তাহনিয়া খান
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
Rabbish rahli sadri wa yas-sir li amri wahloul uqdatam mil-lisaani yafqahu qawli.
O my Lord! expand me my breast; Ease my task for me; And remove the impediment from my speech, So they may understand what I say[20:25-28]
বোর্ডিং হয়ে গিয়েছে, ইমিগ্রেশন হয়ে গিয়েছে, বসে আছি প্লেনে উঠার অপেক্ষায়। এর মাঝে ফজরের নামাজের সময় হয়ে গেলো। হ্যান্ডব্যাগ থেকে জায়নামাজ বের করে নামাজ পড়ে নিলাম। নামাজের জন্য একটা পার্টিশন দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অযু করাই ছিল। পালা করে মেয়েরা সব নামাজ পড়ে নিল। ছেলেরা সবাই জামাত করে নামাজ পড়ে নিল। খুব ভালো লাগছিল। সবাই এহরামের কাপড় পরা।
আমার ভাই তাপস একটু পর পর বলছিল, আপু, কাপড় ঠিক আছে তো ? শরীর দেখা যাচ্ছে না তো ? তার অস্বস্থি কাটে না। সে হজ্জে যাওয়ার আগে নতুন কেডস, মুজা কিনে বাসায় আনে। আমি দেখে বলেছিলাম, তুই সেখানে কেডস নিয়ে কি করবি? সে বললো, কেনো হাটতে হবে না অনেক, কেডস পরে স্পীডে হাটতে পারবো। তখনো সে এহরামের নিয়ম কানুন জানে না। আমি তাকে বললাম, তুই কাফনের কাপড়ের মত দুই টুকরা কাপড় আর দুই ফিতার স্যান্ডেল ছাড়া কিছুই পরতে পারবি না। সে আকাশ থেকে পরলো যেনো। বলে, কি বল এসব? নীচে কিছুই পরা যাবে না ? আমি হাসতে হাসতে শেষ। এখন এয়ারপোর্টে এসে সে অস্বস্থিতে ভুগছে। তার শুধু মনে হচ্ছে শরীর দেখা যাচ্ছে। একটু কেমন বিরক্ত। অথচ এই ছেলে, হজ্জের পড়ে বলেছে, এখন থেকে মাঝে মাঝে এহরামের কাপড় পরে বসে থাকবো। সে খুব সুন্দর করে খুব তাড়াতাড়ি এহরামের কাপড় পরতে পারে।
ফজরের নামাজের পরে প্লেনে উঠার জন্য লাইন দিয়ে আমাদের দাঁড়াতে বলা হোল। একদম প্রথমে এক ভদ্রলোক, তারপর আমি, এরপর আমার ভাই। ভদ্রলোক আগে উঠতে যাবেন প্লেনে, হঠাত কি মনে করে পিছন ঘুরে আমাকে বললেন, আপনি উঠুন আগে। আমার এত খুশী লাগলো। বিসমিল্লাহ বলে উঠে পরলাম সবার আগে। সিট খুঁজে বসে গেলাম। জানালার পাশেই সিট। আহ ! আলহামদুলিল্লাহ্, যাত্রা শুরু। আমাদের রুট ছিল ঢাকা থেকে কুয়েত, কুয়েত থেকে জেদ্দা। সকালের আলো চারদিকে দেখা যাচ্ছে। ঢাকা শহর আমাদের নীচে। আমার ভাই জোর করে আমার মাথা ঘুরিয়ে দিয়ে বললো, দেখো, কত সুন্দর। আমার আবার এক্রোফোবিয়া আছে। উপর থেকে নীচে তাকাতে পারি না। আমার ভাই দুষ্টমি করে বলছে, এখন যদি প্লেন ধপ্পাস করে নীচে পরে যায়, তখন কি হবে ? আমি শুধু বললাম, বাজে কথা না বলে দোয়া পড়তে থাক। সে হাসে। তার হাসির শব্দে অন্যরা ফিরে তাকালো আমাদের দিকে। আমাদের এই হজ্জ গ্রুপের মাঝে হাতে গোনা কয়েকজন ছিলাম কম বয়সের। আর সবাই ছিল বয়স্ক মানুষ। আমরা দুই ভাই বোন এত মজা করে, হাসি আনন্দ করে হজ্জ করেছিলাম যে, আমাদের সবাই আপন করে নিয়েছিল।
কুয়েত এয়ারপোর্টে নেমে যারা এহরাম পরেননি তারা এহরাম পরে নিলেন। হাজীদের জন্য যাওয়ার রাস্তা আলাদা। হাজীদের যাতে কষ্ট না হয় সেজন্য সব ফর্মালিটিস তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলা হোল। সেখানেই যোহরের নামাজ পড়ে আবার প্লেনে উঠলাম। জেদ্দা এয়ারপোর্টে এসে শুরু হোল নিয়ম কানুন। বয়স্কদের খুব তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেয়। কিন্তু কম বয়সি ছেলেদের দুই হাতের ছাপ নেওয়া সহ হাজারটা নিয়ম কানুন শেষ করে ঢুকতে হোল। আমার ভাইকে বার বার বলে দেওয়া হোল আমাকে একা ছাড়া যাবে না। আসলে তাদেরও কোন দোষ নেই। অনেকেই হজ্জ করতে এসে আর দেশে ফিরে যায় না। অবশেষে ইমিগ্রেশন পার হয়ে লাগেজ খুঁজে চলে গেলাম বাংলাদেশের তাঁবুর কাছে। আমাদের সবার কাছ থেকে পাসপোর্ট নিয়ে মাথা গুনে গুনে বাসে উঠানোর জন্য লাইন করানো হোল। কতবার যে এরা মাথা গুনে আর লাইন ঠিক করে। এখনো অনেক পথ বাকি, তার মাঝে লেগেছে খিদা। এদের নিয়ম কানুন শেষ হয় না। এই ফাঁকে আসরের নামাজ পড়ে ফেললাম। মোবাইলের সিম কার্ড কিনে আনলো আমার ভাই। আর এর মাঝে এজেন্সির সৌদি মোয়াল্লেমের একেকজন লোক আসে আর নতুন লাইন করা হয়, নতুন ভাবে আমাদের মাথা গুনা হয়।
হজ্জের পঞ্চম শিক্ষা- ধৈর্য। যে যত ধৈর্য ধরতে পারবে , তার তত সমস্যা কম হবে, সমস্যা তাড়াতাড়ি মিটবে। যারা বেশী হুড়াহুড়ি করে , আগে আগে প্লেনে আর বাসে উঠতে গিয়েছে, মাথা গুনার জন্য আর নতুন লাইন হওয়ার জন্য বার বার তারা পিছিয়ে গিয়েছে। অযথা মানুষের হুড়াহুড়ি দেখে অবাক লেগেছে। পরবর্তি সময়ে যে আরো ধৈর্য ধরতে হবে আর বিরক্ত হওয়া যাবে না, তখনই বুঝে গিয়েছিলাম।
চলবে….