুরা। তাদের হারিয়ে ফেলার শঙ্কা ঘিরে ধরেছিল আমাকে। এফবিআই এজেন্টকে বলে দেওয়ার জন্য জন আমাকে দোষ দিত, আমিও তাকে পাল্টা রাগ দেখাতাম ধোঁকা দিয়ে সিরিয়ায় আনার জন্য। ক্ষোভ থেকে এক পর্যায়ে আমি মুখ ঢেকে রাখা ছেড়ে দিয়েছিলাম, সেটা ছিল জনের জন্য বিব্রতকর। সহযোদ্ধারা তাকে চাপ দিত- হয় আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, না হয় পরিত্যাগ করতে হবে।

শেষ পর্যন্ত জন ‘দয়া’ দেখায়। আমাদের জন্য সিরিয়া থেকে বের হয়ে আসার ব্যবস্থা করে। যদিও সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরও তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়েছে। কারণ বের হয়ে আসার রাস্তায় হয় অবরোধ না হয় লড়াই চলছিল। জন একজন মানব পাচারকারীর হাতে আমাদের তুলে দেয়। অর্থের বিনিময়ে সে আমাদের সিরিয়া সীমান্ত পার করে দেবে।
প্রথমে আমাদের কয়েক মাইল হাঁটতে হয়েছে। তারপর কাঁটাতারের ফোকর গলিয়ে বের হতে হয়েছে। সীমান্ত পার হয়ে কোনো রকমে যখন একটি ট্রাকে উঠে শুয়ে পড়ি, তখন মাথার ওপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছিল স্নাইপারের গুলি। কথা ছিল পাচারকারী সীমান্ত পার করে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। কিন্তু সে আমাদের একটি প্রান্তরের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। আমি হতাশ ও উদ্বিগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। এ সময় একজন দয়ালু তুর্কি আমাদের পথ খুঁজে পেতে সাহায্য করে।

জীবন ফিরে পেয়ে আমি ছিলাম খুবই কৃতজ্ঞ। আমি কেবল চেয়েছিলাম আমার সন্তানরাও জীবন ফিরে পাবে। একটি পরিপূর্ণ জীবন কাটাবে এবং বিপুলা বিশ্বের কাছে ফিরে যাবে।
সিরিয়ায় আইএসের কথিত খেলাফত প্রতিষ্ঠায় জন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল এবং পশ্চিমা তরুণ-তরুণীদের আকৃষ্ট করতে শীর্ষস্থানীয় প্রচারক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিল। তার সঙ্গে আমার আর কখনোই দেখা হয়নি। পরিবর্তীতে জেনেছিলাম যে, সিরিয়ায় সে আবার বিয়ে করেছে। গত বছর আমি জানতে পারি যে, সে মারা গেছে। খুব সম্ভবত ২০১৭ সালে, মার্কিন বোমা হামলায়।

এখন আমি টেক্সাসে থাকি। জনের পিতা-মাতার বাড়ি থেকে কয়েকটি সড়ক দূরে। আমি জানি, নাতি-নাতনীরা দাদা-দাদীর কাছাকাছি থাকা উভয় পক্ষের জন্য ভালো। আমার বর্তমান স্বামী আমার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও মনোযোগী। নিজের অর্জিত স্বাধীনতা আমি উপভোগ করছি। দৈনিক সমকাল

দ্য গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তরিত

Facebook Comments