banner

বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 1967 বার পঠিত

 

সৈয়দা রাজিয়া বিল্লাহ : ‘নারীকে জীবন্ত বৃক্ষ হতে হবে’

ফাতেমা শাহরিন


সৈয়দা রাজিয়া বিল্লাহ একজন ব্যবসায়ী। তার প্রতিষ্ঠানের নাম ‘শুধুই কুরুশ’। তিনি বগুড়ায় একটি সরকারি প্রাইমারি স্কুলের ‘প্রধান শিক্ষিকা’। পেশাগত ব্যস্ততার পাশাপাশি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করছেন। অপরাজিতার পক্ষ থেকে কথা হয়েছিল তার সঙ্গে। সেই সব কথোপকথন নিয়ে আজকের সাক্ষাৎকার তুলে ধরা হলো:

অপরাজিতা: ‘সেলাই কাজ’ কার কাছে হাতে খড়ি হয়েছিল?
রাজিয়া বিল্লাহ: আমার মায়ের কাছে শিখেছি। কুরুশের সেলাই কাজ শেখার পিছনে আমার মায়ের ভুমিকাই বলব পুরোটুকু। আমি আগ্রহ প্রকাশ করেছি, উনি স্কুল সামলে যেহেতু মা ছিলেন হাই স্কুলের ইংরেজি শিক্ষিকা। সংসার সামলে, আমাকে হাতে ধরে শিখিয়েছেন।

অপরাজিতা: এই স্বপ্নের শুরুটা কিভাবে?
রাজিয়া বিল্লাহ: আমি সেলাই শিখি ১৯৯৭ সালে। তখন মুলত ব্লক, বাটিক, হাজারবুটি, সুচের কাজ, দর্জির কাজ সবই করেছি। সে সময় বিভিন্ন হাতের কাজ করে টুকটাক উপার্জনও করতাম । কখনো বাবা মার কাছে হাত খরচ বা অন্যান্য খরচের জন্য টাকা চাওয়ার দরকার হয়নি আলহামদুলিল্লাহ। সে সময় অন্যদের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে কাজ করতাম। এর মধ্যে নানা কারণে নানান সময় বাধ্য হয়েই সেলাই ছাড়তে হয়েছিল। কিন্তু সেলাই আমাকে এমনভাবে গ্রাস করেছে কোনভাবেই সেলাই ছেড়ে থাকতে পারতাম না। এককভাবে আবার কুরুশে ফিরে এসেছি ২০০৭ সালে। সরকারী প্রাইমাারী স্কুলে শিক্ষক হিসেবে ঢুকি ২০১০ সালে, কিন্তু জাতীয়করণের  ফলে ২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ সাল অর্থাৎ আজ পর্যন্ত   বেতন পাই না। এ দিকে আমার বেতনের টাকা পুরোটাই  তখন মেয়ের দুধের খরচের পিছনে যেত। আমার স্বামী যদিও চাকুরীজীবী কিন্তু তার নির্ধারিত আয়ের মাঝে মেয়ের দুধের খরচ প্রায় বন্ধ হয়ে গেল, দিশেহারা না হয়ে সেই খরচ চালানোর জন্যই, ‘শুধুই কুরুশ’ এর যাত্রা শুরু করি। স্কুল করে এসে বাসায় সংসার সামলেছি, বাচ্চা সামলেছি অতঃপর সেলাই করেছি। অর্থাৎ আজও ‘শুধুই কুরুশ’ ব্যবসাটি আমাকে হাটতে সহযোগিতা করছে।

অপরাজিতা: শুরুর গল্পটির শুনলাম, এবার ‘শুধুই কুরুশ’ এর পরবর্তী যাত্রা সম্পর্কে জানতে চাই? কতজন কাজ করতেন, বর্তমানে কতজন করছেন? কিরূপ সংগ্রাম করতে হয়েছিল?
রাজিয়া বিল্লাহ: আমাকে ভীষণ পরিশ্রম করেই আগাতে হয়েছিল। ‘শুধুই কুরুশ’ থেমে যায়নি বরং তারপর কিছুদিন একা কাজ করি। এখন একটা মেয়ে আছে আমার সাথে। এক সময় অনলাইনে পেজ খোলার চিন্তা করি, অনলাইন পেজ ‘শুধুই কুরুশ’ এর যাত্রা শুরু ২০১৫ সালের ২৪ জুন। সেই সময় ছিল ১০ জন মেয়ে, মোটামুটি সবাই অবিবাহিত ছিল কিন্তু পরবর্তীতে তাদের বিয়ে হয়ে যায় এবং একে একে চলে যায়। তবুও কাজ থেমে থাকেনি। বরং আমার পেজ ‘শুধুই কুরুশ’ বর্তমানে ত্রিশ হাজারের উপর সদস্য। এর পর আলহামদুলিল্লাহ অনেক অর্ডার পাই। অনেক মেয়েদের সন্ধান পেয়েছি, যারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকে এবং হাতের কাজ করতে যানে। এর ফলে অনেক মেয়েদের কর্মস্থানেরও ব্যবস্থা হয়। তখন মেয়ে আমার কয়েক মাস বয়সী মাত্র। তাকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনের কাছে রেখে গিয়েছি মেয়েদের কাজ বুঝিয়ে, নতুন কাজ দিয়ে সামনে আনার জন্য চেষ্টা করেছি। যানবাহনের সমস্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। যেহেতু ভারী সুতা ভর্তি ব্যাগ একা টেনে নিয়ে যাওয়া আবার কাজ ভর্তি ব্যাগ একা নিয়ে আসা। এমনও হয়েছে বসার জায়গা তো দুরে থাক, বাসে দাঁড়াতেও পারি নাই ঠিক মতো। সময় ম্যানেজ করার জন্য অনেক সময় স্কুলে থেকেই চলে গেছি দুপুরে না খেয়ে। রাতে বাসায় ফিরে একে বারে খেয়েছি। কখনো বাচ্চাকে রাখার মতো কাউকে না পেয়ে ঘুমন্ত বাচ্চাকে কোলে করে গলার সাথে ব্যাগ ঝুলিয়েও হাঁটতে হয়েছে অনেকটা পথ।

অপরাজিতা: নিজ উদ্যোগেই স্বল্প পরিসরে ‘নারী গ্রুপ’ আবার ব্যবসা জানতে চাই?
রাজিয়া বিল্লাহ: মুলত নারী গ্রুপ করার উদ্দেশ্য, সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন বোন যারা অনেক সময় নানান রকম সমস্যা পড়েন, ভোগেন যেগুলো নিজের পরিবার বা কারো সাথে শেয়ার করা সম্ভব হয় না। ফলে গ্রুপে সবাই নির্দ্বিধায় শেয়ার করেন। বিভিন্নজন তাদের মতামত শেয়ার করে। এতে অনেকে তাদের সমস্যার সমাধান ও খুঁজে পায়। কিছু বোন আছে যারা ঘরে বসে অনলাইনে বিভিন্ন কিছু বিক্রি করে তাদের জন্য সপ্তাহে তিনদিন সেল পোস্ট দেয়ার ব্যবস্থা করেছি। আমি জানি পরিবারের খারাপ সময়ে হাল ধরতে পারা কতটা আত্নতৃপ্তির। আমার গ্রুপের বোনদের মধ্যে আমি বাঙ্গালি জাতিসত্ত্বাকে কে জাগ্রত রাখার জন্য, কোন ধরনের বাংলিশ লেখা বা ইংরেজি অক্ষরে বাংলা লেখা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ আমার এই জোরের জন্য অনেক বোনেরাই শুদ্ধভাবে বাংলা লিখতে পারে।

অপরাজিতা: আবার ‘শুধুই কুরুশ’ ফিরে আসি, একজন নারী হিসেবে এ পথ চলা, কেমন ছিল, সহজ কিংবা কঠিন?
রাজিয়া বিল্লাহ: খুব সহজ ছিল না,  অবশ্যই বলব। এই জন্য যে আমাকে একা একা বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেতে হয়েছে, সত্যি অনেক কষ্টকর ছিল দিনগুলো, সেই ছোট্ট বাচ্চাটিকে রেখে। কাস্টমারের বিভিন্ন ধরনের কথা তো আছেই। তবে আমার জন্য একটা প্লাস পয়েন্ট হল, যা আমাকে সাহস যুগিয়েছে, আমার পরিবারের ১০০% সাপোর্ট। যেটা অন্য অনেকের কাছে শুনেছি পায় না। আমি পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ।

অপরাজিতা: এ সেক্টরে অসহায় মেয়েদের কর্মস্থানের কতটুকু সুযোগ আছে?
রাজিয়া বিল্লাহ: প্রচুর সুযোগ আছে। অসহায় মেয়েরা চাইলে এই কাজ করে সংসার চালাইতে পারেন। আমি নিজে চালিয়েছি কয়েকমাস। আমার বেতন বন্ধ হবার কিছুদিন পর আমার স্বামী তার চাকুরী ছেড়ে দেয়। তখন কয়েকমাস আমিই সংসার চালিয়েছি, আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু লেগে থাকতে হবে এই কাজে, হাল ছাড়লে চলবে না।

অপরাজিতা: মূল ধারার ব্যবসার জন্য নারীরা সহযোগিতা কি আদৌ পাচ্ছে, যদি না পান, কেন পাচ্ছে না বলে আপনি মনে করেন?
রাজিয়া বিল্লাহ: আমার মতে, পাচ্ছে না। এমন বলার কারণ আসলে আমার এই কাজের জন্য আমি কয়েক জায়গায় সাহায্যের জন্য গিয়েছি কিন্তু বিফল হয়েছি। তাই আসলে এই ব্যাপারে কিছু বলতে পারছি না।

অপরাজিতা: মূলধন সংকটের ফলে কোন সমস্যা হতে পারে কি?
রাজিয়া বিল্লাহ: মূলধন সংকটের জন্য অবশ্যই সমস্যা হয়। তবে আমি যেহেতু আমার কাজের অর্ডার ভিত্তিতে করেছি এবং ৫০% অগ্রিম ক্রেতার কাছ থেকেই নিয়েছি। তাই মূলধনের সমস্যা বুঝতে হয়নি। আলহামদুলিল্লাহ।

অপরাজিতা: সফল নারী আসলে কি আপনার মতে?
রাজিয়া বিল্লাহ: সফল নারী আমার একান্ত মতে, সেই যে তার নিজ ধর্মের বিধি-নিষেধ সঠিকভাবে মেনে পরিবারকে খুশী রেখে সমাজের অসহায় গরীব নারীদের, যারা বিভিন্ন ভাবে পিছিয়ে আছে, তাদের জন্য কিছু করতে চায়।

অপরাজিতা: নারী দিবসে নারীদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন?
রাজিয়া বিল্লাহ: নারীদের উদ্দেশ্যে আমি বলব, ‘নারীকে জীবন্ত বৃক্ষ হতে হবে’ এই অর্থে নয় যে, সবাই এসে তার ছায়া নিয়ে ডাল ভেঙে নিয়ে যাবে বরং এই অর্থে যে, বড় বৃৃৃক্ষ সহজে কাটা যায় না, নোয়ানো যায় না। নরম গাছ যেমন এক টানেই উপরে ফেলা যায়। তেমন হওয়া যাবে না। মা হলে, এমন মা হতে হবে যার সন্তানের দিকে অন্য কেউ চোখ তুলে তাকাতে পারবে না। স্ত্রী হলে এমন স্ত্রী হতে হবে যাকে কখনও স্বামী নিজের বোঝা না ভেবে, জীবনের অপরিহার্য অংশ ভাবতে বাধ্য হবে। কন্যা হলে এমনই কন্যা হতে হবে, যাতে বাবা মা এর ভরসা যায়গায় হতে পারে।

অপরাজিতা: নতুন উদ্দ্যোক্তাদের কিভাবে উৎসাহ দিবেন?
রাজিয়া বিল্লাহ: আমাকে যখনই কেউ ইনবক্স করে বলেন, আপু জব খুঁজছি। তখন আমি বলি, চাকুরী করতেই হবে এমন কি মানে আছে বলুন? বরং ব্যবসা করার প্লান করুন। নিজের মধ্যে যে ক্রিয়েটিভিটি আছে, সেইটা দিয়েই শুরু করতে উৎসাহ দেই। এটাও বলি যে ব্যবসা করতে চায় না বলেই আজ বাঙ্গালি জাতি, অনেক পিছিয়ে আছে।

অপরাজিতা: শুধুই কুরুশ নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
রাজিয়া বিল্লাহ: আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা অনেক বড় বলতে পারেন। যেটা আমি জেগে এবং ঘুমিয়ে দুই-ভাবেই দেখি। তা হল কিছু গরীব অসহায় মেয়েকে নিয়ে আমি আগের মত কাজ করছি। বড় করে শোরুম দেয়ার ইচ্ছে আছে। ইনশাআল্লাহ। এর আগে যে মেয়েরা কাজ করত ওরা ছিল এইস এস সি পরীক্ষার্থী। আমার কাছে পাওয়া সেলাইয়ের টাকা দিয়েই ওরা ফরম ফিলাপ করেছে ও প্রাইভেট পড়েছে। নিজের পড়াশুনার খরচ নিজেই চালিয়েছে। কিছু অভাবী মেয়েকে নিয়ে কাজ করব। তাদের ভবিষ্যত আর বর্তমানের জন্য। একটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দেয়ারও ইচ্ছে আছে ভীষণ। বাকীটা আল্লাহর ইচ্ছা।

‘শুধুই কুরুশ’ এর এই গুনি উদ্যোক্তা সৈয়দা রাজিয়া বিল্লাহ (ইরা), আপনাকে অপরাজিতার পক্ষ থেকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

Facebook Comments