banner

শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 966 বার পঠিত

 

মেঘের দেশে ছোট্ট শহর

তাহেরা সুলতানা


গেন্টিং হাইল্যান্ডস, যাকে মালয়েশিয়াতে বলে ‘সিটি অফ এন্টারটেইনমেন্ট’! ঈদের পরদিন এবার ফ্যামিলি ট্যুরে গেন্টিং হাইল্যান্ডসকেই টার্গেট করলাম। এর আগে অবশ্য ২ বার গিয়েছি। ২০১২ সালে একবার আর ২০১৪ সালে আর একবার গিয়েছি। প্রথমবার তো কেবল কারে উঠে ভয়ে যেই একটা চিৎকার দিয়েছিলাম, আজো আমার হাসবেন্ড সেইটা মনে করে খেপায়! এর পরেরবার কিন্তু ভয় লাগেনি! এবার কিছুটা ভয় আর টেনশন হচ্ছিল, কিন্তু সেটা প্রথমবারের মতো অতোটা ছিল না!

আমার বাসা সুবাং জায়াতে। বাসা থেকে যখন গেন্টিং রওনা দিয়েছিলাম তখন সকাল ৯ টা, কটকটা রোদ। কিন্তু যখন থেকেই শুরু হলো পিচঢালা পাহাড়ি পথ, তখন থেকেই আকাশ মেঘলা হতে শুরু করলো। পাহাড়ি পথ বেয়ে আমাদের গাড়ী (গ্রাব) আস্তে আস্তে এঁকে বেঁকে উপরের দিকে উঠছিল। উপরে মেঘের কাছাকাছি বৃষ্টিও হচ্ছিল, বৃষ্টির ছাট গাড়ীর গ্লাসে বার বার বাড়ি খাচ্ছিল। অল্প অল্প ঠাণ্ডা লাগছিল, নির্মল প্রকৃতি আর বৃষ্টিস্নাত আকাশ মনটাকে কোন এক অজানা শহরের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল!

আমি মালয়েশিয়াতে এসে প্রথমদিকে গোমবাক (ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভারসিটি এর কাছাকাছি) থাকতাম। তখন আমার বাসা থেকে গেন্টিং এর চূড়াটা দেখা যেত। মনে মনে ভাবতাম, এতো উঁচূতে কি করে একটা শহর বানানো হলো! কি করে ওইখানে ইট, কাঠ, সিমেন্ট বালি এবং বাকি সব সরঞ্জাম নিয়ে গেল! রাতের বেলা আলোকচ্ছটায় শহরটা আরো বেশি স্পষ্ট হতো! আর বিশেষ বিশেষ দিন কিংবা চাইনিজ নিউ ইয়ারের সময় যেন বাঁধভাংগা আলোকরাজির সম্মিলন ঘটতো! আর সেই আলোকরাজির ছটা মনটাকে গেন্টিং এর চূড়ায় নিয়ে গিয়ে ফেলতো, কখনো ঘুমের ঘোরে নিজেকে খুঁজে পেতাম মেঘের সারিতে ভেসে বেড়ানো মেঘবালিকার বেশে।

কুয়ালালামপুর থেকে মাত্র ১ ঘন্টার দূরত্বে ১৮৬০ মিটার উচ্চতায় তৈরী গেন্টিং সিটিতে আছে রিসোর্টস, থিম পার্ক আর ক্যাসিনো। বাস থেকে নেমে ৩.৩৮ কিমি. স্কাই ওয়ে পেরিয়ে ওখানে যেতে হয় (স্কাই ওয়ে বাই পাস করে সরাসরিও ওখানে যাওয়া যায়)। স্কাই ওয়ের যাত্রা পথ আর নৈসর্গিক দৃশ্য অসাধারণ, অবর্ণনীয় ! গেন্টিংকে মালয়েশিয়ার মন্টিকার্লো বলা হয় এবং এটি এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘ ক্যাবল কারের সংযোগ।

আমরা বিশাল লম্বা লাইন পার করে টিকিট কেটে কেবল কারে চড়ে বসলাম। বাচ্চারা বেশ মজাই পাচ্ছিল! আমরা তখন মাটি থেকে হাজার মিটার ওপরে! নিচের দিকে তাকালে মনে হয়, গহীন জঙ্গলে যেন এক ভৌতিক অবস্থা বিরাজ করছে, শুণ্যে ঝুলে ঝুলে চলেছি আর নিচে গভীর ঘন জংগল! বনের মাঝখান দিয়ে রাস্তাটাও উপর থেকে দেখা যাচ্ছে। নির্জন, নিরিবিলি, কেমন যেন ভূতুরে! আমাদের ক্যাবল কার হালকা হালকা মেঘ আলতো হাতে সরিয়ে সরিয়ে যাচ্ছিল। মনের ভেতর কেমন যেন ছমছম করে উঠছিল! তার ছিড়ে যদি এ জঙ্গলে পড়ি, তবে হাড় গোড় থাকলেও হিংস্র প্রাণী কিন্তু আমাদের টেনে হিঁচড়ে খেয়ে ফেলবে!

প্রায় আধঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে ক্যাবল কার থেকে নেমে যখন শৈল শিখরে পৌছালাম, মনে হলো যেন এক স্বপ্নের দেশে আসলাম! যেন হিমালয়ের কোনো দেশে এসে পাড়ি জমালাম! চারিদিকে আলো ঝলমলে। হাঁটতে শুরু করলাম। এখানে আছে হোটেল, ক্যাসিনো, থিক পার্ক, দোকানপাট, ভিডিও গেম ও অন্যান্য নানা রকম খেলাধুলা ও চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থা। মেঘের উপরে এতো সুন্দর শহর যেনো অন্য একটা জগৎ! এই শহরটাকে তাই ‘মেঘের ভেতর মজার শহর’ ও বলা হয়। শহরের লেকে রয়েছে বোটে ভ্রমণের ব্যাবস্থা। গেন্টিং থিমপার্কে আছে ট্রেন ভ্রমণ, কর্ক স্ক্র, গ্রান্ড প্রিক্স গোকার্ট, ফ্লাইং কোস্টার, স্পেস শট, স্পিনার এবং বাচ্চাদের জন্য এরকম আরও অনেক খেলার ব্যবস্থা। তাছাড়া রয়েছে চকলেটের ফ্যাক্টরি। চারপাশে চোখ ঘুরলে মনে হবে যেন চকলেটের এক রাজ্যে এসে পৌছেছি! থিম পার্ক ঘুরে এসে প্রবেশ করলাম চকলেটের দোকাগুলোতেও। মজার বিষয় হচ্ছে, চকলেটগুলো খেয়ে টেস্ট করা যায়। প্রায় একশ ধরনের চকলেট। গ্রাম হিসেবে বিক্রি করে। একটার টেস্ট অন্যটার চেয়ে ভিন্ন। সত্যিই অনেক সুস্বাদু! না খেলে এ স্বাদ বোঝা খুব কঠিন!

ঘুরতে ঘুরতে ক্যাসিনোর গেটে চলে আসলাম।
বুঝলাম কেন এখানে পৃথিবীর বিখ্যাত সব জুয়াড়িরা এসে মাসের পর মাস পড়ে থাকে। এটাকে ক্যাসিনোর জগৎ বলতেই হবে। ক্যাসিনোতে ঢুকতে হলে টাই কিংবা বাটিকের শার্ট পরতে হয়। পাশেই বাটিকের শার্ট ভাড়া পাওয়া যায়। নির্ধারিত ফি দিয়ে শার্ট ভাড়া করে ভেতরে যাওয়া যায়। এ এক বিশাল ব্যাপার!

বাইরে হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল, ওর মধ্যেই দাঁড়িয়ে কিছু ছবি তুললাম আর ছুটে চলা মেঘের ভিডিও করলাম। কিছুক্ষণ পর পর মেঘ এসে ঘিরে ফেলছিল আমাদের। মাঝে মাঝে মেঘগুলো হাতের উপর দিয়ে উড়ছিল।
ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। চারিদিকের সবুজ পাহাড়গুলো আমাদের থেকে নীচে। পাহাড়ের এক পাশে ঘন কালো মেঘের অন্ধকার। কিছুক্ষণের মধ্যেই বড় বড় বিল্ডিংগুলো মেঘে ঢাকা পড়ে গেলো। দূরে দেখা যায় রোদের রেখা। রোদের মাঝেই হঠাৎ বৃষ্টি। এ যেন এক মেঘের রাজ্য। মনে হচ্ছে যেন আকাশের উপর বসে থেকে আমরা দেশটাকে দেখছি। চারিদিকের পাহাড় ও বন, নিস্তব্ধ প্রকৃতি, অনেক মানুষের কোলাহলও নিস্তব্ধতা ম্লান করতে পারছিল না।

ঘুরাঘুরি শেষ করে সন্ধ্যার দিকে আমরা ট্যাক্সি নিয়ে মসজিদ জামেক চলে আসলাম। সেখান থেকে ট্রেনে আসলাম সুবাং জায়া। রাত ৯ টা নাগাত বাসায় পৌছে গেলাম।

গেন্টিংয়ের জগৎ মানুষকে মোহাবিষ্ট করে তোলে, আচ্ছন্নতায় ভরিয়ে রাখে। সব বয়সের মানুষের জন্য সব ধরনের বিনোদনের ব্যবস্থা এখানে রয়েছে। একজন মানুষকে অনায়াসে ব্যস্ত সময় থেকে গেন্টিং দূরে, বহুদূরে ছুটিয়ে নিয়ে যেতে পারে! ভুলিয়ে দিতে পারে সকল রকম ব্যস্ততা! মেঘের পরে মেঘ, তার উপরে আরও অনেক সারি সারি মেঘপুঞ্জের ভীরে হারিয়ে ফেলতে পারে! তথ্য এবং ছবির উৎস (কিয়দংশ): গুগোল।

Facebook Comments