banner

শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 1394 বার পঠিত

 

যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে……১ম পর্ব

আফরোজা হাসান


“আমাদের জীবনের সবচেয়ে অবধারিত ঘটনা হচ্ছে মৃত্যু। তাই একটি মুহুর্তকেও এলোমেলো, অগোছালো, উদ্দেশ্যহীন ভাবে কাটানোর কোন সুযোগ নেই। তাই কোন ভাবনা যদি স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে বিঘ্নিত করে তবে সেটা থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। কেননা কোন কিছুর বিনিময় জীবনের স্বাভাবিকত্বের সাথে হতে পারে না।” কথাটি আমাদের নিউরো সাইকোলজির প্রফ বলেছিলেন আমাদের এক ক্লাসমেটকে। ক্লাসমেটটি তার পারিবারিক কিছু জটিলতার ভাবনাতে এতোই এলোমেলো হয়ে পড়েছিল যে তার প্রভাব পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিলো। প্রফের কথাটি শোনার পর শুধু সেই ক্লাসমেটই নয় আমরা সবাই’ই সতর্ক হয়েছিলাম আমাদের সেইসব ভাবনার ব্যাপারে যা অকারণ জটিলতার বীজ বুনে চলছিল আমাদের জীবনে।

আমার সবচেয়ে প্রিয় টিচারদের একজন ছিলেন উনি। শুধু তাই নয় যাদেরকে দেখে শিখেছিলাম জীবনকে জীবনের মত করে যাপন করতে, যাদের কাছে জেনেছিলাম জীবনে সুখী হবার সবচেয়ে শর্টকার্ট ও ফলপ্রসূ টিপস হচ্ছে,সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা করা উনি তাদেরও একজন ছিলেন। কিছু মানুষ বুঝিয়েছিলেন জীবনে মাঝে মাঝে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যার উপর আমাদের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। সেসব ঘটনার জন্য কাউকে দায়ী না করে নিয়তি লিখন হিসেবে তার সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়াতেই কল্যাণ নিহিত থাকে।কেননা তাহলেই কেবল মানুষ সবকিছুকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারে। সহজ ভাবে গ্রহণ করতে পারে জীবনের প্রতিটা চড়াই-উৎরাইকে। উনাদেরকে দেখেই উপলব্ধি করেছিলাম নিজের সমস্যা ও কষ্টকে কখনোই বড় করে দেখা ঠিক নয়। আর সেজন্য সবসময় মনে রাখতে হবে যা ঘটার কথা ছিল তাইঘটেছে, আর যা ঘটেছে তার মধ্যেই নিহিত আছে কল্যাণ।

বাবা সেই ছোটবেলা থেকেই বার বার বলতেন, ´´কখন যে জীবন বৃক্ষ থেকে হঠাৎ কে ঝরে যাবে সেটা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। তাই আপনজন, প্রিয়জন, পছন্দের মানুষদেরকে কখনোই যথাযথ মূল্যায়ন করতে অবহেলা করবে না। ´´ কিন্তু তারপরও অবহেলা যে হয়েই যায় সেটা আবারো অনুভব করলাম আমাদের নিউরো সাইকোলজির প্রফের মৃত্যুর সংবাদ শোনার পর। মনের পর্দায় ভেসে এসেছিল ‘খুব ইচ্ছে করছে তোমার হাতের মাটন বিরিয়ানি, চিকেন তান্দুরী আর গাজরের লাড্ডু খেতে’। শেষ যেদিন কথা হয়েছিল আমার হাতের খাবার খেতে ইচ্ছে করছে এই আবদার করেছিলেন প্রফ। একবার কোলকাতায় গিয়ে “যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন…” এই রবীন্দ্র সঙ্গীতটি শুনেছিলেন প্রফ। ফিরে এসে ক্লাসে জানতে চাইলে অর্থ বুঝিয়ে বলার পর কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেছিলেন, আচ্ছা ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’ তোমরা কি আমাকে মনে রাখবে? তোমরা আমাকে মনে রাখতে পারো এমন কিছু তোমাদেরকে শেখাতে পেরেছি? এরপর থেকে প্রতি ক্লাসের পরই উনি আমাদের সবার কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় জানতে চাইতেই, আমাকে তোমরা মনে রাখবে এমন কিছু আজ শেখাতে পেরেছি?!

আমরা কখনোই খুব একটা সিরিয়াসলি নেইনি প্রফের প্রশ্নটিকে। বেশির ভাগ সময়ই হেসে উড়িয়ে দিয়েছি। উনার মৃত্যু সংবাদ শোনার পর প্রথমেই কানে বেজে উঠেছিল ‘খুব ইচ্ছে করছে তোমার হাতের মাটন বিরিয়ানি, চিকেন তান্দুরী আর গাজরের লাড্ডু খেতে’। চোখ থেকে ঝরঝর অশ্রু নেমে এসেছিল। এমনটা আমার দ্বারা কখনোই হয় না সাধারণত। কেউ কিছু খেতে চাইলে শত ব্যস্ততার মধ্যেও আমি তাকে সেটা রান্না করে খাওয়াতে চেষ্টা করি। জানি না কেন প্রফের ক্ষেত্রে ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে আজ করবো কাল করবো করে করে শেষপর্যন্ত আর উনার জন্য রান্না করাই হলো না। ‘আমাকে তোমরা মনে রাখবে এমন কিছু আজ শেখাতে পেরেছি’? এই প্রশ্নটার কথা মনে পড়ার পর বেদনার আরেকটি তীব্র স্রোত বয়ে গিয়েছিল অন্তর জুড়ে। কেন এই ছোট ও সহজ প্রশ্নটির জবাব নিয়ে এত হেয়ালি করেছিলাম? বেদনার সাথে যুক্ত হয়েছিল অপরাধবোধও।

অবুঝের মতো ছুটে গিয়েছিলাম রান্নাঘরে। মাটন বিরিয়ানি, চিকেন তান্দুরী, গাজরের লাড্ডুর সাথে চমচম আর বোরহানিও তৈরি করলাম। প্রফ আমার হাতের চমচম আর বোরহানিও অনেক পছন্দ করতেন। রান্না শেষ করে মেইল লিখতে বসলাম। কত কিছু শিখেছি গত বারো বছরে প্রফের কাছে। এক এক করে সব লিখলাম। প্রফকে দেখে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে জিনিসটা শিখেছিলাম সেটা হচ্ছে মানুষের সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা রাখা। দীর্ঘ এত বছরে এমন একবারও হয়নি উনি কারো ব্যাপারে সামান্য নেতিবাচক কিছু বলেছেন। কিংবা উনার কাছে কেউ কারো সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু বলতে চাইলে সেটাকে প্রশয় দিয়েছেন। আমাদের এক ক্লাসমেট যখন বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির সবার সম্পর্কে ওর নেতিবাচক ধারণার কথা বলছিল প্রফ বলেছিলেন, সারাজীবন যাদের সাথে কাটাতে হবে তাদের ব্যাপারে এত দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক নয়।

Facebook Comments