banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 1015 বার পঠিত

 

চুপ করে থাকো,কাউকে বলো না! (পর্ব-১)

চুপ করে থাকো,কাউকে বলো না!
(পর্ব-১)


রাহনুমা সিদ্দিকা 


নিষ্পাপ শৈশবে- যখন উড়ে যাওয়া এরোপ্লেন দেখে পাইলট হতে ইচ্ছে করে, ফেরিওয়ালার ঝুড়িতে রঙবেরঙের পসরা দেখে পথে পথে ঘুরে ফেরি করতে ইচ্ছে করে, দাদার রেডিওর সমস্ত পার্টস খুলে- আর না লাগাতে পেরে স্টোর রুমে লুকিয়ে রেখে ভবিষৎ সায়েন্টিস্ট প্রস্তুতি নিচ্ছে দুনিয়া জয়ের, স্কুল ম্যাগাজিনে নিজের প্রথম প্রকাশিত লেখা ভবিষৎ সাহিত্যিকের ক্ষুদে বুকটা ভরিয়ে তুলছে- সেই সময়ই কিছু শিশুকে মুখোমুখি হতে কুৎসিত অন্ধকারের, বিনা অপরাধে রঙিন নিষ্পাপ স্বপ্নগুলো হারিয়ে যায় দুঃস্বপ্নের ভীড়ে, জীবনটা হয়ে ওঠে বিভীষিকা।

ক্লাস ওয়ান পড়ুয়া মেয়েটি টিচারের কাছে পড়তে যেতে চাচ্ছে না। তার অভিযোগ টিচার তাকে ব্যথা দেয়। বাবা-মা ধমক দিয়ে পাঠালেন। তারা বললেন, ‘এসব তোমার ফাঁকি দেওয়ার ছল!’ চোখ মুছে শিশুটি টিচারের কাছে পড়তে বসলো। সে জানে না কেন স্যার তাকে কিছু জায়গায় এভাবে ছোঁয়।

গৃহকর্ত্রীর দূর-সম্পর্কের ভাই এসেছে বাসায়। দুপুরবেলা তারই হেফাযতে দশ বছরের কাজের মেয়েটিকে রেখে গৃহকর্ত্রী গেছেন শপিংয়ে। …… লোকটা মেয়েটিকে হুমকি দিলো কাউকে কিছু বললে মেরে লাশ বানিয়ে ফেলবে।

সাত বছরের ফুটফুটে ছেলেটাও বুঝতে পারলো না চাচ্চু তার সাথে বারবার এমন করছে কেন। চাচ্চু বলেছে এটা একটা সিক্রেট মজার খেলা- কাউকে বলা যাবে না। কিন্তু তার খুব কষ্ট হচ্ছে, ব্যথা লাগছে। আম্মু-আব্বুকে কি তার বলা উচিত? যদি তারা বিশ্বাস না করে? ওকেই পঁচা ভাবে? আচ্ছা, চাচা তো খুব ভালো, তাকে কত কি মজার খেলনা দেয়- কত গল্প করে! বলে দিলে কি চাচা আর কখনো ওকে আদর করবে না? সে কীভাবে বলবে আম্মু-আব্বুকে?

মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে মায়াবতী কন্যাশিশুটি যখন বলে উঠলো গ্রামের বাড়ি বেড়াতে এসে তার সাথে কী নির্মম ঘটনাটা ঘটে গেছে, হতভম্ব মা মেয়ের চোখের জল মুছে বললেন, ‘চুপ করে থাকো, কাউকে বোলো না!’

কাকে আমরা চাইল্ড সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ বলছি?

চাইল্ড সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ (CSA) কে বলা যায়, “the imposition of sexual acts, or acts with sexual overtones, by one or more persons on a child (under 18)”– Save the children, CSA Draft Policy.

• শিশুর গোপন অঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ,
• শিশুকে কারো গোপনাঙ্গ ধরতে বলা,
•penetration of a child’s mouth with a penis,
• শিশুর পর্ন ছবি তোলা,
• শিশুকে পর্নোগ্রাফি দেখানো এবং শিশুর সামনে নগ্ন হওয়া,
• শিশুদের পতিতাবৃত্তিতে ঢোকানো, বাল্যবিবাহ,
• শিশুর সাথে বয়স অনুপযোগী sexual behavior নিয়ে আলোচনা,
• শিশুকে ধর্ষণ বা ধর্ষণের চেষ্টা করা (যা ছেলে বা মেয়ে শিশু যে কারো ক্ষেত্রেই ঘটতে পারে)
ইত্যাদি। সুতরাং, কেবল ধর্ষণ নয়, শিশু-যৌননির্যাতন একটি ব্যাপক পরিসরের শব্দ।

শিশুর উপর প্রভাব

মানসিক
বিষণ্নতা, সহিংস আচরণ, আত্মপীড়নমূলক কার্যকলাপ (নিজেকে বিভিন্নভাবে কষ্ট দেওয়া), আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি ও হীনমন্যতা, দুঃস্বপ্ন, অসামাজিক আচরণ, সমবয়সীদের সাথে মিশতে না পারা, হঠাৎ হঠাৎ চমকে ওঠা, আত্মহত্যার প্রবণতা (কিশোর বয়েসীদের ক্ষেত্রে), স্বাভাবিক মানসিক বিকাশে বাধা।

শারীরিক
শিশু গুরুতরভাবে আহত হতে পারে, কোন কোন ক্ষেত্রে চিরতরে প্রজনন ক্ষমতা হারাতে পারে, নিউরোল্যজিকাল ড্যামেজ, দ্রুত ওজন কমে যাওয়া, রাতে বিছানা ভেজানো ইত্যাদি।

কিছু তথ্য-উপাত্ত

১৯০টি দেশের উপাত্ত নিয়ে তৈরি এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘের তরফ থেকে বলা হয়েছে বিশ্বে প্রতি দশ জনে একজন মেয়েশিশু ধর্ষিত অথবা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। WHO এর হিসেব মতে প্রতি বছর পৃথিবীতে প্রায় ৪০ মিলিয়ন শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।

ভারতের নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের ২০০৭ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ভারতে ৫৩ভাগ শিশু শৈশবে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়।

ব্রেকিং দ্যা সাইলেন্স- নামে একটি বেসরকারি সংস্থার একজন কর্মকতা রোকসানা সুলতানা বলেন, ‘বাংলাদেশের শতকরা নব্বইভাগ শিশু পারিবারিক গন্ডিতেই ধর্ষণ থেকে শুরু করে অনাকাঙ্ক্ষিত শারীরিক স্পর্শসহ কোন না কোন যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে।’ ১৯৯৭ সালে তারা শৈশবে যৌন নির্যাতনের শিকার ৫০ জন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেন, যার মধ্যে ৪৬ জনই পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন, পরিচিত মানুষদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিলেন। অর্থাৎ মাত্র ৪ জন শিশুর নির্যাতনকারী ছিলেন অপরিচিত ব্যক্তিরা।

বাংলাদেশের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত পাঁচ বছরের কম বয়েসী ২৮৬ জন শিশু সেক্সুয়াল অ্যাবিউজের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে ৯৯ ভাগ শিশু ধর্ষণের শিকার।

২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত যে ৩৯৬ জন শিশু (অনূর্ধ্ব ১৮) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার, ব্রেকিং দ্যা সাইলেন্স ও ঢাকা শিশু হাসপাতালের কাউনসেলিংয়ের আওতায় আসে তাদের ৮৬ ছেলেশিশু। ছেলেশিশুরাও শংকার বাইরে নয়।

দুঃখজনক যে, বাংলাদেশে এই নিয়ে এখনো সরকারীভাবে পূর্ণাঙ্গ কোনো সমীক্ষা করা হয় নি। সামান্য নথিভূক্ত তথ্য-উপাত্ত যা পাওয়া যায় তা মোটেই প্রকৃত অবস্থাকে প্রতিফলিত করছে না। কারণ, এ ঘটনাগুলোর অধিকাংশই হয় অভিভাবকদের অসচেতনতায় অজানা থেকে যায় অথবা লোকলজ্জার ভয়ে ধামাচাপা দেওয়া হয়।

চলবে—

(অপরাজিতা প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে লিখেছেন রাহনুমা সিদ্দিকা। বাচ্চাদেরকে ধর্ষকের হাত থেকে বাঁচাতে সহযোগিতা করতে পারে এই সামান্য প্রচেষ্টা ধন্যবাদ)

Facebook Comments