আফরোজা হাসান
বেশ অবাক হয়েই নুসরাহর দিকে তাকালো রামিছা। অস্ফুট স্বরে বলল, আমার দায়? আমি তো এমনকিছুই করিনি কখনোই। স্বামী ও সংসারের প্রতি আমি সবসময় বিশ্বস্ত ছিলাম, আছি।
নুসরাহ বলল, আপনি আসলে আমার প্রশ্নটি বোঝেননি রামিছা। খুবই চমৎকার ছোট্ট সুখের সংসার ছিল আপনাদের। কোন কিছুর অভাব যেমন ছিল না। তেমনি বন্ধনগুলোও ছিল সুন্দর। স্বামী আপনাকে যথেষ্ট পরিমাণ ভালোবাসেন সেটা কথা শুনেই বোঝা গিয়েছে। পনেরো বছর কিন্তু অনেক লম্বা সময়। এতটা বছর একসাথে।
মিলেমিশে কাটানোর পর হঠাৎ করে এমন কি ঘটলো যে আপনাদের জীবনে তৃতীয় একজন জায়গা করে নিলো?
এই প্রশ্নটি কি একবারও মনে আসেনি আপনার?
না এভাবে তো ভেবে দেখিনি আমি!
অথচ এ কথাটাই কিন্তু সবার আগে ভেবে দেখা উচিত ছিল। আমার অভিজ্ঞতা বলে যে, একটা সংসার গড়তে যেমন দুজন ব্যক্তির প্রয়োজন পড়ে। ঠিক তেমনি ভাঙতেও দুজনকেই অংশগ্রহণ করতে হয়। দোষ কম-বেশি হতে পারে এটা ঠিক। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই দোষ দুজনেরই থাকে এই ধরণের কেসে। এমন প্রেমময় একজন স্বামী কেন বদলে গেলো এই প্রশ্নটা আসা উচিত ছিল আপনার মনে।
ভাবা উচিত ছিল এমন কি ঘাটতি সংঘটিত হয়েছে আপনার দ্বারা যার ফলে আপনার স্বামীকে অন্য নারীর দিকে হাত বাড়াতে হয়েছে। দেখুন আমি আপনাকে কষ্ট কিংবা অপ্রস্তুত করতে চাইছি না মোটেও। আপনি যদি বলতেন যে আপনার স্বামী খুবই খারাপ লোক, গায়ে হাত তোলেন ইত্যাদি ইত্যাদি। তাহলে এসব প্রশ্ন আমি কখনোই জানতে চাইতাম না। কিন্তু একজন ভালো মানুষ কেন খারাপ পথে চলতে শুরু করলো সেটা অবশ্যই জানা উচিত।
আমি কি উনাকে জিজ্ঞেস করবো?
না আগে আপনি নিজেকে জিজ্ঞেস করুন। শান্ত মনে নিজেকে বিবেকের আয়নায় দেখুন। নিজের কোন দোষ বা ভুলকে ঢাকার চেষ্টা করবেন না। যখন আপনি সমস্যার মূলে পৌছাতে পারবেন তখনই সমাধানের পথে এগিয়ে যাওয়াটা অনেক সহজ হবে।
নিজের দোষ অনুসন্ধানের সাথে সাথে আরেকটি কাজ আপনি করবেন। সেটি হচ্ছে একসাথে কাটানো সুন্দর মুহুর্তগুলো স্মরণ করবেন স্বামীর সাথে বসে। তাকে মনে করিয়ে দেবেন কত সুন্দর একটি জীবন আপনারা একসাথে উপভোগ করেছিলেন। বাচ্চাদের বিষয়ে কথা বলবেন বেশি বেশি। ওদের ভবিষ্যৎ, পড়াশোনা, বিয়ে, এমনকি গল্প করতে করতে নিজেদেরকে নানা-নানু পর্যন্ত বানিয়ে ফেলবেন।
যে কাজটি করবেন না সেটি হচ্ছে ঝগড়া, খোঁচা দিয়ে কথা বলা, মুখ গোমড়া করে থাকা, এবং আলাদা বিছানায় ঘুমানো।
এ সব করলে কি ঠিক হয়ে যাবে আমার স্বামী?
আপনি আপনার স্বামীর যে পরিচয় দিয়েছেন তাতে এসব করলে তার মনে প্রভাব পড়বে আশা করি ইনশাআল্লাহ। সে ভুল পথে চলছে এই উপলব্ধিও জাগ্রত হয়ে উঠতে পারে তার মনে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শরীয়তের বিধি-বিধান, নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করতে চেষ্টা করবেন স্বামীর সাথে, পরিবারের সবাই মিলে একসাথে বসে। আপনার পক্ষে যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করে দেখুন। তারপরও যদি আপনার স্বামী সঠিক পথে ফিরে না আসে তখন অন্য কিছু চিন্তা করা যাবে।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে রামিছা বলল, নিজের দোষ বলতে ঠিক কি খুঁজে দেখবো আমি? আপনি একটু যদি বুঝিয়ে বলে দিতেন?
মানুষের সবচেয়ে বড় একটি সমস্যা হচ্ছে ভালোবাসাকে যথাযথ মূল্যায়ন করতে না পারা। কেউ আমাদেরকে ভালোবাসলে আমরা সেই ভালোবাসাকে স্বীকৃতি ও বদলে তাকে ভালোবাসা দেবার চাইতে বরং সেটাকে দুর্বলতা হিসেবেই ব্যবহার করি বেশির ভাগ সময়। কারো ভালোবাসা পাবার জন্য আমরা যে চেষ্টা ও সাধনা করি। কারো ভালোবাসা অর্জন করে ফেলার পর সেভাবে আর কদর করি না।
আর যে ভালোবাসা না চাইতেই পেয়ে যাই সেটাকে তো নিজের হক বলে ভেবে নেই। এই যেমন ধরুন কেউ আপনাকে এসে বললো যে, তার হাজবেন্ড একটুতেই গায়ে হাত তোলে কারণে অকারণে। আপনি তাকে সান্ত্বনা দেবেন, তার হাজবেন্ডকে বকাঝকা করবেন। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই আপনি যে কত ভালো একজন হাজবেন্ড পেয়েছেন সেটা মনে করতেই ভুলে যাবেন। আমরা মানুষেরা আসলে এমনই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। কেউ হাজার ভালো করলেও তেমন করে তাকে মূল্যায়ন করি না। কিন্তু যদি একটি খারাপ কাজ, কিন্তু এমন কোন কাজ করে যা আমাদের পছন্দ নয়। আমরা কঠোরতা প্রদর্শন করতে এক মুহুর্ত দেরি করি না।
হ্যা, এটা তো আসলেই সত্যি!
নুসরাহ বলল, আবার যে সংসারের স্বামীরা রাগী সেই সংসারের স্ত্রীদের দেখা যায় স্বামী ঘরে ফেরার আগেই চেষ্টা করে সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে ফিটফাট করে রাখতে। কিন্তু যে সংসারের স্বামীরা নরম মনের মানুষ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের আসা যাওয়ার ব্যাপারে স্ত্রীরা বাড়তি কোন সতর্কতা অবলম্বন করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন না। এমনও হয় স্বামী বাসায় ফিরেছেন আর স্ত্রী হয়তো টিভি নিয়েই বসে আছে। উঠে কোন কিছু লাগবে কিনা সেটা জিজ্ঞেস করারও প্রয়োজনীয়তা বোধ করছেন না।
জ্বি আমি বুঝতে পেরেছি আপনার কথা। আমি সবকিছু ভেবে আপনাকে জানাবো।
নুসরাহ হেসে বলল, আপনি এক দিক দিয়ে অনেক ভাগ্যবতী কারণ কোন ধরণের শারীরিক অত্যাচার আপনাকে হতে হয়নি। এবং এখনো আপনার স্বামী আপনার কেয়ার করে। নয়তো বেশির ভাগ সময়ই এমন ভয়ংকর সব সমস্যা নিয়ে মানুষ হাজির হোন! তখন তাদেরকে জীবনের সুখের সময়ের কথা চিন্তা করে দেখতে বলার কোন সুযোগ থাকে না।
আপনার স্বামীর অন্যায়টি মোটেও কম কিছু নয়। কিন্তু যেহেতু আপনি চাইছেন সংসারটা টিকিয়ে রাখতে।
সুতরাং, চেষ্টার পেছনে আপনার হান্ডেড পার্সেন্ট দিতে চেষ্টা করুন। নিজের জন্য, সন্তানদের জন্য এবং আপনার স্বামীর জন্যও।
চলবে….