banner

সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 206 বার পঠিত

 

পথে পথে হয়রানি: নির্যাতন-নিপীড়নে অনিরাপদ ঢাকা

১৯ বছরের কিশোরী নায়লা।বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কোচিং করতে জয়পুরহাটের মফস্বল এলাকা থেকে ঢাকায় এসেছেন। থাকছেন লালমাটিয়ায় একটি মেসে বন্ধুদের সাথে।দিনের বেলা কোচিং থেকে ফেরার পথে ফুটপাতে হাঁটার সময় লক্ষ্য করেন, একদল ছেলে তার পিছু নিয়েছে।এক পর্যায়ে ধানমণ্ডি ২৭ নম্বরে এসে রিকশা নিয়ে লালমাটিয়ায় রওনা হলে দেখেন,সেই পিছু নেওয়া চলছেই।ছেলেগুলো সেদিন মেস চিনে যায়। পরদিন থেকে শুরু হয় উৎপাত।এক সপ্তাহের মধ্যে চারজন ছেলে অচেনা এই শহরে কিশোরীর টিকে থাকা অনিশ্চিত করে দেয়।ধর্ষণের শিকার হয় মেয়েটি।লোকলজ্জার ভয়ে পুলিশি সহায়তা না নিয়ে মেয়েকে সঙ্গে করে এলাকায় ফেরেন অভিভাবক।মেয়েটির পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়।

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা।অফিস শেষে বাড়িতে ফেরার যানবাহনের জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলেন শাহিনা পারভীন।মোটরসাইকেলে আরোহী দুই যুবক তার দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ আচরণ করলে,তিনি প্রতিবাদ করেন।মোটরসাইকেল আরোহী একজন নেমে এসে তাকে শারিরীকভাবে লাঞ্ছিত করলেও আশপাশ থেকে কেউ তাকে সহায়তা করে না।বেশ কিছুক্ষণ পর তাকে মোটরসাইকেলে উঠিয়ে নেওয়ারও চেষ্টা করা হয়।মেয়েটির অভিযোগ,কাছেই একটা টহল পুলিশের ভ্যান থাকলেও কেউ এগিয়ে আসেনি। তার চিৎকার শুনে লোকজন আশেপাশে এলেও কেউ সহায়তা করেনি।একসময় তাকে গালাগালি করে চলে যায় ওই মোটরসাইকেলের আরোহীরা।

যে মেয়েদের জীবিকার তাগিদে কিংবা নানা কাজে বাড়ির বাইরে যেতে হয়, তাদেরকে এধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে কম-বেশি সবাকেই যেতে হয়। বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশনএইড-এর ‘নিরাপদ নগরী নির্ভয় নারী’ প্রচারণার অংশ হিসেবে করা এক গবেষণা তথ্য মতে,…

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস ২০১৪ সালের মে-জুন মাসে নারায়ণগঞ্জসহ দেশের সাতটি বিভাগীয় শহরে ১২০০ জন উত্তরদাতার স্বাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। এর মধ্যে ৮০০ জন নারী ও কিশোরী এবং বাকি ৪০০ জনের মধ্যে ২০০ জন পুরুষ এবং ২০০ জন হলো অনুর্ধ ১৮ বছরের ছেলে।

গবেষণায় দেখা যায়,শতকরা ৮৪ জন নারীকে বখাটেদের কটুক্তি ও অশোভন আচরণের সম্মুখীন হতে হয়েছে।অর্ধেকেরও বেশী নারীকে রাস্তা ঘাটে কুপ্রস্তাব শুনতে হয়েছে। সর্বোপরি ৫৭ শতাংশ উত্তরদাতাকে অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ বা গায়ে হাত দেওয়ার মতো হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়েছে। আরও হতাশার দিক হলো,একজন নারী কিন্তু একাধিকবার একাধিক ধরনের যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। যেমন গড়ে একজন নারী গত তিন মাসে ৪ থেকে ৫ বার অশোভন আচরণের সম্মুখীন হয়েছেন, একইভাবে ৪ থেকে ৫ বার অপরিচিতের কাছ থেকে ‘কুপ্রস্তাব’ পেয়েছেন এবং ২ থেকে ৩ বার অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শের মত হয়রানির সম্মুখীন হয়েছেন।

এছাড়া দেশের ৯৫ শতাংশ নারী মনে করেন, পুলিশি সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে হেনস্তার শিকার হতে হয়।নারী নেত্রীরা বলছেন,সব থেকে ভয়াবহ বিষয় হলো,যৌন নির্যাতনের শিকার ৮৪ শতাংশ নারী এ ব্যাপারে কোথাও অভিযোগ করা দরকার বলে মনে করেন না। উত্তরদাতাদের ৬৫ শতাংশ নারী মনে করেন,পুলিশ অভিযোগকারীকেই দোষারোপ করে।

কেবল পুলিশ না, সামাজিকভাবেও মেয়েটিকেই দোষারোপ করা হয়- বলেন মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান। তিনি বলেন, ‘রাস্তায় কোনও হয়রানির শিকার হলে মেয়েরা পরিবারের সদস্যদের সাথেও শেয়ার করতে সাহস পায় না।সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে গিয়ে অভিযোগ করবে সে-তো অভাবনীয়। এমনকি কোনও নারী ধর্ষণের শিকার না হওয়া পর্যন্ত পরিবারের পক্ষ থেকে কোনও উদ্যোগ নিতে দ্বন্দ্বে থাকতে দেখা যায়। ফলে ইভটিজিং বা যৌন হয়রানির ঘটনায় নারীরা নিজেদের আড়াল করেই টিকে থাকতে চান।’

অ্যাকশন এইড এর জরিপ বলছে, রাস্তায় বা অন্যান্য পাবলিক পরিসরে হয়রানি দিয়ে বুঝা যায়,শহরে বসবাসরত অনেক বাংলাদেশি নারী অনিরাপদ থাকেন এবং নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে অনেক চিন্তিতও থাকেন। অন্তত ১০ শতাংশ নারী পাবলিক পরিসরে নিজেদের অনিরাপদ ভাবেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের মাহবুবা নাসরিন  বলেন, ‘আমাদের পাবলিক প্লেসগুলো নারীবান্ধব না। একজন নারী সন্ধ্যার পর অফিস থেকে বের হয়ে নিজের মতো করে বাসায় ফিরবে, তার জন্য তাকে বাড়তি খরচ করতে হয়। বাসে করে যাওয়া অনিরাপদ বলে তাকে কাছের দূরত্বেও সিএনজি চালিত অটোরিক্সা ভাড়া করতে হয়। ফলে তিনি শুরুতেই নিজে থেকে সতর্ক হতে গিয়ে চলাফেরার পরিধি কমিয়ে দেন। আর যারা সেটা করতে চান না, সমাজ এখনও তাদের সাথে ঘটা যেকোনও অপরাধের জন্য তাদেরই (নারীদেরই) দোষ দিয়ে থাকে। ফলে নারীর জন্য ঘরে-বাইরে সমান অনিরাপদ, যতদিন না আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটানো যাবে।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন  বলেন, ‘নিউ মার্কেট গাউসিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় নারীদের হয়রানির যে চিত্র তুলে ধরা হয়, সেসব বন্ধে আমাদের পরিকল্পনা আছে। মানুষকে সচেতন করে তোলা জরুরি। নারীদের সার্বিক উন্নয়নে নারী কাউন্সিলর বাড়ানোর পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীকে সংবেদনশীলভাবে কাজে লাগানো জরুরি।’ তিনি আরও বলেন,‘ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে কেবল ময়লা আবর্জনা নয়, আমাদের উচিত নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্য নিরাপদ নগরী উপহার দিতে চেষ্টা করা।’

Facebook Comments