banner

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 1096 বার পঠিত

 

মাতৃকথন_৪

ফারিনা মাহমুদ


বাবু তোমার কি নাম ?
– আমার পাতা আর পুত্তি (পশ্চাতদেশ, নরমাল ও সেলিম ওসমান ভার্সন )
এ মা, এইটা রেখে দাও … ভেঙ্গে যাবে তো …
– তুই কুতা বাতা (ট্রান্সলেশন নিষ্প্রয়োজন)
সবশেষে গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বের করে – ওই তালা তর (শালা সর ) ..
অথবা বাড়িতে বেড়াতে আসা অতিথির সামনে – গেসি, খাইসি, খেলতাসি, ভাষায় কথা বলে ওঠা ছোট্ট পুতুলের মতো বাচ্চাটা আমার উচ্চশিক্ষিত নিকটাত্মীয় দম্পতির ।

বাবা মা চাকুরিজীবি হওয়ার কারণে বাচ্চা দিনের বড় সময় থাকে দাদী, ফুফু, কাজের বুয়া, ড্রাইভার, দারোয়ান সবার মাঝখানে । বাচ্চার ভাষা শিক্ষায় কোনো এক অজানা কারণে গৃহকর্মী শ্রেনীর অবদান অত্যাধিক । সেই অবদান বাবা মাকে পাবলিক প্লেসে কি পরিমান বিব্রত করে তা আমি প্রথম বুঝতে পারি যখন আমার সেই আত্মীয়া তাঁর বাচ্চাকে নিয়ে বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেন । আমি ততোধিক বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করি, বাচ্চা প্রতিবার একটা করে গালি দেয় আর বাচ্চার বাবা তার মায়ের দিকে এমনভাবে তাকায় যেন মা রোজ সকালে কবিতার মতো করে গালি মুখস্ত করায় বাচ্চাকে !

শুধু ভাষাই না, বাচ্চা আরো অনেক কিছুই পারিপার্শিকতা থেকে আত্মস্থ করে যা আমাদের পছন্দ না । মা চাকরি করলেও করে, না করলেও করে । কিন্তু দুর্ভাগ্য এমনই আমাদের, অধিকাংশ ক্ষেত্রে দোষের বোঝাটা মায়ের দিকেই যায়, যাচ্ছে , যাবে ই !

উচ্চশিক্ষিতা, ক্যারিয়ারিস্ট মেয়েটা মাতৃত্বকালীন ছুটিতেই দ্বিধা দ্বন্দে পড়ে যায় – চাকরি করবো না ছেড়ে দিবো ? বাচ্চার যত্ন ঠিক মতো হবে তো ? কার কাছে রেখে যাবো ? নানী দাদীর কাছে কি সারা বছর বাচ্চা রাখা যায় ? বাচ্চাটার যত্ন হবে তো? বাচ্চাটা কি শিখবে ? তার উপরে আছে বুক ভাঙ্গা কষ্ট, অন্যের কাছে বাচ্চা রেখে কাজে মন দেয়া !
এইসব নানান ট্রমা পার হয়ে যদিও বা কাজে ফিরলেন, ঘরে ফিরে যখন শুনবেন বাচ্চার মুখে অশুদ্ধ কথা বার্তা, অপরাধবোধ গিলে খাবে আপনাকে ! আর সেই আগুনে ঘি ঢালতে, সেই দায়ের হিমবাহের নিচে আপনাকে পিষ্ট করতে আশেপাশের মানুষজন তো আছেই ! ক্ষেত্রবিশেষে দেখা যাবে মূল সমস্যা আপনার বাচ্চা না, আপনার শ্বাশুড়ির বাচ্চাটা, কবুল বলে একদা যাকে জীবনসঙ্গী করেছিলেন ! আপনার তখন মনে হবে – এই লোক কে? একে তো আমি চিনি না !!

এই মারাত্মক দ্বিধা-দ্বন্দের টানা পোড়নে পড়ে সংসারের সুখের জন্য অনেকেই চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে আসেন। কেউ কেউ হয়তো পরিস্থিতির কারণে বা সামগ্রিক বিবেচনায় কাজটা চালিয়ে যান, বা যেতে বাধ্য হন, কিন্তু ভিতরে ভিতরে একটা অপরাধবোধ ঠিক ই থাকে – ভুল করছি না তো?

এই চরম দুঃসময়ে আসলে কি করনীয় ?
আমার মন চায় ফিরিয়ে প্রশ্ন করতে – কার কি করনীয় ? করনীয় কি খালি মায়ের ? মা যদি বাইরে কাজ করেন, তিনি কি শুধু নিজের জন্য করেন ? সংসারের জন্য, সন্তানের জন্য কি করেন না ? খুব নগ্ন ভাবেই বলি, মায়ের আয়ের সুফল তো মা একা ভোগ করেন না, তাহলে সব দোষের দায় মায়ের একার ক্যানো ? করনীয় এর তালিকা যদি থাকে তা শুধু মায়ের না, সুবিধাভোগী সবার জন্যই তালিকা থাকতে হবে । মায়ের উপার্জিত অর্থের ভোগী উপভোগী সবই পাবেন, তবে ভুক্তভুগী শুধুই মা !!

এই কঠিন দুসময়ে মনে রাখবেন,
যেই সিদ্ধান্তেই যান না কেনো –
১. কিছু পাবেন, কিছু হারাবেন
২. সবাইকে খুশি করতে পারবেন না, কাজেই নিজের খুশিকেই ফোকাস করুন
এবং আপনার সিদ্ধান্ত আপনি নেবেন,

১. আপনার পরিস্থিতি অনুযায়ী, কারো কথায় না, কাউকে অনুসরণ করে না । তবে অন্যের অভিজ্ঞতা জেনে নেয়ায় দোষ নেই।
২. রিস্ক বাই বেনিফিটের রেশিওতে পাল্লা কোনদিকে ভারী তা চিন্তা করে ।
নিজের সিদ্ধান্তে কনফিডেন্ট থাকবেন, সিদ্ধান্ত পাল্টানোর প্রয়োজন পড়লে সেটাও কনফিডেন্টলি পাল্টাবেন । হীনমন্যতার দিন শেষ !

উপরের সবকিছু চিন্তা করে যদি আপনার মনে হয় চাকরি করবো না, বাচ্চাটাকে সময় দেবো, সু-স্বাগতম । অবশ্যই এটা অনেক বড় সিদ্ধান্ত, সাহসী সিদ্ধান্ত। এই সাথে আত্মত্যাগ তো যুক্ত আছেই। “এই সময়টা উপভোগ করুন।” আবার একসময় কাজে ফিরবেন এমন ইচ্ছা থাকলে নিজেকে সেভাবে প্রস্তূত করুন। বাসায় থাকেন বলেই আবার সন্তানের ব্যাপারে ওভার প্রটেক্টিভ হতে যাবেন না।

কারণ দু দিন পরে কিন্তু বাচ্চাকে স্কুলে দিতেই হবে । মানসিক ভাবে তৈরী থেকে বাচ্চাকে একটু স্বনির্ভরশীল করুন, কাজ সহজ হবে।

কিন্তু উপরের সবকিছু বিবেচনায় যদি মনে করেন কাজ চালিয়ে যাবেন, তাহলে এটা জেনে রাখুন যে পৃথিবীতে মিলিয়ন চাকুরিজীবি মায়ের সুসন্তান আছে, কুসন্তানও আছে। একইভাবে পৃথিবীর মিলিয়ন স্টে হোম মামের ক্ষেত্রেও এই কথা খাটে। কাজেই দোষ মায়ের আর মায়ের একার চাকরির না।

নিজে পালেন আর নানী দাদী কাজের মানুষ যার কাছেই বাচ্চা রেখে যান না কেন বাচ্চা কিছু উল্টো পাল্টা কথা আচরণ শিখলেই মুষড়ে পড়ার কিছু নেই । বরং “কিভাবে ওকে এই আচরণ থেকে সরিয়ে আনা যায়, সেটার যুক্তিযুক্ত সমাধান খোঁজাই জরুরি”। বাচ্চার কাছে “ভাত খাবো ” যেমন শব্দ, “কু*র বা*” ঠিক তেমনি একটি শব্দ। সে এর মানে বোঝে না। শুধু বোঝে কোন এক্সপ্রেশন দিতে কোন শব্দ কোন টোনে ব্যবহার করতে হয়। সে এটা জীবনে কোনো একদিন শিখবেই। অল্প বয়সে শিখে ফেলেছে দেখে লজ্জায় গ্লানিতে কুঁকড়ে গিয়ে তাকে বকাঝকা করার চেয়ে তাকে তার উপযোগী করে বুঝিয়ে ওখান থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করুন। শব্দটি যেন বারবার তার সামনে ব্যবহার না হয়, সম্ভব হলে তা নিশ্চিত করুন। কিছুই সম্ভব না হলে – ভালো মন্দ যাহাই আসুক, সত্যেরে লও সহজে !! ভালো খারাপ সব পরিবেশে মিশে মিশে যে ভালো মানুষ হয়, সে ই প্রকৃত ভালো মানুষ । মনে রাখতে হবে দিনশেষে মায়ের সাথে কোয়ালিটি টাইম অনেক বেশি জরুরি কোয়ান্টিটি অফ টাইমের চেয়ে । বাচ্চার সাথে একান্তে কিছু সময় কাটান, তাকে গল্পের বই পড়ে শোনানো, গল্প বলা, গান কবিতা বা খেলার মধ্য দিয়ে তার সাথে আত্তিক যোগাযোগ ঠিক রাখুন । ওকে একটু একটু করে বুঝতে সেখান যে আপনি আর বাবা যে কাজে যাচ্ছেন এতে করে সংসারে কি যোগ হচ্ছে । কাজে যাবার আগে বয়স অনুযায়ী বাচ্চার জন্য সেট অফ একটিভিটি রেখে যান, ছবি আঁকা বা খেলার জিনিস সহ সে যেন ব্যস্ত থাকে সেই আয়োজন করে রাখুন । দিনশেষে তার কাছে জানতে চান, সে সারাদিন কি করেছে । রিওয়ার্ড দিন। তার পরেও কথাও খটকা লাগলে, কোনকিছু ভালো দিকে যাচ্ছে না এমন মনে হলে শিশু বিশেষজ্ঞর সাথে কথা বলতে পারেন ।
সবচেয়ে আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি কিন্তু বাবাদের জন্য বরাদ্ধ থাকলো । অযথা মা-কে সবকিছুতে দোষ দেয়া বন্ধ করেন । বিশেষ করে বাচ্চার সামনে । স্টে হোম অথবা ওয়ার্কিং মাম কারো জীবনই খুব সহজ না । সংসারের প্রতি একজন বাবা হিসাবে দায় দায়িত্ব বাড়ানো অনেক জরুরি । জরুরি সংসারে আপনার ইনভলভমেন্ট । এতে করে বাচ্চা দায়িত্ববোধ শেখে । আর উল্টোটা যদি করেন তো বাচ্চা বেয়াদপি আর অসম্মান ছাড়া কিছুই শিখবে না, তাও শিক্ষক হবেন আপনি নিজেই । এরপর সেই অসম্মান যে সে আপনাকেই ফিরিয়ে দেবে না তার কিন্তু কোনো গ্যারান্টি নেই !
সংযুক্তি : আমি একজন চাকুরিজীবী মা । আমি যেখানে আমার বাচ্চা রেখে কাজে যাই, সেই জায়গা নিরাপদ, সেখানে প্রশিক্ষিত কেয়ারাররা আমার বাচ্চার দেখাশোনা করেন । এই সবকিছু জানার এবং চোখে দেখার পরেও ঠিক এক বছর আগে (১/৬/২০১৫) মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে যেদিন কাজে ফিরেছিলাম, বেশ বড় একটা তোয়ালে-তে মুখ ঢেকে কান্না করতে করতে ট্রেনে এসেছিলাম । আজ এক বছর পার করে দিয়ে আমি একটা কথা আবারও জোর দিয়ে বলি সব মা কে, আপনার সিচুয়েশন আপনি ই বুঝবেন । আপনার সিদ্ধান্ত আপনি ই নেবেন । শুনবেন সবার টাই, কিন্তু করবেন তা-ই যা আপনার ঠিক মনে হয় ।আপনি স্টে হোম মাম হন আর ওয়ার্কিং মাম, আপনার কনফিডেন্সই আপনার বাচ্চাকে কনফিডেন্ট হতে সাহায্য করবে !
স্টে হোম মাম অর ওয়ার্কিং মাম
দে ডোন্ট হ্যাভ টাইম টু রেস্ট
এন্ড বিফোর ইউ ডেয়ার টু ব্লেইম হার
রিমেম্বার, মাদার নো’স দি বেস্ট !!

Facebook Comments