banner

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 1107 বার পঠিত

 

ভারতের শেষ প্রান্ত

একবার ভারতের শেষপ্রান্তটা ঘুরে আসতে পারেন। দক্ষিণ প্রান্তের শেষ সীমা-ছোট্ট একটি বিন্দু। মনে হলে প্রথমেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে নীল সমুদ্রে ঘেরা তামালনাড়ুর ছোট জেলা কন্যাকুমারী। ইচ্ছা হলে বেড়িয়ে আসতে পারেন কেপ কমোরিন বা কন্যাকুমারী থেকেও।
১৯৭০ সাল থেকে ভারতের কন্যাকুমারী অন্যতম উল্লেখযোগ্য পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গোটা বিশ্বের কাছেই পরিচিতি পেয়ে এসেছে। দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর একেবারে শেষ প্রান্তে অবস্থিত কন্যাকুমারীর ভৌগলিক অবস্থান এমনই যে তা পর্যটকদের আকৃষ্ট করবেই। ভারত মহাসাগর, বঙ্গোপসাগর এবং আরব সাগরের সঙ্গম স্থলে অবস্থিত এই কন্যাকুমারী এমন একটি উপদ্বীপ যেটি তীর্থস্থান এবং ভ্রমণস্থল উভয়ের জন্যই বিখ্যাত।
একবার চোখ বুলিয়ে নিন এত জায়গা থাকতে কেন যাবেন কন্যাকুমারীতে? কী দেখবেন সেখানে গিয়ে?
বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল- এটি পর্যটকদের অন্যতম প্রিয় জায়গা। কথিত আছে, রামকৃষ্ণ পরমহংমদেবের শিষ্য সন্নাসী বিবেকানন্দ সাঁতরে পার হয়েছিলেন ভারত মহাসাগর। সেই সময় কন্যাকুমারীতে সমুদ্রের বুকে ভেসে থাকা এক বিশাল পাথরের উপর বসে তিনি বিশ্রাম নিয়েছিলেন এবং ধ্যান করেছিলেন। আধ্যাত্মিক এই গুরুঠাকুর বিবেকানন্দের স্মৃতিতে ১৯৭০ সালে সমুদ্রে উপর তৈরি করা হল ‘বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল’। এই মেমোরিয়ালের উপর থেকে সমুদ্রের ঢেউ-এর উথাল পাথাল দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। দিগম্ত বিস্তৃত সমুদ্রের উথাল হাওয়া আপনাকে নিয়ে যাবে অন্য জগতে। বিবেকানন্দ রক মেমোরিয়াল থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্য-জাস্ট অসাধারণ। এই মেমোরিয়ালের ভিতরে একটি মেডিটেশন হল রয়েছে যেখানে আপনি বসে নিশ্চিন্তে ধ্যান করতে পারেন। এর মাধ্যমে আপনার যাবতীয় চিন্তা-ভবনা দূর হয়ে যেতে পারে।
কন্যাকুমারী সমুদ্রতট-তিনটি সমদ্রের সংযোগস্থলে অবস্থিত এই সমুদ্রতট কন্যাকুমারীর প্রধার আকর্ষণ। এখানে সমুদ্র কিছুটা উত্তাল প্রকৃতির। সমুদ্রতটটি চারিজিক থেকে পাথর দিয়ে ঘেরা। তাই ইচ্ছে হলেও সহজে সমুদ্রের জলে পা ভিজাতে পারবেন না। কিন্তু তার বদলে বিচের ধারে অবস্থিত লাইট হাউস- এর উপর থেকে সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করতে দারুণ লাগবে।
গান্ধী মেমোরিয়াল – মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতিতে ১৯৫৬ সালে তৈরি করা হয়েছে এই মেমোরায়ালটি। এই মেমোরিয়ালটি ‘অমন টেম্পেল’ নামেও পরিচিত। উড়িশার মন্দিরের ধাঁচে তৈরি এই ‘গান্ধী মেমোরিয়াল’ পর্যটন কেন্দ্র কন্যাকেমারীর আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্র। গান্ধীজির মৃত্যুর পর তাঁর অস্থিভস্ম এখানকার সমুদ্রতটের ধারে এই গান্ধী মেমোরিয়ালটি তৈরি করা হয়। এই ‘অমন টেম্পেল’ এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে প্রত্যেকদিন ঠিক দুপুর ১২টায় যখন সূর্য মাথার উপর আসে, তখন গান্ধীজির সমাধিস্থলের উপর সূর্যের রশ্মি এমনভাবে পড়ে যে তাঁর অস্থিভস্ম বিসর্জনের স্থানটি প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে। এই মেমোরিয়াল ঘুরে দেখলে গান্ধীজির শেষ বয়সের নানান কথা সম্পর্কে জানা যায়। তাঁর নানান ছবি, তাঁর শেষ বয়সের ব্যবহারের নানান সামগ্রী অতি যত্ন সহকারে সংরক্ষিত রয়েছে এই মেমোরিয়ালে।
থিরুভাল্লুভার স্ট্যাচু – বিখ্যাত তামাল কবি এবং সন্ন্যাসী থিরুভাল্লুভারকে সম্মান প্রদর্শন করে তৈরি বিশাল উচ্চতার এক মূর্তি হল এই ‘থিরুভাল্লুভার স্ট্যাচু’। সমুদ্রের মাঝে বিবেকানন্দ রকের ঠিক পাশে অবস্থিত এই বিশালাকার মূর্তির উচ্চতা ১৩৩ ফুট বা ৪০.৬ মিটার। আরব সাগর এবং বঙ্গোপসাগর যে জায়গায় ভারত মহাসাগরের সাথে মিলিত হয়েছে, ঠিক সেখানেই তৈরি করা হয়েছে তামিল কবির এই মূর্তি। ১৯৯০ থেকে ২০০০ সালে-টানা দশ বছর ধরে তৈরি করা হয় এই মূর্তি। এই মূর্তির আসল উচ্চতা ৯৫ ফুট এবং মূর্তিটি যে স্তম্ভমূলের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেটির উচ্চতা ৩৮ ফুট। তামিলনাড়ুর বাসিন্দা কবি থিরুভাল্লুভার-র লেখা বই ‘থিরুক্কুরাল’- এর নানান ধর্মপোদেশ খোদাই করা আছে এই মূর্তির পাদদেশের স্তম্ভমূলে। মূর্তিটির ভস্কর্য এতটাই চিত্তাকর্ষক যে প্রত্যেক পর্যটক অবাক না হয়ে থাকতে পারবেন না। এর স্তম্ভমূলটিতে সম্পদ এবং নানান আনন্দমূলক বিষয় সম্পর্কে খোদাই করা রয়েছে। থিরুক্কুরালের ১৩৩টি অধ্যায়ের নানান কথা উল্লেখ রয়েছে এই থিরুভল্লুভার স্ট্যাচু-র গায়ে।
কন্যাকুমারী মন্দির – তামিলনাড়ুর বাসিন্দাদের মধ্যে ঈশ্বর ভক্তি এতটাই বেশি যে সমগ্র রাজ্য মন্দিরে মন্দিরে জয়লাপ। কন্যাকুনারীই বা তার ব্যতিক্রম হয় কি করে? চোখ ধাঁধানো স্থাপত্যের জন্য এখানকার মন্দিরগুলির সৌন্দর্য এককথায় অনবদ্য। এখানকার কিছু কিছু মন্দির ১০০ বছরেরও বেশী পুরোনো। দাক্ষিণাত্যের পাজাদের আমলে তৈরি এই সকল মন্দিরগুলির শিল্পকলা আপনাকে মুগ্ধ করবেই। এই মন্দিরগুলির মদ্যে পর্যটনের জন্য বিখ্যাত হল ‘দেবী কন্যাকুমারী মন্দির’ এবং ‘সুচিন্দ্রম মন্দির’ । সতীর ৫১ পীঠের মধ্যে একটি হল এই কন্যাকুমারী মন্দির। এই মন্দিরের আরাধ্যা দেবী হলেন দেবী পার্বতী। এটি সমুদ্রের একেবারে পাড় বরাবর অবস্থিত বলে পর্যটকরা সারা বছরই এখানে ভিড় জমান। কন্যাকুমারীর অপর বিখ্যাত মন্দির সুচিন্দ্রমে তিন দেবতা ব্র ,বিষ্ণু এবং মহেশ্বরের আরাধনা করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, এই সুচিন্দ্রম মন্দিরে কেউ মানত করলে তার সেই আশা পূরণ হয়। এই মন্দিরটি কন্যাকুমারী থেকে মাত্র ১১ কিমি দুরে অবস্থিত।
থিরপারাপ্পু ঝরনা- রোডায়ার নদীর ঝরনা ৫০ ফুট উপর থেকে নীচে পড়ছে এবং ঝরনার নীচে দাড়িয়ে আপনি ছবি তুলছেন। ভারলেই কেমন যেন মনটা রোমাঞ্চে ভরে ওঠে। তাই হাতে সময় নিয়ে ঘুরতে গেলে থিরপারাপ্পু ঝরনা দেখতে ভুলবেন না ‌‌‌যেন। ৩০০ ফুট দৈর্ঘের এই জলপ্রপাত কন্যাকুমারী শহর থেকে মাত্র ৬০ কিমি দুরে । এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ফটোগ্রাফারদের জন্য আদর্শ একটি স্থান। তাই থিরপারাপ্পু ঝরনা দেখতে গেলে সঙ্গে অবওশ্যই নিয়ে যাবেন ক্যামেরা ।
উদয়গিরি ফোর্ট – যারা অ্যাডভেঞ্চার ভালোবাসেন, তাদের জন্য উদয়গিরি ফোর্ট আদর্শ স্থান। কন্যাকুমারী শহর থেকে মাত্র ১৪ কিমি দূরে অবস্থিত এই ফোর্টটি প্রায় ৪০০ বছরের পুরোনো। ২৬০ ফুট উচ্চতার এই ফোর্ট বা দুর্গটি ধ্বংস করেছিলেন রাজা চোল। এরপর খ্রীষ্টপূর্ব ১৭২৯ থেকে১৭৫৮ সাল-এই সময়কালের মধ্যে দুর্গটিকে পুনরায় তৈরি করা হয়েছিল। ইউরোপিয়ান বন্দী ডি লেনয় এই দুর্গে বহু বছর জীবন কাটিয়েছিলেন বলে এই দুর্গের অপর নাম ‘দিল্লানাই কোট্টাই’ ।
পেচিপারাই ড্যাম – তামিলনাড়ুর পেচিপারাই গ্রামে অবস্থিত এই ড্যাম বা বাঁধটি দেখতে হলে কন্যাকুমারী থেকে মাত্র ৫৬ কিমি পথ অতিক্রম করতে হবে। কোডায়ান নদীর উপর তৈরি করা এই বাঁধটি ১৯০৬ সালে তৈরি করা হয়েছিল। এই ড্যাম এলাকায় বোটিং- এর সুবিধা থাকার এটি বনভোজন এবং পড়ুয়াদের এক্সকারশন-এর জন্য আদর্শ জায়গা। এই ড্যামের পাশে সংকটমোচন হনুমানজির একটি মন্দিরও রয়েছে ।
নাগরাজ মন্দির – সারি সারি নারকেল গাছ এবং তার মাঝে অবস্থিত একটি মন্দির। চারপাশে শুধু সবুজ আর সবুজ, তার বাইরে দিয়ে সমুদ্রের ঘেরাটোপ। সবমিলিয়ে অসাধারণ সুন্দর এই নাগরাজ মন্দির। মন্দির হলেও এটির শিল্পকলা অনেকাংশে বৌদ্ধদের মনেস্ট্রির মত। এই মন্দিরের ছাদটিও অন্যান্য মন্দিরের থেকে অনেকটাই আলাদা আকৃতির। নারকেল পাতা এবং বাঁশ কাঠি দিয়ে এই মন্দিরের ছাদ, মাটি দিয়ে তৈরি দেওয়াল আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই। এই নাগরাজ মন্দিরে চারটি ধর্ম – জৈন, বৌদ্ধ, শৈব এবং বৈষ্ণব ধর্মের মিলিত প্রতীক রূপে তৈরি করা হয়েছে।
Facebook Comments