banner

শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 664 বার পঠিত

 

সব হারানো ফারজানার সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

রাজধানীর মিরপুরে কালশীর বিহারি ক্যাম্পে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে একই পরিবারের নয় জনসহ ১০ জনকে হত্যার ঘটনার দুই বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ। ওই ঘটনায় পল্লবী থানায় দায়ের করা ছয়টি মামলার তদন্ত এখন স্থবির হয়ে আছে। দীর্ঘ দুই বছরেও জড়িতদের কাউকেই শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। নেই তদন্তের কোনো অগ্রগতি।

নিহত ব্যক্তিদের স্বজন ও ভুক্তভোগীরা দাবি করছেন, কালশী বিহারি ক্যাম্পের জায়গা দখলের উদ্দেশ্যেই ১০ জনকে হত্যা করা হয়। পল্লবী থানার পুলিশের সহায়তায় স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের ইন্ধনে ওই হামলার ঘটনা ঘটে। এ কারণেই প্রথমে পল্লবী থানার পুলিশ ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে চায়। পরে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তদন্তভার পেলেও ভুক্তভোগীদের বক্তব্য শোনেনি।

তদন্তকারীরা কয়েকজনের সাক্ষ্য নিয়েছে, অথচ তারা ঘটনাস্থলেই ছিল না। তবে ডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, অপরাধীদের ধরতে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছেন তারা। সেই তদন্তে এখনো কোনো অগ্রগতি হয়নি।

এদিকে সেদিনের হামলায় পরিবারের নয় সদস্যকে হারানো কিশোরী ফারজানাকে এখনো তাড়া করে ফেরে সেই দুঃসহ স্মৃতি। পরিবারের কেউ বেঁচে না থাকায় সে এখন মোহাম্মদপুরে এক খালুর বাসায় আছে।

গত বছরের ১৩ জুন শবেবরাতের রাতে পটকা ফোটানো নিয়ে পল্লবীর কালশী এলাকায় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে ভোরের দিকে কালশীর বিহারি ক্যাম্পের একটি বাড়িতে আগুন ধরে যায়। এতে আগুনে পুড়ে ও গুলিবিদ্ধ হয়ে ১০ জন মারা যায়। তাদের মধ্যে একই পরিবারের নয় জন রয়েছে।

নিহতরা হলো- ইয়াসিন আলীর স্ত্রী বেবী আক্তার (৪৫), ছেলে আশিক (২৫), তিন মেয়ে শাহানি (২০), আফসানা (১৮), রুখসানা (১৪), যমজ ছেলে লালু (১২) ও ভুলু (১২), পুত্রবধূ শিখা (১৯) এবং শাহানির ছেলে মারুফ (৩)। এছাড়া ওই ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আজাদ নামে এক শ্রমিক নিহত হন।

স্বজনদের অভিযোগ, হামলায় সরাসরি অংশ নেয়া সন্ত্রাসী ও এর নেপথ্যে কারা ছিল, তা সবাই জানে। তারা সবাই ছিল বাউনিয়া বাঁধ এলাকার সরকারদলীয় লোকজন, যারা স্থানীয় এমপি ইলিয়াস মোল্লার সহযোগী। পুলিশ তাদের সঙ্গে মিলেই হামলা চালায়। পরে তদন্তে নেমে পুরো ঘটনাই ধামাচাপা দিতে চায়। ডিবি পুলিশ তদন্ত করেও রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করছে না। দুর্বৃত্তরা নয়টি ঘরের দরজায় বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে আগুন দেয়। এ ঘটনায় ১০ জন মারা গেলেও পুলিশ প্রথমে মামলা নিতে চায়নি।

পরে ওই ঘটনায় পল্লবী থানায় ছয়টি মামলা হয়। এর মধ্যে পুলিশ বাদী হয়েছে চারটিতে। বাকি দুটি মামলার বাদী হয়েছেন মোবারক হোসেন নামে এক ব্যক্তি ও স্থানীয় এক চা বিক্রেতা। পাঁচ মামলাতেই আসামি করা হয়েছে হামলার শিকার ক্যাম্পের বাসিন্দাদের। আসামির সংখ্যা তিন হাজার ৭১৪। তবে পুলিশের দায়ের করা হত্যা মামলার আসামি অজ্ঞাত। বাকি মামলাগুলো হয়েছে বিস্ফোরক ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে।

উর্দু স্পিকিং ইয়ুথ পিপলস রিহ্যাবিলিটেশন মুভমেন্টের দপ্তর সম্পাদক ইমরান খান  বলেন, ‘বিহারি ক্যাম্পের জায়গা দখল করতেই হামলা করা হয়। আগুনে পুড়ে ও গুলিতে মারা গেছে বিহারিরা। অথচ মামলায় এই সম্প্রদায়ের লোকজনকেই আসামি করা হয়েছে। ঘটনার পর সাতজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। পরে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু এখনও কোনো বিষয়ে কথা বলতে গেলে ওইসব মামলায় গ্রেপ্তারের ভয় দেখানো হয়।’

তিনি বলেন, ‘গত বছরের জুনে তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁনের সঙ্গে দেখা করেন। তখন তারা মন্ত্রীকে সেই ঘটনার কিছু ভিডিওচিত্র দেন। তাতে দেখা যায়, পুলিশের উপস্থিতিতেই বিহারি ক্যাম্পে আগুন দিচ্ছে দুর্বৃত্তরা। সে সময় মন্ত্রী এক মাসের মধ্যেই ঘটনাটি তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেন। এক বছরেও সেই তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি।’

ডিবির উপ-কমিশনার (পশ্চিম) সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘কালশীর সংঘর্ষ-সহিংসতার ঘটনার মামলাগুলোর তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। সবগুলো মামলাই গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত শেষ না হলে কারা জড়িত বা প্রকৃত ঘটনা কী তা বলা যাবে না।’

স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করছেন, তদন্তভার পাওয়ার পর স্থানীয় কমিউনিটি পুলিশ ও সরকারদলীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছে ডিবির তদন্তকারীরা। তাদের মধ্যে ইসলাম নামের একজন ছিলেন, যিনি ঘটনার সময় দিনাজপুরে ছিলেন। ঢাকায় ফেরেন পাঁচদিন পর। এভাবে ডিবি পুলিশ অনেকের বক্তব্য নিয়েছে, যারা প্রত্যক্ষদর্শী নয় এবং ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। ঘটনার ভিডিও ফুটেজ থাকলেও তা আমলে নেয়নি তদন্তকারীরা।

দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুনে মা, তিন ভাই, তিন বোন, ভাবি ও ভাগ্নের সঙ্গে দগ্ধ হয়েছিল কিশোরী ফারজানা আক্তার। সৌভাগ্যবশত সে বেঁচে গেলেও মারা যায় পরিবারের নয়জন। বেঁচে ছিলেন তার বাবা ইয়াসিন মিয়াও। তবে আগুন দেয়ার ঘটনার আড়াই মাস পর আকস্মিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় তারও মৃত্যু হয়।

এখন খালা সাহিদা বেগম ও খালু আসলাম খানের সঙ্গে তাদের মোহাম্মদপুর মার্কেট ক্যাম্পের বাসায় থাকছে ফারজানা। সে স্থানীয় একটি স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। ফারজানা  বলে, ‘সেই কথা মনে পড়লে আমার ভয় লাগে। সাংবাদিকদের বলে কী লাভ! যারা মারছে তাদের তো বিচার হয় না।’

সে জানায়, পড়ালেখা শেষ করে সে দুস্থ-অসহায় মানুষের সেবায় কাজ করতে চায়। সবার দোয়ও চায় সে।

ফারজানার খালু সেলুনকর্মী আসলাম খান  বলেন, ‘ছোট্ট একটি ঘরে তারা সাতজন থাকেন। তার সামান্য আয়ে সংসারের খরচ ও ফারজানার লেখাপড়া চালানো মুশকিল হয়ে পড়েছে। প্রথমে কিছু সহায়তা পাওয়া গেছে। যা ফারজানার চিকিৎসায়ই খরচ হয়ে গেছে। এখন মেয়েটির ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন তারা।

Facebook Comments