banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 761 বার পঠিত

 

প্রতিবেশিনী……২


আফরোজা হাসান


দরজা খোলায় জন্য যেতে যেতে মাহামের মনে পড়লো সুপার মার্কেটে যাবার সময় তারজন্য লেবুপাতা নিয়ে আসার অর্ডার দিয়েছিলো প্রতিবেশিনী। নিশ্চয়ই লেবুপাতা নিতেই এসেছে। কিন্তু লেবুপাতা কথা তো মনেই ছিল না মাহামের। না জানি প্রতিবেশীর হক বিষয়ক কি লেকচার শুনতে হয় এখন আবার। প্রতিবেশীর উপরে কুরআন-হাদীসের সমস্ত তথ্য ঠোঁটের আগায় নিয়ে ঘোরে তার প্রতিবেশিনীর। আট-ঘাঁট বেঁধে মাঠে নেমেছে সে বোঝাই যায়। মাহাম দরজা খুলতেই দেখলো বিশাল এক লাগেজ হাতে প্রতিবেশিনী দাঁড়িয়ে আছে।

দরজা থেকে সরে দাঁড়ান তো একটু। ভেতরে ঢুকতে দেন আমাকে। বলে নিজেই মাহামকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে লাগেজ টানতে টানতে ভেতরে ঢুকে গেলো প্রতিবেশিনী।

মাহামের বিস্ময় ভরা দৃষ্টি সম্পুর্ন অগ্রাহ্য করে বলল, আজ আমি আপনার সাথে থাকবো। শোনেন আমার খুব গড়াগড়ি করার অভ্যাস তাই সোফায় শুতে পারবো না। আমি আপনার সাথে বেডরুমে ঘুমাবো। আপনার স্বামীকে বলবেন ড্রইংরুমের সোফায় ঘুমাতে।

মাহাম বলল, আপনার বাসায় কি গেস্ট এসেছে?

আরে না গেস্ট আসবে কেন? আমি স্বামীর সাথে ঝগড়া করে এসেছি।

কেন কি হয়েছে?

কি হয় নাই সেটা জিজ্ঞেস করেন। আমাকে বলে কি জানেন? বলে চিড়িয়াখানায় অদ্ভুত মানুষের যদি কোন সেল থাকতো তাহলে সে আমাকে সেখানে দিয়ে আসতো। কারণ আমি নাকি টিকিট কেটে দেখার মতো মানুষ।

হাসি পেলেও লেকচার শোনার ভয়ে প্রাণপণে নিজেকে সামলে নিলো মাহাম। যদিও মনে মনে প্রতিবেশিনীর স্বামীর ভাবনার প্রশংসা না করে পারলো না।

গজগজ করতে করতে প্রতিবেশিনী বলল, আমাকে উল্টা পাল্টা কথা বলার মজা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়াবো। কিন্তু রাগের সময় আমার আবার বুদ্ধি কাজ করে না। স্বামীকে শিক্ষা দেবার কোন বুদ্ধি থাকলে বলেন তো।

আমার স্বামীকে শিক্ষা দেবার তেমন প্রয়োজন পড়েনি কখনোই তাই ঠিক জানি না। তবে আমার মামণিকে কিভাবে বাবাকে শিক্ষা দিতেন সেটা বলতে পারি।

নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। বলেন সেটাই বলেন।

মামণি বলতেন স্বামীকে এমন শিক্ষা দেয়া উচিত যা সে কল্পনার মধ্যেও কল্পনা করেনি কখনো। আর তাই বাবা-মামণির যখনই মনোমালিন্য হতো মামণি সেই সব কাজ করতেন যা বাবা সবচেয়ে বেশি পছন্দ ছিল। যেমন বাবার প্রিয় সব খাবার রান্না করা, বাবার পছন্দের শাড়ি পড়ে, সাজগোজ করে হাসিমুখে কথা বলা, এমন ভাণ করা যে কিছুই হয়নি। এবং মামণির এই পদ্ধতিটা সবসময়ই খুব কাজ দিতো। বাবা নিজের রাগ তো ভুলে যেতেইনি সাথে উল্টো মামণিকে সরি বলতেন।

তারমানে আপনি আমাকেও এমন কিছু করতে বলছেন?

আমি শুধু পরামর্শ দিচ্ছি। কি করবেন সেটা আপনাকেই ঠিক করতে হবে। ভেবে দেখেন আপনি রাগ করে কথা বন্ধ করে দেবেন, রান্না বন্ধ করে দেবেন, কিংবা বাসা ছেড়ে চলে যাবেন এগুলোই কিন্তু স্বাভাবিক। আপনার স্বামী একটুও অবাক হবেন না আপনার এইসব কর্মকান্ডে। কিন্তু আপনি যদি সংসারের সব কাজ ঠিকমতো করেন, এবং খুব স্বাভাবিক ভাবে কথা ও আচরণ করেন উনার সাথে। উনি শুধু যে অবাক হবেন তাই না যে কথা বলেছেন সেটার জন্যও অনুতপ্ত হবেন।

হাসি ফুটলো প্রতিবেশিনীর মুখে। বাহ দারুণ বুদ্ধি তো। এটাকেই মনেহয় কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা বলে। আচ্ছা তাহলে আমার স্বামী আসার আগেই আমি বাসায় চলে যাই। সবকিছু গোছগাছ করে বসে থাকি। এমন চমক দেবো আজ তাকে চোখে সর্ষে ফুল দেখবে।

দরজার কাছে গিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ালো এসে। ফিরে এসে মাহামকে জড়িয়ে ধরে বলল, আপনি অনেক ভালো। জানেন একবার রাসূল সা: সাহাবাদের লক্ষ করে বলেন, “তোমরা কি জানো প্রতিবেশীর হক কী? যদি সে তোমার সাহায্যপ্রার্থী হয় তাকে সাহায্য করবে, যদি সে ধার চায় তাকে ধার দেবে, যদি সে অভাবগ্রস্ত হয় তার অভাব মোচন করবে, যদি সে রোগগ্রস্ত হয় তাকে সেবা দান করবে, যদি তার মৃত্যু হয় জানাজার নামাজে শরিক হবে, যদি তার মঙ্গল হয় তাকে উৎসাহিত করবে, যদি তার বিপদ হয় তার প্রতি সহানুভূতি জানাবে। তার অনুমতি ব্যতীত তোমার ঘর এত উঁচু করবে না, যাতে তার আলো বাতাস বন্ধ হয়ে যায়। যদি তুমি ফলমূল ক্রয় করো, কিছু অংশ প্রতিবেশীর জন্য পাঠাবে। আর যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে তা গোপনে তোমার সন্তানদের খেতে দেবে, যেন প্রতিবেশীর ছেলেমেয়ে তার বাবা-মাকে বিরক্ত না করে।”

মাহাম হেসে বলল, জ্বী আমি জানি হাদীসের এই বানীটি। আসলে পাড়া-প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণের প্রতি অনেক গুরুত্ব দিয়েছে শরীয়ত। আমরা সবাই যদি তা মেনে চলতাম তাহলে আমাদের সমাজে শান্তির অমৃত ধারা প্রবাহিত হতো। পাড়া-প্রতিবেশীর মাঝে অনাকাঙ্ক্ষিত ঝগড়াবিবাদ ও মনোমালিন্য দূরীভূত হতো। এবং সবাই সবার কল্যাণকামী হয়ে একে অন্যের প্রতি দায়িত্ববোধ ও তার অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হয়ে উঠতে পারতো।

প্রতিবেশিনীকে বিদায় জানিয়ে আবার রান্নাঘরে ঢুকলো মাহাম। আয়ান টেবিলে সব খাবার বেড়ে তার অপেক্ষাতে বসে আছে।

মাহাম বলল, আমি তো আসছিলাম তুমি করতে গেলে কেন? এভাবে কিন্তু তুমি আমার অভ্যাস খারাপ করে দিচ্ছো।

আয়ান বলল, সেটা কিভাবে?

এই যে সারাক্ষণ আমাকে সাহায্য করার জন্য হাত উঁচু করে বসে থাকো। এভাবেই এক্সপেক্টটেশন বেড়ে যায়। সবসময় তো তুমি এমন সাহায্য করতে পারবে না আমাকে তাই না? তখন হয়তো আমার মনেহবে তুমি আমাকে আগের মত কেয়ার করো না, ভালোবাসো না। বাবা সবসময় বলেন দাম্পত্যের শুরুর দিকের অপ্রতিরোধ্য আবেগও অনেক জটিলতার বীজ বুনে দিয়ে যায় সম্পর্কের।

হুমম…বুঝলাম। তা বাবার মেয়ে কি বলে সেটাও বলো শুনি।

সম্পর্কের বন্ধন গুলো রেশমের সুতোর মত হয় অনেকটা। তাই সেই সুতোকে কিছু একটার সাথে সুন্দর করে সবসময় বেঁধে রাখা উঠিত। ঐ যে ঘুড়ির লাটাইয়ে যেভাবে ভাঁজে ভাঁজে জড়ানো থাকে সুতো অনেকটা সেরকম। তা না হলে সুতোর প্যাঁচ লেগে যাবার সম্ভাবনা থাকে। প্যাঁচ লেগে যাওয়া সুতোদের একে অন্যের থেকে ছাড়াতে গেলে একটু অসাবধানটাতেই তা ছিড়ে যায়। ছিড়ে যাওয়া সুতো আবার জোড়া হয়তো লাগানো যায়। কিন্তু তাতে গিট পড়ে যায়। আর সম্পর্কের মাঝে কখনোই গিট পড়তে দেয়া ঠিক না।

সম্পর্কের বন্ধনে যাতে গিট না পরে সেজন্য কি করতে হবে?

সুতোগুলোকে শরীয়তের লাটাইয়ে জড়িয়ে নিতে হবে।

সেটাই তো করছি আমি। শরীয়ত যার মাধ্যমে এসেছে তিনিও তো সাংসারিক কাজে সাহায্য করেছেন স্ত্রীকে।

কিন্তু তিনি সবসময় সবকিছুতেই মধ্যাবস্থা অবলম্বন করেছেন।

হাসলো আয়ান। কিছু না বলে প্লেট এগিয়ে দিলো মাহামের দিকে। বড় বেশি লেকচার দেয় এই মেয়ে। এর লেকচার দেয়া বন্ধ করতে হবে। কঠিন কোন শিক্ষা দিতে হবে। কি শিক্ষা দেয়া যায় খেতে খেতে সেটাই ভাবতে লাগলো সে……..

চলবে….

পর্ব-১

Facebook Comments