পারুল, হোসনে আরা, হাসনা হেনা, রেণু আরা—তাঁরা চার বোন। চারজনই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। তবে রান্নাসহ সংসারের প্রায় সব কাজ নিজেরাই করেন। শুধু এই চারজনই নন, তাঁদের আপন ভাইয়ের ছেলে ও মেয়েও চোখে দেখেন না। অনেক আগে চিকিৎসক দেখিয়েছেন। তবে কোনো লাভ হয়নি। চার বোনই এখন সরকারের প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন। আট বোনের মধ্যে চার বোনই এখন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। তাঁদের চার ভাই চোখে দেখেন।
গত ৩১ জুলাই ময়মনসিংহ শহরের ব্রাহ্মপল্লির ১১৫/এ বকুলতলা ঠিকানায় গিয়ে দেখা মেলে দুই বোন ও ভাতিজা-ভাতিজির। এক বোনের কাছ থেকে মুঠোফোনে খবর পেয়ে অন্য দুই বোনও হাজির হন। দুই বোন এক ভাইয়ের আশ্রয়ে আছেন। অন্য দুই বোন এক যুগের বেশি সময় আগে সরকারের কাছ থেকে একটি করে ঘর বরাদ্দ পেয়েছিলেন। সেসব ঘরে মূলত তাঁদের ছেলেরা থাকছেন। ছেলেদের সংসারে তাঁরা খুব একটা ভালো থাকছেন, তা জোর দিয়ে বলতে পারলেন না। কথা হলো চার বোনের সঙ্গে।
ভাইয়ের আশ্রয়ে পাওয়া টিনের ছোট এক চিলতে ঘর হোসনে আরার। ঘরে একটি খাট, সস্তা কাঠের নেট লাগানো ছোট একটি আলমারি, ছোট টেবিলে একটি গ্যাসের চুলা আর পাশেই একটি চেয়ার। ঘরে দিনের আলোতেও তেমন কিছু দেখা যায় না। ঘরটি এতটাই ছোট যে, বিছানা থেকে নামার পর কাজ করতে গেলে বিভিন্ন জিনিসের সঙ্গে ধাক্কা লেগে যায়।
হোসনে আরা এই প্রতিবেদকের সামনেই সকালের নাশতা খাওয়ার জন্য নুডলস রান্না করলেন। গ্যাসের চুলা ধরানো, মরিচ, পেঁয়াজ কাটাসহ সব কাজ একাই করলেন। তিনি জানালেন, বেশ কয়েক বছর একজনের বাসায় রান্নার কাজও করেছেন।
জাতীয় প্রতিবন্ধী সেবা সংস্থা নামের একটি সংগঠনের চেয়ারম্যান হোসনে আরা। বিভিন্ন ধরনের ২৬২ জন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এ সংগঠনের সদস্য। অর্থের অভাবে বর্তমানে সংগঠনটির কার্যক্রম নেই বললেই চলে।
হোসনে আরা জানালেন, একটু বড় হওয়া পর্যন্ত চোখে দেখতেন। এখন কিছুই দেখেন না। স্বামী তাঁকে ফেলে চলে গেছেন। ১২ বছর বয়সী ছেলের দায়িত্বও এখন হোসনে আরার কাঁধে।
হাসনা হেনার বিয়ে হয় ছোট বয়সেই। তাঁর চোখের সমস্যারও শুরু অল্প বয়স থেকেই। বিয়ের পরে স্বামীর সংসারে ১০ দিন থাকার পর স্বামী তাঁকে ফেলে চলে যান। এখন থাকেন হোসনে আরার পাশের ঘরে, ভাইয়ের আশ্রয়ে। ভাইয়ের সংসারের রান্না করা ছাড়াও কাপড় ধোয়া, ঘর ঝাড়ু দেওয়াসহ বিভিন্ন কাজ করে দেন। হাতের ইশারায় সব করতে পারেন বলে জানালেন।
আরেক বোন পারুলের বয়সের কারণে সামনের দুটি দাঁত পড়ে গেছে। স্বামী মারা গেছেন। তাঁর দুই ছেলে, এক মেয়ে। ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। একবার রান্না করার সময় গায়ে আগুন লেগে গিয়েছিল। তিনি এবং তাঁর আরেক বোন রেণু আরা ১৩ বছর আগে সরকারের কাছ থেকে একটি ঘর পেয়েছেন। ওই ঘরে থাকলেও পরিবারের আপনজনেরাই অনেক সময় এমন কথা বলেন, যা শুনে তাঁদের কষ্ট হয় বলে জানালেন।
রেণু আরার এক ছেলে, এক মেয়ে। তাঁরও স্বামী মারা গেছেন। সরকারের কাছ থেকে পাওয়া ঘরে ছেলে ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে থাকেন। এখন ভিক্ষা করে রেণু আরা নিজের খাদ্যের সংস্থান করেন। ছেলের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ নেই। তিনি বললেন, ‘ছেলেরই সংসার চলে না। ১০ জনের কাছে চাইলে একজন কিছু দেয়। তা দিয়েই চলে আমার।’ এই চার বোন সরকারের কাছ থেকে প্রতিবন্ধী ভাতা হিসেবে তিন মাসে ১ হাজার ৫০০ করে টাকা পাচ্ছেন।
এই চারজনের আরেক বোন (চোখে দেখেন) রুমা বললেন, ‘দুই বোন সরকারের কাছ থেইক্যা ঘর পাইছে। অন্য দুই বোন দরখাস্ত দিছে। কিন্তু এখন তো টাকা চায়। টাকা না দিলে কোনো কিছু পাওয়া যায় না। এই দুই বোনের একটা গতি হইলে সবাই বাইচ্যা যাইত।’
হোসনে আরাসহ চার বোনের অনেক কষ্টের স্মৃতি আছে। হোসনে আরা বলেন, ‘ছেলের মুখ দেখতে পাইলাম না আজ পর্যন্ত। খালি চোখের পানি ফালাই। ছেলের মুখটা যদি দেইখ্যা যাইতে পারতাম।’ তিনি চার বোনের মধ্যে সবার ছোট।
হাসনা হেনা বললেন, ‘মানুষ কানা ডাকলে খারাপ লাগে। এইটা তো একটা গালি। তার চাইতে অন্ধ কইলেও হয়। ঘরের বাইরে বাইর হইলেই মানুষ খারাপ কথা কয়।’
এক বোন ছাড়া অন্য তিন বোন মানুষের কাছে হাত পাতেন না। তবে কেউ কিছু দিলে তা ফিরিয়ে দেন না। কেননা মানুষের সহায়তায় তাঁরা এখন পর্যন্ত অন্তত বেঁচে তো থাকতে পারছেন।
বাবার রেখে যাওয়া সামান্য সম্পত্তি নিয়ে বড় ভাইয়ের সঙ্গে বিরোধের জের আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে বলে জানালেন হোসনে আরা। যে ভাইয়ের আশ্রয়ে দুই বোন থাকতে পারছেন, ওই ভাইও তাঁদের ফেলে দিলে তাঁদের আর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। হোসনে আরা বললেন, ‘আমরা বেশি কিছু চাই না। খালি চলার মতন একটি গতি হইলেই খুশি।’