banner

রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 333 বার পঠিত

 

‘অশ্রু দিয়ে লেখা এ গান যেন ভুলে যেয়ো না…’

কেমন ছিল তনুর জীবনের শেষ দিনগুলো? তনুকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থিয়েটারের একজন কর্মী।

ওকে প্রথম কবে দেখেছি, ঠিক মনে নেই। একদিন আবিষ্কার করলাম, আমাদের কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থিয়েটারে একজন উচ্ছল নবীন কর্মী যুক্ত হয়েছে। নাটকের ব্যাপারে নিবেদিতপ্রাণ, নাচ-গানে পারদর্শী; এক কথায় সম্ভাবনাময়। ওর নাম সোহাগী জাহান, সবাই ডাকতাম তনু বলে। গত বছরেই থিয়েটারে যোগ দেয় ও, সদস্য হিসেবে। আমরাই অডিশন নিয়েছিলাম। তনু আমার গ্রুপে ছিল না। পরে শুনেছি, অডিশনের দিনই সবাই ওর প্রতিভার ঝলক দেখেছিল। প্রতিভার প্রমাণও তনু রেখেছিল অল্প কয়েক দিনেই। কলেজ ক্যাম্পাসে, মঞ্চে ও হয়ে উঠেছিল সবার প্রিয়মুখ।

থিয়েটারের সদস্য হওয়ার পর যা হয়, আমরা অর্থাৎ বড়রা নবীনদের প্রশিক্ষণ দিই। প্রশিক্ষণে মাঝেমধ্যে ও দেরি করে আসত। স্বাভাবিকভাবেই আমরা হয়তো বকাঝকা দেওয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু শেষমেশ পারতাম না! নামের সঙ্গে ওর চরিত্রের মিল ছিল, একটু আহ্লাদী ধরনের ছিল। বকা দিতে গেলেই বলে উঠত, ‘ভাইয়া ভাইয়া, প্লিজ বকা দেবেন না! আর কখনো দেরি হবে না!’ সত্যিই, তনু আর থিয়েটার ক্লাসে দেরি করে আসবে না! তনু ঘড়ির কাঁটার ঊর্ধ্বে চলে গেছে!

তনুকে কখনো গোমড়ামুখে দেখিনি। ওর মুখে হাসি লেগে থাকত। চমৎকার নাচত, ফলে ওর চোখেও হাসি হাসি ভাবটা থাকত সব সময়। ছোটবেলা থেকেই নাচ শিখত; ফলে থিয়েটারে এসে নতুন করে অনেক কিছুই শেখাতে হয়নি ওকে। কেবল কি নাচ? গানের গলাও ছিল মিষ্টি। থিয়েটারে একসঙ্গে এত গুণের একজনকে পেলে কার না ভালো লাগে! নবীন কর্মী বলে কোনো নাটকে অভিনয়ের জন্য মঞ্চে ওঠা হয়নি তনুর। প্রথম প্রথম যেটা হয়, মঞ্চের পেছনে কাজ করে নবীনরা। তনুও তা-ই করত। গোমতীর উপাখ্যানপাপ ডাকে অন্ধকার নাটক দুটির নেপথ্যসংগীত গেয়েছিল তনু। ১৩ ও ১৪ মার্চে আমরা পয়লা বৈশাখের প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। সেখানে বিপুল উৎসাহে অংশ নিয়েছিল তনু। আমাদের অনুষ্ঠানমালায় ওর নাচ ছিল গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ। তনু নেই, এবারের পয়লা বৈশাখ আমাদের জন্য এত বিষাদের হবে, কে জানত!

ভিক্টোরিয়া কলেজ থিয়েটারের কর্মীদের সঙ্গে তনু। ছবি: সংগৃহীতকেবল থিয়েটারে নয়, অল্প কয়েক দিনে কলেজের অনেক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিল তনু। শিক্ষকেরাও ওর নাম শুনলে নিশ্চিন্ত হতেন, ‘ও, তনু আছে? তাহলে তো চিন্তা নেই।’ নবীনবরণ অনুষ্ঠানে নিজে থেকেই গান গাওয়ার কথা বলেছিল ও। গত মার্চ মাসে কলেজের বার্ষিক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল। সর্বোচ্চ তিনটি বিভাগে অংশ নেওয়া যায়। তিনটিতে অংশ নিয়ে তনু পুরস্কার জিতেছিল তিনটি বিভাগেই! একক নৃত্যে প্রথম, দ্বৈত নৃত্য ও সংগীতে দ্বিতীয়। প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়ার কথা ছিল ২৬ মার্চে। সে সুযোগ আর হলো না! কেবল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের গণ্ডিতেই নয়, তনুর প্রতিভা ছড়িয়ে পড়েছিল আরও বড় পরিসরে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা কলেজগুলোর মধ্যে যে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা হয়, সেখানেও তনু সফল। নৃত্যে প্রথম হয়েছিল জেলা পর্যায়ে। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বিভাগীয় পর্যায়ে অংশ নিতে গিয়েছিল চট্টগ্রামে। ভালো করেছিল সেখানেও।

খুব সাধারণ আর পরিপাটি ছিল তনু। এক বছরে ওকে আমি তিনটি পোশাকই পরতে দেখেছি। থিয়েটারের কর্মীদের ব্যাপারে খোঁজখবর রাখতে হয় আমাদের। ফলে কর্মীরা ক্লাসে বা ক্যাম্পাসে ভালো-মন্দ কেমন করছে, তা-ও আমরা জানতাম। তনুর ব্যাপারে সব সময় ইতিবাচক মন্তব্যই শুনেছি। বন্ধুবান্ধব ও শিক্ষকদের সঙ্গে ওর খুব ভালো সম্পর্ক ছিল।

ওর মৃত্যুর আগে আগে, ১৭ মার্চ আমরা গিয়েছিলাম শ্রীমঙ্গলের লাউয়াছড়ায়। সেখানে আমাদের থিয়েটারের পালাবদল ও কর্মী মূল্যায়নের অনুষ্ঠান ছিল। খুব চমৎকার সময় কেটেছে সবার সঙ্গে। ১৮ মার্চ তনু এল আমার কাছে। লাফাতে লাফাতে এসে বলল, ‘ভাইয়া, আপনার সঙ্গে একটা ছবি তুলব।’ ছবি তুলল। সারা দিন কথায়, গানে মাতিয়ে রাখল সবাইকে। চা-বাগানের সবুজে ও ছিল আরও সবুজ, আরও উজ্জ্বল। সেখান থেকে ফিরতি বাসে উঠলাম আমরা ১৮ মার্চেই। বাসে ও একটা গান গাইল, ‘অশ্রু দিয়ে লেখা এ গান যেন ভুলে যেয়ো না…’। কী যে চমৎকার গাইল! এখনো কানে লেগে আছে! কুমিল্লা শহরে ঢোকার আগেই ওর বাসা। বাস থেকে নামবে। ওর ভাই এসেছে নিতে। থিয়েটারের বড় ভাই হিসেবে দায়িত্বের জায়গা থেকে বললাম, ‘বাসায় গিয়ে ফোন করো।’ বাসায় গিয়ে ঠিকই ফোন করল। বলল, ‘ভাইয়া, বাসায় এসে পৌঁছেছি।’ সেটাই ওর সঙ্গে শেষ কথা হবে কে জানত!

Facebook Comments