banner

রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 400 বার পঠিত

 

মায়ের মর্যাদা, মাতৃত্বের মর্যাদা

পৃথিবীতে সবচেয়ে মধুর শব্দটি হচ্ছে মা। কবির ভাষায়, ‘যেখানে দেখি যাহা, মা-এর মতন আহা, একটি কথায় এত সুধা মেশা নাই।’ জগৎ-সংসারের শত দুঃখ-কষ্টের মধ্যে যে মানুষটির একটু সান্ত্বনা আর স্নেহ-ভালোবাসা আমাদের সব বেদনা দূর করে দেয়, তিনিই হলেন মা। মায়ের চেয়ে আপনজন পৃথিবীতে আর কেউ নেই। দুঃখে-কষ্টে, বিপদে-সংকটে যে মানুষটি স্নেহের পরশ বিছিয়ে দেন, তিনি হচ্ছেন আমাদের সবচেয়ে আপনজন—মা। প্রতিটি মানুষের পৃথিবীতে আসা ও বেড়ে ওঠার পেছনে প্রধান ভূমিকা একমাত্র মায়ের। মায়ের তুলনা অন্য কারো সঙ্গে চলে না।
শান্তির ও মানবতার ধর্ম ইসলাম মা-কে দিয়েছে সর্বোচ্চ মর্যাদা ও সম্মান। ইসলামের দৃষ্টিতে বাবার চেয়ে মায়ের মর্যাদা তিন গুণ বেশি। এ প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে জানতে চান, ‘হে আল্লাহর রাসুল! মানুষের মধ্যে আমার কাছে সর্বোত্তম সেবা লাভের অধিকার কার?’ নবী করিম (সা.) বলেন, ‘তোমার মায়ের।’ লোকটি পুনরায় জানতে চান, ‘তারপর কার?’ তিনি বললেন, ‘তোমার মায়ের।’ লোকটি পুনরায় জানতে চান, ‘তারপর কার?’ তিনি বললেন, ‘তোমার মায়ের।’ লোকটি আবারও জানতে চান, ‘তারপর কার?’ তিনি বললেন, ‘তোমার পিতার।’ (বুখারি ও মুসলিম)
উপমহাদেশের প্রখ্যাত কবি আল্লামা ইকবাল। তাঁর চিন্তা-চেতনায় ইসলামী ভাবধারা ফুটে উঠেছে। নারীত্ব ও মাতৃত্ব সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন চির স্মরণীয়। নারী অধিকার আন্দোলনের চারণভূমি ইউরোপে তিনি পড়াশোনা করেছেন। কাজেই নারী সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে। আল্লামা ইকবাল মনে করেন, নারী যদি প্রজ্ঞা-পাণ্ডিত্যে প্রাগ্রসর না-ও হতে পারে, মানবতার কল্যাণে কোনো কাজ না-ও করতে পারে, তবুও নারী ‘মা’ হওয়ার কারণে শ্রদ্ধার পাত্র, সম্মান পাওয়ার যোগ্য। পৃথিবীর এমন কোনো মানুষ নেই, যার ওপর নারীর অনুগ্রহ নেই, মায়ের করুণা নেই।
মরহুম ইকবাল মনে করেন, নারীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো আদর্শ মা হওয়া। মাতৃত্বের মাধ্যমে নারীত্ব পূর্ণতা লাভ করে। ইকবাল মনে করেন, মায়েরা হলেন পৃথিবীর ভিত্তিস্বরূপ। তাঁরা ‘মা’ না হলে বংশ বাড়বে না। সমাজ চলবে না। পৃথিবী থমকে যাবে। শত কোলাহল-উত্তাপ থেমে যাবে। সভ্যতার বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। তাই মায়েরা হলেন পবিত্র আমানত, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। ইকবাল বলেছেন, ‘জগতের ভিত হলো মায়ের জাতি/দুনিয়ায় তারা আমানত-শ্রেষ্ঠ সম্পত্তি।’
ইকবাল মনে করেন, মাতৃত্বের প্রেরণা যদি নারীর মধ্যে অবিচল থাকে; তাতে সন্তানের কল্যাণ, পরিবারের কল্যাণ, পৃথিবীর কল্যাণ। যে সমাজে নারীরা মা হতে চায় না, মাতৃত্বের মর্যাদা দেওয়া হয় না, সে সমাজে শান্তি থাকে না। সুখ থাকে না। ঐক্য থাকে না। ছোট-বড়র পার্থক্য থাকে না। সুখের শেষ আশ্রয়স্থল পরিবার হয়ে ওঠে সাক্ষাৎ নরক। যে সমাজ মা হতে উৎসাহিত করে না, মাতৃকুলের মর্যাদা রক্ষা করে না, সে সমাজে নারী ভোগের পণ্য, জৈবিক চাহিদা পূরণের উপকরণ। যৌবন ফুরিয়ে গেলে, জৌলুস হারিয়ে গেলে নারী অর্থহীন, বিত্তহীন, মূল্যহীন। নীরবে-নিভৃতে তার সময় কাটে। অনাহারে-অর্ধাহারে তার দিন কাটে। কেউ তাকে চেনে না। কেউ তাকে দেখে না। বৃদ্ধাশ্রমে তার ঠাঁই মেলে। এ চিত্র আধুনিক যুগের। এ দৃশ্য পশ্চিমা সভ্যতার, পশ্চিমের দেশগুলোর। এ চিত্র ইকবাল স্বচক্ষে অবলোকন করেছেন। যে সমাজের বীভৎস রূপ ইকবাল সন্ধানী চোখে প্রত্যক্ষ করেছেন, সে সমাজের স্বরূপ ইকবাল এভাবে তুলে ধরেছেন : ‘পশ্চিমা দুনিয়ায় মায়েদের মূল্য নেই/তাই তো তাদের সমাজে প্রাণ নেই।’
কেবল সন্তান জন্ম দেওয়ার মাধ্যমেই মায়েরা দায়মুক্ত হয়ে যান না, ভারমুক্ত হয়ে যান না। শিশুর সুন্দর বেড়ে ওঠা, তার ভাষা শেখা, চরিত্র গঠন ও শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রে মায়ের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। সন্তানের জীবনের সব উন্নতি-বিকাশ, চেতনা-সচেতনতা, চিন্তা-বিশ্বাস—সবই তার মায়ের তরবিয়াত ও দীক্ষার ফসল। মায়ের আত্মিক ভালোবাসা ও স্বচ্ছতার অবদান। ইকবাল মনে করেন, পুরনো, জীর্ণ, ঘুণেধরা সমাজ বদলে দিতে নারীরা অনেক বড় অবদান রাখতে পারে। নারীর মধ্যে আল্লাহ তাআলা এমন শক্তি, বিশ্বাস ও দরদ দিয়েছেন, সে চাইলে জাতির ধমনিতে ইমানের জ্যোতির্ময় দীপ্তি ছড়িয়ে দিতে পারে। ইকবালের দৃষ্টিতে নবুয়তের সঙ্গে মাতৃত্বের একটা জুতসই সম্পর্ক আছে। নবীদের মতো মায়েরা উম্মতের জন্য রহমতস্বরূপ। নবীদের মতো মায়েরা জাতির চরিত্র গঠনে ভূমিকা রাখতে পারেন। ইকবালের জবানিতেই দেখুন : ‘মায়েরা করে থাকেন চরিত্র গঠন/সত্য-সুন্দর মণি-মুক্তার মতন।/আদর্শ মা জাতির জন্য রহমত/নবুয়তের সঙ্গে আছে তাঁর নিসবত।/স্নেহ-মমতায় তাঁরা নবীদের মতন/যতন করে জীবন করে গঠন।’
Facebook Comments