শিশুদের শারীরিক যত্নের পাশাপাশি মানসিক বিকাশে সচেতনতা থাকা জরুরি। বিশেষ করে জন্মের পর প্রথম পাঁচ বছর হলো শিশুর মস্তিষ্ক গঠনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময়টাতেই স্মৃতিশক্তি প্রভাবিত হওয়ার ভিত্তি তৈরি হয়। তাই অভিভাবক হিসেবে কিছু কাজ নিয়মিত করলে শিশুর মনে রাখার ক্ষমতা আরও উন্নত হতে পারে।
করণীয়
১. খেলাধুলার মাধ্যমে শেখানো:
শিক্ষাকে আনন্দময় করতে হলে খেলাধুলা ও গেম-ভিত্তিক শেখানো কার্যকর। মেমোরি গেম, ধাঁধা, শব্দজট, চিত্রপরিচিতি—এসব খেলার মাধ্যমে শিশুর শেখার প্রতি আগ্রহ বাড়ে এবং শেখা বেশি সময় ধরে মনে থাকে।
২. কল্পনা করার অভ্যাস গড়ানো:
শিশুকে গল্প শোনানোর পর বলা যেতে পারে, “এবার চোখ বন্ধ করে ভাবো, তুমি কী দেখলে?”—এভাবে কল্পনাকে সক্রিয় করলে স্মৃতিও দীর্ঘস্থায়ী হয়।
৩. শেখা বিষয় অন্যকে শেখাতে উৎসাহ:
যে জিনিসটা সে শিখেছে, তা যদি কাউকে (যেমন ছোট ভাই/বোন, দাদি-নানি) শেখাতে পারে, তাহলে বিষয়টি তার মনে আরও ভালোভাবে গেঁথে যায়। এতে তার আত্মবিশ্বাসও বাড়ে।
৪. ভেঙে ভেঙে শেখানো:
বড় কোনো তথ্য বা অধ্যায়কে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে শেখালে শিশুর পক্ষে তা সহজে মনে রাখা সম্ভব হয়। প্রতিটি ধাপকে বোঝার সুযোগ দিলে তার ধারণা আরও পরিপক্ব হয়।
৫. হাইলাইট এবং রঙের ব্যবহার:
শিশুদের জন্য পড়ার সময় গুরুত্বপূর্ণ শব্দ বা বাক্য রঙিন কলম দিয়ে হাইলাইট করে দেওয়া যেতে পারে। শিশুরা রঙের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে, যা তার মনোযোগ বাড়াতে সাহায্য করে।
৬. দৈনন্দিন রুটিনে শেখার সময়:
শিশুর জন্য একটি নির্দিষ্ট পড়ার ও শেখার সময় নির্ধারণ করলে সে অভ্যাস গড়ে তুলতে শেখে। শেখার সময়টা যেন চাপমুক্ত ও আনন্দদায়ক হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
৭. গল্প বলার অভ্যাস গড়ে তোলা:
ঘুমানোর আগে গল্প বলা শিশুর কল্পনাশক্তি ও শব্দভাণ্ডার বাড়ায়। পাশাপাশি, গল্পের ধারাবাহিকতা মনে রাখার চেষ্টা করাও স্মৃতিশক্তি উন্নত করে।
৮. শরীরচর্চা ও খেলাধুলা:
দৌড়, লাফঝাঁপ, বল খেলা, সাইকেল চালানো—এসব শারীরিক কসরত শিশুর রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে, মানসিক চাপ কমায় এবং শেখার আগ্রহ বাড়ায়।
৯. পুষ্টিকর খাদ্য:
শিশুর খাদ্যতালিকায় রাখুন ডিম, মাছ, দুধ, বাদাম, তাজা ফল, সবজি এবং যথাসম্ভব প্রাকৃতিক খাবার। চকলেট, সফট ড্রিংকস বা ফাস্টফুড কমিয়ে দিলে মনোযোগ বৃদ্ধি পায়।
১০. পর্যাপ্ত ঘুম:
বয়স অনুযায়ী শিশুকে ৮-১০ ঘণ্টা ঘুমাতে দিতে হবে। গভীর ঘুমই তার মস্তিষ্ককে পুনরায় সজীব করে এবং শেখা মজবুত করে।
১১. আবেগিক নিরাপত্তা:
শিশু যেন তার ভুল বলার ভয়ে ভীত না থাকে বা প্রশ্ন করতে সংকোচ না করে, সেজন্য তাকে সহানুভূতির সঙ্গে বড় করতে হবে। এতে শেখার আগ্রহ বাড়ে।
১২. নিয়মিত বইপড়া:
কমিক বই, ছবি সহ গল্পের বই বা ইসলামিক শিশুতোষ বই পড়ার অভ্যাস গড়লে সে শব্দ চিনতে শেখে, ভাষা রপ্ত করে এবং কল্পনা শক্তি বাড়ায়—যা সবকিছু মিলিয়ে স্মৃতিকে জোরদার করে।
বর্জনীয়
শিশুকে অতিরিক্ত পড়ার চাপ দেওয়া যাবে না। এতে শেখার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে যায়।
তার প্রশ্ন শুনে বিরক্ত হওয়া বা উত্তর না দেওয়া একেবারেই উচিত নয়। এতে সে ভবিষ্যতে জিজ্ঞেস করতে ভয় পায়।
“অমুকের মতো হতে হবে” বলে তুলনা করা থেকে বিরত থাকুন। এতে শিশুর আত্মসম্মানবোধ নষ্ট হয়।
প্রতিযোগিতা বা পরীক্ষার চাপে না রেখে শেখার আনন্দটা উপভোগ করতে দিন।
টিভি, মোবাইল, ট্যাব—এসব ডিভাইসে অতিরিক্ত সময় কাটানো শিশুর মনোযোগ ও স্মৃতির বড় ক্ষতি করে।
বড়দের ঝগড়া বা চিৎকার শিশুর মানসিক স্থিতি নষ্ট করে; তাই ঘরের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ
যদি উপরের সব কৌশল অনুসরণ করেও শিশুর মধ্যে স্মরণশক্তি, মনোযোগ বা আচরণগত সমস্যা লক্ষ করা যায়, তাহলে শিশুবিশেষজ্ঞ বা মনোবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া বাঞ্ছনীয়। কখনো কখনো সমস্যার পেছনে শারীরিক বা নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল কারণও থাকতে পারে।
এই পরামর্শগুলো শুধু শিশুদের মেধা বাড়ানোর জন্য নয়, বরং তাদের সুন্দর মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার পথও তৈরি করে।