banner

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

Monthly Archives: April 2024

 

চাইল্ড অ্যাবিউজ (চাইল্ড সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ)

আফরোজা হাসান


চাইল্ড অ্যাবিউজ:

পৃথিবীর সব বাবা-মা’রাই সন্তানের ভালো চান। সন্তান যাতে ভালো হয় তার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। কিন্তু শিশুদেরকে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার।

শিশুদের বৈচিত্র্যতার চেয়েও বেশি দেখেছি বাবা-মাদের বৈচিত্র্যময় আদর-সোহাগ-ভালোবাসা এবং শাসন-শোষণ। জেনে বা না জেনে কিংবা বুঝে বা না বুঝে বাবা-মারা বাচ্চাদের উপর নানা ধরণের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন।

শারীরিক আঘাত চোখে দেখা যায় তাই পরবর্তীতে বাবা-মা তাতে মলম লাগাতে পারেন বা চেষ্টা করেন।

কিন্তু মানসিক আঘাত………!!!

এই আঘাতের কারণেই হয়তো শিশুদের মানসিকতার সঠিক বিকাশ বাধাঁপ্রাপ্ত হয়। কারণ বিভিন্ন ইন্দ্রীয়ের সাহায্যে শিশুরা বিভিন্ন বস্তুগত গুণাবলী ও ঘটনা সম্পর্কে ধারণা বা উপলব্ধি করতে শেখে।

আর এর উপর নির্ভর করেই শিশুদের মধ্যে জন্ম নেয় স্মৃতিশক্তি, কল্পনাশক্তি, সৃজনশীলতা, বিচারবুদ্ধি ইত্যাদি।

আমার পরিচিত একটি বাচ্চা আছে।

১.বাচ্চাটা কোন কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারেনা,
২.স্থির হয়ে বেশিক্ষণ এক জায়গায় বসতে পারে না,
৩.কোন কিছু করতে বললেও ঠিকমতো করতে পারেনা,
৪.একটুতেই রাগ করে-কান্না করে, ৫.বেখেয়ালি তাই খুব ভুল করে বা ভুলে যায়।

বাচ্চাটির বাবা-মাকে যদি পরামর্শ দেয়া হয় যে, ছেলেকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান তারা দুজনই ভীষণ বিরক্ত হন বা রাগ করেন। মোটকথা তারা মানতেই রাজী না যে তাদের বাচ্চাটি এডিডি বা এটেনশন ডেফিসিট ডিজঅর্ডারের শিকার। কেউ বোঝাতে গেলে উল্টো তাদের সাথে মনোমালিন্য হয়। অথচ সন্তানের প্রতি তাদের ভালোবাসার কোন কমতি নেই। বাচ্চা যা চাইছে বলার সাথে সাথে তা সামনে এনে হাজির করেন। কিন্তু মানুষ বলবে যে তাদের বাচ্চাটা স্বাভাবিক না, সে ভয়তে বাচ্চাকে ডাক্তারের কাছে নিতে চায় না বা নিজেরাও মানতে চায়না।

প্রতিবেশী একজনকে দেখেছি বাচ্চা কিছু করতে না চাইলে, নানাভাবে ভয় দেখিয়ে সে কাজটি করতে বাধ্য করে। কেউ আছেন সারাক্ষণ টিভি চ্যানেল আর ফোনালাপ নিয়ে এতো ব্যস্ত থাকেন যে, তখন বাচ্চা কথা বলতে চাইলে ধমক দিয়ে আরেক দিকে পাঠিয়ে দেন।

একজন মাকে দেখেছি বাংলাদেশ থেকে জালিবেত নিয়ে এসেছেন তার পাঁচ বছর বয়সি মেয়েকে শায়েস্তা করার জন্য। এক মা বুকফাটা কান্নার সাথে জানিয়েছিলেন, সাত বছর বয়সি ছেলেটাকে তাঁর স্বামী সামান্য কারণেই মাথায় তুলে সোফা বা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলেন, কখনো লাথি দেন আর বাকিটা নাহয় নাই বললাম।

যে কোন ধরণের আচার-ব্যবহার-কাজ যা শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ বা ভালো থাকায় বাঁধা দেয়, তাকেই এককথায় চাইল্ড অ্যাবিউজ বলে।

চাইল্ড অ্যাবিউজকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে-

♠ফিজিক্যাল অ্যাবিউজ বা যে কোন ধরণের নিয়ন্ত্রণহীন শারীরিক আঘাত।

♠সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ বা শিশু এবং প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে যে কোন রকমের যৌন সংসর্গ।

♠বিহেবিয়ার অ্যাবিউজ বা শিশুর প্রতি অবহেলা-অমনোযোগিতা।

♠ইমোশনাল অ্যাবিউজ বা নানাভাবে শিশুকে বাধ্য করা।

এই প্রত্যেকটি কারণের দ্বারাই শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ বাঁধাপ্রাপ্ত হয়। আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে এই প্রত্যেকটি কারণ নিয়েই আলোচনা করবো।

চাইল্ড সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ

চাইল্ড অ্যাবিউজ নিয়ে কথা বলছিলাম প্রতিবেশী কয়েকজন ভাবীর সাথে। সবাই চলে যাবার কিছুক্ষণ পর এক ভাবী ফিরে এলেন আবার। চেহারা দেখেই বুঝতে পারলাম কিছু বলতে চান। বেশ সময় নিলেন উনি নিজেকে গুছাতে তারপর বললেন, ভাবী আমি যখন ছোট ছিলাম আমাদের বাসায় আমার দূর সম্পর্কের এক মামা থাকতেন। উনি আমাকে খুব আদর করতেন, জড়িয়ে ধরতেন……….!! এসব কি তাহলে অ্যাবিউজ ছিল? কিন্তু আমি তো তখন অনেক ছোট ছিলাম। মাত্র আট বছর বয়স ছিল আমার। বেশির ভাগ সময় আড়ালে করলেও, মাঝে মাঝে তো আব্বু-আম্মুর সামনেও আমাকে আদর করেছে মামা। উনারা তো কখনো কিছু বলেননি। বলেন না ভাবী আমি কি অ্যাবিউজের স্বীকার তাহলে? সংসার জীবনে খুব সুখী এই মেয়েটিকে সে যে অ্যাবিউজের স্বীকার ছিল, বুঝিয়ে বলতে আমার অনেক কষ্ট হয়েছিলো। কিন্তু এখনো মেয়েটা সেসব ভেবে নীরবে কান্না করে।

ক্লাস টেনে পড়তাম তখনকার ঘটনা। আমার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবীটা ছিল ক্লাসের মধ্যে সবচেয়ে আমুদে স্বভাবের। হঠাৎ করে একদিন ওকে ভীষণ চুপচাপ দেখে কি হয়েছে জানতে চাইলাম। অনেক করে জিজ্ঞেস করার পর বললো, দুই সপ্তাহ ধরে আমার আব্বুর এক বন্ধু আমাকে টিউশন দিচ্ছে। প্রথম থেকেই উনি যেন একটু কেমন। প্রথমে ড্রইংরুমে বসে পড়তাম কিন্তু উনি শুধু বেডরুমে বসে পড়লে পড়ায় মনোযোগ বেশি এমন নানা কথা আম্মুকে বললে, পড়ার সুবিধার কথা চিন্তা করে বেডরুমে পড়ার পারমিশন দিয়ে দিলেন আম্মু। তারপর থেকে উনি পড়ার ফাঁকে ফাঁকে নানা ধরণের নোংরা জোকস বলা শুরু করলেন। আর গতকাল আমাকে বললেন যে, তুমি এতো ঢেকেঢুকে বসো কেন? আরো একটু খোলামেলা হয়ে বসবে, এতে দেখতে সুবিধা হয়……..!! আমি এখনই কিছু না করলে লোকটা আরো সাহস পাবে। কিন্তু লজ্জার কারণে আব্বু-আম্মুকে বলতে পারছি না এসব কথা। পরে আমরা কয়েক বান্ধবী মিলে ওর আম্মুকে বলেছিলাম।

এমন অসংখ্য ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে আমাদের চারপাশে। বাবা-মার চোখের সামনে তাদের আদরের সন্তানটি অ্যাবিউজের স্বীকার হচ্ছে কিন্তু তারা বাঁধা দেয়া তো দূরে থাক টেরই পাচ্ছে না। বুক দিয়ে যাদের কাছ থেকে আগলে রাখার কথা সন্তানকে, অজ্ঞতার কারণে নিজেরাই ঠেলে দিচ্ছে তাদের কাছে। আর এই ধরণের ঘটনাগুলো বেশির ভাগই ঘটে ঘরের একান্ত কাছের আত্মীয়-স্বজনদের দ্বারা। যারা আদরের ছলে এমন সব বিকৃত কাজ করে, শিশুরা অস্বস্তিবোধ করলেও ঠিক বুঝে উঠতে পারে না যে এটা আদর নাকি অন্য কিছু। যার ফলে তারা কারো কাছে বিষয়টি জানায় না বা জানাতে যে হবে সেটাও বুঝতে পারে না।

ঘরের মানুষ ছাড়াও যারা শিশুদের কাছে আসার সুযোগ পায়, যেমন বাসার কাজের মানুষ, গৃহশিক্ষক, আশেপাশের বাড়ি বা ফ্ল্যাটের কেউ, স্কুলের কেউ তাদের সবার ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।

শিশু ছেলে হোক বা মেয়ে উভয়ই এই ধরণের অ্যাবিউজের স্বীকার হতে পারে।

আর এসব ঘটনা থেকে তাদের মধ্যে তৈরি হতে পারে নানা ধরণের ছোট-বড় মানসিক সমস্যা, হীনমন্যতা, ব্যক্তিত্বহীনতা, ঘৃণা-বিদ্বেষ প্রভৃতি।

কেউ কেউ মারাত্মক কিংবা অপূরণীয় শারীরিক ক্ষতির স্বীকার হয় এর ফলে।

শিশুরা যাতে এই ধরণের জঘন্য হয়রানির স্বীকার হতে না পারে, সেজন্য সবার প্রথমে বাবা-মাকে সচেতন হতে হবে।

কে কি মনে করবে ইত্যাদি চিন্তা করে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বা লজ্জায় না ভুগে ঘরে অবস্থানরত অন্যান্য সদস্যদের সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে যে শিশুদের কতটুকু আদর করা যাবে।

আর শিশুদেরকে বুঝিয়ে বলতে হবে কোন ধরণের আদর গুলো পচা, শরীরের কোন কোন অংশে কাউকে ছুঁতে দেয়া যাবে না।

এবং বাবা-মাকে অবশ্যই সন্তানদের সাথে এমন সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে যাতে তারা তাদের কোন কথা বাবা-মাকে বলতে দ্বিধা না করে। বাচ্চারা যদি কারো সাথে বাইরে যায় ফিরে আসার পর প্রশ্ন করে জেনে নিতে হবে বাইরে কি হয়েছে, কি দেখেছে, কি করেছে ইত্যাদি।

তার মানে এই নয় যে, আমরা প্রতিটা সম্পর্ককেই সন্দেহের চোখে দেখবো। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য যে, বিভিন্ন কেস স্টাডি থেকে পাওয়া যায় এই ধরণের বিকৃত মানসিকতার মানুষগুলো চাচা-মামা-খালু-দুলাভাই-কাজিন-এমনকি দাদা-নানা….. পর্যন্ত হতে পারে।

সন্তানদের নিরাপত্তার জন্য যদি নিজেকেও সতর্কতার চোখে দেখতে হয়, আমার মনেহয় সেটাই করা উচিত। কে কি মনে করলো সেই চিন্তায় যেন আমরা আমাদের সন্তানদেরকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে না দেই।

সাইকোলজি(পিএইচডি)

 

চাইল্ড অ্যাবিউজ (চাইল্ড ফিজিক্যাল অ্যাবিউজ)

আফরোজা হাসান


চাইল্ড অ্যাবিউজ: পৃথিবীর সব বাবা-মা’রাই সন্তানের ভালো চান। সন্তান যাতে ভালো হয় তার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। কিন্তু শিশুদেরকে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার।

শিশুদের বৈচিত্র্যতার চেয়েও বেশি দেখেছি বাবা-মাদের বৈচিত্র্যময় আদর-সোহাগ-ভালোবাসা এবং শাসন-শোষণ। জেনে বা না জেনে কিংবা বুঝে বা না বুঝে বাবা-মারা বাচ্চাদের উপর নানা ধরণের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন।

শারীরিক আঘাত চোখে দেখা যায় তাই পরবর্তীতে বাবা-মা তাতে মলম লাগাতে পারেন বা চেষ্টা করেন।

কিন্তু মানসিক আঘাত………!!!

এই আঘাতের কারণেই হয়তো শিশুদের মানসিকতার সঠিক বিকাশ বাধাঁপ্রাপ্ত হয়। কারণ বিভিন্ন ইন্দ্রীয়ের সাহায্যে শিশুরা বিভিন্ন বস্তুগত গুণাবলী ও ঘটনা সম্পর্কে ধারণা বা উপলব্ধি করতে শেখে।

আর এর উপর নির্ভর করেই শিশুদের মধ্যে জন্ম নেয় স্মৃতিশক্তি, কল্পনাশক্তি, সৃজনশীলতা, বিচারবুদ্ধি ইত্যাদি।

আমার পরিচিত একটি বাচ্চা আছে।

১.বাচ্চাটা কোন কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারেনা, ২.স্থির হয়ে বেশিক্ষণ এক জায়গায় বসতে পারে না, ৩.কোন কিছু করতে বললেও ঠিকমতো করতে পারেনা,৪.একটুতেই রাগ করে-কান্না করে, ৫.বেখেয়ালি তাই খুব ভুল করে বা ভুলে যায়।

বাচ্চাটির বাবা-মাকে যদি পরামর্শ দেয়া হয় যে, ছেলেকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান তারা দুজনই ভীষণ বিরক্ত হন বা রাগ করেন। মোটকথা তারা মানতেই রাজী না যে তাদের বাচ্চাটি এডিডি বা এটেনশন ডেফিসিট ডিজঅর্ডারের শিকার। কেউ বোঝাতে গেলে উল্টো তাদের সাথে মনোমালিন্য হয়। অথচ সন্তানের প্রতি তাদের ভালোবাসার কোন কমতি নেই। বাচ্চা যা চাইছে বলার সাথে সাথে তা সামনে এনে হাজির করেন। কিন্তু মানুষ বলবে যে তাদের বাচ্চাটা স্বাভাবিক না, সে ভয়তে বাচ্চাকে ডাক্তারের কাছে নিতে চায় না বা নিজেরাও মানতে চায়না।

প্রতিবেশী একজনকে দেখেছি বাচ্চা কিছু করতে না চাইলে, নানাভাবে ভয় দেখিয়ে সে কাজটি করতে বাধ্য করে। কেউ আছেন সারাক্ষণ টিভি চ্যানেল আর ফোনালাপ নিয়ে এতো ব্যস্ত থাকেন যে, তখন বাচ্চা কথা বলতে চাইলে ধমক দিয়ে আরেক দিকে পাঠিয়ে দেন।

একজন মাকে দেখেছি বাংলাদেশ থেকে জালিবেত নিয়ে এসেছেন তার পাঁচ বছর বয়সি মেয়েকে শায়েস্তা করার জন্য। এক মা বুকফাটা কান্নার সাথে জানিয়েছিলেন, সাত বছর বয়সি ছেলেটাকে তাঁর স্বামী সামান্য কারণেই মাথায় তুলে সোফা বা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলেন, কখনো লাথি দেন আর বাকিটা নাহয় নাই বললাম।

যে কোন ধরণের আচার-ব্যবহার-কাজ যা শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ বা ভালো থাকায় বাঁধা দেয়, তাকেই এককথায় চাইল্ড অ্যাবিউজ বলে।

চাইল্ড অ্যাবিউজকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে-

♠ফিজিক্যাল অ্যাবিউজ বা যে কোন ধরণের নিয়ন্ত্রণহীন শারীরিক আঘাত।

♠সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ বা শিশু এবং প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে যে কোন রকমের যৌন সংসর্গ।

♠বিহেবিয়ার অ্যাবিউজ বা শিশুর প্রতি অবহেলা-অমনোযোগিতা।

♠ইমোশনাল অ্যাবিউজ বা নানাভাবে শিশুকে বাধ্য করা।

এই প্রত্যেকটি কারণের দ্বারাই শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ বাঁধাপ্রাপ্ত হয়। আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে এই প্রত্যেকটি কারণ নিয়েই আলোচনা করবো।

চাইল্ড ফিজিক্যাল অ্যাবিউজ

সন্তানদের ভালোর জন্যই প্রয়োজনে
বাবা-মাকে দৃঢ় হতে হয়। এটা অবশ্যই ভালো কারণ বাবা-মার দৃঢ়তা সন্তানদের মনে নিরাপত্তা বোধের জন্ম দেয়।

কিন্তু ছেলেমেয়েরা যখন কথা শোনে না বা অবাধ্যতা করে, তখন তাদেরকে সঠিক পথে আনতে বাবা-মারা যে কাজটি করেন, তাঁর নাম ‘শাসন’।

আর শাসন মানে সবাই মনে করেন যে, বকাঝকা করা নয়তো কোন শারীরিক শাস্তি দেয়া কিংবা পছন্দের জিনিস বন্ধ করে দেয়া ইত্যাদি।

আর শাসনের পক্ষে নানা ধরণের যুক্তিও থাকে বাবা-মার কাছে। যেমন- মাঝে মাঝে শাসন না করলে বাচ্চারা মানুষ হয় না, সাহস বেশি বেড়ে যায়, ছোটবেলায় আমাদের বাবা-মা’রাও আমাদেরকে শাসন করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি।

অথচ শাসন আর গায়ে হাত তোলা কিন্তু এক জিনিস নয়। বাচ্চাদের ভুল বা অন্যায় গুলো অবশ্যই তাদেরকে ধরিয়ে দিতে হবে, তবে এরসাথে গায়ে হাত তোলার কোন সম্পর্ক নেই।

আমি দেখেছি আড়াই বছর বয়সি একটি মেয়েকে তার বাবাকে ঘর ভর্তি মানুষের সামনে চড় লাগিয়ে দিতে, মেহমানদের জন্য সাজিয়ে রাখা খাবার ধরার জন্য।

মেয়েটা ফ্যালফ্যাল করে বাবার দিকে তাকিয়ে ছিল, কারণ চড়টা কেন খেল বুঝতে পারছিলো না।

বাসায় টিচার আসলে পড়তে চায় না তাই চার বছর বয়সি মেয়েকে মা লাঠি পেটা শুরু করলো টিচারের সামনেই।

স্কুল থেকে ডেকে টিচাররা অভিযোগ করলো ক্লাসে বাচ্চা অমনোযোগী থাকে, বাসায় ফিরেই বাবার চড়-থাপ্পড়ের বৃষ্টি বাচ্চার উপর।

ছয় বছর বয়সি ছেলেটা তার তিন বছরের বোনের সাথে খেলনা শেয়ার করতে রাজী না হলেই শারীরিক আঘাতের স্বীকার হয়। ঘরের কোন জিনিসপত্র নষ্ট করলো তো আর রক্ষা নেই। এমন আরো অসংখ্য ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে বাচ্চাদের সাথে।

অথচ এই ব্যাপার গুলোর সমাধানের সাথে শারীরিক আঘাতের কোন সম্পর্ক নেই বা শারীরিক আঘাত এর সমাধানও নয়।

পরীক্ষায় নাম্বার কম পেলে, ঘরের কোন জিনিস নষ্ট করলে, ছোট ভাই-বোনের সাথে বনিবনা না হলে, কথা শুনতে না চাইলে, অবাধ্যতা করলে বাচ্চাদের বুঝিয়ে না বলে,

গায়ে হাত তুললে আসলে তেমন কোন লাভ হয় না।

শরীরে ব্যথা পায় কিন্তু কেন ব্যথা পেলো বুঝতে পারে না, ফলে একই কাজ বার বার করে এবং আবারো শাস্তি পায়।

এর ফলে বাচ্চাদের মনে বাবা-মায়ের প্রতি চাপা ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং ক্রমাগত তা বাড়তে থাকে।

একটা সময় বাচ্চারা বাবা-মার কথাই সহ্য করতে পারে না। ইচ্ছে করে তখন কথা শোনে না বা দুষ্টুমি করে। কারণ চিন্তা থাকে বড়জোর আমাকে ধরে মারবে এই তো!

তাই বাচ্চারা কোন অন্যায় করলে তাদের বোঝাতে হবে। কেন এই কাজটা করা ঠিক না, এর প্রভাব কি হতে পারে ইত্যাদি। আর শারীরিক আঘাতের চেয়ে এই বোঝানোটা অনেক বেশি ফলপ্রসূ।

শাসন আর অ্যাবিউজ কিন্তু এক জিনিস না। শাসন হচ্ছে এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে শিশুর ভুল বা অন্যায় গুলো তাকে ধরিয়ে দিয়ে, তার থেকে বের হবার প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা করা।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে শাসনের নামে বাচ্চারা অ্যাবিউজের স্বীকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত, যার ফলে বাঁধাপ্রাপ্ত হচ্ছে তাদের সুষ্ঠু বিকাশ।

বাবা-মা যখন শাসন করতে গিয়ে বাচ্চাদের গায়ে হাত তুললেই যে সব ঠিক হয়ে যাবে এর কিন্তু কোন গ্যারান্টি নেই।
বরং বাচ্চারা আরো জেদি হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।

যারা বাচ্চাদেরকে বোঝাতে পারেন না বা শেখাতে পারেন না তারাই আসলে শাসনের নামে গায়ে হাত তোলেন। কিন্তু এভাবে সন্তানদের মানুষ করা যায় না।

নিজেদের চরিত্রের অযোগ্যতা, নিয়ন্ত্রণহীনতাকে শাসনের নামে চালিয়ে দেন। যা কিনা প্রকৃত অর্থে চাইল্ড ফিজিক্যাল অ্যাবিউজ।

আজ যে বাচ্চাটাকে আমি সামান্য কারণে গায়ে হাত তুলছি, শরীরের সাথে সাথে ছোট্ট মনটাকেও করছি আঘাতে আঘাতে জর্জরিত…!!

যখন ওর স্নেহ- মমতা-সহমর্মিতা-ভালোবাসার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তখন পাচ্ছে শাসনের নামে চড়-থাপ্পড়-বকাঝকা…!!

একটা বয়সে গিয়ে যখন আমার স্নেহ-মমতা-সহমর্মিতা-ভালোবাসার প্রয়োজন পড়বে, তখন কি সন্তানের কাছ থেকে সেটাকে প্রাপ্য মনে করাটা অন্যায় হবে না?

আমার আজকের আচরণটাই যে আমার সন্তানের আগামীর পাথেয় হবে সেটা যেন আমরা কেউ ভুলে না যাই।

সাইকোলজি(পিএইচডি)

 

‘মা’ তোমাকে ভালবাসি

ডা. সাকলায়েন রাসেল


ক্লান্ত শরীরে সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম..চোখ খুলে দেখি মা.. মাথায় হাত বুলাচ্ছেন! তাঁর দিকে তাকাতেই বললেন…
ঘেমে গেছিস…ফ্যান ছেড়ে দিব?
কিছু বলার আগে আবারো বললেন,
চুল অনেক বড় হয়ে গেছে,কাটাবি না?

চুল তো চাইলেই ছোট করতে পারি…পারিনা নিজেকে ছোট করতে ! তাহলে হয়ত মায়ের সেই ছোট্ট সাকলায়েনটি হয়ে থাকতাম.. চিরদিন!

সেদিন মাকে বললাম, আজ রোজা রাখব…

-শোয়ার আগে মা বলল, সত্যি সত্যি রাখবি?

_‘হু’

-ভোরে উঠে ভাত গরম করে খেতে পারবি?

_আরে না, কি যে বল, ভাত গরম করতে হবে কেন!… পেটে গেলে দু’মিনিটেই সব ঠান্ডা হয়… ! নিজের অক্ষমতা আড়াল করতে এভাবেই যুক্তির আশ্রয় নিলাম।

-কিছুক্ষণ পর মা এসে বলল, শোন, হটপটে খাবার আছে…খেয়ে নিস…!

_আচ্ছা

-কিছুক্ষণ পর, মা আবার এসে ঠোটে হাসির রেখা টেনে বলল, শোন, হটপট সাবধানে খুলিস !

এমন সাবধান বাণীতে অবাক হলেও কোন প্রশ্ন করলাম না…
ঘড়িতে তখন রাত ৩ টা…
খেতে গিয়ে অবাক হলাম…পুরো হটপট ৩ টা সোয়েটারে ঢাকা…!
‘আহ হারে’ ! …

ছেলের খাবার গরম রাখতে কি প্রাণ পণ চেষ্টা মায়ের…! ভাতটুকু গলধকরণের আগেই তাই বোবা কান্নাটাও গিলে ফেললাম…

শেষ প্রান্তে এসে বুঝলাম… ভাত শেষ কিন্তু পেটে ক্ষুধা তখনো রয়ে গেছে!…তবুও একমুঠো ভাত রেখেই খাবার শেষ করলাম…। ব্যাখ্যাঃ যদি সকালে উঠে মা দেখে সব ভাত শেষ… তবে ভাবতে পারে… আমার হয়ত আরো ভাত লাগত… আমি ক্ষুধা নিয়েই রোজা রেখেছি…
ফলাফল, মা সারাদিন মন খারাপ করবে… আফসোস করবে… আহ হারে! কেন ভাত একটু বেশি দিলাম না..! পেট অপূর্ণ থাকার পরও আমি তাই একটু ভাত ছেড়েই উঠলাম… তাতে মা অন্তত স্বান্তনা পাবে, ভাতের পরিমান ঠিক ছিল।

বন্ধুরা, Love you mom…আমি তেমনটা পারিনা…আমার কাছে LOVE মানে ভাত গরম রাখতে সোয়েটার দিয়ে হটপট ঢেকে রাখা…
LOVE মানে পেটে ক্ষুধা থাকা সত্ত্বেও কিছু ভাত ছেড়ে উঠা!

সহকারী অধ্যাপক, ভাসকুলার সার্জারী
ইব্রাহিম কার্ডিয়াক, বারডেম

 

ঝড়ের দিন -শেষ পর্ব

তানজীল আহমদ সিদ্দিকী


আলতানগর প্রাথমিক বিদ্যালয়। কদিন আগেও গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কলকাকলিতে স্কুলটার প্রত্যেকটা ঘর মুখর হয়ে উঠতো। অ আ ক খ ধ্বনি উড়ে উড়ে বেড়াতো স্কুলের প্রতিটি ঘরে। আর এখন স্কুলের প্রতিটি ইটে পাক খায় হানাদারদের দ্বারা নির্যাতিত মানুষগুলোর মরণ আর্তনাদ। জানালার কপাটে ঠুকে মরে ধর্ষিতাদের নিস্ফল কান্না। দেয়ালে লেপ্টে যায় হতভাগীদের অসহায় হাতের ছাপ।
দীপককে কখন ওরা স্কুলের একটা ঘরে বেঁধে রেখে গেছে টের পায়নি সে। যখন জ্ঞান ফিরলো তখন দেখলো একটার অন্ধকার রুমে সিলিং থেকে ঝুলে থাকা দুটো দড়িতে হাত বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। দীপক প্রথমে ভেবছিলো এ ঘরে সে একা, পরে অন্ধকারে চোখ একটু সয়ে আসতে বুঝতে পারলো তার পাশে আরেক জন একইভাবে বাঁধা। হঠাৎ মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো দীপকের। প্রচন্ড দূর্বল লাগছে। নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হতে লাগলো দীপকের। তার ভুলের জন্য পুরো মিশনটাই বোধহয় ভেস্তে যেতে যাচ্ছে। এমন সময় পাশের মানুষটা খুব মৃদু গলায় বলে উঠলো, ‘পানি! পানি! কেউ আমাকে একটু পানি খেতে দাও! ‘ কণ্ঠস্বরটা খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। দীপক ভালো করে কান পাতলো। এ তো তপেশ মাস্টারের গলা!
‘ মাস্টার সাব, ও মাস্টার সাব! ‘
তপেশ মাস্টার প্রথমে বুঝতে পারলেন না কোথা থেকে আসছে কণ্ঠটা। এই পিশাচের দঙ্গলে কে-ই বা তাকে এত সম্মানের সহিত ডাকবে! তবে সাড়া দিলেন!
‘ কে বলছো? তুমি কি এ ঘরেই আছো? ‘
‘ আমি দীপক, মাস্টার সাব! আপনার পাশেই বাঁন্ধা আছি। আপনার এই অবস্থা ক্যান, স্যার? ‘
তপেশ মাস্টার অতি কষ্ট করে একটু হাসলেন। সেই হাসিতে লেগে আছে ব্যথাহত হৃদয়ের উথলে ওঠা আবেগের পরশ। তারপর অসহায় গলায় বললেন, ‘ মিলিটারিরা ধরে নিয়ে এসেছে, নজর আলির নির্দেশে। আমার স্ত্রী, বোন এদের আমি রক্ষা করতে পারিনি। জানিও না এমুহুর্তে কি অবস্থায় আছে ওরা। তোমাকে ধরেছে কেন? ‘ তার চোখ খানিক উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ‘ তুমি মুক্তিবাহিনীর লোক? ‘
দীপক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘ জে, মাস্টার সাব। ‘
হঠাৎ করে ভারী কাঠের দরজাটা খুলে গেলো। নজর আলি আর মেজর ওয়াসিমসহ কয়েকজন মিলিটারি ঘরে ঢুকলো। নজর আলির হাতে হারিকেন। সেই আলোয় পুরো ঘর আলোকিত হয়ে উঠলো। দীপক খেয়াল করলো তপেশ মাস্টারের শরীরের সর্বত্র অত্যাচারের চিহ্ন। বিভিন্ন জায়গায় চামড়া ছিলে ফেলা হয়েছে। রক্ত ঝরছে সেসব ক্ষত থেকে। আসন্ন অত্যাচারের কথা চিন্তা করে দীপকের পুরো শরীর খানিক কেঁপে উঠলো। মেজর ওয়াসিম খান সোজা এগিয়ে আসলেন দীপকের সামনে। তার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ তুম মুক্তি হ্যায়? ‘
পাশ থেকে তপেশ মাস্টার চিৎকার করে উঠলেন, ‘ কিচ্ছু বলো না, দীপক। একদম কিচ্ছু বলো না। পশুগুলো তোমা…’ কথা শেষ করতে পারলেন না তিনি। নজর আলি সজোরে একটা চড় কষিয়ে দিলেন তিনি। তপেশ মাস্টারের চুলের মুঠি ধরে দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, ‘ একদম চুপ, শালা মালাউন। তোর বউটারে তো সৈন্যরা ভোগ কইরা জঙ্গলে ফালায়ে রাইখা আসছে। আর তোর বোইনের মজা লুটসেন আমাগো মেজর। আর একটা কথা যদি কস, তাইলে তোর বউয়ের কাছে তোরে আর তোর বইনরে একলগে পাঠায় দিমু। ‘
নজর আলির কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলেন তপেশ মাস্টার। তার স্ত্রী আর বেঁচে নেই! তার অনাগত সন্তানও আর বেঁচে নেই। ছোট বোনটার ইজ্জত লুটে নিয়েছে পশুগুলো। আর কি লাভ বেঁচে থেকে! হতভাগিনী বোনটাকে সাথে নিয়ে মরে গেলেই বোধহয় সব জ্বালা জুড়িয়ে যায়! ফিসফিস করে শুধু বললেন, ‘ মেরে ফেল আমাকে। ‘
মেজর আবার জিজ্ঞেস করলেন দীপককে, ‘ তুম মুক্তি হ্যায়? ‘
হ্যাঁ না যা-ই বলুক পরিণতি কি হতে পারে জানা আছে দীপকের। তাই ও সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো কোনভাবেই সহযোগিতা করবে না। পিশাচদের সাথে কোন আপোস করা যাবে না। মুখ ভর্তি থুতু ছুঁড়ে মারলো সে মেজরের দিকে। মেজর মুখ খারাপ গাল দিয়ে উঠে হাতের উলটো পিঠ দিয়ে সজোরে চড় মারলেন দীপককে । এমন সময়ে হঠাৎ বাইরে থেকে প্রচন্ড গোলাগুলির আওয়াজ ভেসে এলো। দুম করে গ্রেনেডও ফুটলো একটা। ঘরে উপস্থিত সকলে চমকে উঠলো। এক পাক সৈন্য ছুটতে ছুটতে এসে জানালো মুক্তিরা এট্যাক করেছে এবং সংখ্যায় মনে হচ্ছে বেশ ভারী ওরা! দীপকের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। আসাদ ভাইরা এসে পড়েছেন! দীপক বিজয়ী ভঙ্গিমায় হেসে মেজরকে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘ এবার কোথায় পালাবি? ‘ মেজর সৈন্যদেরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে বাইরে পাঠিয়ে দিলেন। তারপর দীপকের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে নজর আলিকে সাথে নিয়ে নিজেও বেরিয়ে গেলেন। দীপকের চোখ তখন জ্বলছে। ক্রোধের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। আজ পিশাচ বধ হবে। বহুদিন পর আলতানগরের আকাশে আবার স্বাধীন সূর্য উঠবে।
শিবু আর আসাদ যখন দীপকের বাড়িতে পৌঁছেছিলো তখন দীপকের মা-কে তারা বাড়ির উঠোনে অজ্ঞান অবস্থায় পেয়েছিলো। জ্ঞান ফেরানোর পর তিনি কাঁদতে কাঁদতে তাদের জানান যে মিলিটারিরা দীপককে ধরে নিয়ে গেছে। তারা তারপর সিদ্ধান্ত নেয় যে ওপারে ফিরে গিয়ে কমান্ডারকে জানানো যাবে। তারপর সম্ভব হলে একটা রেসকিউ অপারেশন চালাবে। পরবর্তীতে দীপকের মা-কে শান্ত করে খেয়াঘাটে পৌঁছে তারা দেখতে পায় তাদের পুরো গেরিলা দলটা খেয়াঘাটে অবস্থান নিয়ে আছে। কমান্ডার সাদেকও চলে এসেছেন। আসাদ আর শিবু অবাক হয়ে কমান্ডারের কাছে জানতে চেয়েছিলো – দলের একজন যোদ্ধার জন্য কমান্ডার এতবড় একটা ঝুঁকি নিলেন? কমান্ডার মুচকি হেসে বলেছিলেন, ‘ দেশটারে বাঁচাইতেই তো আমরা বেবাক্কে এক হইসি। ধইরা নাও দীপকই দেশ। কি? বাঁচাইবা না নিজের দেশরে? ‘ আসাদ অবাক তাকিয়ে ছিলো। কমান্ডারকে সবাইকে ডেকে পুরো মিশনটা বুঝিয়ে বললেন। চারদিক থেকে স্কুলটা ঘিরে ধরতে হবে। তারপর একসাথে সব দিক থেকে ফায়ারিং শুরু হবে।
প্ল্যান অনুযায়ী কমান্ডারের সাদেকের নেতৃত্বে গেরিলা দলের সবাই স্কুলের চারদিকে অবস্থান নিয়ে নেয়। আসাদ, শিবু সাথে আরো কয়েকজন অবস্থান নেয় স্কুলের সামনের দিকে। স্কুলের সামনে পাহারায় দাঁড়িয়ে থাকা কোন পাক সৈন্য কিচ্ছুটি টের পায়নি। তারপরই কমান্ডারের নির্দেশে শুরু হয়ে যায় গুলি বর্ষণ। স্টেনগান আর থ্রি নট থ্রি রাইফেলের একটানা গুলিবর্ষণে পুরো আলতানগর কেঁপে উঠলো। স্কুলের ভেতরে তখন মেজর দীপককে ইন্টারোগেট করছেন। পাক সৈন্যরা হামলার প্রথম ধাক্কাটা সামলে নিতেই বেশ হিমশিম খেয়ে গেলো। তিন জন সৈন্য গোলাগুলি শুরু হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই লুটিয়ে পড়লো। বাকি সৈন্যরা ততক্ষণে সামলে নিয়েছে। কাভার নিয়ে ওরাও পালটা গুলি করতে লাগলো। পুরোদমে শুরু হয়ে গেলো এক মরণপণ লড়াই। গেরিলা দলটা জীবন বাজি রেখে লড়ছে আলতানগরকে হানাদারমুক্ত করবে বলে। আর পাক বাহিনী দাঁতে দাঁতে চেপে লড়ে যাচ্ছে এই অঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মিলিটারি ঘাঁটির দখল রাখবে বলে। দুই পক্ষই সংখ্যায় ভারি। যদিও পাক বাহিনীর হাতে আছে একটা মেশিনগান। স্কুলের বাউন্ডারি ঘেঁষেই বসানো হয়েছে সেটি। অনবরত গুলি বর্ষিত হচ্ছে তা থেকে। ইতিমধ্যেই দুজন গেরিলা সেই মেশিনগানের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন। কমান্ডার সাদিক সবাইকে খানিক পিছিয়ে যেতে বললেন। মেশিনগানটা কব্জা করতে না পারলে ক্যাম্পের দিকে আগানো সম্ভব না। বাঁশঝাঁড়ে অবস্থান নিয়ে থাকা কমান্ডারের পাশেই ছিলো শিবু। সে বলে উঠলো, ‘ আমি দখল নিমু মেশিনগানের। ‘ কমান্ডার অবাক হয়ে বললেন, ‘ কি কইরা? ‘
এই প্রথম শিবুকে হাসতে দেখলেন কমান্ডার। দু হাতে দুটো গ্রেনেড নিয়ে শিবু বললো, ‘ এইগুলান দিয়া। আপনেরা শুধু আমারে কাভার দেন। ‘ কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই শিবু বাঁশঝাড় থেকে বেরিয়ে এলো। আঁকাবাঁকা করে দৌড় দিলো স্কুলের দিকে, ঠিক যেখানে মেশিনগানটার অবস্থান। কমান্ডার চিৎকার করে সবাইকে নির্দেশ দিলেন শিবুকে কাভার দিতে। সবাই একযোগে গুলি শুরু করলো। স্টেনগানের কড়কড় আওয়াজে কান পাতা দায়। ওদিক থেকে চাইনিজ এসএসজি দিয়ে পাক বাহিনীও সমানে জবাব দিয়ে যাচ্ছে। আর সেই নরকের ভেতর দিয়ে শিবু এঁকেবেঁকে দৌড়ে যাচ্ছে। গুলির নহর ছুটে যাচ্ছে তার পাশ দিয়ে। তবু একটা গুলিও স্পর্শ করছে না তাকে। যেন অসম সাহসী মৃত্যুভয়হীন এই মানুষটাকে পরম শ্রদ্ধায় পথ করে দিচ্ছে গুলিগুলো। মেশিনগানের সামনে বসে গুলি রিলোড করতে পাক সৈন্যটা অবাক হয়ে দেখলো এক বাঙ্গাল দু হাতে দুটো গ্রেনেড নিয়ে ঠিক তার দিকেই ছুটে আসছে। মেশিনগানের গুলি রিলোডিং ফেলে সে তার রাইফেলটা হাতে তুলে নিলো এবং সাথে সাথেই গুলি করে দিলো। তবে তার আগেই ‘ ও মা, তোর লাইগা ‘ চিৎকার দিয়ে শিবু একটা গ্রেনেড ছুঁড়ে দিয়েছে মেশিনগানের দিকে! বিকট আওয়াজ করে দুটো গ্রেনেড একসাথে ফুটলো। মেশিনগান গানার আর তার মেশিনগান টুকরো টুকরো হয়ে গেলো মুহুর্তে। অসম সাহসী শিবুর শরীরও টুকরো হয়ে মিশে গেলো তার বাংলা মায়ের শরীরের সাথে। সাথে সাথে কমান্ডার সাদেক চিৎকার করে সবাইকে আগে বাড়তে বললেন। ক্যাম্পের চারদিক থেকে যোদ্ধারা গুলি করতে করতে এগিয়ে আসতে লাগলো। মেশিনগানটা উড়ে যেতে দেখেই পাক সৈন্যদের সাহস উবে যেতে শুরু করেছিলো, চারদিক থেকে গেরিলাদের এভাবে ছুটে আসতে দেখে অবশিষ্ট সাহসটুকুও আর রইলো না। নির্দিষ্ট কোন টার্গেট ভুলে এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে লাগলো। ফলস্বরুপ বেশিরভাগ গুলিই যোদ্ধাদের আশপাশ দিয়ে চলে যেতে লাগলো। একটাসময় এসে পাক সৈন্যদের আর কেউই বেঁচে রইলো না ক্যাম্পটার দখল বজায় রাখার জন্যে। ভেতরে যারা ছিলো তারা সবাই মাথার উপরে হাত তুলে বেরিয়ে এলো। কমান্ডার সাদিক এগিয়ে আসলেন সামনে। সাত-আট সিপাহীকে সাথে নিয়ে মেজর ওয়াসিম খান সাদিকের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। তাদেরকে কড়া পাহারায় রেখে কমান্ডার কয়েকজনকে সাথে নিয়ে স্কুলের ভেতরে ঢুকলেন। একটা ঘরের দরজা খোলা দেখে ভেতরে ঢুকলেন। তপেশ মাস্টার আর দীপককে এ ঘরেই বেঁধে রাখা হয়েছে। কমান্ডার তাড়াতাড়ি দুজনের বাঁধন খুলে দিলেন। বাঁধন খুলে দিতেই তপেশ মাস্টার মূর্ছা গিয়ে কমান্ডারের শরীরের উপর ঢলে পড়লেন। কমান্ডার আস্তে করে তাকে মেঝেতে শুইয়ে দিলেন। তারপর তিনি দীপকের বাঁধন খুলে তাকে বাইরে নিয়ে এলেন। দীপককে দেখে আসাদসহ অনেকে ছুটে এলো। আসাদ উদ্বিগ্ন স্বরে দীপককে জিজ্ঞাসা করলো, ‘ দীপক, ঠিক আসো তুমি? পশুগুলান মারে নাই তো? ‘ দীপক ক্লান্ত স্বরে বললো, ‘ আমি ভালা আছি, আসাদ ভাই। আপনেরা মাস্টার সাহেবরে দেখেন। ‘ কমান্ডারের মনে পড়লো তিনি মাস্টারকে ঘরে রেখে এসেছেন। সাথে সাথে তিনি একজনকে নির্দেশ দিয়ে দিলেন মাস্টার-কে যেন বাইরে নিয়ে আসা হয়। ততক্ষণে স্কুলের প্রত্যেকটি ঘরের দরজা খুলে বন্দিদের বাইরে নিয়ে আসা হয়েছে। সবই যুবতী মেয়ে। তাদেরকে দিনের পর দিন এখানে আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয়েছে। গায়ে একটা সুতো পর্যন্ত ছিলো না কারো। উপস্থিত গেরিলা দলের প্রত্যেকে তাদের নিজেদের শার্ট-গেঞ্জি খুলে তাদেরকে ঢেকে দিয়েছে। মানসিক আর শারীরিক অত্যাচার হাঁটার শক্তি পর্যন্ত নিয়ে নিয়েছে তাদের। দুজন তাদেরকে নিয়ে গ্রামের দিকে আগালো। আলতানগত যে শত্রুমুক্ত হয়ে গেছে, গ্রামবাসীকে সেকথা তারা-ই জানিয়ে দেবে।
তপেশ মাস্টারকে ধরে ধরে যখন স্কুলঘরের বাইরে নিয়ে আসলো, তিনি তার বোনের খোঁজ জানতে চাইলেন। কমান্ডার সাদিক গম্ভীর মুখে বললেন, ‘ মনডারে শক্ত করেন মাস্টার। ‘ কমান্ডারের কথা শুনে তপেশ মাস্টার ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। এমন সময় ভেতর থেকে দুজন মুক্তিযোদ্ধা একটি মেয়ের লাশ ধরাধরি করে নিয়ে এলো। তারা সেই লাশটা পরম যত্নে শুইয়ে দিলো বারান্দার মেঝেতে। তপেশ মাস্টার এগিয়ে আসলেন। এ যে তার বোনেরই লাশ। তিনি আস্তে করে বসে পড়লেন তার বোনের পাশে। তারপর শান্ত গলায় কমান্ডারের কাছে জানতে চাইলেন, ‘ কিভাবে? ‘ কমান্ডার ধরা গলায় বললেন, ‘ পরনের শাড়ি দিয়া। পশুগুলোর অমানুষিক অত্যাচার আর নিতা পারেনি বেচারি। ‘ কমান্ডারের কথা শোনার পর তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তপেশ মাস্টার শান্তভাবে তার বোনের মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। কমান্ডার আর দাঁড়াতে পারলেন সেখানে। আস্তে করে সরে আসলেন। মাটিতে হাঁটু গেড়ে মাথায় হাত দিয়ে বসা আত্মসমর্পণকারী পাক সৈন্যদের দিকে এগিয়ে এলেন। মেজর ওয়াসিম খানের সামনে এসে ডাক দিলেন তার এক সহযোদ্ধা-কে। শিক্ষিত লোক তিনি। শহরের কলেজে শিক্ষকতা করতেন, যুদ্ধের দামাম বাজতেই দেশের ডাকে সাড়া দিয়ে অস্ত্র কাঁধে নেমে পড়েছেন যুদ্ধক্ষেত্রে। কমান্ডার তার হয়ে মেজরের সাথে কথা বলতে অনুরোধ করলেন তাকে।
তিনি কমান্ডারের কথা মতো মেজরকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ ডু ইউ ফিল গিলটি ফর হোয়াট ইউ হ্যাভ ডান, মেজর? ‘
মেজর ঠান্ডা গলায় জবাব দিলেন, ‘ নো। বাট আই রিপেন্ট ওয়ান থিংগ। ‘
ভদ্রলোক তার মাথায় চেপে বসা রাগটা কোনরকমে ঠেলে সরিয়ে রেখে জানতে চাইলেন, ‘ হোয়াট? ‘
মেজর কুৎসিত একটা হাসি দিয়ে বললেন, ‘ ইফ আই কুড ফাক মোর ওব ইওর গার্লস! ‘ আর সহ্য করতে পারলেন সেই শিক্ষক। অন্তরের সব ঘৃণা এক করে হাতের মুঠোয় এনে সজোরে এক ঘুষি মেরে বসলেন মেজরকে। মেজরের নাক দিয়ে রক্তের ফোয়ারা ছুটলো। কমান্ডার তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে সরিয়ে নিয়ে গেলেন ভদ্রলোককে।
ভোর হবার খানিক আগে, কমান্ডার সাদিকের আদেশে মেজর ওয়াসিমকে স্কুলের পেছনে নিয়ে গিয়ে একটা বড় আমগাছের সাথে বেঁধে গুলি করে হত্যা করা হয়। বাকি সৈন্যদের যুদ্ধবন্দি হিসেবে আটকে রাখা হয় স্কুলের একটা ঘরে। পরে সুযোগমতো অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হবে। পরিবেশ একটু শান্ত হতেই সবার মনে পড়লো নজর আলির কথা! আশেপাশের দশ-বারোটা গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত রাজাকারটা কোন ফাঁকে যেন পালিয়ে গেছে। কমান্ডার সাদিকের নেতৃত্বে গেরিল দলের একাংশ নজর মেম্বারের বাড়িতে পৌঁছুলো। কমান্ডার ঘরের বাইরে থেকে জোরে ডাক দিলেন, ‘ নজর আলি! নজর আলি, তুমি বাইর হয়া আহো। আলতানগরে স্বাধীন মাটিতে আইজ তোমার বিচার হইবো। ‘ খানিকক্ষণ পর সদর দরজা খুলে গেলো। জোহরা বেগম বেরিয়ে এলেন ভেতর থেকে। ঘোমটার আড়াল থেকে আশ্চর্য শান্ত গলায় তিনি বললেন, ‘ তিনি বাড়িতে নাই। ‘ কমান্ডার একটু রেগেই বললেন, ‘ অবশ্যই সে বাড়িতে আছে। বাইর হইতে কন তারে। ‘
জোহরা বেগম বললেন, ‘ তিনি গোয়ালঘরে আছেন। যান। ‘
কমান্ডার কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে রইলেন এই মহিয়সী নারীর দিকে। তারপর তার সহযোদ্ধাদের আদেশ দিলেন নজর আলিকে ধরে আনার জন্যে। কিছুক্ষণ বাদেই তারা নজর আলি-কে টানতে টানতে নিয়ে এলো। নজর আলির দুচোখে মৃত্যুভয় স্পষ্ট। কমান্ডার ঘৃণাভরে কণ্ঠে বললেন, ‘ উপরে বিচার করবেন আল্লাহ, আর নিচে তোমার বিচার করবো এই আলতাগরের মানষে, যাগোর লগে বেঈমানি করসো তুমি। ‘ কমান্ডারের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধারা নজর আলিকে তুলে দেয় ক্রোধের আগুনে জ্বলতে থাকা গ্রামবাসীদের হাতে। দা, বটি, কুড়াল কি দিয়ে তারা আঘাত করেনি নজর আলিকে! শেষপর্যন্ত যখন গ্রামবাসীদের ক্রোধের আগুন নিভলো, তখন নজর আলির শরীরটা একদলা মাংসপিন্ড ছাড়া আর কিছুই না। ততক্ষণে চারপাশ আলো হয়ে গেছে। গেরিলা দলটা স্কুলটাকে তাদের অস্থায়ী ঘাঁটি বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মুসেগুল থেকে এসে যদি হানাদাররা আক্রমণ করে, তাই শক্ত অবস্থান নিতে হবে তাদের। অনেক রক্ত ঝরেছে আলতানগর মুক্ত করতে। সেই রক্তের প্রতিটি ফোঁটার সম্মান তাদের বাঁচিয়ে রাখতেই হবে।
আজ অনেকদিন পর আলতানগরের আকাশে মেঘের ভেলা সরে গিয়ে ঝকঝকে লাল সূর্য উঠেছে। সেই চোখ ধাঁধানো আলোয় একজন নিঃসঙ্গ মানুষ একা বসে আছে নদীর ধারে। মানুষটা তপেশ মাস্টার। নদীর ওপারে দৃষ্টি তার। কিংবা শুধু চোখটাই সেখানে ফেরানো, দৃষ্টি নেই তাতে। সূর্য পরম ভালোবাসায় তার পবিত্র আলো বুলিয়ে দিতে লাগলো মানুষটার সারা গায়ে। সব গেছে তার, শুধু প্রাণটা আছে। ঠিক যেন এই অভাগা দেশটার মতো। সব যাচ্ছে তার, শুধু ধুকপুক করা প্রাণটা আছে। একদিন এই প্রাণ থেকে আবার সব হবে। নকূল বাউলরা আবার এই আলতানগরের পথে হেঁটে বেড়াবে। শিবুরা আবার পরম ভালোবাসায় তার দেশমায়ের জন্য জীবন বাজি রাখবে। তপেশ মাস্টারের হতভাগিনী বোনটার মতো ষোড়শীরা আবার আলতানগরের পথে হাসতে হাসতে ছুটে বেড়াবে। ঝড়ের দিন শেষ হয়েছে। এখন প্রতিদিন সূর্য উঠবে, উঠবেই উঠবে।

এইচ এস সি শিক্ষার্থী
চট্টগ্রাম

 

আমার শরীর, আমার অংশ, আমার স্বপ্ন!

ডা.সংগীতা হালদার রায়


ছোট খাট কিছু কম্পলিকেশন ছিল , ছিল মিস ক্যারিজের হিস্টরী, আর বাবুর মাথাও বেকে ছিল । তাই নরম্যাল ডেলিভারির আশা ছেড়ে দিয়ে সিজারিয়ান সেকশনের জন্যে চলে গেলাম CMH এ নির্ধারিত দিনের আগের দিনই।

মস্তিষ্কের একটা স্বাভাবিক প্রবণতা হল খুব চাপের সময়ে সে অন্য কোন পুরাতন স্মৃতি মনে করিয়ে দেয় বা অন্য কোন কিছু চিন্তাতে নিউরনগুলোকে কাজে লাগিয়ে ফেলে।

তাই ভর্তির সময়ে যখন আমার চিন্তিত বা আশংকিত হবার কথা ছিল পরদিন কি হবে বা সব কিছু ঠিক ভাবে হবে কিনা তখন আমি প্যালেস্টাইনি এক রোগীনির ভর্তি হবার পুরো প্রক্রিয়াতে মনোনিবেশ করে ফেললাম।

বেচারা ভীনদেশে বাবা হতে গিয়ে প্রচন্ড ভীত, ইন্টার্ন ডাক্তারদের কিছুতেই রোগীনিকে পরীক্ষা করতে দেবেন না , বলছেন ‘ আই ওয়ান্ত অনলি র‌্যাঙ্ক দক্তর’ । হিস্টরী নিয়ে রোগীকে রেডি করে সিনিয়রকে ডাকাই ইন্টার্নদের প্রথম দায়িত্ব, সে বেচারারা ভেবাচেকা খেয়ে একবার উনাকে বুঝাচ্ছিল, একবার রোগীকে বুঝাবার চেষতা করছিল, আরেকবার সিনিয়র নার্সকে জিজ্ঞেস করছিল সিনিয়র ডাক্তারকে ডাকা ঠিক হবে কিনা।

মহিলার প্রতিক্রিয়া দেখতে গিয়ে দেখি ছিপছিপে লম্বা ভদ্রমহিলা কিঞ্চিত দুশ্চিন্তা নিয়ে স্বামীর কান্ড দেখছেন কিন্তু কিছু বলতে চেয়েও পারছেন না। মহিলা এতোই ছিপছিপে ছিলেন যে নিজের বিশাল পেটের দিকে তাকিয়ে মনে হল, ” আরে আমার বাচ্চাটা কি পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে আর ইনারটা এটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নাকি? ”

ভেবেই আনমনে ফিক করে হেসে দিয়েছিলাম, মহিলা তো আর জানতেন না যে আমি ঐ অবস্থায় এরকম বিচিত্র কথা ভেবে হাসছিলাম; কাজেই উনি সৌজন্য বিনিময়ের হাসি ফেরত দিলেন আমায়। আমি সংযত হয়ে বসলাম লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে।যাহোক নিজের ক্যাবিনে এলাম। ঘর , বাথ্রুম , বারান্দা দেখে মোটামুটি সন্তুষ্ট হয়ে পরদিন কি পরে ওটিতে যাব , বাচ্চা কি পরবে, কোন কাঁথায় তাকে বরণ করা হবে সব কিছু একবার মা আরেকবার স্বামীকে বুঝিয়ে দিলাম ।

বুঝতে পারছিলাম অস্থিরতা কাজ করছিল ওর মাঝে, ছেড়ে যেতে চাইছিল না আমায়, কারণ আমার মায়ের কোমরে ফ্যাকচার আছে, হঠাত করে হাসপাতালের চিকন বেড থেকে ভারি শরীর নিয়ে ওঠা নামা করা ইত্যাদি কাজে অসুবিধার আশংকা করছিল সে। কিন্তু CMH এর নিয়ম ওটাই, কিছু করার ছিল না। বলে গেল ঘুমাতে আর সাথে দিয়ে গেল গল্পের বই, খুবই পরস্পরবিরোধী সিদ্ধান্তের কাজ ছিল সেটা কিন্তু আমার স্নায়ুকে শুধু বই-ই শান্ত রাখতে পারে , অগত্যা!মা কিছুক্ষণ ঘুমাতে বলে ঘুমিয়ে গেল , আমি গল্পের বইতেও মনযোগ দিতে পারছিলাম না আর অস্থিরতায় ঘুমও আসছিলনা। পেটে হাত দিয়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম অনাগত সন্তানের কথা ভেবে, কথা বললাম বাবুটার সাথে খানিক্ষণ , অতঃপর ঘুমিয়ে গেলাম।

কিন্তু নতুন জায়গায় চিকন বেডে ছাড়া ছাড়া ঘুম হচ্ছিল, বার বার ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছিল । বেড়ালের ডাকে, গাড়ির চাকার শব্দে, এমনকি ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকেও । আবার ঘুমাবার চেষ্টা করছিলাম , নিজেকে বোঝাচ্ছিলাম যে আমার ব্লাড প্রেশার স্বাভাবিক রাখার জন্যে আমার ঘুমাতে হবে। আমার বাবুকে সুস্থ রাখতে আমাকে ঘুমাতে হবে।পরদিন ঘুম ভাংলো অনেক ভোরে সকালে উঠে দেখি মা স্নান সেরে নিজে নিয়ে আসা স্যাভলন দিয়ে ঘর , বারান্দা , এমনকি বাথরুমও মুছে ফেলেছে। আমি উঠতেই সাত তাড়াতাড়ি করে নিজের ফ্যাকচারড কোমর নিয়েই বেড থেকে নেমে এলো আমায় ব্যালান্স করে নামাতে । ধীরে ধীরে নেমে বাথরুমে গিয়ে মুখ ধোবার সময়ে নিজের চিন্তাক্লিস্ট চেহারাটা আয়নায় দেখে নিজেরই কেমন যেন লাগল । মনে হল আমার বাচ্চাটা প্রথমবার এমন ভাবে দেখবে আমায়!
বেড়িয়ে এসে সুন্দর করে নিজের চিল আচড়ে দুইটা বেনি করলাম। হালকা করে বিবি ক্রিম , পাউডার কাজল , হাতে পায়ের নখে নেইল পলিশ লাগালাম। তবুও দেখি সময় কাটেনা, স্বামীও আসেনা। মা তখন গীতা পড়ে যাচ্ছে মন দিয়ে। মাকে খেয়ে নিতে বলে আমার নিজের গীতাটা খুললাম । সাড়ে সাতটার দিকে আয়ারা চলে এলো আমাদের রুম মুছে দিতে আর আমাকে রেডি করে নিয়ে যেতে । আমার চুলের রাবার ব্যান্ড খুলে গজ ফিতা দিয়ে আবার বেঁধে দিল, কেন কে জানে ! আমার মনে হচ্ছিল যে ওদের করার কিছু নেই বলেই হয়তো অমন করেছিল। কারণ ঘর মোছা আর আমায় হালকা সাজুগুজু দেখে ওরা দুজন গা টেপাটেপি করে হেসেছিল।যখন নিয়ে যেতে চাইলো মা তখন ভয় পেয়ে গিয়েছিল একটু, কারণ বাবা বা তার জামাই কেউই তখনো আসেনি। এদিকে ‘ম্যাডাম বলেছে’ বলে ওরা আমাদের আটকে ফেলেছে । ফ্যামিলি ওয়ার্ড থেকে ওটিতে যাবার জন্যে এম্বুলেন্সে আরো তিন বা চারজন হবু-মা শুকনো মুখে উঠে বসে আছেন , তাড়া দিচ্ছিল ওরা তাই। হেসে মাকে প্রনাম করে যখন গাড়িতে উঠলাম তখন শুকনো চোখেও ঝাপসা দেখছিলাম দুশ্চিন্তায়, সামনের কারো চেহারা দেখি নি আমি । গাড়ির পেছনের কাঁচে মাকে দেখছিলাম ব্যস্ত হয়ে মোবাইল চাপতে।

ওটির কাছে পৌঁছে দেখি মা আর স্বামী দুজনেই এসে গিয়েছে। ওয়েটিং রুমে কিছুক্ষণ বসানো হল আমায়। জানতে পারলাম বাবা নাকি অনেক আগেই পৌঁছে কোন ওটিতে অপারেশন হবে , কে করবেন তাদের সাথে কথা বলতে গিয়েছে।

নিজের প্রাক্তন কাজের জায়গাতে মেয়ের কোন অসুবিধা হবেনা এমনটাই আশা ছিল তার। ফোনে শাশুড়িমা- শশুরের কাছে আশীর্বাদ চেয়ে বিদায় নিলাম ওটিতে ঢুকে যাবার আগে । মা আর স্বামী দুজনেই চিন্তিত মুখে আর ছলছল চোখে বিদায় জানালো আমায়।

হেঁটে যেতে শুরুতেই আমার জুতো খুলে নিতে বললো কিন্তু অন্য কোন জুতো দেয়া হলনা। হাসপাতালের ময়লা জীবাণু কল্পনা করে খুবই অস্বস্তি হচ্ছিল , ডাস্ট এলার্জির জন্যে খালি পায়ে হাঁটতে আমার ভালোও লাগছিলনা আর ঐ ভারী শরীরে হাঁটতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল । হাঁপাচ্ছিলাম, ঘেমে গিয়েছিলাম আর অনুরোধ করছিলাম একটা ট্রলিতে নিতে। কিন্তু আয়া ‘এইতো আরেকটু’ বলে বলে নিয়ে যাচ্ছিল তো যাচ্ছিলই। দোতলায় উঠে অন্য একটা ওটির বাইরের ট্রলি পাওয়া গেল অবশেষে একটা।ওটিতে নিয়ে ক্যানুলা করিয়ে যখন ক্যাথেটেরাইজড করানো হচ্ছিল , প্রথমবার বুঝতে পারলাম আমার রোগীনিদের কেন অত অস্বস্তি লাগতো । সব সময় রোগীদের কাউকে নরম স্বরে আর কাউকে গরম হয়ে বলতাম “শুনেন আমরা প্রতিদিন ২০/২৫ জনকে এভাবে ক্যাথেটার পরাই, কাজটা ভালোভাবে করার চেষ্টা করি তখন। রোগীর দিকে কেউ অন্য চোখে তাকায় না”।

একই কথা আমার বেলায়ও প্রযোজ্য ছিল, কিন্তু মন মানছিলনা কিছুতেই ।ওটি বেডে শোয়ানোর পরে এনেস্থেটিস্ট আমাকে বলতে শুরু করলেন তিনি আমাকে ছোটবেলায় কবে কখন দেখেছেন, বাড়িয়ে দিলেন আমার অস্বস্তি । বাবাকে নিয়মের দোহাই দিয়ে চলে যেতে বললেন, আমি বাবার দিকে তাকিয়ে হেসে সাহস দিলাম যে আমার অসুবিধে হবেনা । এনেস্থেসিয়া হবার পরে যখন অপারেশন শুরু হল, মনে হচ্ছিল আমি সবই হাল্কা হাল্কা টের পাচ্ছিলাম , নিজের confusion দূর করতে একবার জিজ্ঞাসাও করে ফেললাম ‘ আঙ্গকেল আমি তো সবই বুঝতে পারছি মনে হচ্ছে, এমনই কি হয়?’ , উনি বললেন ‘তোমার মনের ভুল এটা’।

এক পর্যায়ে পাশে তাকিয়ে দেখি ওটি দরজার চৌকো কাঁচে বাবার মুখ দেখা যাচ্ছে। সেই মুখ হঠাত হেসে উঠতেই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ৯।৪৫ মিনিট বাজছে । মাথার কাছে এনেস্থেটিস্ট আংকেল হেসে বললেন তোমার মেয়ে হয়েছে, এখুনি মুছিয়ে নিয়ে আসবে।আমি বারবার তাকাচ্ছিলাম যেদিকে মোছাতে নিয়ে গেল সেদিকে , চিন্তা করছিলাম ওরা কি আমার পছন্দের জামাটা মেয়ের পরাবার জন্যে দিতে পেরেছে? কাঁথাটা দিতে পেরেছে তো? তোয়ালে দিয়েছে? আমি তো একটাই কাঁথা রেখে এসেছিলাম, যদি আরো লাগে ওরা সবাই পারবে তো দিতে?

ভাবতে ভাবতেই আমার সবুজ শাড়ির কাঁথায় মোড়ানো লাল টুকটুকে জামা পরা একটা ছোট্ট পুতুলকে পাশে নিয়ে এলো আয়া। শুনেছিলাম হাসপাতালে বাচ্চা বদলে যায় , খুব ভাল করে দেখে চিনে রাখার চেষ্টা করলাম মেয়েকে যেন বদলে না দেয়।

“আপনার ধর্মে আলহামদুলিল্লাহ’র মত যেইটা আছে সেইটা বলেন” বলে আয়া আমার গালে ছুঁইয়ে দিলো আমার সন্তানের গাল । আমার ডান গালে হালকা ঠান্ডা নরম স্পর্শে তখন অনেক বিস্ময় আর অনেক অনেক আনন্দ ! আমার শরীরের অংশ , আমার স্বপ্নের টুকরা আমার আমার চোখের সামনে ।

বিশ্বাস হচ্ছিল না যেন এই বাচ্চাটাই আমার শরীরে ছিল ! সত্যিই এ-ই ছিল তো (যদিও চিকন চোখ আর চাপা নাকে মেয়ের বাবার চেহারার আদলে সন্দেহ করবার মত আদৌ কিছু ছিলনা) । মায়া , ভালোবাসা, প্রতীক্ষা শেষের খুশী নেমে আসছিল চোখ বেয়ে !এরপরেও ঐ ওটিতেই আবারো কাঁদতে হয়েছিল, কাঁদতে কাঁদতে ঘামতে হয়েছিল এনেস্থেশিয়ার ঔষধের কার্যকারীতা শেষ হয়ে যাওয়ায় । কিন্তু সারাক্ষণ ঈশ্বরের কাছে বাঁচিয়ে রাখবার প্রার্থনা করছিলাম শুধু মেয়ের কাছেই ফিরে আসবার আকাংক্ষায়। প্রথম দেখায় কিংবা দেখারও আগে যাকে ভালবেসে ফেলেছিলাম তাকে এরো একবার দেখবার আকাংক্ষায়।

ফরমাল লেকচারার
শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ, ঢাকা

 

ঝড়ের দিন: পর্ব-৪

তানজীল আহমদ সিদ্দিকী


গাঁয়ে মিলিটারি ঢোকার পর থেকে সন্ধ্যা হলেই পুরো গ্রাম শ্মশানঘাটের মতো নিস্তব্ধ হয়ে যায়। কিছু কিছু বাড়ি থেকে মিটিমিটি কূপির আলো দেখা যায়, বাকি বাকিগুলোতে তাও চোখে পড়ে না। জীবিত মানুষগুলো বেঁচে থাকার তাগিদে মৃতের ছদ্মবেশ ধরে। সময়টাই এমন। আলোতেও ভয় কাটে না বরং চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে। মিলিটারিরা যদি আলো দেখে বাড়িতে এসে কড়া নাড়ে? তাই পুরো বাড়ি অন্ধকার করে রেখে মানুষগুলো একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁপে। প্রার্থনা করে আরেকটা সূর্যোদয়ের।
সন্ধ্যে হয়ে গেছে। চারদিকে লালচে অন্ধকার। আকাশের দিকে তাকালে একটা দুটো তারা চোখে পড়ছে। খেয়াঘাটে কেউ নেই। শুধু দুটো নৌকা দুলকি চালে ভাসছে। খুঁটির সাথে বাঁধা সেগুলো। ভোর হলে পরে মাঝিরা এসে ভাসাবে। শুধুমাত্র একটা নৌকা খুব ধীরে আলতানগরের দিকে এগিয়ে আসছে। দূর থেকে তাকালে শুধু দাঁড় বাইতে থাকা মাঝিকে দেখা যাবে। ঘুণাক্ষরেও কেউ টের পাবে না যে নৌকার পাটাতনের নিচে আরো তিনটে মানুষ লুকিয়ে আছে। এরা হলো আসাদ, দীপক আর শেবু। একটা সশস্ত্র গেরিলা দলের রেকি টীম তারা। আজ রাতে আলতানগরে একটা গেরিলা এট্যাক হবে। রেকি দলের কাজ হলো শেষবারের মতো সবকিছু দেখে গিয়ে রিপোর্ট করা। নদীর ওপারেই বাকি যোদ্ধারা অপেক্ষা করে আছে। আসাদ আস্তে করে পাটাতন থেকে বেরিয়ে এলো। সুমন মাঝি অভ্যস্ত হাতে দাঁড় বাইছে। এই নদী তার নিজের হাতের তালুর মতো চেনা। রাতের অন্ধকারেও চোখ বন্ধ করে খেয়াঘাটে নৌকা ভেড়াতে পারে সে। আসাদ ছইয়ের ভেতরে ঢুকে পড়লো। পাড় থেকে কেউ লক্ষ রাখলে মাঝি ছাড়া আর কাউকে দেখবে না। তারপর সেখান থেকেই কথা বলতে লাগলো সুমনের সাথে।
‘ সুমন ভাই, গ্রামের অবস্থা কিরাম? ‘
‘ ভালা নারে ভাই। পাকিস্তানি বেজন্মাগুলা মশামাছির মতো মানুষ মারে। বাড়ি থেকে মেয়েদের উঠায়া ক্যাম্পে নিয়া যায়। নজর কুত্তাটায় হেগোরে পথ দেখায়। নজর আর মিলিটারির ভয়ে গেরামের মানুষ ঘর থিইকানই বাইর হয় না। দিনে যাও বা বাইর হয়, রাইতে তো পুরা গেরাম শ্মশান হয়া যায়। এশার ওয়াক্তে মসজিদে এক কাতার মানুষও হয় না! ‘
বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আসাদ। ছমাস আগে যখন ঘর ছেড়েছিলো তখন মুসেগুলেও পরিস্থিতি এমনই ছিলো। বরঞ্চ আরো খারাপ ছিলো। শুক্রবার হাট বেলায় মুসেগুল বাজারে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলো পশুগুলো। তখন বাবার সাথে বাজারেই ছিলো আসাদ। হঠাৎ করে ‘ আগুন লাইগা গেসেরে ‘ চিৎকার শুনে আর সবার মতো সেও দৌঁড়েছিলো রুদ্ধশ্বাসে। পেছনে ব্রাশ ফায়ারের আওয়াজ। দাউ দাউ করে জ্বলছে দোকানপাট। মানুষজন চেঁচাতে চেঁচাতে দৌঁড়ুচ্ছে। এদিন যেন নরক নেমে এসেছিলো সেখানে। দৌড়ুতে দৌড়ুতে কখন যে বাজার থেকে বহুদূরে চলে এসেছে খেয়াল করতে পারেনি আসাদ। আব্বা কোথায় গেলেন! সাথে সাথে দৌড়ে বাজারে ফিরেছিলো সে। জন্মদাতা পিতার অর্ধদগ্ধ লাশটা পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার করে উঠতে গিয়েও থেমে গিয়েছিলো আসাদ। পিতার অর্ধদগ্ধ লাশটা কাঁধে তুলে নিয়ে চুপচাপ হাঁটা দিয়েছিলো সে। যত্রতত্র পড়ে থাকা দগ্ধ, অর্ধদগ্ধ, ব্রাশফায়ারে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া লাশগুলো টলাতে পারেনি তাকে। শত মানুষের হাহাজারিতে ভারি বাতাসে খুব অল্প অল্প করে কিছু দীর্ঘশ্বাস পড়ছিলো তার। সেই দীর্ঘশ্বাসগুলোর সাথে বেরিয়ে যাচ্ছিলো সব আবেগ। শুধু রয়ে গেছিলো বুকভর্তি ঘৃণা। নিজ হাতে বাবাকে দাফন করে বাড়ি ফিরেছিলো আসাদ। শোকে কাতর মা আর ছোট ভাই-বোন দুটোকে নিজে পৌঁছে দিয়ে এসেছিলো মামাবাড়িতে। তারপর কদিনের ভেতরেই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে চলে গিয়েছিলো ইন্ডিয়া। দু সপ্তাহ হলো সেখান থেকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে একজন প্রশিক্ষিত গেরিলা হিসেবে আবার নিজ জন্মভূমিতে ফিরেছে আসাদ। তার পিতার মতো এমন হাজারো পিতার মৃত্যুর বদলা নিতে হবে তাকে। সন্তানহারা হাজারো মায়ের চোখের পানির বিনিময়ে স্বাধীনতার রক্তলাল সূর্যটা ছিনিয়ে আনতেই হবে।
সুমন মাঝি অভিজ্ঞ হাতে নৌকা ভিড়ালো ঘাটে। আসাদ আস্তে করে ডাক দিলো বাকি দুজনকে। দীপক আর শিবু তাদের স্টেনগান হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো। মাঝিকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে আসাদ তার দুই সঙ্গীকে নিয়ে সামনের বাঁশঝাড়ে ঢুকে গেলো। ঘন বাঁশঝাড়ে বসে তারা আরেকটু রাত হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলো। আসাদ চুপচাপ পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে। শিবু একটা বিড়ি ধরিয়ে অন্য হাতে ধরে রাখা স্টেনগানটার দিকে তাকিয়ে রইলো। নির্লিপ্ত মানুষ সে। কখনো মুখ দেখে তার মনের ভাব ধরতে পারা যায় না। আসাদ বুঝতে পারে না এই মানুষটাকে। নিজের সম্পর্কে কাউকে কিছু বলে না শিবু। শুধু নির্লিপ্ততার মূর্তিমান উদাহরণ হয়ে অস্ত্র কাঁধে হেঁটে বেড়ায় যতদূর শত্রুপক্ষের সীমানা কাঁটাতার দিয়ে আলাদা করে দেওয়া। দীপক কিছুক্ষণ থেকেই কেমন উশখুশ করছে। নৌকায় শিবুর সাথে বসে থাকার দরূণ কথা বলার সুযোগ পায়নি বেচারা। এখন কথা বলার একটা ছুঁতো খুঁজছে। দীপক দলের সবচেয়ে কনিষ্ঠতম সদস্য। তার কৈশোরসুলভ চঞ্চলতায় পুরো মুক্তি ক্যাম্প মাতিয়ে রাখে সে। আসাদ ব্যাপারটা খেয়াল করে জানতে চাইলো, ‘ দীপক, কিছু বলবা? ‘
‘ আমরা রওনা হমু কখন? ‘
‘ আরেকটু অন্ধকার নামুক, তারপর। ‘
দীপক কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলো। মায়ের সাথে একবার দেখা করে আসতে মন টানছে তার। মুখ ফুটে সেকথা কি করে বলে! আরেকটু বাদেই তাদের মিশন। আসাদ বুঝতে পারলো। সব আবেগ সেদিন চলে যায়নি তার। দু, আপনজনের অনুপস্থিতির বেদনা সবই পোড়ায় তাকে। আসাদ কোমল স্বরে দীপককে বললো, ‘ মায়ের লাইগা মন টানে? ‘
দীপক মাথা নিচু করে আস্তে করে শুধু ঘাড়টা উপর-নিচ করলো। আসাদ তাকে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে দিলো। তবে শর্ত দিয়ে দিলো যে খুব সাবধানে থাকতে হবে এবং এক ঘণ্টার ভেতরেই চলে আসতে হবে। খুশিতে দীপকের মুখটা চিকচিক করে উঠলো। তারপর স্টেনগানটা শালের ভেতরে রেখে বেরিয়ে এলো বাঁশঝাড় থেকে। সতর্ক পায়ে হাঁটা দিলো বাড়ির দিকে। হতভাগিনী মা তার পথ চেয়ে আছেন।
দীপক যাওয়ার ঘণ্টাদেড়েক হয়ে গেছে। এখনো আসার নামগন্ধ নেই। আসাদ অধৈর্য হয়ে পড়লো। ধরা পড়ে গেলো না তো ছেলেটা? সে শিবুকে জানালো তার আশংকার কথা। শিবু নির্লিপ্ত মুখে বললো, ‘ আমারো তাই মনে হইতেসে। ‘ সদা নির্লিপ্ত শিমুর কণ্ঠে শংকার আওয়াজ পেয়ে আসাদের ভয় লেগে উঠলো। সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো সে। দীপকের বাড়ি পর্যন্ত যাবে তারা, গিয়ে দেখবে দীপকের আসতে এত দেরি হচ্ছে কেন। আসাদ প্রথমে সুমন মাঝিকে গিয়ে জানালো যে, যদি ঘণ্টাখাকের মধ্যে তারা কেউ না ফিরে তবে যেন সে ওপারে গিয়ে কমান্ডারকে খবরটা দেয়। তখন তিনি যা ভালো বুঝবেন তা করবেন। তারপর শিবুকে সাথে নিয়ে ঝোঁপঝাড় ঘেষে দীপকের বাড়ির দিকে হাঁটা দিলো আসাদ। ছেলেটার কিছু হয়ে গেলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না সে।
দীপকের মা তার বুকের মানিককে কাছে পেয়ে আনন্দে একদম আত্মহারা হয়ে গেলেন। একবার হাসতে হাসতে ছেলের সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দেন, তো আরেকবার বুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদেন। ছেলে বেঁচে আছে এটাই যেন তাঁর বিশ্বাস হচ্ছে না। দীপক অনেক কষ্টে তার মা-কে শান্ত করলো। বুঝিয়ে বললো যে আজ রাতে তাদের একটা মিশন আছে। তাই হাতে একদমই সময় নেই। বিচলিত মা শান্ত হলেন। ছেলের জন্য গরম গরম ভাত রাঁধতে বসে গেলেন। দীপক মায়ের পাশে বসে তার গেরিলা দলের গল্প করতে লাগলো। এমন সময় বাইরে কে যেন কড়া নাড়লো। সাথে সাথে দীপক স্টেনগান বের করে ফেললো। ফিসফিস করে তার মা কে বললো, ‘ আমি খাটের নিচে লুকাইতেসি। তুমি বাইর হয়া কও কেউ নাই ঘরে। ‘ পুত্রের বিপদের আশংকায় কাতর মা দরজা ঠেলে বাইরে বের হলেন। নজর আলি আর বেশ কজন মিলিটারি দাঁড়িয়ে আছে!
‘ ঘরে কে? ‘
দীপকের মা ঘোমটার আড়াল থেকে জবাব দিলেন, ‘ কেউ নাই। আমি একলা।’
নজর আলির কাছে খবর এসেছে গ্রামে মুক্তি ঢুকেছে। আর গ্রামের যেসব ছেলের নাম মুক্তি সন্দেহে লিস্টে তোলা আছে, সেখানে দীপকের নামও আছে। তাই নজর আলি দীপকের মায়ের কথা বিশ্বাস করলেন। তিনি ইশারা করতেই দুজন সৈন্য সামনে এগিয়ে এলো। তারপর বন্দুকের বাঁট দিয়ে এক বাড়ি মেরে মাটিতে শুইয়ে দিলো। মহিলা আর্তচিৎকার করে উঠলেন। নজর আলি তার বুকে একটা লাথি দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ দীপক কুত্তার ছাওটা কই? ‘
মহিলা মুখ ভর্তি থুতু ছুড়ে মারলেন নজর আলির মুখে। ক্ষেপে গিয়ে নজর আলি আরেকটা লাথি মারলেন বৃদ্ধাকে। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠলেন মহিলা। আর সহ্য করতে পারলো না দীপক। স্টেনগান হাতে দৌড়ে চলে আসলো বাইরে। ‘ বেজন্মার বাচ্চা ‘ বলে স্টেনগান দিয়ে বাড়ি মেরে দিলো নজর আলি। নজর আলি বাড়ি খেয়ে পড়ে যেতে যেতে চিৎকার করে উঠলেন, ‘ গোলি মাত করো। জিন্দা পাকড়াও ইসে। ‘ পাক সৈন্যরা ঘিরে ফেললো দীপককে। নজর আলি মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থায় চিৎকার করে বললেন, ‘ একদম নড়বি না, দীপক। নইলে তোর মা রে মাইরা ফালামু। ‘ কথাটা শুনে দীপক তার হাতের স্টেনগান ফেলে দিলো। সাথে সাথে এক সৈন্য বন্দুকের বাঁট দিয়ে বাড়ি মেরে দিলো দীপকের মাথায়। অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো দীপক। তারপর সেই অজ্ঞান দেহকেই মরা কুকুরের মতো টেঁনে হিঁচড়ে ক্যাম্পের দিকে নিয়ে চললো। সবার আগে নজর আলি। স্টেনগানের আঘাতে মাথার চামড়া কেটে রক্ত পড়ছে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তার। গ্রামে মুক্তি ঢুকেছে! তিনি এতদিন শুধু শুনেছেন দেশের বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিরা গেরিলা হামলা চালাচ্ছে। আলতানগরেও যে মুক্তি ঢুকবে স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি তিনি। এই বেজন্মাটার থেকে সব কথা বের করতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতে জোর পদক্ষেপে হাঁটতে লাগলেন নজর আলি। দীপকের বাড়ির সামনে তার বৃদ্ধা মা তখন ফ্যালফ্যাল করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। উপরে বোধহয় ভগবান বলে কেউ নেই। নইলে তার সৃষ্ট মর্ত্যে পিশাচেরা হাসিমুখে হেঁটে বেড়ায় কি করে? বাঁশঝাড়ে শনশন করে বাতাসের ফিসফিসানি উঠে। এক অসহায় মায়ের বোবা কান্না ধীরে ধীরে ঘুরপাক খায় পিশাচের রাজত্বে।(চলবে)

এইচ এস সি শিক্ষার্থী
চট্টগ্রাম

 

প্রসব পরবর্তীকালীন বিষণ্ণতা

ডা.সংগীতা হালদার রায়


কিছুদিন আগে এক দাওয়াতে গিয়ে ‘বেবি ব্লুজ’ বা ‘প্রসব পরবর্তীকালীন বিষণ্নতা’ নিয়ে কথা উঠেছিলো।

টেবিলে বসা পুরুষদের একাংশের ধারণা এটা মর্ডাণ মেয়ে / মায়েদের হয় যেহেতু তারা ক্যারিয়ার / শপিং / স্টাইলিং ইত্যাদিকে জীবনে অত্যাধিক প্রাধান্য দিয়ে থাকেনন যা আগের যুগের মায়েদের বেলায় হত না।

সেই রাত থেকেই মনে হচ্ছে একজন ডাক্তার ও মা হিসেবে আমার উচিত আমার বন্ধুদের কিছু জানানো যা আমি জানি;

বেবি ব্লুজ : বই অনুযায়ী ৭০% – ৮০% মায়েদেরই হয়। আমার ধারণা আরো বেশি সংখ্যায় হয়ে থাকে কিন্তু ডাক্তারের কাছে ‘কেস’ খুব কম আসে বলেই বই এ ডকুমেন্টারি কম আছে।

হওয়ার কারণ : প্রেগন্যান্সির সময় প্রয়োজনয়ীয় হরমোন ১০০ – ১০০০ গুন (100- 10000 fold decrease) কমে যাওয়া এবং MAO – A হরমোনের হঠাৎ বেড়ে যাওয়া যা ব্রেইন সেলে বিষণ্নতা উৎপন্নকারী হরমোন বাড়িয়ে দেয় ।

সময় : প্রসবের পর থেকে শুরু হয় এবং ২-৩ সপ্তাহ স্থায়ী হয় সাধারণত । দিনে কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘন্টা হতে পারে এর স্থায়ীত্বকাল ।

স্টেজ: মোটা দাগে তিন ভাগে ভাগ করা যায় ।

(লক্ষণ সমূহ হিসেব করলে ডাক্তারী হিসেব মতে মোট ৬ টা স্টেজ , কিন্তু যারা ডাক্তার নন আবার সচেতন থাকতে চান তারা তিনটা জানলেই চলবে )

ক) বেবি ব্লুজ
মন খারাপ হয় কারণ ছাড়া, শুধু শুধুই কান্না পায় ( weeping ), খুব বেশি গুরুতর কারণ ছাড়াই বিরক্তি লাগে , মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে , বাচ্চা ও বাচ্চার যত্ন নিয়ে অতিরিক্ত টেনশন হয় (বাচ্চার বাবার কোলে বাচ্চা দিতেও টেনশন হয় )

প্রতিকার
শুধু মিষ্টি ব্যবহার , সহানুভূতিসম্পন্ন কথা ও ব্যবহার (তুমি ঠিক পারবে , সবারই এরকম অসুবিধা হয় আর এটাই স্বাভাবিক) বাচ্চা সামলাতে সহানুভূতিশীল সাহায্যই যথেষ্ট’
‘আমরা তো অমুক করেছি’ বা ‘আমরা যেন আর বাচ্চা সামলাই নাই ‘ টাইপ কথা বলা মানুষজনকে ১০০ x ২ = ২০০ হাত দূরে রাখা খুব দরকার।

খ) পোস্টপারটাম ডিপ্রেশন 
বাচ্চা হবার তিন মাস পরেও যখন লক্ষণসমূহ থেকেই যায় বরং আগের সমস্ত লক্ষণ আরো প্রকট হয় , নিজের ছোট্ট বাচ্চাকে সহ্য করতে না পারা , নিজের উপরে নিজের অসন্তোষ , নিজের ক্যারিয়ার + নিজের রূপ সবকিছু নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগা, নিজের জীবনের প্রতি মায়া চলে যাওয়া।

প্রতিকার
কোন এমন মানুষের সাথে মনের কথা বলা যার উপরে মা পূর্ণ বিশ্বাস রাখেন , বাচ্চা সামলানোর জন্যে সাহায্যকারী যাতে মা অন্য কিছু করেও নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে পারেন, একটু কোথাও ঘুড়ে আসা তা পাশের পার্কেও হতে পারে

গ) পোস্টপারটাম সাইকোসিস 
মা মনে করতে থাকেন শুধু তিনি মরে গেলেই মানুষ বুঝবে যে তিনি তার শিশুকে কত্ত ভালোবাসতেন , আত্মহত্যার প্রচেষ্টা এবং শিশুকে মেরে ফেলার ঘটনাও লিপিবদ্ধ আছে ।

পরিশেষে বলবো , এরকম আগেও হত ( ঘরে ছোট ভাইবোন আসার পরে মায়ের পিট্টি খাওয়া বা অতিরিক্ত কাজের চাপ নিয়ে মায়ের খিটখিটে হয়ে যাওয়া বা মা- বাবার / মা- দাদীর ঝগড়া বেড়ে যাওয়ার স্মৃতি মনে করে দেখুন ) আর এর সাথে ‘MODERNISM’ কোন সম্পর্ক নেই ।

‘উত্তম ব্যবহারেই উন্নত বংশের পরিচয়’ আর ‘সৃষ্টিকর্তাও একজন প্রসবিনীর প্রসব-পূর্ব সমস্ত পাপ মাফ করে দেন’ এগুলো তো অনেক প্রচলিত জানা কথা ।
কাজেই একটু ধৈর্য ধরে সহানুভূতিশীল ব্যবহার করুন। কারণ প্রতিটি মা-ই তার সন্তানকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন । তাকে মন ও শরীরে সম্পূর্ণ সুস্থ একজন মা হয়ে ওঠার সময়টুকু দিন প্লিজ।

ফরমাল লেকচারার
শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ, ঢাকা

 

রাজধানী শহর ঢাকায় দূষণ বেড়েছে ৮০ ভাগ

বাতাসকে পরিশুদ্ধ করতে পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোর একটি প্রচেষ্টা স্পষ্টতই সাফল্য পেয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। গত দশ বছর ধরে মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসা’র একটি স্যাটেলাইটের পর্যালোচনায় এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

অরা মিশন নামের এই স্যাটেলাইটটি ২০০৪ সালে উৎক্ষেপণ করা হয় বিশ্বজুড়ে নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইডের নিঃসরণ পর্যবেক্ষণ করতে।

পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে এই দূষণের মাত্রা কমেছে। কিন্তু একই সময়ে বাংলাদেশ-সহ এশিয়ার কিছু দেশে দূষণের হার বেড়েছে। বিশেষ করে ঢাকায় এই দূষণের হার গত দশ বছরে বেড়েছে শতকরা আশি ভাগ পর্যন্ত। আর চীনে এই বৃদ্ধির হার শতকরা ২৫ ভাগ।
অপরপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে গত দশ বছরে নাইট্রোজেন দূষণের হার কমে গেছে শতকরা ২০ থেকে ৫০ ভাগ পর্যন্ত।

সার্বিক বিচারে গত দশ বছরে বিশ্বে গড়ে এই গ্যাসের দূষণ অবশ্য কমেছে শতকরা ১৪ ভাগ হারে। নাইট্রোজেন ডাইঅক্সাইড গ্যাস মূলত জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানোর ফলে নিঃসারিত হয়।

সংক্ষেপে ‘এনওটু’ নামে পরিচিত এই গ্যাসটির মূল উৎস গাড়ির নির্গমন পাইপ ও কয়লা পোড়ানো হয় এমন শিল্প কারখানা।

হলদে-বাদামী এই গ্যাস মানুষের শ্বাসযন্ত্রে মারাত্মক প্রদাহের কারণ। এটি বায়ুমণ্ডলের নিম্নভাগে ওজোন গ্যাস বাড়াতেও ভূমিকা রাখে।

অরা মিশন থেকে প্রাপ্ত গত দশ বছরের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এর ফলাফল আমেরিকান জিওফিজিক্যাল ইউনিয়নের এক বৈঠকে উপস্থাপন করেন বিজ্ঞানীরা।
সুত্র: ইন্টারনেট

 

ঝড়ের দিন: পর্ব – ৩

তানজীল আহমদ সিদ্দিকী


যে রাতে মেজর ওয়াসিম খানের নির্দেশে নকূল বাউলকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়, তার পর চার চারটে মাস পেরিয়ে গেছে। আলতানগরের পরিবেশ আর আগের মতো নেই। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এখন আর ক্ষেতের আইল জুড়ে ঘুড়ি হাতে উড়ে বেড়ায় না। জমির উদ্দিনের বাড়ির উঠোনে এখন আর মার্বেল খেলার আসর জমে না। রাতের বেলা ছোট বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতে গেলে মায়েদের আর বর্গির গল্প করতে হয় না, উড়ে এসে জুড়ে বসা হায়েনার দলকে এখন তারা ভালোভাবেই চেনে। আজকাল মাগরিবের আজান পড়ে গেলে সে-ই যে সবাই ঘরে ঢোকে, বিশেষ কোন প্রয়োজন না পড়লে ভোর হওয়ার আগ পর্যন্ত কেউ বের হয় না। মড়ক লাগা গ্রামে যেমন চারদিক সুনসান থাকে, আলতানগরের অবস্থাও এখন তেমনি। মড়ক এখানেও লেগেছে, আতংকের মড়ক।
নজর আলির পরামর্শ মতো গ্রামের স্কুলেই মিলিটারিরা ক্যাম্প বসিয়েছে। আশপাশের দশ-বারোটা গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে বড় ক্যাম্প এটাই। মুসেগুল থেকে জীপভর্তি সৈন্য এনে এখানে মোতায়েন করা হয়েছে। তাদের অত্যাচারে গ্রামবাসীর জীবন বাঁচানো দায় হয়ে পড়েছে। প্রায় প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে মশামাছির মতো মেরে ফেলা হয়। মানুষ মারতে তাদের কোন অজুহাতের প্রয়োজন পড়ে না তাদের। দুদিন আগে দুজন মিলিটারি ক্ষেতের আইল দিয়ে হাঁটছিলো। সেখানে তাদের একটা মোটাসোটা ছাগী চোখে পড়ে। ক্ষেতে গাঁড়া খুঁটিতে বাঁধা ছিলো ওটা। মিলিটারি দুজন দড়ি খুলে সেই ছাগল নিয়ে হাঁটা দেয় ক্যাম্পের দিকে। এমন সময় ছাগলের মালিক দৌঁড়ে এসেছিলো। মিলিটারি দুজনের পায়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো ছাগীটা না নিয়ে যেতে, গরীব মানুষ ও। অসহায় মানুষটাকে বন্দুকের বাঁট দিয়ে মারতে মারতে ক্যাম্পে নিয়ে গেছিলো ওরা। পরদিন সকালে, গ্রামবাসীরা রাস্তার একধারে খুঁজে পায় হতভাগ্য লোকটার মৃতদেহ। নকূল বাউলের মতোই ফেঁড়ে ফেলা হয়েছে দেহটা। টুঁ শব্দটি করতে পারেনি কেউ। হাতে দা-কাস্তে নিয়েও নিশ্চল দাঁড়িয়ে ছিলো তারা। রাইফেল কাঁধে পিশাচের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর হিম্মত তাদের নেই। দুমাস আগে এই মানুষগুলোই তপেশ মাস্টারের বাড়িতে বসে শেখ সাহেবের কণ্ঠে যখন শুনেছিলো – ” এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ” তখন চোখে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলো। কোদাল আর কাস্তে হাতে মিলিটারির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা ভেবেছিলো। সব স্বপ্নের আগুন নিভে গেছে। পরিবার পরিজন নিয়ে একেকটা দিন বেঁচে থাকাটাই যখন সংগ্রাম, স্বাধীনতার স্বপ্ন তখন কুহকিনীর মিথ্যে আশ্বাস।
আজকাল নজর আলির কাজের অন্ত নেই। পিস কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তার কাঁধে এখন প্রচুর দায়িত্ব। মেজর সাহেবের খেদমতের দায়িত্ব তিনি নিজ হাতে কাঁধে তুলে নিয়েছেন। মেজর সাহেবের প্রতিবেলার খানাদানা থেকে শুরু করে অবসর সময়ে বিনোদনের ব্যবস্থা পর্যন্ত সবকিছু তিনি নিজে দেখভাল করেন। মেজর সাহেব বহুদিন ধরে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। জোয়ান মানুষ, শরীরে যে মাঝেমধ্যে বেচাইন করে সে তিনি ভালোভাবেই বোঝেন। তাই অবসর সময়ে একটু আধটু বিনোদনের জন্য মাঝেমধ্যেই ক্যাম্পে মেয়ে পাঠান তিনি। গ্রামে কোন কোন ঘরে সুন্দরী যুবতী আছে সব তার জানা। সেসব ঘর থেকেই যুবতী মেয়েদের জোর করে তুলে আনেন তিনি। সৈন্যরাই টেনে হিঁচড়ে বের করে আনে, তিনি শুধু প্রয়োজনীয় নির্দেশটুকু দেন। এই তো সেদিনই জামাল নাপিতের বড় মেয়েটাকে তুলে আনতে গেছিলেন। চোখ ধাঁধানো রূপ মেয়ের। মেয়েটাকে কায়দামতো পেলে তিনিই ভোগ করতেন, মেজরের জন্য নিয়ে যেতেন না। সৈন্যরা যখন টেনে হিঁচড়ে বের করছিলো মেয়েটাকে, জামাল নাপিতের বৌটা দা হাতে ছুটে এসেছিলো তার দিকে। আরেকটু হলেই ঘাড় থেকে তার মাথাটা নেমে যেতো যদিনা এক সিপাহী মহিলাকে গুলি না করতো। নজর আলি মেয়েটাকে সেদিন তার মায়ের লাশের উপর দিয়ে টেনে হিঁচড়ে এনে ক্যাম্পের একটি ঘরে ছুঁড়ে ফেলেছিলেন। পরে শুনেছিলেন শুধু মেজর না, ক্যাম্পের প্রায় সব সৈন্যই সেদিন রাতটা সেই ঘরে কাটিয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত মেয়েটার পরিণতি কি হয়েছে সেটা জানা নেই তার, জানার ইচ্ছেও নেই। এমন কত গণিমতের মাল আসবে আর যাবে!
শেষ বিকেল। সূর্য বিদায় নেবার আগে তার শেষ রশ্মিটুকু অকাতরে বিলাচ্ছে। বাড়ির উঠোনে সেই রশ্মিগুলো কানামাছি খেলছে। তপেশ মাস্টার জানালা দিয়ে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে আছেন। বয়স তার চল্লিশের উপর। শান্ত সৌম্য চেহারা। জুলফির গোড়ায় খানিক পাকা চুল ছাড়া বয়সের চিহ্নমাত্র পাওয়া যায় না। তবে এ কদিনে স্বাস্থ্যের বেশ অবনতি ঘটেছে তার। আর হবে নাই বা কেন! মাত্র কয়েক মাসে সবই কেমন ওলটপালট হয়ে গেছে। মূর্খ পশুগুলো তার স্কুলটা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে। সেখানে তারা ক্যাম্প বসিয়েছে। যে ঘরগুলোতে বসে বাচ্চারা অ আ শিখতো, সেই ঘরগুলোতে এখন মানুষ জবাই হয়। মা-বোনের ইজ্জত লুণ্ঠিত হয়। সব দেখে শুনেও কিছু করতে না পারার অক্ষমতার গ্লানিতে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছেন তিনি। কদিন ধরে কানাঘোষা শুনছেন দেশের অনেক জায়গায় নাকি পাক হানাদারদের সাথে খন্ড খন্ড যুদ্ধ হচ্ছে। সর্বস্তরের সাধারণ মানুষরাই এই যুদ্ধে শামিল হয়েছে। আশেপাশের গ্রামের অনেকেই নাকি ইন্ডিয়ায় পালিয়ে গেছে। সেখান থেকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে আবার দেশে ঢুকবে। তারও ইচ্ছে হয় সেই সংগ্রামীদের সাথে যোগ দিতে কিন্তু সন্তান সম্ভাবা স্ত্রী আর ছোট বোনটাকে এই নরকে ফেলে রেখে যাবেনই বা কি করে? তিনি কিংবা তাঁর স্ত্রী কারোরই তিনকূলে কেউ নেই যে কোন আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে উঠবেন। শেষপর্যন্ত মনে হচ্ছে ইন্ডিয়াতেই পালিয়ে বাঁচতে হবে। এমন সময় একটা ডাকে তপেশ মাস্টারের ভাবনায় ছেদ পড়লো।
‘ মাস্টার! ও মাস্টার! একটু বাইরে আহো।
তপেশ মাস্টার চিনতে পারলেন গলাটা। নজর মেম্বার এসেছে। লোকটা সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত, যখন যেখানে যায় মৃত্যুর দুর্গন্ধ ছড়ায়। তিনি তাড়াতাড়ি তার বোন আর স্ত্রী-কে ডেকে বললেন, ‘ তোমরা কিছুক্ষণ বাড়ির পেছনে খড়ের গাদায় লুকিয়ে থাকো। আমি না বলা পর্যন্ত বের হবা না। ‘ বিনাবাক্য ব্যয়ে তারা তার নির্দেশ মেনে বাড়ির পেছনে চলে গেলো। তপেশ মাস্টার উঠোনে গিয়ে দেখলেন নজর আলি, সবুজ আর পাঁচ-ছজন মিলিটারি দাঁড়িয়ে আছে।
‘ কি ব্যাপার মেম্বার? এসময়ে এখানে? ‘
‘ মেজর সাব তোমারে তলব করসেন,মাস্টার। পুরা পরিবার সহ। ‘
‘ আমি ওদের আগেই অন্য জায়গায় রেখে এসেছি। আর তোমার মেজরকে গিয়ে বলে দিও, আমি তার হুকুমের চাকর নই যে তিনি তলব করলেই সাথে সাথে দৌঁড় দেবো। দরকার পড়লে তিনি নিজে এসে যেন আমার সাথে দেখা করে যান। ‘
‘ তোমার তেজ খুব বাড়সে, মাস্টার। ছুটাইতেসি তেজ ‘, বলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সিপাহীকে হাত দিয়ে ইশারা দিলেন। সাথে সাথে সেই সিপাহী তপেশ মাস্টারের তলপেটে সজোরে লাথি মারলো। তপেশ মাস্টার মাটিতে ছিটকে পড়লেন। বাকি সিপাহীরা এবার এগিয়ে আসলো। বন্দুকের বাঁট দিয়ে উপর্যুপরি মারতে লাগলো মাস্টারকে। মাথায় একটা শক্ত বাড়ি খেয়েই তপেশ মাস্টার অজ্ঞান হয়ে গেলেন। নজর আলি তখন দুজন সৈন্যকে নির্দেশ দিলেন তপেশ মাস্টারকে যেন মরা কুকুরের মতো হিঁচড়ে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। আর বাকি চর সৈন্যকে নির্দেশ দিলেন পুরো বাড়ি খুঁজে দেখতে। মেয়েমানুষ দুটো যাবে কোথায়! একটু বাদেই নারীকণ্ঠের চিৎকার শোনা গেলো। সৈন্যরা নির্দয় হাতে টেনে হিঁচড়ে তপেশ মাস্টারের ষোড়শী বোন আর সন্তানসম্ভবা স্ত্রী-কে নিয়ে এলো। তপেশ মাস্টারের বোনকে দেখে নজর আলির ভেতরে আবার কামনার আগুন জ্বলে উঠলো। মেয়েটাকে ঘরে আটকে রেখে এখানেই…! না, নজর আলি নিয়ন্ত্রণ করলেন নিজেকে। ঘটনাটা জানতে পারলে মেজর রেগে যাবেন। নজর আলি তপেশ মাস্টারের বৌকে এখানেই শেষ করে দিতে বলে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যাওয়া মেয়েটার হাত ধরে টানতে টানতে ক্যাম্পের দিকে হাঁটা দিলেন। সাথে রইলো আরেক সৈন্য। বাকি তিন সৈন্য চিৎকার করে কাঁদতে থাকা অসহায় প্রসূতি মহিলাটাকে টানতে টানতে জঙ্গলের দিকে নিয়ে গেলো।
তপেশ মাস্টারের স্ত্রী সৈন্যগুলোর পায়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘ আপনারা আমার ভাইয়ের মতো। ছাইড়া দেন আমারে। ভাই হয়া বোনের ইজ্জত নিয়েন না। ‘
সৈন্যরা অট্টহাসি দিয়ে উঠলো। বাঙ্গালি নারী তো বরাবরই তাদের কাছে ভোগের সামগ্রী, ” বেহেন ” হতে যাবে কোন দুঃখে! মানুষের মতো দেখতে সেই হায়েনাগুলো তারপর ঝাঁপিয়ে পড়লো অসহায়ভাবে পড়ে থাকা সেই মহিলার উপর।
একটা নারীকে শারীরিকভাবে যত রকমভাবে অসম্মান করা যায়, সব করলো তারা। উপর্যুপরি কয়েকবার গণধর্ষণ শেষে হতভাগিনী মহিলা যখন তার মৃত্যুর প্রহর গুনছেন, তখন পশুগুলো তার পেট বরাবর বেয়োনেট চার্জ শুরু করলো। অবাক প্রকৃতি নিশ্চুপ শুনে গেলো এক মৃত্যুপথযাত্রী গর্ভবতী মায়ের অসহায় আর্তনাদ। পৃথিবীর প্রতি একরাশ ঘৃণা আর অভিমান নিয়ে তপেশ মাস্টারের হতভাগিনী স্ত্রী অবশেষে তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। নরপশুগুলো প্যান্ট পরা শেষ করে বেল্ট পড়তে পড়তে হাঁটা দিলো ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে।
ততক্ষণে সন্ধ্যে হয়ে গেছে। তপেশ মাস্টারের মৃত্যুপথযাত্রী স্ত্রী-র মৃত্যু চিৎকার সহ্য করতে না পেরে যে কাকটা উড়ে চলে গিয়েছিলো, সে-ই কাকটা আবার এসে বসলো বিশাল বড় আমগাছটার মগডালে। তারপর স্থির চেয়ে রইলো হাঁটতে হাঁটতে দূরে সরে যাওয়া মিলিটারিদের গমনপথের দিকে। মানুষ অনেক দেখেছে সেটি। তবে অমানুষ বোধহয় এই প্রথম দেখলো! (চলবে)

এইচ এস সি শিক্ষার্থী
চট্টগ্রাম

 

গল্পে গল্পে বাচ্চাদের শেখানো

আফরোজা হাসান


বাগানে বসে কাজ করছিলো সিহাব। হঠাৎ কান্নার শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখল ভাতিজা আয়াত কান্না করতে করতে আসছে। অতি প্রিয় চাচ্চুকে দেখে আয়াতের কান্নার শব্দ আরো বেড়ে গেলো।কাজ বন্ধ করে ভাতিজাকে ধরে সিহাব বলল, কে ছেড়ে দিলো চোখের নল, ঝরছে অঝোর ধারায় জল।মোর আঁখিও ছলছল, এখনি বুঝি নামবে ঢল। চাচ্চুর ইন্সট্যান্ট কবিতা শুনে আয়াতের চোখে আনন্দের ঝিলিক দিয়ে উঠলেও সে কান্না জারি রাখলো।

-আরে আরে কি হয়েছে আমার সোনা বাবাটার? কেন কান্না করছেন আপনি বাবা? ব্যথা পেয়েছেন নাকি কেউ মেরেছে?

-(ফোঁপাতে ফোঁপাতে) নুবাঈদ আমার খেলনা নিয়ে গিয়েছে। সকালে তামান্না আমার চকলেট নিয়ে গিয়েছিলো। সবাই আমার কাছে থেকে সবকিছু কেড়ে নিয়ে যায় সবসময়।

-(হাসি চেপে) সবাই তোমার কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নিয়ে যায়?

-(পুতুলের মত মাথা দুলিয়ে) হ্যা সবকিছু নিয়ে যায়।

-তুমি নিতে দাও কেন? কাউকে কিছু বলো না কেন?

-দাদুভাই আমাকে বলেছে কাউকে কষ্ট দিতে নেই। তা না হলে আল্লাহ রাগ করবেন আমার উপর।

-দাদুভাই তোমাকে কাউকে কষ্ট দিতে মানা করেছেন কিন্তু আত্মরক্ষা করতে তো নিশ্চয়ই মানা করেননি।

-দাদুভাই বলেছেন কারো সাথে রাগ না করতে। কাউকে কষ্ট না দিতে।

-(হেসে) আচ্ছা ঠিকআছে। এখন তুমি কান্না বন্ধ করো। চলো তোমাকে চাচ্চু একটা গল্প শোনাই। শুনবে গল্প?

-(চোখ মুছে হাসি মুখে) হ্যা শুনবো।

-(ভাতিজাকে কোলে বসিয়ে আদর করে দিয়ে) এক গ্রামের রাস্তার ধারে এক সাপ বাস করতো। ভীষণ ছিল তার আকৃতি। সে যখন ফণা তুলে ফোঁস ফোঁস করতো তখন রক্ত হীম হয়ে আসতো।

-সাপটার নাম কি চাচ্চু?

-সাপটার নাম মিস্টার ফোঁস ফোঁস। কারণ রাস্তা দিয়ে মানুষ যেতে দেখলেই সে ফোঁস ফোঁস করে তার দিকে তেড়ে আসতো আর কামড় দিতো। বিনা দোষে পথচারীরা প্রাণ হারাতো। মিস্টার ফোঁস ফোঁসের এই অত্যাচারের কারণে সেই রাস্তা দিয়ে মানুষ চলাচল বন্ধ হয়ে গেলো। একদিন এক সাধু সেই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন।

-দুষ্টু মিস্টার ফোঁস ফোঁস সাধুকেও কামড়ে দিলো তাই না চাচ্চু?

-শোনই না তারপর কি হল। মিস্টার ফোঁস ফোঁস তো অনেকদিন পর মানুষের দেখা পেয়ে ফোঁস ফোঁস করতে করতে ছুটে এলো। কামড়ে দেবার দেবার আগেই সাধু তার মন্ত্রের জোরে তাকে বশ করে ফেললো। সে তখন মাথা নত করে চুপ করে থাকলো। সাধুটি কাছে বসে বললেন, অকারণে মানুষকে কষ্ট দিয়ো না, কারো ক্ষতি করো না, হিংসা পরিত্যাগ করো পুরোপুরি এবং পারলে মানুষের উপকার করবে। উপদেশ দিয়ে তো সাধু চলে গেলেন।

-মিস্টার ফোঁস ফোঁস কি তখন ভালো হয়ে গেলো চাচ্চু?

-বলছি কি হলো। এরপর তো অনেকদিন পার হয়ে গেলো। হঠাৎ একদিন সাধুটি ঐ রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি দেখলেন মিস্টার ফোঁস ফোঁস রাস্তার এক কোণে পড়ে আছে। তার শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ। সাধু তখন এগিয়ে গিয়ে বললেন, তোমার এই অবস্থা কি করে হল? সে জবাব দিলো, আপনার উপদেশ মানতে গিয়ে। সাধু অবাক হয়ে বললেন, সেটা কি করে? বলল, আপনি বলেছিলেন হিংসা ত্যাগ করো, কাউকে কষ্ট দিয়ো না। যখন থেকে আমি তা করছি সবাই আমার উপর অত্যাচার করছে। এখানকার ছেলেরা আমাকে মেরে এক কোনায় ফেলে রেখেছে। আমি তাদেরকে কিছুই বলিনি। তখন সাধু বললেন, আরে বোকা আমি তোমাকে হিংসা পরিত্যাগ করতে বলেছি, কাউকে অকারণে কষ্ট দিতে মানা করেছি কিন্তু আত্মরক্ষা করতে তো নিষেধ করিনি। তুমি অবশ্যই কারো ক্ষতি করবে না এবং সেই সাথে কেউ যাতে তোমার ক্ষতি করতে না পারে তাই ফোঁস ফোঁস করে তাদের ভয় দেখানোতে কোন দোষ নেই। এখন বলো কি বুঝলে গল্প থেকে?

-আত্মরক্ষা করবো কিন্তু কাউকে কষ্ট দেবো না। আমি কারো ক্ষতি করবো না এবং কেউ যাতে আমার ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য প্রয়োজনে প্রতিবাদ করবো।

-(হেসে) মাশাআল্লাহ! এই তো তুমি বুঝে গিয়েছো। এখন তাহলে কি করতে হবে?

-নুবাইদকে প্রতিবাদ করতে হবে। জাযাকাল্লাহ চাচ্চু আমাকে বুঝিয়ে বলার জন্য। আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।

চাচ্চুর কোল থেকে নেমে প্রতিবাদ করতে ছুটল আয়াত। আর সিহাব হেসে কাজে মন দিলো।

@সাইকোলজি (পিএইচডি)

 

ঝড়ের দিন: পর্ব-২

তানজীল আহমদ সিদ্দিকী


নজর আলির বাড়ি গ্রামের আর সকল বাড়ির মতো নয়। বিশাল বড় একটা আড়তের মালিক হওয়ার সুবাদেই হোক কিংবা এটা-সেটা ইলিগ্যাল ব্যবসায় টাকা খাটানোর সুবাদেই হোক গ্রামের সবচেয়ে বড় এবং সুন্দর বাড়িটাই নজর আলির। তার বাড়ির সামনে দিয়ে যে-ই যায় সে-ই বলে, ‘ নজর আলির নজর বেশ উঁচু। ‘ বাড়ির সামনে আছে বিশাল বড় একটা উঠান। আর পেছনে পেল্লাই এক পুকুর। নজর আলি অবশ্য সেটাকে দিঘী বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। বাড়ির আর সকল ঘরের কথা বাদ, শুধুমাত্র বৈঠকখানাতেই কমপক্ষে দশ জন লোক আয়েস করে বসে যেতে পারে। সেই বৈঠকখানার চেহারাই আজ পাল্টে গেছে। মেহমান আসবে বলে সুন্দর করে সাজানো সবকিছু। নজর আলির মতো মানুষদের স্বভাব সাধারণত পোষা কুকুরের মতো। মালিককে খুশি করে দেয়ার শেষ চেষ্টাটা পর্যন্ত তারা ছাড়তে চায় না।
নজর আলি মেহমানদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে বাইরে উঠোনে বসে ঝিমুচ্ছিলেন। হঠাৎ পায়ের শব্দে মুখ তুলে তাকালেন, দেখতে পেলেন সবুজ মিলিটারিদের নিয়ে আসছে। তিনি দৌঁড়ে উঠোনে নামলেন।
‘ আসসালামু আলাইকুম, মেজর সাব। আইয়্যে আইয়্যে। ‘
মেজর সিপাহীদেরকে বাইরে পাহারা দিতে বলে নজর আলি আর সবুজের সাথে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেলেন। নজর আলি তাদেরকে তার সুদৃশ্য বৈঠকখানায় নিয়ে বসালেন।
মেজর সাহেব শুধু উর্দু আর ইংরেজি বোঝেন। এদিকে নজর আলির উর্দু খুব একটা আসে না। তাই সব কথাবার্তা সবুজের মাধমেই হতে লাগলো। প্রথমেই মেজর জানতে চাইলেন গ্রামবাসীদের মধ্যে ভিন্নধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা কেমন? জবাবে নজর আলি এক গাল হেসে বললেন, ‘ সে আগেই অনেক কম আছিলো। আপনারা স্যার গ্রামে আসতেসেন শুইনা বেবাক্কেই ভাগসে। দুই একটা পরিবার মাটি কামড়ায়া আছে শুধু। ‘ উত্তরটা সবুজ মেজরকে উর্দুতে অনুবাদ করে দিলো।
মেজর তারপর জানতে চাইলেন ক্যাম্প করার জন্য গ্রামের কোন জায়গাটা সবচেয়ে ভালো হবে? নজর আলি প্রথমে তার পুরনো গোলাঘরের কথা বলতে যাচ্ছিলেন। তারপর হঠাৎ করে তার মনে এলো গ্রামের স্কুলের কথা। আজকাল তপেশ মাস্টারের বাড় বড্ড বেড়েছে! সেই শালার স্কুলে মিলিটারি ক্যাম্প বসালে সবদিক দিয়েই ভালো হয়। মেজর সাহেবও ক্যাম্প করার জন্য ভালো একটা জায়গা পেয়ে তার উপর খুশ হবেন, সেই সাথে সেই তপেশ মালাউনটাকেও উচিত শিক্ষা দিয়ে দেয়া যাবে। নজর আলি সবুজকে বলে দিলো মেজর সাহেবকে স্কুলঘরের কথাটা বলতে। সবুজের থেকে স্কুলঘরের কথাটা শুনে মেজর সাহেব বেশ সন্তুষ্ট হলেন। গ্রামে ঢোকার পর স্কুলটা দেখেছেন তিনি। গ্রামের স্কুল হিসেবে বেশ বড়ই বলা যায় সেটাকে। ক্যাম্প বসানোর জন্য একদম আদর্শ জায়গা। নজর আলি দেখলেন মেজর সবুজের সাথে কথা বলছেন। তিনি আস্তে করে উঠে পড়লেন। মেজর সাহেবের নিশ্চয়ই ক্ষিদে পেয়ে গেছে। বড়বিবি টেবিল সাজিয়েছে কিনা কে জানে।
নজর আলির বড়বিবি জোহরা বেগম মানুষ হিসেবে অত্যন্ত ভালো। ধীর-স্থির স্বভাব তার। তাকে কেউ কখনো উঁচু গলায় কথা বলতে শোনেনি। তাকে কিছু না জানিয়েই নজর আলি যখন ছোটবিবিকে বিয়ে করে ঘরে এনেছিলেন সেদিনও শান্ত ছিলেন তিনি। নজর আলি পান চিবোতে চিবোতে নতুন বউয়ের ঘরে ঢুকে ছিটকিনি লাগানোর আগ পর্যন্ত এক ফোঁটা চোখের পানি পড়েনি তার। তারপর সেই রাতে খুব কেঁদেছিলেন জোহরা বেগম। তার কান্নায় কারো কিছু যায় আসেনি। কেউ ছুটে এসে বলেনি, ‘ সব ঠিক হয়ে যাবে, মা।’ পূর্ণ নারীত্বের স্বাদ কখনোই পাননি তিনি। স্বামীর ভালোবাসা আর সন্তান সুখ এ দুটোই সৃষ্টিকর্তা দেননি তাকে। এখন আর এসব পোড়ায় না তাকে। শুধু আক্ষেপ রয়ে গেছে, ম্লান হয়ে গেছে অনুভূতি।
ছোটবিবিকে কখনোই সতীন হিসেবে ভাবতে পারেননি জোহরা বেগম। বরং ছোট বোনের মতো বুকের ভেতরে আগলে রেখেছেন সবসময়। নজর আলি যখনই শাসন করতে যান তার ছোটবিবিকে, বট বৃক্ষের মতো আড়াল করে রাখেন তিনি মেয়েটিকে। আজো যখন নজর আলির থেকে শুনেছেন রাতে কারা আসবে মেহমান হয়ে, তিনি ছুট্টে এসেছেন ছোটবিবির ঘরে। ঘরের দোরে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন জোহরা বেগম। আস্তে করে ডাক দিলেন, ‘ বইনা, সজাগ আসোস? ‘
‘ হ বুবু, আহো না ঘরে। ‘
জোহরা বেগম ঘরে ঢুকলেন। দেখলেন ছোটবিবি বিছানার উপরে বসে কাঁথা সেলাই করছে। জোহরা বেগম প্রথম যখন ছোটবিবিকে দেখেছিলেন, অবাক হয়ে খানিকক্ষণ তাকিয়েছিলেন। তার কাছে মনে হচ্ছিলো স্বর্গ থেকে কোন হুর ভুল করে পৃথিবীতে নেমে এসেছে। ছোটবিবির গাত্র বর্ণ ধবধবে ফর্সা, চিকন ঠোঁট, সরু নাক। চুল ছেড়ে দিলে একদম কোমরে নেমে আসে। পেটে বাচ্চা আসার পর সেই রূপ যেন আরো খুলেছে। মেয়েটার দিকে তাকালে জোহরা বেগম যেন তার নিজের অতীতকেই দেখতে পান।
‘ কি হইলো বুবু? এমন কইরা চায়া আছো ক্যান? ‘
‘ এমনেই রে বইন। তোরে দেখি। ‘
‘ আমি কি যাত্রাপালার নায়িকা যে আমারে দেখবা? ‘ বলে খিলখিল করে হেসে উঠে ছোটবিবি। তার সেই হাসিতে যেন মুক্তো ঝরে।
‘ রাইতেবিরেতে মেয়েমানুষরে এত হাসতে নাই। কর্তার অমঙ্গল হয়। ‘
ঠোঁট ওল্টালো ছোটবিবি। জোহরা বিবির হঠাৎ করে মনে পড়লো তার স্বামী সাবধানবাণীর কথা।
‘ বইন, একটু বাদে মেহমানরা আইবো। তুই কিন্তু একদম ঘর থিইকা বের হবি না। ‘
‘ ক্যা বুবু? ‘
‘ হেরা মানুষ ভালা না। সুন্দর মেয়েমানুষ দেখলে হুশ থাকে না। ‘
ছোটবিবি মুখ নিচু করে প্রায় শোনা যায় না এমন স্বরে বললো, ‘ আমাগো স্বামীর মতোন। ‘
জোহরা বিবি চোখ গরম করে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন এমন সময় দরজার কাছে আওয়াজ পেয়ে থেমে গেলেন। নজর আলি এসে দাঁড়িয়ে আছেন দরজার কাছে!
‘ কি হইলো, বড়বিবি? টেবিল সাজাইসো? ‘
‘ এইতো সাজাইতেসি। ‘
‘ তাড়াতাড়ি করো। মেজর সাহেব কতক্ষণ হইসে বইসা আসেন। হুশ থাকে কই? ‘
জোহরা বেগম তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। ছোটবিবির দিকে একদৃষ্টিতে খানিক চেয়ে থেকে নজর আলিও বেরিয়ে গেলেন। ছোটবিবি ঘরে একা হয়ে গেলো, যেমনটা সে বরাবরই থাকে।
খাওয়াদাওয়ার সময় টেবিলে কোন কথা হলো না। জোহরা বেগমের রান্নার হাত ভালো, মেজর সাহেব খুব তৃপ্তি সহাকারেই খেলেন।ল বাকি সিপাহীদের আলাদা ঘরে খেতে দেয়া হলো। খাওয়া শেষ করে নজর আলি মেজর আর সবুজকে নিয়ে উঠোনে চলে এলেন। মেজর উর্দুতে কিসব বললেন নজর আলিকে। বেশিরভাগই বোধগম্য হলো না তার। সবুজ বুঝিয়ে বললো। মেজর বলেছেন কয়েকদিনের ভেতরেই আলতানগরে ক্যাম্প বসিয়ে দেয়া হবে। আর একটা কমিটি গঠন করা হবে, পিস কমিটি। মেজর সাহেব নজর আলির উপর খুশ হয়েছেন, তাকেই বানাবেন সেই কমিটির চেয়ারম্যান। তবে পরেরবার থেকে তার সাথে মালাউনের ভাষা বাংলাতে কথা না বলে উর্দুতে কথা বললেই তিনি খুশি হবেন। সবুজের কথা শুনে নজর আলি খুশিতে একদম গদগদ হয়ে গেলেন। তিনি কথা দিলেন এখন থেকে সাচ্চা পাকিস্তানি নাগরিকের মতোই উর্দুতে কথা বলবেন। রাত বেশি বেড়ে গেলে কুয়াশাও বেড়ে যাবে। তাই মেজররা রওয়ানা হয়ে গেলেন। আগের মতোই টর্চ হাতে সবুজ সামনে। নজর আলি তাদের গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মেজর সাহেবের মতো মানুষই হয় না। পাকিস্তানটা যাতে ভেঙ্গে না যায় সেকারণে কত কষ্ট করে ছুটে এসেছেন সেই সুদূর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। আর মালাউনের বাচ্চারা কিনা স্বাধীনতা চায়! এসব ভাবতে ভাবতে ঘরে ঢুকে গেলেন নজর আলি। আজ রাতে ভালো ঘুম হবে তার।
কুয়াশা বাড়ছে। আলতানগরের পথ-ঘাট অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে দৃশ্যপট থেকে। জোনাকিরা পর্যন্ত পথ হারিয়ে দিগ্বিদিক ঘুরছে। আলতানগরের আকাশে বাতাসে যে অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে সেই অন্ধকারের সীমা ছড়িয়ে গেছে বহুদূর। আলতানগরের মতো এমন হাজারো গ্রাম ডুবে আছে এই অন্ধকারে। এখন অন্ধকারের যুগ। মানুষের মতো দেখতে নিষ্প্রাণ চোখের পিশাচের যুগ। জোনাকিরা এখন মৃত। (চলবে)

এইচ এস সি শিক্ষার্থী
চট্টগ্রাম

 

ঝড়ের দিন: পর্ব – ১

তানজীল আহমদ সিদ্দিকী


আলতানগরে অন্ধকার নেমে এসেছে। শীতের বিকেল, দেখতে না দেখতেই ফুরিয়ে যায়। তারপর বিশ্ব চরাচর আঁধার করে দিয়ে নেমে আসে রাত। নজর আলি তার বাড়ির বারান্দায় বসে সেই রাতেরই অপেক্ষা করছেন। আজ রাতে তার বাড়িতে কিছু মেহমান আসবেন। তাদেরকে ভালোভাবে আপ্যায়ন করতে হবে, নইলে একেবারে জীবন সংশয়। নজর আলি তার বড় বিবিকে ডাক দিলেন। রান্নাবান্নার কদ্দুর কি হলো সেটা জানা দরকার।
‘ বড়বিবি। এ বড়বিবি। ‘
জোহরা বিবি দৌড়ে আসলেন। স্বামী পরিচয়ের এই অমানুষকে ভয় পান তিনি।
‘ দুই ডাক দেয়া লাগলি ক্যান? ‘
জোহরা বিবির চোখ মাটির দিকে। সামনে বসে থাকা এই মানুষটার মুখের উপর টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করার সাহস তার নেই।
‘ রাইতে যে মেহমান আইতেসে হেইডা মনে আছে তো? ”
‘ জে। ‘
‘ যা যা পাক করতে কইসিলাম সব পাক করসো তো? তেনারা কিন্তু গোশত খুব শখ কইরা খান। কি হইলো কথা কও না ক্যান? ‘
‘ জে, সব রান্না শেষ করসি। গোশত আমি নিজে দাঁড়ায়া রান্না করসি। ‘
‘ ঠিক আছে। যাও তাইলে। না না, দাঁড়াও। ‘
জোহরা বিবি ঘুরে চলে যাচ্ছিলেন। স্বামীর ডাকে আবার ফিরলেন।
‘ জে? ‘
‘ ছোটবিবিরে কয়া দিয়ো আইজ রাইতে যাতে ঘর থেইকান না বাইর হয়। ‘
জোহরা বিবির চোখে ভয় ফুটলো। নজর আলির মেহমান কারা সেটা তিনি ভালো করেই জানেন। আর সেই মেহমানদের কুকীর্তির কথা আর সবার মতো তার কানেও এসেছে।
‘ আইচ্ছা ‘, বলে জোহরা বানু দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকে গেলেন। ছোট বিবিরে সাবধান করতে হবে। আইজ রাতে যারা ঘরে আসছে তারা যে নজর আলির থেকেও বড় পিশাচ!
নজর আলি তার বড়বিবির গমনপথের দিকে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে রইলেন। একটাসময় খুব সুন্দরী ছিলো তার বড়বিবি। এখন বার্ধক্যের ঘুণপোকায় শরীর ক্ষয়েছে। নতুন শরীরের নেশায় কদিন আগে আরেকটা বিয়ে করেছেন তিনি। তবু নেশা মিটে না। গাঁয়ের রাস্তা দিয়ে কোন যুবতীকে হাঁটতে দেখলেই শরীরে কেমন অদ্ভূত শিরশিরানি উঠে। অবশ্য এ কারণেই গাঁয়ের লোকেরা তাকে লুইচ্চা নজর ডাকে। যদিও সবই তার পশ্চাতে।
‘ বাইঞ্চোদের দল ‘, দাঁত কিড়মিড় করেন নজর আলি। মালাউনের বাচ্চাদের কেমন করে সিধা করতে হয় সেটা ভালো করে জানা আছে তার।
রাত বাড়ছে। জোনাকিরা সবে বাসা থেকে বের হচ্ছে। ভালো করে তাকালে বাঁশঝাড়ের কোণায় কোণায় একটা দুটো আলোর ফুটকি চোখে পড়ে। বাঁশঝাড়ের পাশেই হাঁটাপথ। আলতানগরের একদম মধ্যখান দিয়ে সরু ফিতার মতো চলে গেছে সেই মেহেদিগঞ্জ পর্যন্ত। অন্য সকল দিনে এসময়ে কেউ বেরোয় না। সন্ধ্যার একটু পর খেয়েদেয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। তাই রাত হলে শেয়ালের পাল আর নকূল বাউল ছাড়া আর কেউ চলাচল করে না এই পথ দিয়ে। নকূল বাউল পাগলাটে মানুষ। তার দিনও যা, রাতও তাই। রাত-বিরেতে গান গেয়ে গেয়ে পথ হাঁটা তার পুরনো অভ্যেস। মেহেদিগঞ্জে আজ একটা আসর ছিলো। সেটা শেষ করে বাড়ি ফিরছে নকূল। আসর জমজমাট ছিলো, তাই মনে তার বড় সুখ। আপনা থেকেই গলা দিয়ে গান বেরুতে লাগলো। নজর মেম্বারের বাড়ি থেকে খানিক দূরে এসে নকূল দাঁড়িয়ে গেলো। ওপাশ থেকে টর্চের আলো এসে তার মুখে পড়েছে। টু সেল ব্যাটারির টর্চ, ওপাশের কিচ্ছু ঠাওর করতে পারলো না নকূল।
‘ নকূল, এত রাইতে এনো কি করো? ‘
টর্চটা নেমে গেলো। নকূলের সামনে ছয়-সাত জন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। এদের মধ্যে শুধু একজন তার পরিচিত, সবুজ। টর্চটা সে-ই মেরেছিলো। সবুজের সাথে বাকি যারা আছে তারা মিলিটারি। পাকিস্তানি মিলিটারি।
‘ জলসা ছিলো, এখন ঘরে ফিরতাসি। ‘ নকূল ভালো করে তাকালো মিলিটারিদের দিকে। ছয় জনের মধ্যে পাঁচজনই সাধারণ সৈন্য। খাকি পোশাক, মাথায় সবুজ হ্যালমেট। প্রত্যেকের পিঠে একটা করে করে বন্দুক, ধারালো বেয়নেট সহ। আর একজনকে দেখে মনে হচ্ছে অফিসার। নকূল যদি ইংরেজি পড়তে পারতো তাহলে বুঝতে পারতো সেই অফিসারের বুকের কাছে লেখা আছে – মেজর ওয়াসিম খান। মেজর সবুজকে কিসব যেন বললেন। উর্দু বোঝে না নকূল, তাই হা করে তাকিয়ে রইলো তাদের দিকে। মেজরের কথা শেষ হওয়ার পর সবুজ নকূলের দিকে ফিরে বললো, ‘ মেজর সাব জানতে চাচ্ছেন তুমি মুসলমান নাকি মালাউন? ‘
‘ জে আমি বাউল মানুষ। প্রকৃতি আমারে জন্ম দিসে, মইরা গেলে প্রকৃতিই আবার নিয়া যাবে। সৃষ্টিকর্তা বলতে আমি আমার মাটিরেই চিনি। আলাদা কইরা কোন ধর্মের গান আমি গাই না, সবুজ। তাই মেজর সাব রে কয়া দাও আমি মুসলমানও না, আবার মালাউনও না। আমি মানুষ। ‘
সবুজ মেজরের কানে গিয়ে ফুসুরফুসুর করে কিসব বললো। সাথে সাথে মেজরের মুখের ভাব কেমন বদলে গেলো। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই মেজর সামনে এগিয়ে এসে নকূলের তলপেট বরাবর বুট দিয়ে সজোরে একটা লাথি দিলেন। নকূল দু হাত দূরে ছিটকে পড়লো। মেজর দাঁত কিড়মিড় করে করে বলে উঠলেন, ‘ সব বাঙ্গাল সালে মালাউনকা বাচ্চে। বেয়নেটসে গাঁড়দো ইসে। ‘
সিপাহীরা কাঁধ থেকে বন্দুক নামিয়ে এগিয়ে এলো নকূলের দিকে। তারপর শুরু হলো এলোপাথাড়ি বেয়োনেট চার্জ। আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠলো নকূলের আর্তচিৎকারে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মাটি। রক্তের স্রোত সবুজের পা পর্যন্ত আসা মাত্র আর সহ্য করতে পারলো না সে। বসে পড়লো পথের তারপর হড়বড় করে বমি করে দিলো। এদিকে সিপাহীরা কাঁটাচামচ দিয়ে মোরব্বা গাঁথার মতো বেয়োনেট দিয়ে গেঁথেই যাচ্ছে নিথর নকূলকে। অবশেষে মেজর থামতে বলার পর থেমে গেলো তারা। ততক্ষণে সবুজ কিছুটা সামলে নিয়েছে নিজেকে। মেজর সবুজকে হুকুম দিলেন নকূলের লাশটা পথের ধারে ফেলে রাখতে। সবুজ সামনে এগিয়ে এসে নকূলের লাশের দিকে তাকাতেই আবার প্রচণ্ডভাবে অসুস্থ বোধ করতে লাগলো। বেয়োনেটের খোঁচায় নকূলের ডান চোখটা বেরিয়ে ঝুলে আছে গালের কাছে। বাম চোখ বলে কিছু নেই। অক্ষিকোটরের ভেতরে চোখ থেঁতলে গেছে। মুখের বাকি অংশে আলাদা করে নাক ঠোঁট কিছু বোঝা যাচ্ছে না। কণ্ঠনালি ফালা ফালা করে ফেলা হয়েছে। শরীরের নিচের দিকের অবস্থাও বর্ণনাতীত। সবুজ কোনরকমে লাশের পা দুখানা ধরে টানতে টানতে রাস্তার পাশে এনে ফেললো। তারপর বিবর্ণ মুখে মেজরের সামনে গিয়ে বলল,’ হো গায়া, মেজর সাব। ‘ মেজর কিছু বললেন না, শুধু হাত দিয়ে ইশারা করে আবার হাঁটা শুরু করার নির্দেশ দিলেন। এ গ্রামের মেম্বার নজর আলির বাড়িতে আজ তাদের দাওয়াত আছে। গ্রামে ক্যাম্প বসাতে লোকটার সাহায্য দরকার হবে তার। সবুজের দেখানো পথে এগিয়ে চলা মিলিটারির ছোট্ট দলটা আস্তে আস্তে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো। আর পেছনে পথের ধারে অবহেলায় তাচ্ছিল্যে গায়ে ধূলো রক্ত মেখে পড়ে রইলো নকূল বাউলের নিথর দেহ। পাশে তার প্রিয় একতারা। আলতানগরের পথেঘাটে আর কেউ কখনো দেখবে না নকূলকে। রাতবিরেতে বাতাসের ভাঁজে ভাঁজে আর ভাসবে না নকূলের দরাজ গলা। একতারার ঝংকারে আর কেউ কখনো বলবে না, ‘ নকূল, তুমি একখান হীরা আছো বাহে! ‘ ঘুমিয়ে গেছে নকূল। পরম শান্তিতে সে তার প্রকৃতি মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে। বাতাসে হঠাৎ মাতম উঠলো। নকূলের শেষকৃত্যে প্রকৃতি তার দূত পাঠিয়েছে। একটু পরই বাতাস থেমে গেলো। শেষ রাতে বোধহয় ঝড় আসবে। ঝড়ের দিন তো কেবল শুরু হলো… (চলবে)

এইচ এস সি শিক্ষার্থী
চট্টগ্রাম

 

রান্নার রেসিপিতে বাহারি ‘ভর্তা’

রোজকার জনপ্রিয় খাবার গুলোর মধ্যে ‘ভর্তা’
অন্যতম। আজকের রেসিপি তে থাকছে হরেক প্রকার ভর্তার রেসিপি যা সহজেই আপনি ঘরে বসে বানাতে পারেন।

আসুন রেসিপি গুলো ধাপে ধাপে দেখি-

টাকি মাছ ভর্তা

উপকরণ: টাকী মাছ ২৫০ গ্রাম, পেঁয়াজ কুচি ১ কাপ, গোটা কাচা মরিচ ৪ টি, গোটা রসুন ৭ কোয়া, আদা সামান্য, হলুদ হাফ চা চামচ, সয়াবিন তেল হাফ কাপ, লবণ স্বাদমতো।

প্রণালী: টাকী মাছের আঁশ ছাড়িয়ে নিন। মাথাটা কেটে ফেলুন; মাঝে চিরে নিয়ে কাটা গুলো ফেলে দিন। এভাবে সব গুলো মাছ কেটে ধুয়ে নিন। কড়াই চুলাই দিয়ে গরম হলে অর্ধেক পরিমান তেল দিন। তেল গরম হলে আদা ছাড়া সব উপকরণ সহ মাছ গুলো দিয়ে আন্দাজ মতো পানি দিয়ে মৃদু আঁচে মাছ গুলো ঢাকা দিয়ে ২০ মিনিট রান্না করুন। এবার আঁচ বাড়িয়ে দিয়ে মাছ গুলো ভালকরে ভাজুন। বাকী তেল দিয়ে ভাজা ভাজা করুন। লাল লাল হয়ে নীচে লাগা লাগা হলে নামিয়ে নিন। এবার অল্প কাঁচা আদা দিয়ে পাটায় মিহি করে বেটে নিন। বাটা হয়ে গেলে একটি বাটিতে তুলে পরিবেশন করুন।

আলু ডিম ভর্তা

উপকরণ: ডিম ২টি, আলু ১টি (মাঝারি সাইজের), কাঁচামরিচ কুঁচি ১ চা চামচ, পেঁয়াজ কুঁচি ১ টেবিল চামচ, ধনেপাতা কুঁচি ১ চা চামচ, লবণ পরিমাণমতো।

প্রণালী: আলু এবং ডিম সেদ্ধ করে নিন। খোসা ছাড়িয়ে আলু এবং ডিম আলাদাভাবে চটকে নিন। এবার পেঁয়াজ কুচি, লবণ এবং আধা চা চামচ সরিষার তেল দিয়ে ডিম ও আলু ভালোভাবে মেখে ভর্তা তৈরি করুন।

থানকুনি পাতার ভর্তা

উপকরণ: থানকুনি পাতা ১ কাপ, কাঁচামরিচ ২টি, রসুনের কোয়া ২টি, লবণ স্বাদ মতো, তিল ২ টেবিল চামচ, কালিজিরা ১ চা চামচ।

প্রণালী: সব একসঙ্গে বেটে (সব পাতা ধুয়ে পানি মুছে নিতে হবে) ভর্তা তৈরি করতে হবে। এরপর গরম ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করুন।

কাঁচা করল্লা ভর্তা

উপকরণ: কাঁচা করল্লা ২টি, কাঁচামরিচ কুঁচি ১ চা চামচ, পেঁয়াজ কুঁচি ১ টেবিল চামচ, ধনেপাতা কুঁচি ১ চা চামচ, লবণ পরিমা মতো।

প্রণালী: করল্লা ধুয়ে খুব মিহি করে কুঁচি করে নিন। এবার করল্লা কুচি চটকে নিয়ে পেঁয়াজ, কাচা মরিচ, লবন এবং তেল দিয়ে ভর্তা তৈরি করুন।

 

মোনালিসার নীল স্মৃতি

ডা. সাকলায়েন রাসেল


মোনালিসা সর্বদা জানালার পাশেই বসে।
আজও তার ব্যতিক্রম হল না। পার্থক্য হল অন্যদিন সিটে বসা মাত্রই নানা কথা বলে। আজ মুখে শব্দ নেই। নিঃশব্দ আমিও। উদ্দেশ্য তার নিরবতাকে সমর্থন করা।
শাপলা চত্ত্বর ঘুরে গাড়ী তখন কলেজ রোডে। এ রোডের এক পাশেই মোনালিসার বাড়ী। যে বাড়ীতে কেটেছে তার শৈশবের সবটুকু। দ্রুত গাড়ীটা সেখানেই চলে এলো। সে রাস্তার ধারেই।
রাস্তাটির পাশে আসতেই মোনালিসা সিটের বাম দিকে ঘুরে বসল…জানালার কাঁচ বরাবর। জানালার পাশে রাস্তাটা বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে…দ্রুতই পার হয়ে যাচ্ছে সে রাস্তা। একটু একটু করে পিছনে সরে গেল সব কিছু।
ঘাড় ঘুরিয়ে রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে রইল সে…
বিরাটাকার এক শূন্য দৃষ্টি নিয়ে…
যতক্ষণ পারা যায়…
ফ্যালফ্যাল করে…
এই রাস্তা ধরেই সোজা পূর্বে চলে গেছে মোনালিসাদের বাড়ী..
আমার স্ত্রীর বাবার বাড়ী…
আমার সন্তানের নানার বাড়ী…
আমার শ্বশুর বাড়ী!
গাড়ী এগিয়ে চলল আপন গতিতে… মোনালিসা বাড়ীর দিকে হাতটা উচু করে একটু নাড়াল…
হাতের ভাষায় বিদায়ের ছাপ…
যেন হাত দিয়ে আলিঙ্গন করল এক শূন্যতাকে…
এক অসীম শূন্যতা…
মুখে কিছু বলল না…
যেন সব কষ্ট গলায় এসে পথ হারিয়ে ফেলেছে…
আমি ঘাড়ে হাত রাখলাম। স্পর্শের ছোঁয়ায় নিরব স্বান্তনা..ও দ্রুত চোখ মুছে নিল।
আমার স্পষ্ট মনে আছে…
বিয়ের পরপরই বিসিএস পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপ করেছিল সে…
বর্তমান ঠিকানায় যখন রংপুরের এই বাড়ীর ঠিকানা দিচ্ছিল…
আমি আপত্তি জানিয়েছিলাম…
“তুমি থাকছো আমাদের বাসায় আর বর্তমান ঠিকানা দিচ্ছো রংপুরের!”
সে কোন উত্তর দিল না…পরে একদিন জানাল,
দেখ, বিয়ে হল সবে কয়েক মাস…
ঐ বাড়ীটা যে আমার না সেটা মন থেকে মেনে নিতেও তো কিছু সময় লাগবে, তাই না?
আমার অবুঝ মন সেদিনই প্রথম বুঝতে পারল…
একজন মেয়ের ফেলে আসা নিজ বাড়ী আকড়ে ধরে রাখার এ আকুতি…
আমার মাকেও দেখেছি, যতবারই নানার বাড়ী থেকে বিদায় নিয়ে ঢাকার পথে রওয়ানা হতাম ততবারই কাঁদত… জোরে জোরেই কাঁদত!…
আমি অবাক হতাম! কি আছে এই বাড়িতে! এতো বড় হয়েছে তবুও কান্না শুকায় না!
এখন আর কাঁদে না মা…
কি জানি, হয়ত কাঁদে…
আমি সেটা দেখতে পাইনা…
শুনতে পাইনা…
আচ্ছা, কষ্টের কি শেষ আছে? নাকি কষ্ট শুধু রূপান্তরিত হয়? শব্দ কান্না থেকে বোবা কান্নায়? নাকি অশ্রুতেই কস্টের উত্তাপ কমে যায়?
কি আছে এই মেয়েটার বাবার বাড়িতে?
মোনালিসা প্রায়ই বলত, তার বাবার বাড়ীতে খালারা,মামারাসহ সব আত্মীয় স্বজনের সরব উপস্থিতি ছিল প্রায় প্রতিটা দিন, প্রতিটা ক্ষণ। এমন কোন দিন সে পায়নি যেদিন তারা এ বাড়িতে শুধু নিজেরাই থেকেছে !!
কিন্তু যেদিন হটাৎ করেই তার মা এ বাড়ি থেকে বিদায় নিল…
চলে গেল না ফেরার দেশে…
সেদিন থেকেই একে একে শেষ হতে লাগল এ বাড়ীর সব আয়োজন… যেন বিরাটাকার এক বটবৃক্ষ, প্রচন্ড এক ঝড়ে একে একে হারাতে বসেছে সব ডালপালা!…
হারাতে হারাতে আজ সে প্রায় শূন্য!
এখানে আজ আর জীবন নেই…নেই কোন আয়োজন…ছন্দ হারিয়ে থেমে গেছে তাই সব কবিতা!!
ছাদের দিকে তাকিয়ে মোনালিসা সেদিন বলল, দেখ ওই ছাদটার দিকে। এই বিছানায় যখনই শুইয়ে শুইয়ে পড়তাম.. দৃষ্টি পড়ত ঐ ছাদটার উপর..
কত বছর হল!!…
মা চলে গেল…একে একে সবাই চলে যাচ্ছি আপন ঠিকানায়…
আমি শিশু থেকে শিশুর মা হয়ে গেলাম… অথচ ছাদটায় কোন পরিবর্তন নাই… সেই আগের মতই আছে!
অথচ আজ থেকে এই বাড়ীটা কেবলই একটা স্মৃতি হতে বসেছে!! আমি চলে যাচ্ছি ঢাকায়, ভাইয়েরা হোস্টেলে, আর বাবা গ্রামের বাড়ীতে। আজ থেকে এটা কেবলই একটা পরিত্যক্ত স্মৃতি!
মোনালিসা ফ্যালফ্যালে ভেজা দৃষ্টিতে শূন্য পানে তাকিয়ে রইল…
হয়ত অসীম সেই শূন্যতার এক কোণে বসে মা দেখছেন সন্তানের এ স্মৃতিকাতরতা! আচ্ছা, মায়েরা কি সত্যি দেখেন। ওনাকে হারিয়ে প্রথম দিন মনে হয়েছিল জীবন থেকে একজন মানুষকে চিরতরে হারিয়ে ফেললাম। আস্তে আস্তে মনে হল, জীবন থেকে আরেকটা জীবন ঝরে পড়েছে। আমরা সবাই তাই জীবনের ছন্দ হারিয়ে দিনকে দিন দিগ্বিদিক হয়ে যাচ্ছি। সামান্য শূন্যতা আজ তাই অসীমে রূপান্তরিত।
আমার ৯ বছরের বিবাহিত জীবনের নানা স্মৃতির প্রায় পুরোটাই এ বাড়ীটিকে ঘিরে… যদিও মাত্র দু’বছরেই ফিকে হয়ে গেছে স্বপ্নের ক্যানভাসের সব গুলো রং!..
আজ থেকেই হয়ত গল্প হয়ে গেল এ বাড়িটা!… যে গল্প শুধু নোনা জল ঝরাবে দুচোখ দিয়ে!
চাপা স্বভাবটা আর লুকিয়ে রাখতে পারল না মোনালিসা…বিদায়ের আগ মুহুর্তে বলে বসল…
”খুব খারাপ লাগছে, কেন জানি মনে হচ্ছে এটাই শেষ, এ বাড়িতে আর ফিরে আসা হবে না কখনো”
বিদায় বেলা দৃষ্টি দিয়ে স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিল সে পুরো বাড়ীটাতে!..কষ্টের তীব্রতার ঢেউ আছড়ে পড়ল আমার ললাটেও।
আমি শুধু মুখস্ত বুলিগুলো আওড়াতে লাগলাম…এটাই নিয়ম মোনালিসা, এভাবেই মানুষের সব স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়… ভাঙ্গা স্বপ্নের টুকরা গুলো জোড়া লাগিয়ে সব কিছু আবার নতুন করে সাজাতে হয়… নতুন করে সাজানো তোমার এই স্বপ্নের আঙ্গিনায় হয়ত বীজ বুনবে আমাদের আরিবা… তারপর??
তারপর??
তারপর আবারো সেই ভাঙ্গা সুর…ভেঙ্গে যাবে সে মিলন মেলাও…
তখন হয়ত দৃশ্যপটে চলে আসবে নতুন কোন আরিবা!
রাত এখন চারটা…
বৃষ্টি ভেজা রাতে যমুনার বুকে চাঁদের মত বাঁকানো এই ব্রিজটাও কেমন জানি কেঁপে কেঁপে উঠছে। গাড়ি দ্রুতবেগেই ধেয়ে চলছে ঢাকার দিকে। অনেক হারিয়ে অনন্তের পথে ছুটে চলেছি আমরা দু’জন। আমি আর আমার মোনালিসা!
বিদায়..
বাড়ী নং —১৩৪
রোড নং —১/২
C/O মরহুমা নুরান্নাহার বেগম!!

সহকারী অধ্যাপক, ভাসকুলার সার্জারী
ইব্রাহিম কার্ডিয়াক, বারডেম

 

ঘর সাজিয়ে তুলুন মাটির জিনিসে

শহরে থাকলেও আমরা পারি বাসার কোনো এক জায়গায় একটু গ্রাম্য ছোঁয়ায় সাজাতে। অনায়াশে শহুরে মানুষের জীবনের মধ্যে আজও জীবন্ত হয়ে উঠে গ্রামের মাটি। দামি কার্পেট, ফুলদানি, শো পিসের সাথে মানিয়ে নিয়েছে এখন মাটির জিনিসপত্র স্ব মহিমায়। মাটির তৈরি জিনিস তুলনামূলক সস্তা। আসুন অল্প খরচে নিজের ঘরের সাজকে করে তুলি ছিমছাম ও সুন্দর। সুন্দরভাবে ঘর সাজাতে সব চেয়ে বেশি প্রয়োজন রুচিবোধ।

মাটির জিনিস দিয়ে কীভাবে ঘর সাজাবেন আসুন দেখি কিছু কৌশল-

মাটির তৈরি শো পিস

ঘর সাজিয়ে ফেলুন মাটির তৈরি শো পিস দিয়ে। ঘরে রাখতে পারেন সুন্দর কোনো ওয়াল হ্যাঙ্গিং। এটি ঘরের চেহারাই পালটে দেবে।

মাটির কলসি

মাটির কলসি দিয়ে ঘর সাজাতে পারেন সুন্দর করে। বড় বড় চারটি কলসি চারদিকে রেখে তার উপর কাচ বসিয়ে দিন। তা সেন্টার টেবিল হিসেবে দিব্য ব্যবহার করতে পারবেন।

টেরাকোটা

ঘরের সাজে ভিন্নতা আনতে চাইলে সামর্থ্য অনুযায়ী বসার ঘর, শোবার ঘর অথবা খাবার ঘরে দেয়ালের একপাশে মাটির ফলক অর্থাৎ টেরাকোটা ব্যবহার করতে পারেন। আভিজাত্য ফুটিয়ে তুলতে মূল দরজার সামনের ফ্রেমে মাটির টেরাকোটা ব্যবহার করতে পারেন।

মাটির ফ্রেম

খুব সাধারণ ও সুন্দরভাবে ঘর সাজাতে চান তাহলে ফুলদানি, পুতুল, শো-পিস ইত্যাদি ব্যবহারের পাশাপাশি ঘরের ভিতরে যে স্থানটি খুব সহজেই সকলের নজরে পরে সেখানে মাটির ফ্রেম ব্যবহার করে তাতে যে কোনো ছবি বাঁধাতে পারেন।

ছোটো জার

মাটির তৈরি ছোটো জার কিনে তার উপর নিজের মতো করে ডিজ়াইন করতে পারেন।

মাটির ফুলদানি

দামি ফুলদানির বদলে মাটির তৈরি ফুলদানি বাড়িতে রাখতে পারেন। সেখানে কিছু সতেজ ফুল রাখার চেষ্টা করুন। তাতে আপনার ঘরের সাজগোজ যেমন ছিমছাম দেখাবে, তেমনই দেখাবে আকর্ষণীয়।

মাটির টব

শহুরে জীবনে এখন মাটির টবের জায়গায় এসেছে আধুনিক ফুলের প্লাস্টিক ও চিনা পাথরের টব। কিন্তু ফুলগাছ মাটির টবে রাখলে তা ভালো থাকে আবার মাটির টবও আপনার ঘর সাজাবে।

কলমদানি-মোমবাতি

মাটির তৈরি কলমদানি, মোমবাতি স্ট্যান্ডের মতো জিনিস আপনার ঘরের সৌন্দর্য বাড়াবে।

প্লেট-গ্লাস-ফুল-ফল-বাটি

ঘর সাজানোর জন্য কাজে লাগাতে পারবেন মাটির তৈরি প্লেট, গ্লাস,ফুল-ফল, বাটি। আপনি চাইলে এসব জিনিসের উপর কারুকার্য করতে পারেন। তাতে সামান্য জিনিসও অসাধারণ হয়ে উঠবে।

 

শীতে আপনার সোনামনি ‘গোসল’

ডা. এমডি আব্দুল হাকিম


এখন একটু একটু শীত পড়ছে। বিশেষ করে ভোর বেলা ঠান্ডা একটু বেশী পড়ে। এ সময় আপনার বাচ্চার ঠান্ডা লাগতে পারে। একটু সতর্ক হলেই এ সমস্যা কাটিয়ে উঠা সম্ভব। খুব ছোট বাচ্চকে বুকের সাথে আগলে ধরুন। ওর খালি বুক আপনার খালি বুকে লাগিয়ে দুধ খাওয়ান।

দু’জনের উপর গরম কাপড় ঢেকে দিন। বাচ্চা প্রশ্রাব-পায়খানা করেছে কিনা খেয়াল করুন এবং টিস্যু বা গরম ভেজা নেকড়া দিয়ে পরিষ্কার করে দিন। ডায়াপারও পরাতে পারেন। তবে সেটি ৪-৫ ঘন্টার বেশী না রাখাই ভালো। একটু বড় বাচ্চাকে ভালো করে গরম কাপড় দিয়ে ঢেকে দিন।

শীতে শিশুর গোসল

জন্মের প্রথম তিন দিন শিশুকে গোসল না করানোই ভালো। কম ওজনের এবং অপরিণত শিশুর ক্ষেত্রে আরো দেরি করা ভালো- বিশেষ করে শীতের দিনে।

শিশুকে প্রতিদিন গোসল করানোর প্রয়োজন নাই। ২-৩ দিন পর পর গোসল করালেও চলে। শিশুকে খোলা জায়গায় গোসল না করানোই ভালো।

গোসল করাতে হবে বাথরুম, শোবার ঘর বা এমন জায়গায়-
যেখানে শিশুর শরীরে বাতাস না লাগে। গোসলের সময় ঠান্ডা বাতাস শিশুর শরীর থেকে তাপ টেনে নেয় এবং শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ে ।

শিশুকে গোসলের আগে দুধ না খাওয়ানোই ভালো –
এতে গোসলের সময় বাচ্চা বমি করতে পারে।

যিনি শিশুকে গোসল দিবেন, তিনি গোসলের দেওয়ার আগে হাতের অলংকার খুলে ফেলবেন এবং ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নেবেন।

একটি গামলায় কুসুম গরম পানি নিতে হবে-যেনো শিশু চামড়ার সাথে সহনীয় তাপমাত্রার হয়।

শিশুকে গোসল করানোর আগে কবজি পর্যন্ত হাত ডুবিয়ে পানির উষ্ণতা পরীক্ষা করাতে হবে।

শিশুর গোসলের পানিতে ডেটল বা স্যাভলন মেশানো যাবে না। এতে শিশুর শরিরে লালচে দানা উঠতে পারে।

শিশুর দেহের ভাঁজগুলো যেমন-গলা,কানের পিছন,কুচকী,বগল, যৌনাঙ্গ ও নিতম্বের ভাঁজগুলো ভালোভাবে পরিস্কার করে দিতে হবে।

পায়খানা করে থাকলে গোসলের আগে পরিস্কার করে নিতে হবে-যাতে গামলার পানি অপরিস্কার না হয়।

বেশী ছোট শিশুর ক্ষেত্রে সাবান-শ্যাম্পু ব্যবহার না করাই ভালো এবং মাথায় পানি না দিয়ে মাথা মুছিয়ে দেয়া ভালো।

তবে বড় শিশুর ক্ষেত্রে বেবীসোপ বা কোমল সাবান ব্যবহার করা যাবে।

শিশুকে পানিতে ডুবানো যাবে না । গোসল যথাসম্ভব কম সময়ে শেষ করা ভালো।

মেয়ে শিশুদের স্ত্রী অংগে অনেক সময় সাদা ময়লা জমে। গোসলের আগে ঐ স্থানটা পানিতে ভেজানো পরিস্কার তুলা দিয়ে পরিস্কার করে দিতে হবে।

গোসলের পরপরই শুকনো পরিস্কার তোয়ালে দিয়ে শিশুকে জড়িয়ে সর্বত্র আলতো চাপ দিয়ে শিশুর শরীরের সব পানি ভালোভাবে মুছে নিতে হবে।

শরীরে পরিস্কার শুকনা কাপড়, মাথায় টুপি এবং হাতে-পায়ে মোজা পরাতে হবে।

গোসলের পরপরই শিশুর মাথা বা শরীরে লোশন, তেল বা পাউডার না লাগানই ভালো।

গোসলের পর শিশুকে বুকের দুধ দিতে হবে। এতে করে মায়ের বুকের গরম, দুধের গরমে সে গরম বোধ করবে এবং ঠান্ডা লাগার সম্ভাবনা কমে যাবে।

 

স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ায় দীর্ঘ সময় বসে কাজ করলে

ডা. সঞ্চিতা বর্মণ


জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে অফিস বা ব্যবসা ক্ষেত্রে আমাদের দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতে হয়। অনেকক্ষণ বসে থাকার ফলে ধীরে ধীরে শরীরে বাসা বাঁধতে শুরু করে নানা রোগ-ব্যাধি, যা কখনো মারাত্মক রূপও ধারণ করতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কোমরে চর্বিজমা, রক্তে অতিরিক্ত কোলেস্টেরল, হার্টের সমস্যা, ওজন বৃদ্ধি সমস্যা যারা বসে কাজ করেন তাদের মধ্যে বেশি।

এছাড়াও যারা ডেস্কে বসে বেশিক্ষণ কাজ করেন তারা কোমর ও ঘাড় ব্যথায় বেশি ভোগেন। কিন্তু জীবনের তাগিদে নিত্যদিনের কাজ ত্যাগ করা সম্ভব নয়। তাই প্রতিদিন কাজের ফাঁকে কিছু অভ্যাস তৈরি করা উচিত। যেমন এক ঘণ্টা পর পর চেয়ার থেকে উঠে কিছুক্ষণ হাঁটা, লিফটের পরিবর্তে সিঁড়ি দিয়ে উঠা-নামার অভ্যাস করা, চেয়ারে সোজা হয়ে বসা।

এছাড়াও

১. কিছু ছোট-খাটো ব্যায়াম আছে যা চেয়ারে বসেই করা যায়, কাজের ফাঁকে এই ব্যায়ামগুলো করা।

২.খাবার খাওয়ার সময় নাশতায় ভাজা পোড়া বা ফাস্টফুডের পর্রিবতে মৌসুমী ফল বা বাদাম জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করতে হবে।

৩.গ্রিন টি আমাদের শরীরে কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে, তাই চা বা কফির পরিবর্তে গ্রিন টি খাওয়া যেতে পারে।

৪.প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট হাঁটার চেষ্টা করতে হবে।

এছাড়া কোনো প্রকার স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

লেখক : ত্বক, লেজার এন্ড এসথেটিক বিশেষজ্ঞ

 

স্তন ক্যান্সার পরীক্ষা করার নিয়ম ও প্রতিরোধ

ডা. মিজানুর রহমান কল্লোল


মেয়েদের ক্যান্সারের মধ্যে শতকরা ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হচ্ছে স্তন ক্যান্সার। আর এ সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এ রোগের ৬০ শতাংশ রোগীরই বয়স ৩০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। এমনকি শতকরা পাঁচ শতাংশের বয়স ৩০ বছরের নিচে। অনেক ক্যান্সারের সাথে স্তন ক্যান্সারের একটা বড় পার্থক্য হলো- সঠিক সময়ে ধরা পড়লে এবং সঠিক চিকিৎসা হলে এ রোগ থেকে সেরে ওঠার সম্ভাবনা প্রায় ৯০ শতাংশ।

স্তন ক্যান্সার এমন একটি রোগ, যা চিকিৎসকের আগে রোগী নিজেই এই রোগ নির্ণয় ও ডায়াগনোসিস করতে পারে। একজন সচেতন নারী খুব সহজে ও দ্রুত এটি ধরে ফেলতে পারেন।

পরীক্ষা করার নিয়ম

১. মাসিক শেষ হওয়ার পরে স্তন পরীক্ষা করতে হয়। কারণ এ সময় স্তন নরম থাকে। তাই প্রতি মাসের মাসিকের শেষ দিনটিতে স্তন পরীক্ষা করা উচিত।

২. পর্যাপ্ত আলোযুক্ত স্থানে আয়নার সামনে জামাকাপড় খুলে স্তনের আকার, রঙ, বোঁটার রঙ ও অবস্থান, চামড়ার অবস্থা ইত্যাদিতে কোনো অস্বাভাবিকতা চোখে পড়ে কি না দেখতে হবে।

৩. হাত দুটো কয়েকবার মাথার ওপরে উঠিয়ে ও নামিয়ে পরীক্ষা করে নিন স্তন দুটো ত্বকের নিচে সহজে নড়াচড়া বা ওঠানামা করে কি না।

৪. এবার বিছানায় শুয়ে প্রথমে ডান হাত মাথার নিচে বাম হাতের মধ্যবর্তী তিনটি আঙুল দিয়ে ডান স্তনটি ভালো করে চেপে দেখুন- কোনো চাকা বা গোটা হাতে পাওয়া যায় কি না। এ পরীক্ষা করার সময় স্তান ও এর আশপাশের সম্পূর্ণ জায়গা, বগলের নিচের অংশসহ পরীক্ষা করতে হয়। এবার বাম হাত মাথার নিচে দিয়ে ডান হাত দিয়ে বাম স্তন ও এর আশপাশে পরীক্ষা করুন।

৫. আরেকবার দাঁড়িয়ে এভাবে ওপরের স্তন চেপে পরীক্ষা করুন। গোসল করার সময় সাবান লাগিয়ে পরীক্ষা করলে যেকোনো চাকা আরো ভালোভাবে হাতে ধরা পড়ে।

স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ

১. ২০ বছর বয়স থেকে প্রতি মাসে একবার নিজের স্তন নিজেই পরীক্ষা করুন।

২. পরিবারের কারো স্তন ক্যান্সারের ইতিহাস থাকলে সতর্ক হোন।

৩. দেরিতে মাসিক শুরু হওয়া, অবিবাহিত ও সন্তানহীন নারী এবং দেরিতে মা হওয়া নারীদের ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে বেশি বলে এদের বেশি সচেতন হতে হয়।

৪. চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অল্প বয়সে দীর্ঘ সময় ধরে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন করা বা মেনোপজের পর দীর্ঘ সময় হরমোন রিপ্লেসমেন্ট নেয়া থেকে বিরত থাকুন।

৫. প্রতিদিন অন্তত একটি করে ফল খান। প্রচুর শাকসবজি খেতে হবে।

৬. শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ালে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়।

৭. ওজন কমান, বয়স বাড়ার সাথে সাথে খাবারে চর্বিজাতীয় খাদ্য, যেমন গরুর গোশতের পরিমাণ কমিয়ে দিন।

৮. নিজেকে জানুন, চিনুন এবং নিজের সম্পর্কে সচেতন হোন।

স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা

১. ব্রেস্টে চাকা হওয়ার অর্থই ক্যান্সার নয়। ক্যান্সার ছাড়াও স্তনে চাকা হতে পারে। অনেক সময় তা এমনিতেই সেরে যায়।

২. স্তন ক্যান্সার হলেই পুরো স্তন কেটে ফেলে দিতে হবে- এমন কথা নেই। এটা নির্ভর করে ক্যান্সারের স্টেজের ওপর। এমনকি পুরো স্তন কেটে ফেললেও আজকাল রিকনস্ট্রাকটিভ সার্জারির মাধ্যমে স্তনের আসল আকার-আকৃতি ফিরে পাওয়া সম্ভব।

৩. কেমো ও রেডিও থেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যেমন- চুল পড়ে যাওয়া, বমি, খাবারে অরুচি, দুর্বলতা, গায়ের রঙ কালো হয়ে যেতে পারে। যা পরে আপনা আপনি সেরে যায়।

৪. অকারণে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ম্যামোগ্রাফি ঘন ঘন করা উচিত নয়। কারণ রেডিয়েশন স্বাভাবিক কোষকে ক্যান্সারে পরিণত করতে পারে।

লেখক : স্বাস্থ্য নিবন্ধকার, কথা সাহিত্যিক ও সহকারী অধ্যাপক, অর্থোপেডিকস ও ট্রমা বিভাগ, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল। চেম্বার : পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার লিঃ, ২, ইংলিশ রোড, ঢাকা। ফোন: ০১৭১৬২৮৮৮৫৫
(সুত্র:নয়াদিগন্ত)

 

বিজয়


অনবরত বৃক্ষের গান


বিজয় আমার কাছে জ্ঞানের অমিয় সুধা,
আধাঁরের ভাজ কেটে যেন আলোর রেখা।

বিজয় আমার কাছে
নদীর ঢেউ বেয়ে বয়ে চলা
যে থামতে জানে না,
ছুটে যায় নিরবধি।

বিজয় আমার রাসূলের জীবনপটে আঁকা সুন্দর ছবি,
চাঁদের আলোয় মাখা
সুরভিত ফুল।

বিজয় আমার কাছে হাসিমাখা
মমতায় ভরা মুখ,
যে আলোয় গাঁধা যায়
অব্যক্ত সকল দুঃখ।

বিজয় আমায় কাছে কালির আঁচড়ে,
সত্যের গান গাওয়া
মনফুটে সব অকপটে ঝরঝর।

বিজয় আমার কাছে সহজ,চিরবাস্তব,মহানুভব
নেতৃত্বের দৃঢ়তায় ছুঁয়ে যাওয়া।

বিজয় আমার কাছে ধৈয্য,
ওহুদের পাহাড়,শৃঙ্খলা শত-সহস্র,কোটি ঝড়ে যা টলে না শান্ত, অমিশ্র।

বিজয় আমার কাছে বীরের জুলফিকার,
তেজী ঘোড়ায় ছুটে চলা।

বিজয় আমার কাছে বিনীত হৃদয়,রবের ভয়ে সিক্ত চোখ,
কোমলতায় মোড়া ক্ষমা।

বিজয় আমার কাছে পরম আরাধ্য,সুগভীরচাওয়া।
প্রভু সুদীর্ঘ করুন এ বিজয়, বসুন্ধরা থেকে নীল আসমান।

ইসলামিক স্টাডিজ,অনার্স ৩য় বর্ষ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

পতাকা কেবল এক টুকরো কাপড় নয়

জাজাফী


একটুকরো লাল রঙের কাপড়ের যেমন বলার মত কোন মূল্য নেই তেমনি একটুকরো সবুজ রঙের কাপড়ের ক্ষেত্রেও তাই।আবার ও দুটোকে একসাথে জোড়া লাগানোর পরও খুব বেশি পরিবর্তন হয়না।কিন্তু যখন পরিমাপ করে সবুজ কাপড়ের মাঝে গোল করে লাল একটুকরো কাপড় জোড়া লাগিয়ে দেওয়া হয় তখন?সেটা হয়ে ওঠে অমূল্য।সেটা তখন আমরা বুকে ধরি। সেই কাপড়টি যখন একটা লাঠির মাথায় বেঁধে আকাশে ওড়াই তখন আমরা অপলোক তার দিকে তাকিয়ে থাকি।পতাকা হলো একটি দেশের পরিচয় বহনকারী এবং নিদর্শন স্বরুপ।অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে একটা কাপড় কতটা মযার্দাপুর্ন হয়ে ওঠে তার দৃষ্টান্ত এটা।যেমন একটুকরো সাদামাটা কাপড় যখন আল কুরআনের গিলাফ হিসেবে ব্যবহৃত হয় তখন সেই কাপড়ের টুকরোটি হাত থেকে পড়ে গেলে সাবধানে সেটা উঠিয়ে আমরা চুমু খাই।এটা কিন্তু ওই কাপড়ের প্রতি সম্মান দেখানো নয় বরং কাপড়টি যার ছোয়া পেয়ে ধন্য হয়েছে তাকে সম্মান দেখানো।

শেখ সাদীর জীবনের একটি ঘটনা আমরা জানি।সাধারণ পোষাকে তিনি যখন একটা দাওয়াতে উপস্থিত হয়েছিলেন তখন তাকে কেউ সম্মান দেখায়নি,চিনতেও পারেনি এবং সেখানে ঢুকতে দেয়নি।পরে যখন তিনি ভাল পোষাক পরে উপস্থিত হলেন তখন তাকে যথাযথ সম্মান দেখানো হলো।বাকি ঘটনাটা আমরা এখানে না বললেও চলবে।আমরা বলতে চাইছি একই ভাবে যখন লাল সবুজের কাপড় সাদামাটা ভাবে জোড়া লাগানো হয় তখন তা ততোটা মযার্দা পায়না যতটা পায় পতাকা হিসেবে।লাল সবুজের ওই পতাকায় মিশে আছে আমাদের ভালবাসা ও শ্রদ্ধা।

কিন্তু আফসোস দিন যতই গড়াচ্ছে ওই পতাকার প্রতি আমাদের ভালবাসা ও শ্রদ্ধা ততোই কমে যাচ্ছে।আপাত দৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে আগের তুলনায় পতাকার প্রতি ভালবাসা বেড়েছে কিন্তু ওটার অধিকাংশই মেকি ভালবাসা ও শ্রদ্ধা।
তবে কি আমরাও আমেরিকার মত পতাকাকে একটুকরো কাপড় ভাবতে শুরু করেছি?একটু খেয়াল করলে দেখবেন আমেরিকানরা পতাকাকে আমাদের মত ভালবাসে না শ্রদ্ধাও করে না।তারা পতাকাকে অন্য আর একটুকরো কাপড়ের মতই মনে করে।তাই তারা পতাকা দিয়ে অর্ন্তবাস তৈরি করে,পতাকা দিয়ে তারা বিকিনি তৈরি করে।তার পর সেটা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।এই ঢাকা শহরের দোকানেও আমেরিকান পতাকার অর্ন্তবাস কিনতে পাওয়া যায়।

আমরা অনেক রক্তের বিনিময়ে লাল সবুজের এই পতাকাটি পেয়েছি তাই পতাকার প্রতি আমাদের যে ভালবাসা আছে তা পৃথিবীর আর কারো থাকার কথাও নয়।কিন্তু দিন দিন নানা ভাবে আধুনিকতার নামে আমরা পতাকাকে তুচ্ছজ্ঞান করছি।জেনে কিংবা না জেনে পতাকার মযার্দা ক্ষুন্ন করছি।জাতীয় দিবসে আমরা ভালবেসে পতাকা ওড়াই।কিন্তু একদিন পরই দেখি সেই পতাকা ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে।অনেক সময় দেখি পতাকা একবার আকাশে ওড়ানোর পর তা আর নামানো হচ্ছেনা।পতাকা বাতাসে,ঝড় বৃষ্টিতে একদিন ছিড়ে নষ্ট হচ্ছে।
ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে দশ টাকা দিয়ে যে হাতে ধরা পতাকা আমরা কিনছি তা অনুষ্ঠান শেষে কিংবা পরেরদিনই রাস্তায় লুটোপুটি খাচ্ছে।আমরা গত কাল যে পতাকাকে বুকে ধরেছিলাম পরদিন সেটিই আমাদের গাড়ির চাকার নিচেয়,নিজেদের পায়ের নিচেয় পিষ্ট হচ্ছে।শুধুকি এক টুকরো পতাকাকে পা দিয়ে দলিত করছি?পক্ষান্তরে এটাকি দেশটাকেও পদদলিত করা নয়?

জাতীয় পতাকার প্রতি অবহেলা,অনাদরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নির্মিত একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘লাল সবুজের পতাকা’। যেখানে ফুটে উঠেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দিবসে জাতীয় পতাকার প্রতি মানুষের অতিরিক্ত আগ্রহ এবং ভালোবাসার যে চিত্রটি দৃশ্যমান, তার বিপরীতে জাতীয় দিবসের বাইরে, অন্যান্য সাধারণ সাদামাটা দিনে সেই একই জাতীয় পতাকার প্রতি মানুষের আগ্রহের যেমন অভাব, তেমনি রয়েছে এক ধরনের অবহেলা ও অজ্ঞতা।

কাগজে লাল সবুজের পতাকা ছাপানো হচ্ছে এবং সেটা জাতীয় দিবসে সুতোয় বেধে রাস্তায় ঝোলানো হচ্ছে নিবার্চনী পোষ্টারের মত। সেটাও রোদ,বৃষ্টি,ঝড়ে নষ্ট হচ্ছে।আমেরিকানদের বিকিনিতে পতাকা ব্যবহার করার মত পযার্য়ে যেতে কি বেশি সময় লাগবে?

লাল সবুজের পতাকা আমাদের অহংকার।এটি পাওয়ার জন্য আমাদের পুবর্পুরুষেরা যে আত্মত্যাগ স্বীকার করেছে তা আমাদের মনে রাখতে হবে।পতাকাকে শুধু মাত্র একটুকরো কাপড় ভাবলে চলবেনা।

হরহামেশা দেখছি গাড়িতে ইচ্ছেমত পতাকা ঝোলানো হচ্ছে।নিজ দেশের পতাকা ব্যবহার করার অধিকার প্রত্যেকেই রাখে তবে সেটার একটা নীতিমালা থাকা উচিত। ব্যক্তিপযার্য়ে জাতীয় পতাকা ব্যবহারের কোন বিধান আছে কিনা আমার জানা নেই।যদি থাকে তবে সেটিকে কাযর্কর করতে হবে।সবাইকে জানাতে হবে।আর যদি না থাকে তবে এখনি সময় ব্যক্তিপযার্য়ে জাতীয় পতাকা ব্যবহারের ক্ষেত্রে নীতিমালা প্রণয়নের।তা না হলে একদিন আমাদের দুঃখের সীমা থাকবেনা যেদিন আমেরিকানদের মত হয়ে যাবে।

অন্য দেশ ও জাতি তাদের পতাকাকে সম্মান দেখাক বা না দেখাক তাতে আমাদের কিছু যায় আসেনা কিন্তু লাল সবুজের পতাকা তুচ্ছ কোন একটুকরো কাপড় নয়।সেটার প্রতি যথাযথ সম্মান দেখাতে হবে।নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পতাকা নামাতে হবে।
অনেক রক্ত,প্রাণ আর সম্ভ্রমের বিনীময়ে অর্জিত পতাকার সম্মান বজায় রাখা প্রতিটি বাঙ্গালীর কর্তব্য।পতাকার প্রতি অসম্মান দেখানো মানে দেশকেই অপমান করা।নিজের মাকে অপমান করা।অবশ্য অনেক অভাগাই আছেন যারা নিজ মাকে বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে আসেন।তাদের কাছে পতাকাও একটা ফেলনা কাপড় ছাড়া কিছুনা। আর সে জন্যই নীতিমালা করে এটার অসম্মান যেন না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।মনে রাখতে হবে পতাকা কেবল মাত্র এক টুকরো কাপড় নয়।

#জাজাফী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ওয়েবসাইটঃ www.zazafee.com

 

সেই ঝড় একটু উঠুক

ফাতিমা শাহীন


– কি হলো , কিছু বলছেননা যে !

রিসিভার কানে লাগিয়ে তবুও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো বিভা , কথা বললনা । আর বলবেই বা কি ! যে গান শুরু করার আগেই তাল লয় কেটে গেছে, ভুলসুরে সে গান কষ্ট করে গেয়ে কি লাভ ! রেশাদ নিজে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে বিভাকে দেখে গেছে, কোনো এক শুভক্ষণে বিভার চম্পাকলি অনামিকা মৃদু কাঁপুনিতে একটি স্বর্ণ বন্ধনে জড়ানোর অপেক্ষায়…. আর সেখানে কিনা একটি উড়ো খবরে বেঁকে বসলো সবাই , কি না , মেয়ের ছোট বেলায় পোলিও হয়েছিল ….এক পায়ে খাটো… একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে…কত কি !

এসব শুনে টুনে তো বিভার বাবা রেগে মেগে সারা । যারা নিজের চোখের চেয়ে পরের কানকে বিশ্বাস করে, তাদের সাথে আর যাই হোক আত্মীয়তা করা চলেনা …..রেশাদ তার পরিবারকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেছে , কিন্তু মা আর ভাই বোনদেরকে কিছুতেই বোঝাতে পারেনি ।

এখন আর কোনো উপায় দেখতে না পেয়েই অবশেষে বিভাকে ফোন …..

_ হ্যালো বিভা, আপনি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন তো!

_ জ্বি, পাচ্ছি ।

_ আমি কিন্তু এখনো আমার প্রশ্নের উত্তর পাইনি । আবার ও জানতে চাইছি , আমি যদি একক সিদ্ধান্তে এসে আপনাকে সাথে নিয়ে আমাদের নতুন জীবন শুরু করি, আপনি কি আমার ডাকে সাড়া দেবেন ?

একটুক্ষণ চুপ থেকে বিভা এবার বলল :

_ দেখুন, আমি বিভা বা আপনি রেশাদ , আমরা জীবনের যে পর্যায়ে আজকে এসে পৌছেছি ..এখানে আমরা কেউ ই একক প্রচেষ্টায় আসতে পারিনি । আমাদের পরিবার , বিশেষ করে বাবা – মা , অনেক ঝড় ঝাপটা , আপদ বিপদ নিজেরা বুক দিয়ে ঠেকিয়েছেন , কিন্তু আমাদের গায়ে একটু আঁচ ও লাগতে দেননি । তাদের আদর , ভালবাসার ছায়ার নিচে থেকে থেকেই আজ আমরা বড় হয়েছি , পায়ের তলায় শক্ত মাটি খুঁজে পেয়েছি । আর আজ যেখানে বিয়ের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি, সেখানে কেমন করে আমরা নিজেরাই এই সিদ্ধান্ত নেব ? বাবা মায়ের দোয়া ও আশীর্বাদের হাত যদি আমরা আমাদের মাথার উপর না পাই , কেমন করে সফল হবে আমাদের জীবন চলার পথ ? কেমন করে গড়ব আমাদের স্বপ্নের , সাজানো সংসার ? আপনি আমাকে মাফ করবেন । বাবা মায়ের দোয়া আর সন্তুষ্টিতে আল্লাহর পক্ষ থেকে আমার জন্য যা কল্যানকর বলে বিবেচিত হবে, তা ই আমি খুশিমনে মাথা পেতে নেব ।

রিসিভার নামিয়ে রেখে পায়ে পায়ে বারান্দায় এলো বিভা । কাল রাত থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে । কখনো টিপ টিপ , কখনো মুষলধারে । দুটি কাক রাস্তার পাশের রেইন ট্রি টার ডালে বসে চুপচুপে হয়ে ভিজছে । সিডি প্লেয়ারে হেমন্তের গান চালিয়ে দিল বিভা । নিজেই টের পেলনা কখন যেন মনটাও গানের সুরের সাথে সাথে ভিজে উঠতে শুরু করেছে …..

আকাশে বৃষ্টি আসুক , গাছের উঠুক কেঁপে ঝড়ে…

সেই ঝড় একটু উঠুক তোমার মনের ঘরে ..।

 

ভালো মানুষ

সোহা ফারাহ


গাড়িতে উঠতে গিয়ে হঠাৎ করেই আমড়া বিক্রেতা ছোট ছেলেটার আমড়াগুলো মাথা থেকে পড়ে গেলো পাকা রাস্তায়। আশেপাশের সকলেই তাকিয়ে দেখছে, আমিও দেখছি! সে মন খারাপ করে কাঁদোকাঁদো সুরে কি যেন বলছে আর পড়ে যাওয়া আমড়াগুলো উঠাচ্ছে। শেষমেষ কয়টা ভাঙ্গা আমড়া নিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছিলো। এমন সময় একটা লোক তাকে কাছে ডাক দিলো তারপর পকেট থেকে কিছু টাকা হাতে দিয়ে বললো- মন খারাপ করোনা আবার শুরু করো।
(ভালো মানুষ)

শহর থেকে ফিরছিলাম বাড়িতে। হঠাৎ শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। তড়িঘড়ি করে উঠে বসলাম একটা লেগুনায়। হেল্পার বাচ্চা ছেলেটা বৃষ্টিতে ভিজেই গেটে দাড়িয়ে ছিলো। হঠাৎ গাড়িতে বসে থাকা এক লোক তাকে ভেতরে বসতে বললো। ছেলেটা রাজি না হলে হাতে টান দিয়ে ভেতরে বাসিয়ে দিলো। আবার বললো, ভেজার কি দরকার অসুস্থ্য হয়ে যাবা। ভেতরে ফাঁকাই তো রয়েছে। আর যারা উঠার এমনিতেই উঠবে ডাকতে হবেনা।
(ভালো মানুষ)

বাসের জানালা দিয়ে বই মেলার সারি সারি স্টলগুলো নজরে পড়া মাত্রই দ্রুত ভাড়া মিটিয়ে নেমে পরছিলাম। হঠাৎ ‘এই যে আপা শুনেন’ বলে হেল্পার দৌড়ে এসে সামনে দাড়ালো। বললো, আপা আপনার টাকা পড়েছে। ড্রাইভারটাও অনেক্ষণ গাড়ি স্লো করে রেখেছিলো! অবাক হয়ে দেখলাম হেল্পার এক হাজার টাকার নোট’টা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরেছে। ভাড়া দিতে গিয়ে কখন যে নোট’টা নিচে পরেছিলো তা খেয়াল করিনি।
(ভালো মানুষ)

বোনের চার মাসের বাচ্চার জ্বর হয়। সন্ধায় জ্বরের মাত্রা ছড়িয়ে যাওয়ায় ডাক্তারের উদ্দেশ্যে দু বোন বাচ্চাটাকে নিয়ে বেরোই। ফেরার পথে রিক্সায় আসতেই রাস্তায় দু’গ্রুপের মারামারি লাগে। চারিদিকে চিৎকার হট্টগোলে পরিস্থিতি ভয়াবহ। হঠাৎ রিক্সার পেছনে লাঠি দিয়ে জোড়ে বাড়ি দেয় একজন। রিক্সার হুড আধভাঙ্গা হয়ে একপাশে ঝুলে পরে। অসুস্থ্য বাচ্চাটা ভয়ে কান্না শুরু করে। দিশেহারা হয়ে বোন রিক্সা থেকে নেমে যেতে চায়। রিক্সাওয়ালা তাড়াতাড়ি তাকে বাধা দিয়ে বলে, আম্মা এই মারামারিতে বাচ্চা নিয়ে রাস্তায় নামলে আরও বিপদে পরবেন। পাশের ঐ বস্তিতে আমার বাড়ি, আমি কোনও ভাবে রিক্সা একপাশে নেই। আপনারা আমার বাড়িতে কিছু সময় বসেন। পরিস্থিতি শান্ত হলে বাসায় ফিরেন। তিনি বহু কসরতে ভাঙ্গা রিক্সাটা নিয়ে যান রাস্তার সাইডে। আমরা তার বাসায় গিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাচি। কিছু সময় পর রাস্তা ফাঁকা হলে বেরিয়ে গাড়ি খুজতে থাকি। ঐ রিক্সাওয়ালা তার ভেঙ্গে যাওয়া রিক্সায় আমাদের রেখে আসতে পারবেননা। কিন্তু রিক্সা বা গাড়ি কোন কিছুই পাওয়া যাচ্ছিল না। আবারও এগিয়ে এলেন তিনি। প্রায় এক ঘন্টা সময় রাস্তায় ঘুরাঘুরি করে আমাদের জন্যে রিক্সা আনলেন। দু’বোনকে রিক্সায় তুলে দিয়েই তিনি ঘরমুখো হলেন।
(ভালো মানুষ)

ভালো মানুষে ছেয়ে আছে এ দেশ ও জগৎ তাই হয়তো এখনো পৃথিবী জীবিত। আমাদের নজরে চট করে মানুষের খারাপটা সহজেই পরে যায়। কিন্তু আশেপাশে থাকা অসংখ্য ভাল মানুষদের যেন আমরা দেখতেই পাইনা। তারা দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যায় বেশিরভাগ!
হ্যঁ মন্দ মানুষও আছে, কিন্তু আমাদের একটু ভাল ব্যবহারে তারাও ভাল হয়ে যেতে পারে। পৃথিবী তো বাঁচবেই শুধু তাকে সুন্দর করে গুছিয়ে রাখাটার দায়িত্বই আমাদের। চারপাশের শুধু মন্দ বিষয়গুলো না দেখে ভাল কিছু যে হচ্ছে সেটাও খেয়াল রাখা জরুরী।
(ভালো মানুষ)

 

‘টাইম আউট’ বাচ্চাদের শৃঙ্খলা শেখানোর একটি পদ্ধতি

 ভাবানুবাদ:ফাতেমা শাহরিন

“শৃঙ্খলা” শেখানোর জন্য সুন্দর প্রক্রিয়া হল ‘টাইম আউট’। দুরন্তপনা বাচ্চাদের জন্য এই প্রক্রিয়াটি খুব ভাল কার্যকর।

‘টাইম আউট’ হচ্ছে আপনার(৩ থেকে ১০)বছর বয়স সীমার বাচ্চাদেরকে পাঁচ মিনিটের জন্য একটি বিরক্তিকর জায়গায় পাঠানো।

‘টাইম আউট’ প্রক্রিয়াটি কিভাবে কার্যকর হবে

প্রথমত, সময় নির্ধারণ করুন (দুষ্টুমির মাত্রার উপর এবং বয়সের উপর বিবেচনা করে সময় নির্ধারণ করুন)

দ্বিতীয়ত, স্থান (খেয়াল রাখতে হবে বাচ্চার জন্য ক্ষতিকর স্থান যেন না হয়, এমন যায়গায় নির্ধারণ করুন যেন বাচ্চা বুঝতে পারে তাকে ‘টাইম আউট’ টেকনিক মধ্যে ফেলানো হয়েছে)

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়

টাইম আউট করার সময় বাচ্চাকে প্রথমে পুরো প্রক্রিয়াটি বুঝিয়ে বলতে হবে যদি বাচ্চা বুঝতে না পারে কেন ‘টাইম আউট’ দেওয়া হচ্ছে তাহলে উল্টো কাজের চেয়ে ক্ষতি হতে পারে। ( এ সময় হয়ত চিৎকার অর্থাৎ কান্না করবে, কিন্তু উত্তর দেওয়া যাবে না- এটা খুব অল্প সময়ের জন্য হতে পারে) সাধারণত এর মধ্যেই বাচ্চা থেমে যায়, আর যদি তাতেও না থামে, অনেক সময় বাচ্চাদের জেদ উঠতে পারে তখন ‘টাইম আউট’ পদ্ধতি নয় বরং বাচ্চাকে শান্ত করা দরকার।

‘টাইম আউট’ বিহ্যাভিয়ার টেকনিকটি সম্পর্কে ৭টি বিষয় জানা দরকার

১. লক্ষ্য আচরণ নির্ধারণ

সন্তানের যে আচরণটি পরিবর্তন করতে চাচ্ছেন তা নির্দিষ্ট জিনিস ব্যবহার করার মাধ্যমে ‘টাইম আউট’ প্রয়োগ করুন। ‘লক্ষ্য আচরণ’ বলতে, ধরুন ‘আপনার সন্তান প্রায় মানুষকে আঘাত’ এই আচরণটি হল ‘লক্ষ্য আচরণ’ যা আপনি পরিবর্তন করতে চান। লক্ষ্য আচরণ একাধিক নয় বরং একটি নির্ধারণ করুন।

২. বিরক্তিকর স্থান

‘টাইম আউট” ঘরটি যেন বিরক্তিকর এবং নিরাপদ হয়। লন্ড্রি রুম, গেস্ট রুম, বাথরুম এবং ঘরের কোণে সাধারণত উপযুক্ত। যখন আপনি রুম নির্বাচন করবেন, নিশ্চিত করুন যে ঘরটি খালি এবং নিশ্চিত হয়ে নিন বাচ্চার জন্য নিরাপদ। এ সময় তাদের অন্যান্য শিশুদের এবং মজাদার কার্যক্রমগুলি থেকে দূরে রাখুন। ওদের বুঝতে দিন আপনি টাইম আউটে ফেলেছেন তাকে।

৩. কত সময় রাখবেন

সময়কাল মুলত নির্ধারণ করা হয় শিশুদের বয়স উপর ভিত্তি করে। ৩-৫ বছরের শিশুর জন্য ৩ মিনিটের জন্য, ৫ থেকে ১০ বছরের জন্য ৫ মিনিট, ১০ বছরের উপর হলে ১০ মিনিটের চেয়ে দীর্ঘতর সময় যেন না হয়।
‘টাইম আউট’ এর সময় ঐ রুমে একটি ঘড়ি থাকতে ভাল। কারণ আপনি সন্তানকে ঐ ঘড়ি দেখিয়ে বুঝিয়ে বলতে পারেন এবং বড় ঘড়ি হলে ইশারা করেও বুঝিয়ে দেওয়া যাবে।

৪. টাইম আউটের প্রভাব

টাইম আউট দেবার ফলে কোন প্রভাব পড়ছে কিনা, লক্ষ্য আচরণটি পরিবর্তন হচ্ছে কিনা খেয়াল করুন। এই ‘সময়’ দেবার আগে বুঝিয়ে বলুন আপনি ‘টাইম আউট’ দিচ্ছেন শুধু নির্ধারিত আচরণটির পরিবর্তনের জন্য। সেরা সময়ে যখন আচরণটি পরিবর্তন হচ্ছে শান্ত এবং যুক্তিসঙ্গতভাবে তখন বাচ্চাকে ‘ভাল বলুন’।

৫. ব্যাখ্যা করুন

সন্তানদের জন্য ‘টাইম আউট’ সবচেয়ে ভাল কাজ করবে যখন শিশুটিকে যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা বুঝিয়ে দেওয়া হয়।আপনার সন্তান যখন বুঝতে পারবে মা বাবা ভাল আচরণ করতে তাকে সাহায্য করছে তখন মুলত খুব ভাল ভাবে ‘টাইম আউট’ প্রক্রিয়া কার্যকর হবে।

৬. হুমকি বা বার বার ব্যবহার না করা

হুমকি হিসাবে ‘টাইম আউট’ ব্যবহার করা ঠিক নয়। এতে বাচ্চার কাঙ্ক্ষিত আচরণ পরিবর্তন হবে নানা। উদাহরণ দিয়ে বললে, হতে পারে আপনি সন্তানকে হুমকি দিচ্ছেন, তুমি দুষ্টুমি বন্ধ না করলে নিচের ঘরে রেখে আসব, আপনি পরবর্তীতে তা করলেন না এ সময় বাচ্চারা অতিরিক্ত সুযোগ পায় অন্যায় করার। শুধু ‘টাইম আউট’ প্রক্রিয়া বার বার প্রয়োগ করবেন না বরং অন্যান্য আচরণগত প্রক্রিয়াগুলও ব্যবহার করুন।

৭. ‘টাইম আউট’ কার্যকর হলে পুরস্কার

‘টাইম আউট’ ব্যবহার ফলে যদি সফল হয় নির্ধারিত আচরণের দিকে এগিয়ে যায়। তখন বাবা ময়েরা খেয়াল করবেন পরের দিনটি অনুসরণ করছে কিনা,এ সময় বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের সাথে সুন্দর সময় কাটানো এবং পরবর্তীতে তাদের ঘুরতে নিয়ে যাওয়া বা পুরস্কার দেবার পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে।

সীমাবদ্ধতা: দুর্ভাগ্যজনকভাবে ‘টাইম আউট’ মধ্যেও অনিবার্য কারণে কিছুটা ভুল ধারণা রয়ে গেছে,কেউ কেউ সন্তানকে আউটিং খেলার সময় ‘টাইম আউট’ দেয়। যা বাচ্চাদের আবেগীয় বিকাশে ক্ষতি করে।

টাইম আউটের সময় বাচ্চাদের উপর নিরবে খেয়াল রাখুন অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে। সুত্র:’প্যারেন্টি’ অনলাইন।

ফাতেমা শাহরিন
মনোবিজ্ঞান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
মেইল:zummi093824@gmail.com

 

মায়ের বুকের দুধের উপকারিতা এবং খাওয়াবার নিয়ম

ডা.মারুফ রায়হান খান

এটা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাই একটি শিশুর জন্মের পর কী খাবে তার আগাম ব্যবস্থা করে পাঠান। গবেষণায় দেখা গেছে যে, সারা বিশ্বজুড়ে প্রায় ১ মিলিয়ন নবজাতকের মৃত্যু নিবারণ করা সম্ভব, যদি জীবনের প্রথম ১ ঘণ্টার মধ্যেই শিশুকে বুকের দুধ পান করানো যায়। আরও বলা হয় যে, অনূর্ধ্ব ৫ বছরের শিশুমৃত্যুর হার প্রায় ১৩ ভাগ কমিয়ে আনা যেতো শিশুকে জন্মের প্রথম ৬ মাস শুধু বুকের দুধ দেওয়া হতো। এবার আলোচনা করা যাক বুকের দুধের উপাকারিতা নিয়ে।

শিশুর জন্যে উপকারিতা:

১. এটি একটি পূর্ণাঙ্গ খাবার। সব ধরনের পুষ্টি উপাদান রয়েছে এর মাঝে।
২. এটি সহজেই হজম হয়, পরিপাকতন্ত্রে ভালোভাবে শোষণ হয়।
৩. জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে।
৪. মায়ের সাথে শিশুর এক আত্নিক-আবেগিক বন্ধন গড়ে ওঠে।
৫. মস্তিষ্কের গঠন সুসংহত হয়। বুদ্ধিমত্তা শক্তিশালী হয়।
৬. বিভিন্ন ধরনের এলার্জি থেকে প্রতিরোধ করে।
৭. যেসব শিশু নিয়মিত বুকের দুধ পান করে, তাদের শৈশবকালীন ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা কম থাকে।

মায়ের জন্যে উপকারিতা:

১. জরায়ু গর্ভকালীন সময়ের আগের স্থানে দ্রুত ফিরে যেতে সহায়তা করে।
২. পরবর্তী গর্ভধারণকে বিলম্বিত করে।
৩. স্তন এবং ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।

পরিবার এবং সমাজের উপকারিতা:

১. অর্থ বাঁচায়।
২. পরিবার-পরিকল্পনায় সহায়তা করে।
৩. যেসব শিশুকে যথার্থভাবে বুকের দুধ খাওয়ানো হয়, তাদের হাসপাতালে কম ভর্তি করতে হয়।
৪. শিশুকে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে সহায়তা করে। আর একজন সুস্থ শিশুই পারে সমাজকে তার সর্বোচ্চটুকু দিতে।

শিশুকে বুকের দুধ কীভাবে খাওয়াতে হয়?

১. মায়ের হাত দিয়ে শিশুর পুরো শরীরটাকেই সাপোর্ট দিয়ে রাখতে হবে।
২. শিশুর শরীর মায়ের শরীরের সাথে লাগানো থাকবে।
৩. মাথা এবং শরীর সোজা থাকবে।
৪. শিশুর মুখ স্তনের দিকে থাকবে, নাক স্তনবৃন্তের (নিপল) বিপরীতে থাকবে।
৫. শিশুর থুতনি স্তন স্পর্শ করবে।
৬. শিশুর মুখ বড় করে খোলা থাকবে।
৭. নিচের ঠোঁটটা বাইরের দিকে থাকবে।
৮. স্তনের কালো অংশ (এরিওলা) নিচের থেকে উপরের অংশ বেশি দৃশ্যমান হবে।

ডা.মারুফ রায়হান খান
প্রভাষক
ফার্মাকোলজি বিভাগ
এনাম মেডিকেল কলেজ

 

কত ধর্ষিত শিশুর লাশ পেলে কতৃপক্ষ জেগে উঠবে

ধর্ষণ ও শ্বাসরোধ করে খুনের সাত ঘন্টা পর উদ্ধার হয় কুমিল্লার চান্দিনায় শিশু কন্যা মীম। হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য উন্মোচিত হয়েছে। ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ওমর ফারুক (১৯) নামে একজনকে আটক করা হয়েছে।

আটক মোস্তফা কামালের ছেলে ওমর ফারুক চান্দিনা পৌরসভার বেলাশহর গ্রামে বাসিন্দা এবং মীমের প্রতিবেশী। ঘাতক পেশায় গাড়ি চালক।

রবিবার রাতে তাকে আটক করার পর গতকাল সোমবার দুপুর ২টায় ম্যাজিস্ট্রেট বিপ্লব কুমার দেবনাথ এর আদালতে হাজির করা হলে ১৬৪ ধারায় লোমহর্ষক স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি দেয় সে। তার জবানবন্দিতে জানা যায়, নিহত শিশু সুবর্ণা আক্তার মীমের পাশ্ববর্তী বাড়ির বাসিন্দা গাড়ি চালক ওমর ফারুক।

ঘটনার দিন গত ৬ ডিসেম্বর (বুধবার) সকাল থেকে ওমর ফারুক তার প্রাইভেটকারটি ওয়াশ করছিল। গাড়ি দেখে মীম এগিয়ে গেলে তাকে গাড়িতে চড়ানোর প্রলোভন দেখিয়ে পুকুর থেকে পানি সরবরাহ করিয়ে গাড়ি ওয়াশ করে চালক ওমর ফারুক। দুপুর ১২টার কিছু পর গাড়ি ওয়াশ শেষে ওমর ফারুক তার কথামত মীমকে গাড়িতে উঠিয়ে বেলাশহর আরএনআর ব্রিক্স ফিন্ড সংলগ্ন স্থানে এনে ধর্ষণ করার চেষ্টা করে। এসময় মীম চিৎকার করে অচেতন হয়ে পড়লে গাড়ি চালক ওমর ফারুক তাকে ওড়না দিয়ে শ্বাসরূদ্ধ করে হত্যা শেষে গাড়ির পিছনের বক্সে লুকিয়ে রেখে গাড়িটি তার গ্যারেজে রেখে দেয়।

প্রায় সাত ঘন্টা শিশুটির মরদেহ গাড়িতে থাকার পর সন্ধ্যা অনুমান সাড়ে ৭টায় গাড়ি যোগে পাশ্ববর্তী থানগাঁও গ্রামের মাস্টার বাড়ি সংলগ্ন একটি খালপাড়ে শিশু মীম এর মরদেহ ফেলে আসে। বিষয়টি ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে ওই গাড়ি চালক তার গোপন একটি মোবাইল নম্বর দিয়ে শিশু মীমের পিতা কোরবান আলীকে ফোন করে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবী করে মুহুর্তের মধ্যে মোবাইল ফোনটি বন্ধ করে সীম কার্ডটি ফেলে দেয়।

চান্দিনা থানার পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ওই কল লিস্টের সুত্র ধরে চান্দিনা থানার ওসি মোহাম্মদ আলী মাহমুদ, উপ-পরিদর্শক (এস.আই) স্বপন কুমার সরকার ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (এস.আই) ডালিম কুমার মজুমদার সহ ‘টিম চান্দিনা’ অভিযান চালিয়ে উপজেলার মাইজখার ইউনিয়নের বদরপুর-মেহার গ্রাম থেকে তাকে আটক করার পর এ তথ্য উন্মোচিত হয়।

চান্দিনা থানার ওসি মোহাম্মদ আলী মাহমুদ জানান, মূলত যৌন তাড়নায় গাড়ি চালক ওমর ফারুক এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে। এর আগে নিহতের মা খাদিজা আক্তার সিমু বাদী হয়ে মীম এর সৎ মা লাভলী আক্তার (৩৫) ও তার ছোট ভাই দেবিদ্বার উপজেলার বাগুর গ্রামের মোস্তফা সরকারের ছেলে সালাউদ্দিন সরকারকে (৩২) আসামী করে থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। বাদির লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে সৎ মা ও মামাকে আটক করে বিজ্ঞ আদালতে পাঠানো হয়।

প্রসঙ্গত, গত বুধবার (৬ ডিসেম্বর) দুপুর ১২টার পর থেকে শিশু মীমকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরদিন বৃহস্পতিবার (৭ ডিসেম্বর) সকালে পাশ্ববর্তী গ্রামের থানগাঁও ব্রিজসংলগ্ন এলাকায় গলায় ওড়না পেঁচানো অবস্থায় শিশু মীমের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

সুত্র ও ছবি: ইন্টারনেট

 

‘বাচ্চাদের প্রশ্ন করা’—আফরোজা হাসান

গতকাল আমাদের ভলান্টিয়ার টিচারদের আলোচনার বিষয় ছিল বাচ্চাদের প্রশ্ন করা। প্রতিটা ক্লাসেই আমাদের প্রত্যেকজন টিচারকে রীতিমত হিমশিম খেতে হয় বাচ্চাদের প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে।

সারাক্ষণ প্রশ্ন করতেই থাকে বাচ্চারা। পড়া বিষয়ক প্রশ্ন, সাধারণ প্রশ্ন, মাঝে মাঝে গুরুত্বপুর্ণ প্রশ্নও। আসলে বাচ্চাদের স্বভাবই হচ্ছে তারা প্রশ্ন করতে ভালোবাসে। অবশ্য প্রশ্ন করাটা খুব ভালো এতে বাচ্চাদের চিন্তাশক্তি প্রসারিত হয়।

সমস্যা হচ্ছে বেশির ভাগ অভিভাবক বাচ্চাদের প্রশ্নের জবাব ঠিকমতো দেন না। আগে আমার ধারণা ছিল যে আমরা বাঙ্গালী বাবা-মায়েরাই মনেহয় বাচ্চাদের বেশি প্রশ্ন শুনলে বিরক্ত হই বা ঠিকমতো জবাব দেই না। কিন্তু বাচ্চাদের সাথে কথা বলার পর থেকে বুঝলাম যে সব দেশী বাবা-মায়েদের অবস্থাই প্রায় একই রকম। অথচ প্রশ্ন করা আর এর জবাব দেয়ার মাধ্যমে বাচ্চাদেরকে অনেক দরকারি বিষয় খুব সহজেই শিখিয়ে ফেলা যায়।

বাবা-মাদের কখনোই উচিত নয় বাচ্চাদের প্রশ্নের উত্তর দেয়া থেকে বিরত থাকা। বরং বাচ্চারা যাতে বেশি বেশি প্রশ্ন করতে পারে সেই পরিবেশ সৃষ্টি করা উচিত। স্কুলে যেমন আমাদের বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নপত্র আছে বাচ্চাদের জন্য। প্রশ্নপত্র গুলো এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে জবাব দিতে গিয়ে বাচ্চারা আত্মসমালোচনা করা শিখতে পারে….হতে পারে অমুখাপেক্ষী ও দায়িত্বশীল। প্রতিটা প্রশ্নের জবাব দিতে বাচ্চাদেরকে আমরা সাহায্য করি এটা ঠিক কিন্তু যখন ওদের চিন্তা আর পথ খুঁজে পায় না সামনে বাড়ার শুধু তখন।

পরিবার বিষয়ক প্রশ্নপত্রে যেমন আছে, তুমি কি তোমার বাবা-মাকে ভালোবাসো? কেন বাসো? তোমার বাবা-মা কি তোমাকে ভালোবাসে? কিভাবে বুঝলে যে তারা তোমাকে ভালোবাসে? বাবা-মার কোন জিনিসটা তোমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে এবং কেন ভালো লাগে? কোন জিনিসটা সবচেয়ে অপছন্দ করো এবং কেন করো অপছন্দ? তুমি কি তোমার ভাইবোনকে হিংসা করো? কি কি কারণে হিংসা করো? ভাইবোনের কোন জিনিসটা সবচেয়ে পছন্দ আর কোনটা সবচেয়ে অপছন্দ এবং কেন? ইত্যাদি এই ধরণের আরো কিছু প্রশ্ন।

এই প্রশ্নগুলো বাচ্চাদেরকে সাহায্য করে নিজেকে বুঝতে, জানতে ও চিনতে। কেন, কি কারণে বা কিসের জন্য একটা জিনিস পছন্দ বা অপছন্দ সেই ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয়ে যায় মনে। কারণ ছাড়া কোন কিছু করা যাবে না বা ঠিক না এটা বদ্ধমূল হয়ে যায় বাচ্চাদের মনে। যা তাদের চিন্তাকে যুক্তির পথে পরিচালিত হতে সহায়তা করে। তাই বাচ্চাদেরকে বেশি বেশি প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করতে হবে এবং তারা যাতে নিজের চিন্তাকে কাজে লাগাতে পারে সেই পথ প্রসন্ন করতে হবে।

 

“বন্ধ্যাত্বের জন্য কোনক্রমে কি আপনি দায়ী”—ডা.মারুফ রায়হান খান

১ বছর যাবত অরক্ষিত শারীরিক মিলনের পরেও গর্ভধারণ না করতে পারাটাকেই বন্ধ্যাত্ব বলা হয়। প্রজননের বয়সের ১০-১৫% দম্পতি এ সমস্যায় ভুগে থাকেন।
img20171210_233801
অনেকগুলো জীবনযাত্রার ব্যাপার আছে যার প্রাকৃতিক জন্মদানক্ষমতার ওপর প্রভাব রয়েছে। সেগুলো হলো :
img20171210_234142
১. বয়স : বন্ধ্যাত্বের ক্ষেত্রে বয়স একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নারীদের ক্ষেত্রে ৩৫ বছরের পরে গর্ভধারণ ক্ষমতা উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসে। পুরুষের বয়সও গুরুত্বপূর্ণ, তবে তাদের অক্ষমতাটা শেষ বয়সে পরিলক্ষিত হয়।
img20171210_234109
২. বিগত মাসিকের দশম থেকে আঠারোতম দিনে গর্ভধারণের সম্ভাবনা বেশি থাকে। গর্ভধারণের সম্ভাবনা বাড়াতে প্রতি ৪৮ ঘণ্টাতেই যৌনমিলন করা প্রয়োজন।
img20171210_234049

৩. সাফল্য পেতে প্রতি ১-২ দিনে একবার যৌনমিলন করা উচিত। তবে মানসিক চাপ থেকে রেহাই পেতে, আরও কম যৌনমিলন করা গ্রহণযোগ্য।
img20171210_234214
৪. কোনো নির্দিষ্ট আসনে যৌনমিলন গর্ভধারণের সম্ভাবনার উন্নতি ঘটায় না।

৫. বিএমআই (বডি মাস ইনডেক্স) যদি অনেক বেশি থাকে (>৩৫) বা অনেক কম থাকে (<১৯) তবে বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকি বেড়ে যায়। img20171210_233931
৬. ধূমপান, মদ্যপান (দিনে ২ বারের বেশি) এবং অতিরিক্ত ক্যাফেইন পান ( দিনে ৫ কাপের বেশি) বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকি বাড়ায়।

৭. স্বামীর জন্যে – উষ্ণ, আঁটসাঁট, নাইলনের অন্তর্বাস পরিহার করা উচিত। তাদেরকে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল করতে বলা হয়। কারণ শরীরের অভ্যন্তরে যে তাপমাত্রা তারচেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম তাপমাত্রা অণ্ডথলিতে থাকতে হয় কার্যকর শুক্রাণু তৈরির জন্যে।
img20171210_234235
৮। খাবার : মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের কিছু ভূমিকা আছে সন্তান জন্মদান-সক্ষমতার ক্ষেত্রে। ফলিক এসিড এবং জিঙ্কের ঘাটতি থাকলে শুক্রাণু তৈরি কমে যেতে পারে। তাছাড়া খাবারে এন্টিঅক্সিডেন্ট মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট যেমন : বিটা-ক্যারোটিন, লাইকোপেন, রেটিনল এবং আলফা টকোফেরোলের ঘাটতি থাকলে জননতন্ত্রের নিঃসরণ কমে যেতে পারে। ফলে পুরুষের বন্ধ্যাত্ব দেখা দিতে পারে।

৯. অনেক দম্পতি যৌনমিলনের সময় শুষ্ক যোনিপথের কারণে পিচ্ছিলকারক পদার্থ ব্যবহার করেন। এসব পদার্থ প্রায়শই অম্লীয় হয়ে থাকে এবং শুক্রাণুকে হত্যা করে।

১০. অতিরিক্ত উদ্বিগ্নতা সন্তান জন্মদানের সক্ষমতা কমায়।

১১. সামাজিক শ্রেণি : গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহুরে নারীদের বন্ধ্যাত্বের পরিমাণ বেশ বেশি। কারণ উচ্চশ্রেণির নারীরা তাদের ক্যারিয়ার প্রতিষ্ঠা না করে সাধারণত সন্তান নিতে চান না। আবার কিছু কিছু রোগ এ শ্রেণির মধ্যে বেশি হয়; যেমন : এন্ডোমেট্রিওসিস, যা নিজেই কিনা বন্ধ্যাত্বের জন্যে দায়ী। যে বয়সে এসে প্রাকৃতিকভাবেই সন্তান জন্মদানের ক্ষমত কমে যায় এবং বিভিন্ন গাইনোলজিক্যাল সমস্যা দেখা দেয়, তখন সন্তান নেবার চেষ্টা বন্ধ্যাত্বকে প্রভাবিত করে।
img20171210_234125
১২. সন্তান জন্মাদানের সক্ষমতার ওপর কিছু কিছু ওষুধের প্রভাব আছে।

তাই নিঃসন্তান দম্পতির দুজনকেই গাইনী বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করে ওষুধ খাওয়া উচিত।

 

রত্নগর্ভা এক মায়ের গল্প

২০১৭ সালে পেয়েছেন সেরা জয়িতা- রত্নগর্ভা অ্যাওয়ার্ড ‘রত্নগর্ভা মা’ মোছা:হামিদা বেগম। সুন্দর আলোয় উদ্ভাসিত এই মা নিজের দৃঢ় মনোবল, অদম্য সাহস ও সততা কারণে গৌরব অর্জন করেছেন।
img20171210_145908
মা তার সন্তানদের রত্ন বানানোর স্বপ্ন থেকে কখনও সরেননি একচুলও।

একজন গ্রাম্য মাতব্বরের খুব সাধারণ স্ত্রী ছিলেন তিনি। এক সংগ্রামী মা। তার জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে সমাজের নানা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। যে সংগ্রামের শুরু তার শৈশব। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এখন তার বড় পরিচয় তিনি একজন সফল মা।
হামিদা বেগম ছিলেন একান্নবর্তি সংসারের পরিবারের বউ আর তাই দায়িত্বটাও ছিল বেশি। ৩০/ ৩৫ জনের ঢেকি-হেঁসেল-হাড়ী ঠেলে ক্লান্ত। হাজবেন্ড কর্মপাগল সামাজিক ও ব্যবসায়িক ব্যস্ততার জন্য সন্তানদের শাসন-সোহাগের যে শুন্যতা তৈরী হত তাও তিনি একাই পুষিয়ে দিয়েছেন। সব ক্লান্ত ঠেলে সেই মা রাতের বিছানায় স্বপ্ন বুনতেন রোজ। সংকল্প করেন হামিদা সন্তানদের উচ্চশিক্ষিত করে গড়ে তোলার।

হামিদা বেগমের ছেলে মেয়েরা সবাই স্ব স্ব স্থানে প্রতিষ্ঠিত আছেন। তার সন্তানদের সম্পর্কে জানা যায়,

বড় সন্তান ড. আব্দুস সালাম আযাদী। তিনি লেখাপড়া করেছেন রিয়াদের কিং সউদ বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল সহ মাস্টার্স। বৃটেনের অয়েলস এ স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তিনি প্রখ্যাত মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

মেজো ছেলে, আর্মি মেডিক্যাল কোরে জয়েন করেছিলেন। বর্তমানে তিনি অবসরে আছেন।

ছোট ছেলে আব্দুস সামাদ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া থেকে ইংরেজী বিভাগ থেকে এম এ করেছেন। বর্তমানে ঢাকার তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসায় অধ্যাপনা করছেন।

বড় মেয়ে তাসলিমা রহমান একটি কুরআন একাডেমি পরিচালনা করছেন। হাজবেন্ড একটি ফাযিল ডিগ্রী মাদরাসার ভাইস প্রিন্সিপাল।

মেজো মেয়ে সেলিনা হাবীব কামিল এম এ। একটি ফাযিল ডিগ্রী মাদরাসায় অধ্যাপনা করছেন। তার হাজবেন্ড একটি মহিলা মাদরাসায় অধ্যাপক।

সেজো মেয়ে নুরুন্নাহার লাভলি কামিল এম এ করেছেন।একটি কুরআন একাডেমির ইনস্টাক্টর হিসাবে আছেন।

এরপর নাজমুন্নাহার স্বপ্না ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ করেছেন। তার হাজবেন্ড কর্মরত আছেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে।

সবার ছোট শামসুন্নাহার মলি আই আই ইউ সি থেকে ইংরেজীতে অনার্স শেষ করেছেন। বর্তমানে ফিনল্যান্ডে আছেন ফেমিলী সহ।

মা কে নিয়ে একজন সন্তান লিখেছেন— ‘তার ঘরটি ছিল মাটির কিন্তু তিনি সোনা ফলানোর স্বপ্ন দেখতেন। শীতের রাতে যে বিছানাটাতে ঘুমোতেন সেটার ভিতরে তুলো ছিলো না। যে জায়নামাজে বসে আরশের মালিকের কাছে আমাদের জন্য হাত তুলে বসে থাকতেন সেটা মখমলের ছিল না। এতগুলো ভাইবোনের কত প্রয়োজন মিটাতে হত অথচ তার হাতে দুটো টাকা থাকতো না। অনেক বড় বড় স্বপ্নভরা গল্প শুনাতে শুনাতে আমাদের দুচোখে স্বপ্ন এঁকে দিতেন।’

সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত আট সন্তানের এই জননী। তিনি প্রতিটি সন্তানকে শিক্ষায় এবং নৈতিকতায় পরিপূর্ণ আলোয় আলোকিত করে তুলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন।

আট সন্তানকে গর্ভে ধারন করে তিনি যেমন মা হয়েছেন আবার গর্ভে ধারন না করেও অনেকের মা ডাক শুনে যাচ্ছেন। স্বমহিমায় উজ্জ্বল পথের দিশারী অন্যদের কাছেও।

ফাতেমা শাহরিন

 

‘নারীদের মূত্রনালীতে ইনফেকশান বেশি হয়’ এর কারণ, লক্ষণ, ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় ও করণীয় —ডা.মারুফ রায়হান খান

খুব অহরহ যে রোগটিতে মানুষ আক্রান্ত হয় সেটি হলো মূত্রতন্ত্রের প্রদাহ বা Urinary Tract Infection (UTI)। সাধারণত মূত্রথলী এবং মূত্রনালীর প্রদাহকেই UTI বলা হয়।
সবচেয়ে বেশি এ রোগটি হয় যে জীবাণু দিয়ে তা হলো Escherichia coli।
এটি নারীদেরই সাধারণত হয়। পুরুষদের কমই দেখা যায়। তবে জীবনের ১ম ১ বছর এবং ষাটোর্ধ্বদের ক্ষেত্রে হতে পারে।
img20171209_214403
কেন নারীদের বেশি হয়?

-তাদের মূত্রনালী আকারে ছোট হয়।
-এটি মলদ্বারের নিকটবর্তী, তাই সেখান থেকে জীবাণু প্রবেশ করতে পারে।
-প্রোস্টেট গ্লান্ড থেকে পুরুষদের এক ধরনের তরল নিঃসৃত হয় যা ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলতে পারে। নারীদের ক্ষেত্রে তার অনুপস্থিতি।

এছাড়া যৌনমিলনের সময় মূত্রনালীতে আঘাত লাগতে পারে তখন পেরিনিয়াম থেকে মূত্রথলীতে জীবাণু প্রবেশ করে এ রোগটি হতে পারে।
img20171209_214533
ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়ঃ

– যারা বিভিন্ন কারণে মূত্রথলী পরিপূর্ণভাবে খালি করতে পারেন না।
– মূত্রনালীতে যদি ক্যাথেটার করা থাকে। কিডনী, মূত্রথলি কিংবা মূত্রনালীতে যদি পাথর জমা হয়।
– যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, যেমনঃ মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া নারী ও ডায়াবেটিস রোগী।
img20171209_214633
লক্ষণসমূহঃ

১। হঠাত করে ঘনঘন প্রস্রাব পাওয়া।
২। প্রস্রাব করার সময় খুব জ্বালাপোড়া হওয়া।
৩। প্রস্রাব করার সময় অথবা শেষে তলপেটে ব্যথা অনুভব করা।
৪। প্রস্রাব করা শেষে পুরোপুরিভাবে প্রস্রাব হয়নি, কিছু থেকে গিয়েছে এরকম অনুভব করা।
৫। প্রস্রাব কখনও কখনও ধোঁয়াচ্ছন্ন হতে পারে, দুর্গন্ধযুক্ত হতে পারে।
৬। কখনও কখনও প্রস্রাবের সাথে রক্ত যেতে পারে।
img20171209_214655
চিকিৎসাঃ

উপযুক্ত এন্টিবায়োটিক এক্ষেত্রে প্রধান চিকিৎসা। তবে বলে রাখা ভালো, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া নিজেরা কিংবা ফার্মেসিওয়ালাদের কাছ থেকে যেকোনো এন্টিবায়োটিক গ্রহণ করা বিপদজনক হতে পারে। এছাড়া প্রচুর পরিমাণে পানি খেতে বলা হয়ে থাকে।

যাদের বারবার এই রোগটি হয় তারা এটি প্রতিরোধের জন্য যা করতে পারেন :

১. দিনে ২-৩ লিটার পানি খাবেন।
২. প্রস্রাব আটকে রাখবেন না। যখন প্রস্রাবের বেগ আসবে করে ফেলবেন।
৩. যৌন মিলনের আগে ও পরে প্রস্রাব করে নেবেন। (সঙ্গমের পরে প্রস্রাব করে নিলে এসময় যদি কোনো ব্যাক্টেরিয়া মূত্রনালীতে যেয়ে থাকে তাহলে বেরিয়ে যাবে।)
৪. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখবেন। টয়লেট সেরে পরিষ্কার হবার সময় সবসময় সামনে থেকে পেছনের দিকে পরিষ্কার করবেন।
৫. বেশি করে ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ খাবার খাবেন। (এটা ইউরিনে অম্লীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে, ফলে ব্যাকটেরিয়া বেশি বৃদ্ধি হতে পারে না।)
৬. মাসিকের সময় পরিষ্কার কাপড় ব্যবহার করবেন। (গ্রামাঞ্চলে হয়তো এখনও অনেকে ন্যাপকিন/প্যাড ব্যবহার করেন না।) নিয়মিত প্যাড চেঞ্জ করবেন। বলা হয়ে থাকে ৬ ঘণ্টার বেশি এক প্যাড না ইউজ করার জন্যে।
৭. কটনের আন্ডারওয়্যার ব্যবহার করবেন। ( কারণ ব্যাকটেরিয়া আর্দ্র জায়গায় বেশি জন্মায়, কটন আর্দ্রতা ধরে রাখে না।)

 

নারীশিক্ষার অগ্রদূত ‘বেগম রোকেয়া’

“অশিক্ষিত চোখ যেই খানে ধূলি-কর্দম দেখে, শিক্ষিত চোখ সেই খানে দেখে মণি-মাণিক্য”

আপনার ধারণায় ঠিক বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের উক্তি এটি। তিনি নারীদের শিক্ষা দিয়ে আলোকিত করার অগ্রদূত। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ১৮৮০ সালে রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। খুব অল্প সময়, মাত্র ৫২ বছর তিনি বেঁচে ছিলেন। কিন্তু এই অল্প সময়ে এবং হাজার বাধার মধ্যে তিনি এত কাজ করেছেন যে ভাবতে অবাক লাগে। নারীশিক্ষার জন্য যে কর্মকাণ্ড পরিচালনা তিনি করেছেন, যে সাহস দেখিয়েছে, সেটা তিনি দেখিয়েন আমাদের অনুপ্রেরণাককারী হিসেবে। বেগম রোকেয়া ১৩৭তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে গুগলের হোমপেজে বিশেষ একটু ডুডল প্রদর্শন করা হচ্ছে।

প্রতিবছর ডিসেম্বরের ৯ তারিখ বেগম ‘রোকেয়া দিবস’ পালন করেন বিভিন্ন নারী সংগঠন, এনজিও, সরকারের নারীবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দেশব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। ‘রোকেয়া পদক’ দেওয়া হয় বিশিষ্ট নারীদের। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় রোকেয়া দিবস উপলক্ষে আজ শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে রোকেয়া পদক-২০১৭ প্রদান ও আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি থাকবেন।
এ বছর রোকেয়া পদক পেয়েছেন
images(81)
চিত্রশিল্পী ‘সুরাইয়া রহমান’, লেখক ‘শোভা রানী ত্রিপুরা’, সাংবাদিক ‘মাহফুজা খাতুন বেবী মওদুদ(মরণোত্তর)’, সংগঠক ‘মাজেদা শওকত আলী’,
সমাজকর্মী ‘মাসুদা ফারুক রত্না’।
আজ তাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী।

বেগম রোকেয়া দিবস থেকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস—ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস, বাংলাদেশের নারীদের এই অনন্যসুযোগ অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। সামগ্রিকভাবে সবাই মিলে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের প্রস্তুতি আমরা রোকেয়া দিবস থেকেই শুরু করতে পারি। সমাজের সবাইকে মনে করিয়ে দেয়, নারীমুক্তির জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করার মাধ্যমে ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখা যায়। রোকেয়া সেই দিকটি প্রতিষ্ঠা করেছেন। ছবিসুত্র:বিডিনিউজ২৪,গুগল

 

মাদকা ও সাইবার আসক্তি নিরাময়ে SBT(Spiritualistic Behaviour Therapy) অধিক কার্যকরী —- ডা.কবীর জুয়েল

রাজধানীর সাউথ-ইস্ট ইউনিভার্সিটিতে ‘মানসিক স্বাস্থ্য’ সম্পর্কিত সেমিনার সম্পন্ন হয়েছে। মালয়েশিয়াস্থ AIMST -এর ভিজিটিং সহযোগী অধ্যাপক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. কবীর জুয়েল মধ্যপ্রাচ্যে বহুল ব্যবহৃত
SBT(Spiritualistic Behaviour Therapy) -এর মাধ্যমে আসক্তি নিরাময়ের ওপর আলোচনা করেন। সেমিনারে তিনি মাদক ও সাইবার আসক্তি নিরাময়ে নৈতিক শিক্ষাগ্রহণ জরুরী বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।

প্রায় তিন শতাধিক ছাত্র-ছাত্রীর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত উক্ত অনুষ্ঠানমালায় অন্যতম আকর্ষনীয় দিক ছিল প্রখ্যাত মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, বলিষ্ঠ সংবাদ পাঠক ও ভাস্কুলার সার্জন ডা. সাকলায়েন রাসেল। আরও উপস্থিত ছিলেন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও সাউথ-ইস্ট ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা ভি.সি ও প্রফেসর অফ এমিরেটাস অধ্যাপক ড. এম শমসের আলীসহ আরও অনেকে। সভাপতিত্ব করেন সাউথ-ইস্ট ইউনিভার্সিটির ভিসি অধ্যাপক ড. এএনএম মেশকাত উদ্দিন।

মাদক একটি মরণব্যাধি। মুলত IDU(Intra Venous Drug Users) অর্থাৎ শিরায় নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণকারীদের নিরাময় প্রকল্পে Psychiatrist ও Vascular Surgeon -এর যুগপৎ ভূমিকা রয়েছে।

সেমিনারে বক্তিতা শেষে, শিরায় ক্রমাগত ইঞ্জেকশান নেওয়ার কারনে তাদের শিরা জনিত রোগ দেখা দেয়, এ বিষয়ে উপর তারা দুজনে পালাক্রমে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।

এছাড়াও ৫-জন মেধাবী ও প্রাণবন্ত ছাত্র-ছাত্রীকে নিয়ে ” South East University Mental Health Club” খোলা হয়।
ডা. এম এস কবীর জুয়েল
এমবিবিএস, বিসিএস, এম.ফিল(নিউরো-সাইকিয়াট্রি), ডক্টর অফ মেডিসিন(এম.ডি) মনোরোগ
সৌদি বিশেষায়ীত স্বাস্থ্য কমিশন সার্টিফাইড ইন সাইকিয়াট্রি এন্ড সাইকোথেরাপী
ভূতপূর্ব মনোরোগ ও মাদকাসক্তি বিশেষজ্ঞ, সাইকিয়াট্রিক হাসপাতাল, আল জউফ, সৌদি আরব
ভূতপূর্ব সহযোগী অধ্যাপক
এশিয়ান ইনষ্টিটিউট অফ মেডিসিন, সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি কেদাহ্, মালয়েশিয়া
ইউনিট প্রধান, সাইকোথেরাপি ও কাউন্সিলিং ইউনিট, মনোরোগ বিভাগ
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল

 

ধূপছায়া -সুমাইয়া তাসনিম

নাশতা করে আয়েশ করে কম্বলের নিচে ঢুকতেই অনু দরজায় এসে দাঁড়ালো। আমি তাকাতেই ঠোঁট প্রসারিত করে একটা মেকি হাসি দিল। আমি মনে মনে কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। এই সাত সকালে কি অঘটন ঘটিয়েছি বুঝতে পারছিনা। অনু ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে। আমি ঢোক গিললাম, কি করেছিস সাজিদ? কি? কি?? মনে কর!
অনু খুব কাছে আসার পর আমার চিন্তার মোড় ঘুরে গেলো। মুখ তুলে ওর চোখের দিকে তাকালাম। আচ্ছা… মেয়েটার মনে আমার জন্যে তাহলে একটু মায়া মোহাব্বত জন্মাচ্ছে কিনা…
অনু আরেকটু এগিয়ে এসে আচ্ছা একটা ঠুয়া দিল কপালে। তাও নিজের কপাল দিয়ে। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপসে গিয়ে বললাম, তোমার ওই কপাল দিয়ে বাড়ি দিলে নারিকেলও ফেটে যাবে। কি দরকার ছিল কাছে এসে হার্টবিট বাড়িয়ে দেওয়ার..
-আর কতদিন মাথায় আমাজনের জঙ্গল বানিয়ে রাখবা?
অনু তীর্যক কন্ঠে প্রশ্ন করল।
আমি আবার দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আমাজন যে জঙ্গল না সেটা বলতে গিয়েও থেমে গেলাম।
-এত ঘনঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলো কেন? আমাকে ভাল্লাগেনা না? তাড়াতাড়ি যাও। এমনিই ছুটির দিন, পরে সিরিয়াল পাবানা।
আমি সন্তর্পণে আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। উঠে তৈরি হতে হতে একটু ইতস্ততভাবে জিজ্ঞেস করলাম, ইয়ে অনু, ওই শরফুদ্দীন আসবে তো.. দুপুরে আমাদের সাথে খেতে বলি?
অনু চুলের খোঁপাটা নতুন করে বেধে আঁচল গুজে নিতে নিতে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, হ্যা বলো, অসুবিধা কি! উনি কি কি খেতে পছন্দ করে সেটা ডায়রীতে লিখে দিয়ে যাও।
খেয়েই বের হবো বলে বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আড়চোখে এলোমেলো চুলের অগোছালো খোঁপা বাধা দেখতে দেখতে আমি মৃদু হাসলাম। অনুর এই ব্যাপারটা আমার ভাল লাগে। ওর আপ্যায়নে কেউ খুশি না হয়ে পারেনা। আমার মত কিছুটা অসামাজিক নিরীহ স্বভাবের বিরস কারো জন্য এটা একটা দারুণ ব্যাপার। আমার সামাজিকতার ঘাটতিটা ও পূরণ করে দেয়। ওর ডায়রীতে মোটামুটি সবার পছন্দের খাবারের লিস্ট আছে। সবাইকে এত সহজে কাছের করে নেয়! কেবল আমি বাদে… আমি আবার দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।

আর সবার মতই শরফুদ্দীন খেতে বসে অবাক হল। ছোট্ট সংসার তাই আয়োজন সীমিত কিন্তু সবই ওর পছন্দের। নারকেল দিয়ে ঝোল ঝোল করে রান্না করা ডিমের তরকারি, লইট্যা মাছ ভুনা, ধনেপাতার ভর্তা আর টকদই দিয়ে মাখানো বাহারি রঙের সালাদ।
নিজেই প্লেট টেনে নিতে নিতে বললো, তুই বড় কপালওয়ালারে সাজিদ। আমি মুচকি হাসলাম। শরফুদ্দীন সেই স্কুল লাইফ থেকে এমনই। একটুও বদলায়নি। অসম্ভব চটপটে আর স্মার্ট এই ছেলেকে ম্যানেজ করার সহজ উপায় হলো তার পছন্দের খাবার খাওয়ানো। একে তো তার প্রিয় খাবার, তার উপর অনুর রান্নার হাত অসাধারণ।
সালাদের বাটি শেষ করে বললো, এত স্বাদের সালাদ আমি আর খাইনি।
আমি বউয়ের প্রশংসায় তৃপ্তির হাসি হাসলাম। দেখতে হবেনা কার বউ!
হাটতে হাটতে শরফুদ্দীন বললো, তোদের বিয়ের ব্যাপারে দ্বিমত করেছিলাম বলে কিছু মনে রাখিস না। মনে হচ্ছে তোরা বেশ আছিস। আসলে আমার সাথে ভাবির প্রথম পরিচয়টা যেমন হবার কথা ছিল ঠিক তেমন ছিল না.. এজন্যই আরকি ওরকম বলেছিলাম।
আমি মৃদু কণ্ঠে সায় দিলাম।
অনুকে দেখতে যাওয়ার পরপরই কিছু ফাইনাল হয়নি। আসলে একইসাথে দুটো সমন্ধ ছিল। অনুকে দেখার পর আমার খারাপ লাগেনি। কিন্তু শরফুদ্দীন জোর করেছিলো দ্বিতীয় সমন্ধটার ব্যাপারে। তাই অনুর ব্যাপারে হ্যা-না কিছু বলার আগে বন্ধুর কথা রাখলাম। সত্যি, মেয়েটার কোনো কমতি ছিল না। দেখতেও আকর্ষণীয়। কিন্তু বিপত্তিটা ঘটেছিল দেখতে গিয়েই।
এই দেখাদেখিটা আমার ঠিক পছন্দ না। মানে আমার খুব অস্বস্তি লাগে কেন যেন। তাই রেস্টুরেন্টের কোনার একটা টেবিলে হাত কোলে মাথা নিচু করে বসেছিলাম। মেয়েটা আসার পর টুকটাক কথা বলছি এমন সময় আচমকা কোথা থেকে যেন উড়ে এলো অনু। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে একবার অনু একবার নিগার নামের মেয়েটার দিকে চাইতে লাগলাম। অনু খুবই সাবলীল ভাবে জিজ্ঞেস করল, এই মেয়েটা কে? আমি আরো হতভম্ব হয়ে গেলাম। স্রেফ গতকাল পরিচয় হওয়া একটা মেয়ে আমার সাথে এমন পরিস্থিতিতে এভাবে কথা বলবে তা আমার ভাবনার অতীত। অনু আবার জিজ্ঞেস করল। আমি কিছু বলার আগেই নিগার মৃদু হেসে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বসুন। অনু বসলে নিগার এক মুহূর্ত তাকে পর্যবেক্ষণ করে পানির গ্লাস এগিয়ে দিতেই অনু ছো মেরে গ্লাসটা নিয়ে পানিটুকু শেষ করে আমার দিকে চেয়ে রইল। আমি বিস্ময়াভিভূত চোখে অনু নামের মেয়েটার দিকে অপলক চেয়ে রইলাম। অনু একটা বড় শ্বাস নিয়ে একটুপর বলল, আমি বেশ কিছুক্ষণ থেকেই আপনাদের দেখছি। যা বুঝেছি, আপনি মেয়ে দেখতে এসেছেন যেমন করে গতকাল আমাকে দেখতে গিয়েছিলেন। আপনার কি আমাকে পছন্দ হয়নি? কিন্তু আমার তো আপনাকে পছন্দ হয়েছে।

আচমকাই এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য নেমে এলো যেন।আমি পূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে অনুর চোখে চোখ রাখলাম। দীর্ঘ পল্লবে কাজলের সন্ধ্যা নেমে এসেছে এই ব্যস্ত সকালে। চোখের গাঢ় কালো তারার মাঝে পাপড়ি মেলে আছে আশ্চর্য এক কৃষ্ণ বুনোফুল। নাক ঘামছে এই এসি রুমেও। শিশিরের মত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিন্দু ফুটে আছে ঠোঁটের উপরিভাগে। হালকা বেগুনী আভাযুক্ত ঠোঁটজোড়া চেপে রাখা সত্ত্বেও তা সুক্ষ ছন্দে তিরতির করে কাপছে। থুঁতনির এক কোণে অবছাভাবে ফুটে আছে একটা লালচে তিল।
হঠাৎ মৃদু গলা খাঁকারিতে সম্বিত ফিরে পেয়ে ভীষণ লজ্জিত হয়ে নিগারের দিকে চাইলাম। নিগার একটু বিব্রত হেসে বলল, আমি তাহলে উঠি। আমাকে আর কিছুই বলার সুযোগ না দিয়ে নিগার দ্রুতই প্রস্থান করতেই অনুও উঠে দাঁড়ালো। সম্ভবত সে বুঝতে পেরেছে কাজটা ঠিক ভাল হলোনা। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে একবারও আমার দিকে না তাকিয়ে হনহন করে হেটে বেরিয়ে গেল।
স্বাভাবিকভাবেই শরফুদ্দীন ব্যাপারটা জেনে তেতে উঠল। নিগারের ভাই শরফুদ্দীনের কলিগ। সুতরাং সে যথেষ্ট বিব্রত একইসাথে গোটা ব্যাপারটাই তার কাছে সস্তা ড্রামা মনে হয়েছে বলে মন্তব্য করল। এবং এই সমস্ত হুজুগের পছন্দ টিকেনা বলে মতামত ব্যক্ত করল। আমি চুপ রইলাম। শরফুদ্দীন মাঝে মাঝে তেতে ওঠে সত্যি, কিন্তু ভেবেচিন্তে কাজ করার সুনাম আছে ওর। যদিও স্ত্রীর সাথে ছাড়াছাড়ির পর তাতে কিছুটা ছন্দপতন ঘটেছে। পাঁচ বছরের সংসার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়া একদিন হুট করে শেষ হয়ে গেলে দীর্ঘদিন ও এক বিমূঢ় বিস্ময়ে ডুবে ছিল। কেবল বলতো, আমি ঠিক বুঝলাম নারে, রুবি তো আমাকে ভালোবাসে! আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওর কাঁধে হাত রাখতাম। এক সময় শরফুদ্দীন ধাতস্থ হলে তরল কন্ঠে বলতো, আমি ঠিক জানিনা কিভাবে কি হলো, কিন্তু অনুভব করতে পারি। আর সেই অনুভূতি কেন যেন আমারই দিকে আঙ্গুল তাক করে।
জবাবে আমি কাঁধে আলতো করে চাপড় দিয়ে আঙ্গুলের ডগা নাচিয়ে না সূচক মাথা নাড়তাম। মাঝেমাঝে শরফুদ্দীন নিঃশব্দে কাঁদতো। আমি কাঁদতে দিতাম। কিছু সম্পর্কের ব্যবচ্ছেদ করেইবা কি লাভ? সত্য তাতে বদলায় না মোটেই। কিছু সম্পর্ক শেকলের মত, অথচ সে শেকলে মরচে ধরে ভেঙ্গে পড়লে মানুষ হয়ে পড়ে শেকড় কাটা পড়া গাছের মত। শরফুদ্দীন রুবিতে এতটাই অভ্যস্ত ছিল যেমনটা আমরা আলোবাতাসে। পুরুষমানুষ শক্তিমান, বুদ্ধিমান, সূর্যের কান্তি তার শরীর জুড়ে ঝলমল করে। আবার তারা নোংরা ঘরে ইঁদুর মরার গন্ধ সয়ে নিতে পারে, ধুলোয় অন্ধকার হয়ে আসা কক্ষে অবলীলায় নিশ্বাস নিয়ে বেঁচে যেতে পারে, নোংরা কাপড়ে সপ্তাহ পার করে দিতে পারে, কিন্তু পুরুষের হৃদয় বড় দূর্বল। পুরুষ হয়ে ওঠার পর পুরুষমানুষ সম্ভবত অনাথ হয় বউ হারালে। আচমকা একদিন আবিষ্কার করে টুথব্রাশটাও নিজের জায়গায় থাকেনা, তাকে রাখতে হয়। কাপড়টা আয়রন করা থাকেনা, করে রাখা হয়। জুতোটা, তাকেও চকচকে করা রাখা হয়। গাছে পানি না দিলে ওই ঝুলে থাকা বাহারি গাছটাও প্রতিদিন একটু একটু করে মরে যায়। ধুলোর আস্তরণে চাপা পড়ে থাকে সহাস্য যুগলছবি। এমনকি দেয়াল ঘড়িটাও একদিন বেকে বসে। সবকিছু পরিমাণ মত না হলে রান্না কিছুতেই সুস্বাদু হয়না, সুঘ্রাণ ছোটেনা পাশের বাড়ি পর্যন্ত। সস্তা বা দামী, কোনো রেস্তোরাঁর খাবারেই সেই আটপৌরে গন্ধটা পাওয়া যায়না কিছুতেই…
আর দিনশেষে চোখ বুজলে পরে কানে বাজতো যে নিঃশ্বাসের শব্দটুকু, তার অনুপস্থিতি সহ্য করা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ে।
শরফুদ্দীন অন্তর্দাহে অঙ্গার হয়ে যেন অনেকটাই বুড়িয়ে গেল। কাজপাগল ও আগে থেকেই ছিল। সেটা আরো খানিকটা বাড়লো। স্বাভাবিকভাবেই কর্মক্ষেত্রে শরফুদ্দীনের সুনাম ছিল। আর সেই সুবাদেই নিগারের সমন্ধটা আসে আমার বাড়ি পর্যন্ত। কিন্তু রেস্টুরেন্টে ঘটা অঘটনের পর আমার মনে বউ বলতে ওই স্থান কাল পাত্রের বিচার বিবেচনাহীন মেয়েটাই গেঁথে রইলো। কেন, তা নির্দিষ্ট করে বলার মত কিছুই পাইনি। হয়ত তার সহজ স্বীকারোক্তি আমার মধ্যে যে ছন্দপতন ঘটিয়েছিল, যা আর কখনো ঘটেনি, তাই!
শরফুদ্দীন প্রথমে মোটেই রাজি ছিল না। এমন উড়নচণ্ডী স্বভাব মেয়ের সংসার ধর্ম কদ্দিন ভাল লাগবে তা নিয়ে সে যথেষ্ট সন্দিহান ছিল। কিন্তু আমি তাকে রীতিমত হৃদয়ে স্থান দিয়ে ফেলেছি!

বিয়ে ঠিক হয়ে যাবার পর শরফুদ্দীন একদিন ডাকলো। অনেকক্ষণ চুপ থেকে মানিব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে বললো, তোর ভাবির চিঠি লেখার শখ ছিল। আমার কখনো জবাব লেখা হতোনা ব্যস্ততায়… এটা ওর শেষ চিঠি ছিল।

আমি দ্বিধাগ্রস্ত হাতে কাগজটা খুললাম।

“জগতে ভালোবাসতে জানাটাই বড় কথা নয়। তাতো কতজনেই জানে!
কিন্তু এমন কাউকে ভালোবাসা, যে সেই ভালোবাসাকে তারই মত করে বুঝে কৃতজ্ঞ হয়, সৌভাগ্যবান ভাবে নিজেকে, তাকে মূল্যায়ন করতে জানে, পরম পাওয়া ভেবে বুকের একদম গহীনে আগলে রাখে, এমন সৌভাগ্য ক’জনের হয়! তবেই না ভালোবাসা সার্থক হয়, পূর্ণতা পায়।
“আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
এই কথাটুকু সবাই বলতে পারেনা মুখ ফুটে। বলতে পারলেও বুঝিয়ে বলা বড় শক্ত। কিংবা যে বলে, সে নিজেই কি বুঝে বলে সব সময়?
নাহ…
তোমার কণ্টকপূর্ণ ভালোবাসা আমি সেই শুরুর মুহূর্তেই সমস্তই বুঝেছি। কিন্তু তার গহীন পর্যন্ত পৌঁছাতে আমাকে কতটা ক্ষতবিক্ষত হতে হয়েছে তা কি তুমি জানতে পেরেছো কোনো কালেই?
ভালোবাসতে তুমি সফল। এক আত্মবিস্মৃত অতীন্দ্রিয় ভালোবাসা তুমি আমাকে দিয়েছো। নিজেকে সমস্ত সমর্পণ করে ভীষণ এক ঘূর্ণির মত লণ্ডভণ্ড করেছো আমার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। নিজেকে অবধি ভুলেছি তোমার দুর্নিবার আকর্ষণ উপেক্ষা করতে না পেরে। কিন্তু তাতে কেবল নিজেকেই খুঁইয়েছি শেষতক।
তুমি তখন কোথায় ছিলে?
আজ এ জিজ্ঞাসা বড় অর্থহীন শোনায়, নাহ? ভালোবাসলে, অথচ ভালোবাসতে দিলেনা। এর চেয়ে বড় শাস্তি আর কিছু হয়?”

আমি চিঠিটা ফেরত দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
শরফুদ্দীন বলল, নারীর মন বুঝা শক্ত কিন্তু এটুকু বুঝলেও অনেক হতো যে, অবহেলা জিনিসটা একটা ব্ল্যাকহোলের মতন। নারীর অসীম সহ্য ক্ষমতা ওতে এসে নিঃশেষ হয়ে যায়। কিছু কথা, যা মানুষে মানুষে হয়না, নারীতে আর পুরুষে হয়, সে কথাগুলো বারবার আমার কাছে এসে ফিরে গেছে হৃদয়ের বন্ধ দরজায়। আমি স্বার্থপর পুরুষ, বাহু জড়িয়ে তাকে আগলে রেখেও হৃদস্পন্দন শুনবার জন্য নিজেকে একমূহুর্ত স্থির করতে পারিনি। সেই ব্যস্ততা আমাকে এখন অভিশাপ দেয়। কাজের প্রশংসাকে মনে হয় উপহাস। কতটা শূন্য আর অসম্পূর্ণ আমি, তা এক খোদা জানেন, যিনি হৃদয়সমূহের মালিক।
শরফুদ্দীনের কাছে সেদিন যা শিখেছিলাম তা আমি কখনো ভুলবো না। যে তুষের আগুন ওর ভেতরে জ্বলছে অনির্বাণ, তা নিভিয়ে ওকে একদন্ড সস্তি দিবে কিসে?
আমি বোকা মানুষ। এবং ভীতুও। যাকে আচমকা ভালোবেসে ফেলেছি তাকে হারানোর আগে আমার আরেকটা জীবনের নিশ্চয়তা চাই যে জীবনে তাকে আর হারাতে হবেনা।
বাসায় ফিরে হাসির শব্দ পেলাম। অনু খিলখিল করে হেসেই যাচ্ছে। আমি প্রচণ্ড কৌতুহল নিয়ে শোবার ঘরে ঢুকে দেখলাম একটা ছবির এ্যালবাম অনুর সামনে খোলা। আমার ছোটবেলার ছবির এ্যালবাম। আম্মুর কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিল গত সপ্তাহে।
অনুর হাসির তরঙ্গ আরো বেগবান হলো আমার উপস্থিতিতে।
আঙ্গুলি নির্দেশ করে একটা ছবি দেখিয়ে বলল, দ্যাখো দ্যাখো! এই পাতিল কাট হেয়ার স্টাইলে তোমাকে কত গুলুগুলু লাগছে দেখতে!
আমি গুণগুণ করে গাইলাম, তোমার হাসির শ্রাবণ ঢলে স্বপ্ন নিয়ে ভাসতে চাই…

“আজকে সুরাইয়ার সতের বছর পূর্ণ হলো। এরকম একটা গল্প ওকে ঠিক উৎসর্গ করা যায় কিনা তা ভাবনার বিষয়। তবু করা হল। আমি জানি,অন্যেরা যেখানে কেবলই প্রেম-ভালবাসা দেখে সেখানে এর চেয়ে বেশিকিছু দেখার চোখ আছে ওর।”

 

রান্নার স্বাদে মজাদার-স্যুপ

বড়দের এবং সোনামণিদের জন্য আজকের রেসিপি “রান্নার স্বাদে মজাদার-স্যুপ”। সোনামণিদের জন্য খুব অল্প সময়ে রান্না করে মানিকদের সামনে হাজির করতে পারবেন। চলুন দেখা যাক দুই প্রকার স্যুপের রেসিপিঃ
♣সবজি স্যুপ
♣নুডলস স্যুপ

img20171208_160759
সবজি স্যুপ

উপকরণঃ
♦–বিভিন্ন রকম সব্জি(ফুলকপি, বাধাকপি, গাজর, মটরশুটি ইত্যাদি মাঝারি সাইজ করে কাটা), ♦–টমেটো কেচাপ= ৩ টেবিল চামচ, ♦– ম্যাগি ভেজিটেবল স্যুপ= ১টা, ♦–ম্যাগি স্বাদের ম্যাজিক= ১/২ টা, ♦–ইন্ডিয়ান পেয়াজ= ২ টা (১ টা পেয়াজ কে ৬ বা ৪ ভাগ করে কাটতে হবে জাতে খোসা গুল বড় বড় হয়), ♦–মরিচ ফালি =৮-১০ টি, ♦–পানি= পরিমান মত
♦–তেল=২ টেবিল চামচ

প্রণালীঃ
১। প্রথমে হাল্কা আচে পেয়াজ নরম ভেজে নিতে হবে। এরপর কড়াই এ পানি দিতে হবে। বলক আসলে লবণ ও সবজি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।কিছুক্ষণ পরে মরিচ ফালি দিয়ে দিতে হবে।
২। সবজি সিদ্ধ হয়ে গেলে টমেটো কেচাপ দিয়ে নাড়তে হবে। সব্জির সাথে মিশে গেলে ম্যাগি স্বাদের ম্যাজিক এর অরধেক টা এবং ম্যাগি স্যুপ ২ কাপ পানির সাথে মিশিয়ে কড়াইতে ঢেলে দিয়ে একটু নেড়ে নামিয়ে ফেলতে হবে।
সহজ উপায়ে এবং অল্প সময়ে রান্না করা এই সুস্বাদু ভেজিটেবল টি রাইসের সাথে পরিবেশন করা যায়। ভেজিটেবল যারা পছন্দ করেন তারা এম্নিতেও খেতে পারেন।
img20171208_160610
নুডলস স্যুপ

উপকরণঃ
♦– ১ টেবিল চামচ তেল, ♦– ১ টেবিল চামচ মিহি রসুন কুচি, ♦– ১ টেবিল চামচ মিহি আদা কুচি, ♦– ১ মুঠো লেমন গ্রাস বা থাই গ্রাস, ♦– ২ কাপ পানি, ♦– ২ কাপ চিকেন স্টক, ♦– ১ কাপ হাড় ছাড়া মুরগীর মাংস ছোট কিউব করে কাটা, ♦– ২ প্যাকেট ইনস্ট্যান্ট নুডলস পানি দিয়ে সেদ্ধ করা, ♦– ১ টেবিল চামচ তাজা লেবুর রস, ♦– আধা চা চামচ লবণ, ♦– ২ টি মিহি পেঁয়াজ কুচি, ♦– ১ টি লাল কাঁচা মরিচ কুচি

প্রণালীঃ
১.প্রথমে একটি সসপ্যানে তেল গরম করে নিন। এতে রসুন কুচি, আদা কুচি ও লেমনগ্রাস দিয়ে কিছুক্ষণ নেড়ে নিন অল্প আঁচে।
২. এরপর চিকেন স্টক ও পানি দিয়ে এতে সেদ্ধ করা মাংস দিয়ে ফুটিয়ে নিন।এরপর ৫ মিনিট এভাবেই রান্না করে নিন মাংস সেদ্ধ হওয়া পর্যন্ত।
৩. মাংস সেদ্ধ হয়ে এলে এতে নুডলস দিয়ে দিন এবং অল্প নেড়ে বাকি উপকরণ গুলো দিয়ে আরও ৫ মিনিট অল্প আঁচে চুলার উপরেই রাখুন।
৪. ব্যস, এরপর নামিয়ে গরম গরম পরিবেশন করুন। তবে, পরিবেশনের সময় লেমন গ্রাস তুলে ফেলে দিতে ভুলবেন না।

 

‘আমাদের অপরাধ, সন্তানদের পরিণতি’ -নাঈমা জান্নাত

মা শব্দটি সবার কাছেই অতি প্রিয়। সেই সাথে বাবাও। খুবই অল্প দৈর্ঘ্যের এই শব্দ দু’টির গভীরতা অনেক বেশি। আমাদের মনে ও জীবনে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে শৈশব থেকে কৈশোরে পা ফেলার সময় এমন কী ঘটে, যার খাতিরে আমরা নৈতিক বিষয়গুলো অনেক সময় ভুলতে শুরু করি। যৌবন প্রাপ্তির স্বল্প পথ চলাটুকুতে বাবা-মা বা পরিবারের কী এমন অসতর্কতা থাকে, যার কারণে ছেলেমেয়েরা মানবিকতার নিয়মকানুন ভুলে অপাত্রে পরিণত হয়?

এখন সবারই একটাই জানার আকুতি। সেটা হলো- কেন এই অত্যাচার শিশুদের ওপর, নারীদের ওপর? কখনও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী, কখনও তিন বছরের শিশু, কখনও গৃহকর্মী, কখনও বিবাহিতা স্ত্রী। শিশু থেকে বৃদ্ধ, রেহাই পাচ্ছে না কেউই। কোথা থেকে এলো এই বর্বরতা, কিভাবে জন্ম নিলো তা। তবে কি গোড়াতেই গলদ রয়েছে আমাদের? তবুও যদি আমরা কিছু বিষয়ে সচেতন হই, সমস্যা অনেকটা কমে আসতে পারে।

সবার আগে মায়ের সচেতনতা সবচেয়ে কাম্য। একজন মা-ই পারেন, সন্তানকে নতুন করে ভাবাতে, নতুন করে পথ চলা শেখাতে। কারণ আমাদের সমাজে মা-ই শিশুর সার্বিক যত্নের গুরুদায়িত্ব পালন করে থাকেন। সেক্ষেত্রে মায়ের দৃঢ় বিশ্বাস থাকা জরুরি যে, নারী বলেই সে দুর্বল নয় এবং তাকে দিয়েই সন্তানের সুন্দর ও নির্মল ভবিষ্যৎ তৈরি করা সম্ভব।

আমরা আমাদের সমস্যাগুলোকে যদি ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে দেখি, তাহলে আমাদের সামনে বেশ পরিষ্কার চিত্র ফুটে উঠবে।

১. বাবা-মা নিজের অজান্তেই ছেলে মেয়েকে মিথ্যা বলতে আয়ত্ব করাচ্ছি। ছোট বেলায় তাদের কল্পনার গল্পগুলোকে মিথ্যা বলে আখ্যা দিচ্ছি। আবার অনেক সময় তাদের সামনে স্বামী-স্ত্রী একজন আরেকজনের কাছে মিথ্যা বলছি। অথবা প্রতিবেশির কাছে বা মোবাইল ফোনে। ঘরে বসেই বলছি রাস্তায় আছি। বিশ্রামের সময় বলছি, ব্যস্ত আছি।

২. একদিকে ছেলেমেয়েকে বলছি, ঘুষ নেয়া বা দেয়া একটি সামাজিক ব্যাধি। অন্যদিকে ভালো চাকরির জন্য যত ধরনের তদবির লাগে, তা করছি। জেনে বুঝেই এই অপরাধ করছি।

৩. অপসংস্কৃতির বেড়াজাল থেকে সন্তানদের দূরে থাকার পরামর্শ দিচ্ছি। আবার বাবা-মা নিজেই হয়তো কর্মক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতনকে খুশি করার চেষ্টায় বা বন্ধু মহলে আনন্দ উদযাপনে অপসংস্কৃতিকে আগলে রাখছি।

৪. একদিকে শ্লোগান দিচ্ছি, যৌতুক একটি সামাজিক অপরাধ। অন্যদিকে উপহারের নামে নতুন বিবাহিত দম্পতিকে যৌতুকের জন্য প্রতিনিয়ত চাপ দিচ্ছি।

৫. একদিকে বলছি, পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করো না। অন্যদিকে সন্তানের পরীক্ষার আগের দিন প্রশ্নপত্র ফাঁসের আশায় রাত জেগে বসে আছি।

৬. ছেলেমেয়েকে শেখাচ্ছি, বাবা-মায়ের কাছে কিছুই গোপন করতে নেই। অন্যদিকে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের কাছে প্রতিনিয়ত নানা বিষয় লুকিয়ে রাখছি।

৭. একদিকে বলছি, বড়দের সম্মান করো, ছোটদের স্নেহ কর। অন্যদিকে বাসার গৃহকর্মীকে সন্তানের সামনেই নানাভাবে অত্যাচার অপমান করছি।

৮. সমস্যা মোকাবেলার ক্ষেত্রে ছেলে মেয়েদের  ধৈর্য্য ধারণ করার কথা বলছি। বাসাকে পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখার কথা বলছি। আবার সেই বাবা-মা-ই বাসের লাইন থেকে শুরু করে ব্যাংক পর্যন্ত যে কোন নিয়ম ভাঙার ক্ষেত্রে উৎসাহ যোগাচ্ছি।

৯. একদিকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কথা বললেও অন্যদিকে বাবা মায়েরা রাস্তায় ময়লা ফেলা থেকে শুরু করে কথাবার্তায় পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখছি না।

১০. ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাকে শেখাচ্ছি, না বলে কারো জিনিস নিও না। অন্যদিকে আমরাই অন্যের সম্পদ লুটপাটের মহোৎসবে ব্যস্ত আছি।

১১. বাসায় একটি শিশু প্রতিনিয়তই দেখছে, তার মাকে বাসায় বয়স্ক, নারী বা পুরুষ যে কেউ নানাভাবে অপদস্থ করছে। তবে আমরা কি আশা রাখতে পারি যে, পরবর্তীতে ঐ শিশুর আচরণে নারীর প্রতি সম্মান প্রতিফলিত হবে?

১২. একদিকে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন, আরেকদিকে সিগারেটের ধোঁয়ায় অসংখ্য জীবনের ক্ষতি করছি, যত্রতত্র দাঁড়িয়ে বা চলার পথে দেদারসে ধূমপান করছি। নিকোটিনের ধোঁয়া উড়িয়ে নিজেকে স্মার্ট সাজাচ্ছি। আসলে ধোঁয়ায় কি কোন আত্মবিশ্বাস আনে?

আমরা কি রুখতে পারি, আমাদের নিজেদের ছোট ছোট অস্বাভাবিকতাকে? ছোট ছোট অস্বাভাকিতা থেকেই বড় অপরাধের জন্ম। একজন মা যখন নিজেই দুর্বল, সে কি পারবে অপরাধ প্রবণতা রুখতে? এতকিছুর পরও সমাজে অনেক উল্টো চিত্রও আছে। আমাদের বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা করলেই আমরা বুঝতে পারি, সে সংখ্যা কত হতে পারে। একজন মাকে গড়ে উঠতে হবে আত্মবিশ্বাস নিয়ে। সব ধরনের অপরাধ, কুরুচিকে না বলার ক্ষমতা নিয়ে। যে কোন অশোভনীয় আচরণকে একজন মা যখন দৃঢ় কণ্ঠে না বলতে পারবেন, তখনই কেবল শিশুরা অগ্রগামী সৈনিকের মতো একদিন সব অস্বাভাবিকতা নির্মূল করতে পারবে। নেপোলিয়ন ঠিকই বুঝেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত ও সভ্য জাতি দেব’।

তারপরও অনেক শঙ্কা, উৎকণ্ঠা, অনেক প্রশ্ন মনে নাড়া দিয়ে যায়। এ ধরনের সামাজিক অপরাধ ঠেকাতে কি আইনের যথাযথ প্রয়োগ নাকি আচরণের পরিমিতি আর চিন্তার পরিচ্ছন্নতা একান্ত কাম্য?

লেখক :  ফ্রিল্যান্স সাইকোলজিস্ট ও এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সুত্র:জাগোনিউজ২৪

 

‘সুরাইয়াকে’ গলাটিপে হত্যার পর মুখে বিষ ঢেলে দিলেন স্বামী ‘হিমু’

ঝালকাঠিতে কলেজছাত্রীকে গলাটিপে হত্যার পরে মুখে বিষ ঢেলে আত্মহত্যার প্রচারণা চালানোর কথা স্বীকার করেছেন তার স্বামী গ্রেফতারকৃত মাইনুল ইসলাম হিমু আকন (২৫)। মঙ্গলবার বিকালে ঝালকাঠির সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এইচ এম কবীর হোসেন ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় মাইনুল ইসলামের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করেন।

এর আগে মঙ্গলবার সকালে থানা হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের কাছে স্ত্রীকে হত্যার বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য প্রকাশ করে হিমু। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সরোয়ার হোসেন মঙ্গলবার বিকাল ৩ টায় গ্রেফতারকৃত মাইনুল ইসলামকে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি রেকর্ড করার আবেদন করেন। বিকাল ৫টায় স্বীকারোক্তি গ্রহণ শেষে মাইনুলকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এইচএম কবীর হোসেন।

আদালত ও পুলিশ সূত্র জানায়, স্বীকারোক্তিতে হিমু জানিয়েছে, গত রোববার দুপুর একটার দিকে গলা টিপে স্ত্রীকে হত্যার পর বিষয়টি তার পিতা মিল্টন আকনকে জানান। মিল্টন আকন তার ছেলেকে বিষ খাওয়ার ঘটনা সাজানোর কথা শিখিয়ে দেয়। পিতার পরামর্শে হিমু তার মৃত স্ত্রী সুরাইয়া ইয়াসমিনের মুখে তুঁতে ঢুকিয়ে দেয় এবং নিজেও তুঁতে খেয়ে অসুস্থ হওয়ার অভিনয় করে।

প্রায় দুই বছর আগে দুই পরিবারের সম্মতি ছাড়াই শহরের কাঠপট্টি সড়কের মিল্টন আকনের ছেলে মাইনুল ইসলাম আকন হিমু একই এলাকার আসলাম ফরাজীর মেয়ে বিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সুরাইয়া ইয়াসমিন বিয়ে করেন। বিয়ের পর থেকে হিমুর বাবা মিল্টন আকন এবং সৎ মা আয়শা বেগম এ বিয়ে মেনে নেননি।

এ নিয়ে প্রায়ই পারিবারিক কলহ লেগে থাকত হিমুর পরিবারে। হিমুর স্ত্রী সুরাইয়া ইয়াসমিন বেশিরভাগ সময় তার বাবা মায়ের সাথে থাকতেন। হিমুও মাঝে মধ্যে সেখানে গিয়ে থাকতেন। কিছু দিন আগে থেকেই হিমু তার বাবা মাকে তাদেরকে মুড়ির মিলের কক্ষে একটু থাকার জায়গা দেয়ার জন্য অনুরোধ করে আসছিল।

রোববার সকালে সুরাইয়াকে ফোন করে হিমু তার বাবার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মুড়ি ও সেমাই তৈরির কারখানার দোতলায় আসতে বলে। বেলা ১২টার দিকে ওই কক্ষে আসে সুরাইয়া। স্ত্রীর সঙ্গে ঘন্টাখানেক অন্তরঙ্গ সময় কাটায় হিমু। দুপুর একটার দিকে বাবার সমালোচনা করায় সুরাইয়ার সাথে হিমুর কথাকাটাকাটি হয়।

একপর্যায় হিমু সুরাইয়াকে চড় মারে এবং সুরাইয়াও হিমুকে পাল্টা ধাক্কা মারে। উত্তেজিত হিমু গলাটিপে শ্বাসরোধে স্ত্রীকে হত্যা করে। হত্যাকান্ডের পুরো ঘটনা হিমু তাঁর বাবাকে জানায়। বাবা মিল্টন আকন মৃত স্ত্রীর মুখে বিষ ঢেলে দেয়ার বুদ্ধি দেয় ছেলেকে। এমনকি ছেলেকেও বিষপানের পরামর্শ দেন। বাবার কথামতো হিমু মৃত স্ত্রীর মুখে বিষ ঢেলে দেয়। নিজেও বিষপান করে চিৎকার দেয়। মৃত অবস্থায়ই ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় সুরাইয়াকে। কিছুটা অসুস্থ অবস্থায় হিমুকে নিয়ে যাওয়া হয় বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

ঝালকাঠি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবুল কালাম আজাদ জানান, জিজ্ঞাসাবাদে হিমু জানিয়েছে সে আগে নেশা করতো, এখন করে না। তিনি এসএসসি পাস হলেও তার স্ত্রী বিএ পড়েন। বেকারত্ব এবং পরিবার বিয়ে মেনে না নেয়ায় সে কিছুটা হতাশাগ্রস্ত ছিল। বাবাকে নিয়ে কটূক্তি করায় ক্ষিপ্ত হয়ে হিমু স্ত্রীকে গলা টিপে ধরে। এতেই তার মৃত্যু হয়। লাশ ফেলে রেখে ওপর থেকে নিচে নেমে হিমু তার বাবার কাছে যায়। বাবা তাকে স্ত্রীর মুখে বিষ ঢেলে ও ছেলেকে বিষ পানের বুদ্ধি দেয়।
মৃত্যুর পরের সব নাটক সাজিয়েছেন হিমুর বাবা মিল্টন আকন। পুলিশ মামলার অপর আসামিদের গ্রেফতারের জন্য বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালাচ্ছে।
সুত্র: নয়াদিগন্ত

 

শূন্যতা উদ্ভাসিত পূর্ণতায়… আফরোজা হাসান 

কেন জানি না কিছুই ভালো লাগছে না মুহিতের। সামনে পরীক্ষার তাই অনেক পড়া জমে আছে কিন্তু বই নিয়ে বসতে ইচ্ছে করছে না। সাধারণত টিভি দেখে না সে আর দেখলেও শুধু জিওগ্রাফী চ্যানেল দেখে। প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য ভীষণ রকম আকর্ষণ করে তাকে। কিন্তু অজানাকে জানার আগ্রহ আজ মনে কোন উচ্ছ্বাস তৈরি করতে পারলো না। কিছু যেন বাঁধা দিচ্ছে তাই ভেতর প্রবেশ করতে পারছে না বিশুদ্ধ বাতাস। কেমন যেন দম বন্ধ করা অনুভূতি হচ্ছে। কেমন যেন হাহাকার জাগানো শূন্যতার অনুভূতি হতে লাগলো মুহিতের। নিজেকে হঠাৎ আবিষ্কার করলো ধূ ধূ এক মরুভূমির মাঝে। চারিদিকে কেউ নেই, কিছু নেই। যতদূর চোখ যায় শুধু শূন্যতা আর শূন্যতা। অসহায়ত্বের উত্তাল সাগরের ঢেউ ভাসিয়ে দিয়ে গেলো মনের সৈকত। তীব্র স্রোতের ঝাপটা এসে লাগলো চোখে, ছলকে ছলকে বেড়িয়ে আসতে চাইলো পানির ধারা। 

এমন মুহুর্তগুলোতে প্রিয়জনদের সাথে কথা বললে অনেক প্রশান্ত হয় মন শুনেছিল সে। এমন কেউ যার সাথে কথা বলতে ভালো লাগে, যার কথা শুনতে ভালো লাগে। মনের অজানা ঝড়ের তাণ্ডবে নিভু নিভু আশার প্রদ্বীপ্তিকে যে দুহাতে আগলে ধরে আবার জ্বলে উঠতে সাহায্য করে। যার আশা জাগানিয়া শব্দরা কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশ ভেদ করে হাজির হয় সূর্য কিরণ রূপে। বাবার সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছে করলো মুহিতের। কিন্তু সে জানে মনের এই অবস্থায় বাবার সাথে কথা বলতে গেলে আরো বেশি দুর্বল হয়ে যাবে। আর তার কণ্ঠ শুনেই বাবা বুঝে ফেলবেন কিছু একটা হয়েছে তার। কিভাবে যেন বাবা তার মনের সব কথা না বলতেই বুঝে ফেলেন। শুধু তাই না প্রয়োজন গুলোও কখনো মুখে বলতে হয় না বাবাকে। যখন যা দরকার বলার আগেই বাবা সবময় সেটা এনে দিয় তাকে। 

বন্ধুদের আড্ডায় সবাই যখন তাদের মাদের কথা বলে, মুহিত মুগ্ধ কণ্ঠে বাবার কথা বলে। অবশ্য মাকে নিয়ে বলার মতো তেমন কিছু নেইও মুহিতের। তার যখন তিন বছর বয়স মা চলে গিয়েছেন কভু না ফেরার দেশে। এরপর থেকে গত পনেরো বছর ধরে তার ভুবন বাবাময়। বাবা-মা-ভাই-বোন-বন্ধু সবকিছুর ভূমিকা বাবা একাই পালন করে যাচ্ছেন তার জীবনে। নিজের কোন কারণে বাবাকে টেনশন দিতে একদম ইচ্ছে করে না মুহিতের। তাই কথা বলার প্রচণ্ড ইচ্ছার পরও বাবাকে ফোন না দিয়ে পছন্দের দুই ক্লাসমেটকে ফোন করলো। কিন্তু একজনের ফোন বন্ধ আর আরেকজনেরটা এনগেজ টোন শুনিয়ে জানিয়ে দিলো সবাই নিজ নিজ জীবনে ব্যস্ত। তোমাকে দেবার মত সময় এখন কারোই নেই। 

মন খারাপের মাত্রাটা হঠাৎ করে আরো বেড়ে গেলো মুহিতের। আগেও দেখেছে যখন প্রয়োজন তখন আপন বা পছন্দের কাউকেই পাশে পাওয়া যায় না। এমনকি যারা নিজেদের বিরক্তিকর অবসরের কথা বলে তাদেরকেও খুঁজে পাওয়া যায় না এমন সময় গুলোতে। একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো মুহিতের ভেতর থেকে। কেন এমন শূন্যতা ভর করেছে মনে বোঝার চেষ্টা করলো। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও শূন্যতার পেছনের কারণ খুঁজে বের করতে পারলো না। মোবাইলের শব্দে চিন্তার জগত থেকে বেড়িয়ে এলো মুহিত। স্ক্রীনে বাবার হাসোজ্জ্বল চেহারা দেখে আনন্দাশ্রুতে ভরে এলো দুচোখ। ছেলে হিসেবে খুব বেশি ইমোশনাল হবার মোহর সবাই মিলে অনেক আগেই লাগিয়েছে তার উপর। মুহিত নিজেও অনুভব করে সত্যি তার বয়সী অন্যান্য অনেক ছেলের চেয়ে অনেক বেশি স্পর্শকাতর সে, অনেক বেশি অভিমানী তার মন। 

সালাম বিনিময়ের পর বাবা বললেন, বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পর পেলাম তোমাকে। কথা বলছিলে কারো সাথে? 

মুহিত বলল, জ্বী না বাবা। বন্ধুদের ফোন করার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু পাইনি কাউকেই। 

মন খারাপ তোমার? কণ্ঠস্বর কেমন যেন বিষণ্ণ শোনাচ্ছে। 

বাবার কাছে কখনোই কিছু গোপন করে না মুহিত। অবশ্য চাইলেও পারে না গোপন করতে। তাই বলল, কেন জানি না ভালো লাগছিলো না বাবা। খুব একাকীত্ব বোধ হচ্ছিলো। তাই বন্ধুদের সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু সবাই ব্যস্ত। 

কিছুক্ষণ নীরবতার পর মুহিতের বাবা হেসে বললেন, হ্যা প্রয়োজনের সময় বেশির ভাগই আমাদের বন্ধুরা ব্যস্ত থাকে। আবার অনেক সময় আমরা নিজেরাই কিছু বন্ধুকে দূরে রাখতে চাই সমস্যা থেকে। 

মুহিত বলল, আমি তোমাকে ফোন করিনি সেজন্য কি তুমি কষ্ট পেয়েছো বাবা? 

বাবা হেসে বললেন, না আমি কষ্ট পাইনি। আমি তোমাকে বুঝতে পারছি। কারণ আমার নিজের ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়। আমি আমার মন খারাপ বা সমস্যার কথা বলে কোন প্রিয় মানুষের মন খারাপ করতে চাই না। 

তাহলে তোমার মন খারাপ হলে তুমি কি করো বাবা? 

আমি এমন এক বন্ধুর কাছে যাই যে কখনোই ব্যস্ত থাকে না। যে কখনোই আমার কোন সমস্যা শুনে মুষড়ে পরে না। কারণ আমার সব সমস্যার সমাধান তার কাছে আছে। তাই তার কাছ থেকে কখনোই আমাকে নিরাশ বা আশাহত হতে হয় না। তুমি কি আমার সেই বন্ধুর সাথে পরিচিত হতে চাও? 

মুহিত বলল, অবশ্যই বাবা। কে তিনি? 

তিনি হচ্ছেন কালামুল্লাহ। আল্লাহর কালাম। যা লিপিবদ্ধ আছে পবিত্র কুরআনে। জানি খুব অবাক হচ্ছো তুমি আমার কথা শুনে। কিন্তু একথা নিয়ে দ্বিমত বা দ্বীধা পোষণের কোন সুযোগই নেই যে কুরআন আমাদের শ্রেষ্ঠ বন্ধু। একজন ব্যক্তি তখনই আমাদের খুব ভালো বন্ধু হয় যখন তাকে আমরা শুভাকাঙ্খী বা কল্যাণকামী হিসেবে আমাদের পাশে পাই সর্বদা। আর কালামুল্লাহ’র চেয়ে শুভাকাঙ্খী বা কল্যাণকামী কে হতে পারে আমাদের জন্য? তুমি যদি খুঁজে দেখো তোমার মনের প্রতিটি অবস্থা ও পরিস্থিতির বর্ণণা ও সমাধান খুঁজে পাবে কুরআনে। করণীয়-বর্জনীয়, পরামর্শ ও দিক নির্দেশনা খুঁজে পাবে। কুরআনের সুমধুর ধ্বনি তোমার অশান্ত হৃদয়ে প্রশান্তির বারিধারা বইয়ে দেবে। কাঁটা বিছানো পথ রুপান্তরিত হবে ফুল ছড়ানো পথে। তবে গুরুত্বপূর্ণ কথা কি জানো? 

কি বাবা? 

কোন মানুষের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব যেমন হুট করে একদিনেই হয়ে যায় না। বরং নিয়মিত যোগাযোগ রাখার মাধ্যমে ধীরে ধীরে হৃদ্যতা বৃদ্ধি পায়। কুরআনের ক্ষেত্রেও কিন্তু ঠিক এমনটিই। যত তুমি কুরআনের দিকে এগোবে ততই কুরআনকে তোমার সান্নিধ্যে পাবে। কারণ কুরআনের কাছাকাছি যাওয়া মানে আল্লাহর নিকটাবর্তী হওয়া। আর হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি রাসূল (সঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে,মহান আল্লাহ বলেছেন,”বান্দাহ যখন আমার দিকে আধ হাত পরিমান এগিয়ে আসে,আমি তার দিকে এক হাত পরিমান এগিয়ে যাই। আর যখন সে আমার দিকে এক হাত এগিয়ে আসে,আমি তার দিকে দুই হাত এগিয়ে যাই। আর যখন সে আমার দিকে হেঁটে আসে,আমি তার দিকে দৌড়ে যাই।” সুবহানাআল্লাহ। যদি আল্লাহ কারো আশ্রয় হন তাহলে তার তো একাকীত্ব বোধ করার কোন সুযোগই থাকে না। কারণ আল্লাহ তো সর্বত্র বিরাজমান। 

অনেকটা সময় চুপ থেকে মুহিত বলল, আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না বাবা। 

বাবা বললেন, আমাদের দুর্ভাগ্য কি জানো মুহিত? দুনিয়ার পেছনে ছুটতে ছুটতে আমরা আমাদের জীবনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকেই ভুলে গিয়েছি। মুমিনের জীবনের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য হচ্ছে মহান আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলা’মীনের ভালোবাসা, বন্ধুত্ব ও তাঁর সান্নিধ্য অর্জন করা। ভেবে দেখো পৃথিবীতে কারো ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব পাওয়ার জন্য কত কিছুই না আমরা করে যাই বিরামহীন ভাবে। অথচ এটা কখনোই আমাদের সম্পূর্নরুপে জানা থাকে না যে,যাকে আমরা ভালোবাসি বা যাকে বন্ধু রূপে পেতে চাইছি তাকে পাওয়ার জন্য কি কি করতে হবে? কোন দিক নির্দেশনা যেহেতু দেয়া থাকে না তাই বিভিন্ন ভাবে আমরা বুঝে নিতে চেষ্টা করি। বুঝে নেয়ার ও বোঝার পরের সফর পারি দিতে অনেক ধরণের কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয় এবং তা করার জন্য প্রস্তুত থাকি আমরা। কারণ সম্পর্ক থেকে কিছু পেতে হলে কিছু দেয়া প্রধান শর্ত। তাই আমরা খুশি মনেই তা করি কারণ লক্ষ্য থাকে প্রিয় মানুষকে সন্তুষ্ট করার মাধ্যমে তার ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব অর্জন। জীবন চলার পথে সুখ-দুঃখ ও আনন্দ-বেদনার মুহুর্তগুলোতে পাশে পেতে চাই তাই অনেক কদর করি তাদের। অথচ যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, যার রহমত ছাড়া একটি মুহুর্ত আমাদের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয় ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব পেতে আমরা কি ত্যাগ স্বীকার করি? অথচ আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন তো আমাদের শুধু এই দুনিয়াতেই ভালোবাসেন না বরং পরকালেও দিবেন চির শান্তির জান্নাত। আর তাঁর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আমাদের কি করতে হবে তাও তিনি বলে দিয়েছেন কুরআনে। শুধু বলেই দেননি রাসুল (সঃ) মাধ্যমে বাস্তবে তাঁর প্রতিফলন করে দেখিয়েছেন। যাতে আমাদের কোন কিছু নিয়ে দ্বীধা-সংকোচে ভুগতে না হয়। ভেবে দেখো আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের চেয়ে বড় শুভাকাঙ্খী ও কল্যাণকামী কি কেউ হতে পারবে আমাদের জন্য? 

মুহিত বলল, ইনশাআল্লাহ বাবা এই মুহুর্ত থেকে আমি কুরআনকে আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করলাম। তুমি ঠিক বলেছো বাবা সেই তো শ্রেষ্ঠ বন্ধু যে সর্বাবস্থায় কল্যাণকামী হিসেবে পাশে পাওয়া যায়, যাকে কোন কথা বলতে দ্বীধা-সংকোচ স্পর্শ করতে পারে না। যে সবসময় শুনিয়ে যায় আশার কথা, দিয়ে যায় নিরবধি প্রেরণা, যার সঙ্গ সর্বদা অন্তরকে করে প্রশান্ত। যে স্বপ্ন দেখায় সুন্দর এক জগতের। মনের সকল শূন্যতা যার ছোঁয়ায় উদ্ভাসিত হয় পুর্ণতায়। আর একমাত্র কুরআনই এমনটা হতে পারে কারো জন্য। বাবা আজ থেকে তাই তোমার মতো আমারো সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু হচ্ছেন কালামুল্লাহ। 

বাবা হেসে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। তাহলে তুমি তোমার বন্ধুর সাথে সময় কাটাও এখন। অফিসের কাজ সেরে বাসায় ফিরে কথা হবে, ইনশাআল্লাহ। 

বাবাকে বিদায় জানিয়ে মুহিত কুরআন ও তাফসীর নিয়ে বসলো।

 

‘মেয়েটিকে নানান অজুহাতে মারধর ও টয়লেটে বন্দি রাখত’

‘আমাকে মারধর করত, কম খাবার দিত। বাবা-মার সঙ্গে কথা বলতে দিত না, বাড়ির বাইরে যেতে দিত না। ওরা মানুষ না, অমানুষ। আল্লাহ ওদের বিচার করবে।’ এভাবেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথা বলছিল গৃহপরিচালিকা সুমি খাতুন। সুমি এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

পাবনার চাটমোহরে গৃহবন্দি অবস্থায় সুমি খাতুনকে (১৫) উদ্ধার করেছে পুলিশ। গতকাল রোববার রাত সাড়ে ৯টার দিকে পৌর শহরের ছোট শালিকা মহল্লা (কালীনগর) থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়। সুমি পার্শ্ববর্তী গুরুদাসপুর উপজেলার দড়িহাসমারি গ্রামের শফিকুল ইসলামের মেয়ে।
এ সময় বাড়ির গৃহকর্তা আবদুস সোবহান বিচ্ছু, তাঁর স্ত্রী ফেরদৌসি বেগম এবং ছেলে ফজলে রোহানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসে পুলিশ।

জানা গেছে, দড়িহাসমারি গ্রামের আলতাব হোসেন সুমিকে পাঁচ বছর আগে আবদুস সোবহান বিচ্ছুর বাসায় কাজ করার জন্য রেখে যান। তুচ্ছ ঘটনায় আবদুস সোবহানের স্ত্রী ফেরদৌসি মেয়েটিকে নানা অজুহাতে মারধর করতেন ও টয়লেটে বন্দি করে রাখতেন। সুমিকে প্রয়োজন মতো খেতে দেওয়া হতো না। বাড়ির বাইরে তাকে বের হতে দেওয়া হতো না। এতে করে মেয়েটি অসুস্থ হয়ে পড়ে। এই অবস্থা দেখে প্রতিবেশীরা মানবাধিকারকর্মীদের বিষয়টি খুলে বলেন এবং পুলিশকে অবহিত করেন।
img20171204_235124
রোববার রাত সাড়ে ৯টার দিকে মানবাধিকারকর্মীরা ওই বাড়িতে গিয়ে সুমিকে উদ্ধারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে পুলিশ গিয়ে সুমিকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। তবে ওই সময় সুমির গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রীর ভয়ে কোনো অভিযোগ না আনায় পুলিশ মুচলেকা নিয়ে তাঁদেরকে ছেড়ে দেয়।

মানবাধিকার কমিশন চাটমোহর উপজেলা শাখার সভাপতি কে এম বেলাল হোসেন স্বপন বলেন, ‘আমরা গত দুদিন আগে এমন অভিযোগ পেয়ে বাড়িটির ওপর নজর রাখছিলাম। রোববার ওই বাড়ির মালিককে কয়েকবার বিষয়টি জিজ্ঞেস করলে তাঁরা সুমিকে গৃহবন্দির বিষয়টি অস্বীকার করেন। পরে পুলিশ গিয়ে সেই বাড়ি থেকেই সুমিকে উদ্ধার করে।’ বিষয়টি অমানবিক বলে তিনি জানান, সুমির চিকিৎসা ও আইনী সহায়তার জন্য চাটমোহর উপজেলা মানবাধিকার কমিশনের কর্মীরা পাশে থেকে সহযোগিতা করবে।

এ বিষয়ে চাটমোহর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম আহসান হাবীব জানান, সুমিকে উদ্ধার এবং বাড়ির গৃহকর্তা-গৃহকর্তী ও তাঁদের ছেলেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসা হয়। কোন অভিযোগ না থাকায় তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে মেয়েটির পরিবারকে খবর দেওয়া হয়েছে। তাঁরা অভিযোগ দিলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সুত্র: এনটিভি, ছবি:যুগান্তর,এনটিভি।

 

শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য “সুন্দর সামাজিক পরিবেশ” -ফাতেমা শাহরিন

শিশুদের সুস্থতার জন্য শারীরিক স্বাস্থ্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি মানসিক স্বাস্থ্যও।মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সুষ্ঠ স্বাস্থ্যকর সামাজিক পরিবেশ ভূমিকা অপরিসীম। সন্তানদের মা-বাবাসহ এবং সকল কেয়ারগিভারদের (দাদা-দাদীসহ সকল পারিবারিক সদস্য) মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান জানা থাকলে মানসিক বিকাশ সুন্দর হয়।
img20171204_233625
প্রবাদে আছে “একটি মানসিকভাবে অসুস্থ শিশুর পেছনে কাজ করে একটি অসুস্থ পরিবারের প্রভাব।”
শিশুটি পরিবারের সবার সন্তান। মা-বাবার অথবা অন্যান্য পারিবারিক সদস্যদের মাঝে যদি সম্পর্ক ভালো না থাকে তাহলে ছেলেমেয়েদের মনের গঠন প্রক্রিয়ার ওপরে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
img20171204_225706
আসুন প্রথমে জানা যাক ‘সামাজিক পরিবেশ’ আসলে কি?
সামাজিক পরিবেশ গড়ে ওঠে মুলত এই তিনটি সেক্টর মাধ্যমে।যেমন-
img20171204_234018
একজন ব্যক্তির চারপাশের পরিবেশ(physical surroundings): একজন বক্তির চারপাশের পরিবেশ বলতে নিরাপদ ঘর, শিক্ষার সুবিধা, স্বাস্থ্যসেবা, চাকরি এবং বিনোদন অন্তর্ভুক্ত।
img20171204_225756
জনসমাজ (community resources):জনসমাজে অন্তর্ভুক্ত আছে হোম পলিটিক্স, গড়ে ওঠা সংগঠন, যেখানে থেকে শিশুরা পায় নানান জ্ঞান, দক্ষতা এবং সামাজিকতা।
img20171204_224508
সামাজিক সম্পর্ক (social relationships): পরস্পরের সাথে সুন্দর সম্পর্ক, একে অপরের সাথে আবার দল বা গ্রুপের সাথে ইতাদি।
শিশুদের সামাজিকভাবে বিকশিত করার জন্য তাই এই তিনটি সেক্টরের গুরুত্বপূণ ভূমিকা আছে। মনে রাখতে হবে, এখানে শিশুদের সামাজিক ক্ষেত্র হল “পরিবার”।

এবার অসুস্থ সামাজিক পরিবেশের কতকগুল বৈশিষ্ট্য দেখি,
img20171204_225308
♦দাম্পত্য কলহ:
মা-বাবার মধ্যে অথবাা অন্যান্য পরিবারের সদস্যদের সাথে প্রকাশ্যে সর্বদাই যদি খিটিমিটি বা দাম্পত্য কলহ লেগে থাকে। তাহলে মা-বাবার স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন যেমন ক্ষুণ্ণ হয় তেমনি তাদের ভেতরে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। ফলে তার পভাব সন্তানের উপর পড়ে।
img20171204_225356
♦বাবার মেজাজ:
অত্যাধিক কড়া বাবা “বাবার হুকুমই সর্বোচ্চ হুকুম”। বাবা যখন রাগী এবং রুক্ষ স্বভাবের, হুকুমের নড়চড় হলে বাড়িতে অশান্তি বেঁধে যাবে। শিশুদের মনের ভেতরে রাগ ক্ষোভ বা বেদনা ধুমায়িত হয়ে ঘোরাফেরা করে।
img20171204_225442
♦রাগী মা:
খুব ব্যক্তিত্বশালী মায়েরা সংসারে ঠিক উল্টো ছবি আঁকেন। তার রাগারাগির ভয়ে শিশুরা তটস্ত হয়ে থাকে।কখনো প্রতিবাদী হয়ে ওঠে উঠতি বয়সী শিশুরা। মায়ের এতবেশি নিয়মকানুন মানতে রাজি থাকেন না তারা।
img20171204_234602
♦অন্যান্য কেয়ারগিভারের আচরণ:
দাদা দাদীরা যদি বাবা বা মায়ের নামে বিভিন্ন অভিযোগ নাতী নাতনীর কাছে পেশ করে। অথবা কেয়ার গিভারদের সম্পর্কে অর্থাৎ দাদা-দাদী, নানা-নানী এবং দুই পরিবারের সদস্য সম্পর্কে বাবা অথবা মা সন্তানদের কাছে বিরূপ এবং বিভিন্ন দোষারোপ করে এক্ষেত্রে বাচ্চাদের সামাজিক বিকাশ ব্যাহত হয়।
যেহেতু শিশুর সমাজ বলতে তার পরিবার, রাষ্ট্রও তার পরিবার।
img20171204_225212
অসুস্থ সামাজিক বিকাশের ফলে বাচ্চাদের আচরণগত কতকগুল সমস্যা দেখা যায়।
সেগুল হলো-
১.শিশুরা অস্বাভাবিক চালচলন শুরু করে।জেদ, রাগ, মারামারি।
২.ঠিকমতো স্কুলে না যায় না।
৩.পড়াশোনায় ভালোভাবে মনোযোগ দেয় না।
৪.রাতের বেলা না ঘুমানো।
৫.মিথ্যা কথা বলে।
৬কথায় কথায় বাবা-মায়ের সঙ্গে তর্ক করে বা বাবার হুকুম অমান্য করার সাহস দেখায়।
৭.খাওয়ার টেবিলে খাবার ছুড়ে ফেলে।

শিশুটি কি আদৌ সুন্দর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বড় হচ্ছে নাকি সামাজিক পরিবেশে সমস্যা আছে। খুঁজে দেখুন। আমরা আমাদের শিশুটিকে সুশীল করে গড়ে তুলতে চাই। এই পরিবেশ পরিস্থিতিতে তোলা সম্ভব কি না সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহাতীত প্রশ্ন আছে।

তাহলে শিশুদের ভবিষ্যৎ এর জন্য কি করব আমরা?
img20171204_225016
♥বাবা-মার নিজেদের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি:
শিশুরা যেহেতু প্রতিটি মা-বাবাদের খুবই প্রিয় এক অস্তিত্ব। সুতরাং মা-বাবা তাদের জীবনে সুন্দর করার লক্ষ্যে সর্বদাই নিজেদের সুখ ও শান্তির দিকে শুধু নয় বরং সার্বিক সুন্দর দাম্পত্য সম্পর্ক বজায় রাখবে। নিরাপদ বসবাসের জন্য পৃথিবীটাকে তাদের জন্য সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতে হলে হতে হবে সচেতন।
img20171204_230130
♥পারিবারিক সুন্দর বন্ধন:
একটি শিশু যদি পরিবারে জন্ম না নেয়, তাহলে সেই পরিবারের মুখ থেকে হাসি হারিয়ে যায়। নিজেদের খুবই দুর্ভাগা বলে মনে করে। শিশুটি জন্মের পর থেকে যেন পুরো পরিবারের বন্ধনগুলর বিশৃঙ্খলার জন্য শিশুর বিকাশে সমস্যা হয়ে না দেখা যায় সে জন্য পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মাঝে যেন থাকে সুন্দর বন্ধন।
img20171204_224533
♥শিশুকে নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত প্রতিযোগী না হয়ে ওঠা:
আজকাল শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতরে সীমাহীন এবং অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতা ঢুকে গেছে যা শিশুদের কোথাও আর ঢিলেঢালা হওয়ার সুযোগ দেয় বা। আজকাল শিশুদের মা-বাবারা অন্য শিশুদের মা-বাবার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় করে। ফলে শিশুটি পরীক্ষায় ফল খারাপ করলে মা-বাবা তার সঙ্গে কথা বলে না। স্বামী-স্ত্রীর ভেতর শিশুকে নিয়ে প্রচণ্ড বাগবিতণ্ডা শুরু হয়ে যায়। এই নোংরা প্রতিযোগিতা ক্ষতিকর। সুতরাং সচেতনতা প্রয়োজন।
img20171204_231409
শিশুদের জন্য যেমন গভীর ভালবাসা আছে তেমনি দ্বায়িত্ববোধ। আমরা যা কিছু করি না কেন, সব সময়ই থাকে শিশুরা আমাদের জীবনের প্রতিটি ভাবনায় নিয়ে, তাই আমরা সবসময় তাদের কল্যাণ চাই। আমরা তাদের অনেক ভালোবাসি।

 

‘একজন রাকিবার কথা বলছি’

চমৎকার রৌদ্দজ্জল সকালে বারান্দায় মাদুর পেতে বসে আছে হয়ত ওরা তিন ভাই বোন কল্পনায় সেই চিত্র। ওদের মা রাকিবা আখতারের সাহসিকতা গল্প জানানোই আজকের আর্টিকেলের মুল উদ্দেশ্য। যা মা দের অনুপ্রেরণা যোগাবে। ‘সফলতা’ জীবন যাপনের ক্ষেত্রে একটি কাঙ্ক্ষিত শব্দ। সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠির কাছে তাদের পেশার বৈচিত্র্যতার ধরণ অনুযায়ী সফলতা একেক অর্থ বুঝায়। তবে ধরণ যাই হোক না কেন সফলতার শীর্ষে যারা পৌঁছে যেতে পারেন তারা হয়ে ওঠেন আমাদের প্রিয় ‘হিরো’।

জগতের প্রতিদিনকার চ্যালেঞ্জ সামাল দিয়ে টিকে থাকা এই ‘মা’ তাকে নিয়েই আমাদের আয়োজন ‘একজন রাকিবার কথা বলছি’ ।

সেদিন ফেইস বুকের একটি পোষ্টে (https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1541462359251846&id=260876280643800) চোখ আটকে গেল। একজন মায়ের সংগ্রামের কথা , রাকিবা নামের একজন সাহসী মা অপরাজিতার ভাষায়, তুমিও কি রাকিবা হতে চাও? সেই ‘সফলতা’ অনুভূতির কথা বলি।

সফলতার গল্পগুল অনেক মানুষকে স্বপ্ন দেয়। যার জন্য আমরা সবসময় সফল মানুষদের শুরুর দিকের গল্প শুনতে আগ্রহী হই। পরবর্তীকালে আপন যোগ্যতা বলে নিজেকে মেলে ধরতে সক্ষম। এদের মধ্যে রাকিবা আক্তার একজন।

বিশিষ্ট্য ব্যক্তিবর্গ বলেন, নারীকে বেশি বেশি সম্মান করতে হবে। মায়ের তুলনা অন্য কারো সঙ্গেই হয় না।

রাকিবার ভাষায় বলতে গেলে, ‘৬ বছর বয়স ছিল আমার মেয়েটি, আমার বড় ছেলের বয়স তখন ৩ বছর এবং আরেকজন তখন সবেমাত্র ৫মাস, বিশ বছর আগের কথা বলছিলেন তিনি, যখন তিনি ঢাকা থেকে চলে যান।’

কাক ডাকা ভোর থেকে কাজ শুরু হয় তার, শেষ হয় সবার শেষে। বাইরে কাজের পাশাপাশি সংসারেও তাকে সময় দিতে হত।

তিনি বলছিলেন, ‘আমি টাকা উপার্জন করতাম তখন মাইলের পর মাইল হেটে, ছাত্র ছাত্রীদের অংক করাতাম, টিউশনি করাতাম কিন্তু নিজের জন্য অহেতুক টাকা /পয়সা খরচ করেনি কখনও বরং সন্তানদেরকে পড়াশুনা করানোর জন্য সংগ্রহ করতাম। কখনও কখনও দেখা যেত একদিনে ৮ কিলোমিটারের বেশি পথ হাঁটতে হতো। প্রতিদিন আমি সেই সকাল ৭টায় শুরু করি দিন এবং রাত ১১ টায় সময় কাজ শেষ করার পর বাড়িতে ফিরতাম। বেশিরভাগ সময় দেখা যেত আমি কোন যানবাহনই ব্যবহার করিনি।’

সত্যি এটা একজন মায়ের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। আজকের দিনে নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বি হচ্ছে। আর এই অর্থ সে শুধু নিজের প্রয়োজনেই খরচ করছেন তা কখনও নয়, সন্তানদের কল্যাণেই জন্য ব্যয় করা মুল বিষয় থাকে।

রাকিবা বলছিলেন, ‘আমি আমার বাচ্চাদের পড়াশুনা আর শিক্ষা দান করার জন্য অর্থ সঞ্চয় করতাম। হয়ত এ জন্য পুরো দিন না খেয়ে থাকতে হত পুরোটা দিন, সারাদিন কাজের চাপে আমি শারীরিকভাবে এবং মানসিকভাবে নিঃশেষ হয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। কিন্তু আমি আমার স্বপ্ন ছেড়ে কখনই চলে আসিনি!’

এক পর্যায়ে রাকিবা তার নিজের ছোট্ট বেলার স্মৃতিচারণ করেন।

তিনি বলেন, ‘আমার বয়স যখন মাত্র ১৩ বছর তখন আমি আমার বাবার হারাই এবং আমি আমার পরিবারের বড় মেয়ে ছিলাম, তাই আমার পুরো পরিবারের যত্ন নেবার দায়িত্ব ছিল। আমি তখন কাজ করতাম এবং একই সাথে আমি আমার পড়াশুনাও অব্যাহত রেখেছিলাম। আমি সবসময় আমার সন্তানদেরকে বলি, আমার সম্পর্কে, আমার সংগ্রামের কথা এবং তাদের পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা যোগাই। আমাকে কতটা কঠোর পরিশ্রম করতে হত সে ব্যাপারে তারাও বুঝত।’

সন্তানদের ব্যাপারে বলতে গিয়ে তার ভাষ্যমতে, ‘তারা সবসময় আমাকে আসত্ত্ব করেছে, আমার স্বপ্ন পূরণ করার জন্য তারা সবচেয়ে সেরাটি আমাকে উপহার দিবে, এই আশাটি ওরা দিয়েছিল আমাকে সবসময়। আমার ছেলেমেয়ে সবসময় পড়াশুনার ব্যাপারে প্রচন্ড আগ্রহী।অতিরিক্ত কোন রূপ চাহিদা ছিল না তাদের। না ছিল অতিরিক্ত দাবি দাওয়া এবং আমরা খুব সহজ সাধারণ জীবনযাপন করেছি! হা, এখন আমার বড়মেয়েটি একজন ডাক্তার এবং আমার বড় ছেলে যান্ত্রিক প্রকৌশলী। আমার ছোট ছেলে পড়ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার সম্পূর্ণ স্বপ্ন কেবলমাত্র আমার দৃঢ়সংকল্প এবং কঠোর পরিশ্রম। পাশাপাশি অজস্র ত্যাগ তিতিক্ষা। আমি তৈরি করেছি, এটি সত্যি।’

বর্তমানে রাকিবার কি করছেন জানতে চাইলে,তিনি জানান, ‘চার বছর আগেই,আমি আমার নিজের উপার্জনের টাকা দিয়ে ফার্মেসিকে শুরু করেছি; এখন আমি আর পড়াশোনা করি না। আমি এই ফার্মেসি দিয়ে উপার্জন করছি। এই আয় দিয়ে আমি আমার পরিবারের যত্ন নিই।’

প্রত্যেক নারীই যদি কাজ করতে শুরু করে। সত্যি তবে আর কেউ দারিদ্র্য থাকবে না। নারী এগিয়ে এলেই সমগ্র সমাজ এগিয়ে যাবে, এখন পাশাপাশি নিজেদের জীবন মানেরও পরিবর্তন আনতে পারবেন। আমি সবসময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, যে আমি যেন কর্মরত অবস্থায় এই পৃথিবী থেকে চলে যেতে পারি। _ রাকিবা আক্তার(৪৭)

মুলত মায়ের ভালোবাসা নিঃস্বার্থ। মা সন্তানকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসেন। মায়ের জীবনে চাওয়া-পাওয়া একটাই সন্তানের মঙ্গল কামনা করা।

 

“ইয়া রাসূল,ইয়া হাবীব” -জাজাফী

আমি যদি তোমায় নিয়ে না লিখি হে রাসুল (সা:)
যা লিখেছি এক জীবনে জানি আমার সবই ভুল।

কাউকে যদি একটু বেশি ভালোবাসি তোমায় রেখে
মা’বুদ আমার না জানি হায় কতই নারাজ সেটা দেখে।

দুনিয়াবি শানশওকাত সবই বৃথা তুমি বিনে
তোমার দিদার চাই হে রাসুল মউত এবং হাশর দিনে।

সালাম সালাম ইয়া নবী বিশ্বজনের আলোর দিশা
তুমি বিনে চারিদিকে কেবলই ঘোর অমানিশা।

আমায় তুমি দিদার দিও,রেখো তোমার মুহাব্বতে
রোজই তোমায় দুরূদ পাঠায়,গোনাহগার এ উম্মতে।

ইয়া রাসূল,ইয়া হাবীব হে আমাদের বিশ্ব নবী
তোমায় নিয়ে লেখার মত হইনি আমি তেমন কবি।

যা লিখেছি ক্ষমা করো,দিদার দিও রোজ হাশরে
দিদার দিও ইয়া রাসূল মরণ কালে আধার গোরে।

#জাজাফী
১২ রবিউল আউয়াল
২ ডিসেম্বর ২০১৭

 

“পানির বোতল দিয়ে পানি পান করছেন”

প্রায় কম-বেশি সবাই পানি বা এজাতীয় কিছুর ক্ষেত্রে প্লাস্টিক বোতল ব্যবহার করি হরহামেশায়।ফ্রিজে পানি জাতীয় কিছু রাখার ক্ষেত্রেও। কিন্তু সব প্লাস্টিকের বোতল যে আপনি ইচ্ছা করলেই যত খুশি তত ব্যবহার করতে পারেন না! কারন এটা আমরা সবাই জানি যে প্লাস্টিক মানব দেহের/পরিবেশের জন্য মোটেও ভাল নয়। এর প্রভাব নিয়ে তাই কিছু লিখলাম না।
img20171202_003605
✈এখন আসি কোন বোতল কিভাবে ব্যবহার করা যাবে!

আমি আমার স্বল্প অভিজ্ঞতার আলোকে তুলে ধরলাম। আমি নিজেও জানতাম না এর ব্যবহার।যখন আমি ডিপার্টমেন্ট থেকে Partex Beverage ltd. এ Industrial Tour এ যাই তখন বিস্তারিত জানতে পারি+ইন্টারনেট থেকেও।সুতরাং আমারও ভুল থাকতে পারে।
img20171202_003412
প্লাস্টিক বোতল যখন কোম্পানি থেকে সরবরাহ করা হয় তখন বোতলের পানির উপর যে ফাকা অংশ থাকে সেখানে কার্বন -ডাই অক্সাইড (CO2) দেওয়া থাকে যাতে পানির সাথে প্লাস্টিক কোন বিক্রিয়া বা অন্য কোন মাধ্যমে মিশ্রিত হতে না পারে।খেয়াল করলে দেখবেন যেসব পানির বোতল ইন্টেক বা সরকার দ্বারা অথরাইজড করা সেগুলির মুখাটি খোলার পর একধরনের গ্যাস বের হয়ে আসে(কার্বন ডাই অক্সাইড) যা চোরাই বা ২ নাম্বারিং বলে জানি সেগুলিতে পাবেন না। সেজন্য সিল করা বোতলের পানি অনেকদিন ধরে ভাল থাকে।

✈এখন আসি কোন বোতল কতবার ব্যবহার করতে পারব?
img20171202_003206
খেয়াল করলে দেখবেন প্লাস্টিক বোতলের তলায় অথবা প্যাকেটের মোড়কে ত্রিকোণ একটি চিহ্ন থাকে। এই চিহ্নে বর্ণনা করা হয়, বোতলটি কতটা বিধিসম্মতভাবে তৈরি। এই চিহ্নের থাকা সংখ্যা দিয়েই জানা যাবে যে এই বোতল কতদিন ব্যবহার করা যাবে, পরিবেশে ওই বোতলের প্রভাব কতটুকু। এটি কেমন নির্ভরযোগ্য তা এই চিহ্নের মধ্যে থাকা সংখ্যা দ্বারা বোঝা যায়। ন্যাচারাল সোসাইটি ওয়েবসাইট থেকে জানা যাচ্ছে, প্লাস্টিক বোতলের ক্রিকোণ তত্ত্ব।
img20171202_004051
ত্রিকোণের মাঝে ১ সংখ্যা থাকলে : এর মানে বোতলটি মাত্র একবার ব্যবহার করা যাবে। বোতলটিতে পলিথিলিন টেরেপথ্যালেট প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়েছে। এ ধরনের বোতল বহু ব্যবহার স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক।
img20171202_003834
২ থাকলে: এই ধরনের প্লাস্টিক বোতলে ঘন পলিথিন ব্যবহার করা হয়েছে। মূলত শ্যাম্পু, জুসের বোতল রাখার ক্ষেত্রে এই ধরনের বোতল ব্যবহার হয়। এটি তুলনামূলক নিরাপদ।

৩ থাকলে: এই ধরনের বোতল বেশি ব্যবহার করা উচিত নয়। কারণ, এই বোতল তৈরি হয় ‘পোলিভিনিল ক্লোরাইড’ বা ‘পিভিসি’ থেকে। এতে অস্থিমজ্জার সমস্যা ও লিভারের সমস্যা ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ‘পিনাট বাটার’ রাখতে এই বোতল ব্যবহার করা হয়।
img20171202_003953
৪ থাকলে: এই ধরনের প্লাস্টিক বহু ব্যবহারের উপযোগী। বিশেষ করে, প্লাস্টিকের প্যাকেটে এই চিহ্ন প্রচুর দেখা যায়। খুব দামি বোতলে এই চিহ্ন থাকে।

৫ থাকলে : একদম নিরাপদ এবং ব্যবহারের যোগ্য। আইক্রিম কাপ বা সিরাপের বোতল অথবা খাবারের কন্টেনারে এই ধরনের চিহ্ন দেখা যায়।

৬ অথবা ৭ থাকলে : প্লাস্টিকের ‘রেড কার্ড’ বলা হয় একে। এই ধরনের প্লাস্টিক মারাত্মক রকমের ক্ষতিকারক। কারণ এই ধরনের প্লাস্টিক তৈরি হয় পলিস্টিরিন এবং পলিকার্বোনেট বিসপেনল-এ। এটা মানুষের মধ্যে হরমোন সমস্যা তৈরি করে। ক্রমাগত এধরনের প্লাস্টিকের ব্যবহার ক্যানসারের প্রবণতা বাড়ায়।
সুত্র:সংগৃহীত

 

‘প্রেগনেন্সিতে করণীয় যা’ -ডা. মারুফ রায়হান খান

‘প্রেগনেন্সি’বিষয়টা আমার কাছে মিরাকিউলাস লাগে। একটা দেহে দুটো প্রাণ। একসাথে নির্ভর করছে দুটো সত্ত্বার ভালো থাকা-মন্দ থাকা, সুস্থতা-অসুস্থতা–মায়ের সুস্থতার উপর নির্ভর করে সন্তানের বাঁচা-মরা। প্রেগনেন্সিতে স্বাভাবিক অবস্থা থেকে হরমোনের বেশ তারতম্য ঘটে, শারীরিক গঠনের কিছু পরিবর্তন হয়–তাই মায়ের কিছু কিছু শারীরিক সমস্যা নতুন করে দেখা দেয় বা বেড়ে যায়। দেখা যায় যে, ডেলিভারি হয়ে যাবার পরপর সে সমস্যাগুলোও চলে যায়। এগুলোর বেশিরভাগই ফিজিওলজিক্যাল বা স্বাভাবিক। প্রেগনেন্সি ইস্যুটা যেহেতু সবার কাছে খুব সেন্সিটিভ তাই অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এসব সমস্যায়। আসলে খুব বেশি আতঙ্কগ্রস্ত হবার কিছু নেই। জীবনধারায় কিছু পরিবর্তন নিয়ে এলে, কিছু পরামর্শ মেনে চললে যার অধিকাংশই প্রতিকার বা প্রতিরোধ করা যায়। একেবারেই কমন কিছু সমস্যার সমাধান নিয়ে লেখার চেষ্টা করছি।

♦বমিবমি ভাব এবং বমি :
দেখা যায় যে প্রতি ১০০ জন গর্ভবতীর প্রায় ৭৫ জনেরই এ সমস্যাটা দেখা দেয়। সাধারণত সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরপরই এ সমস্যা হয়।
-সকালে ঘুম থেকে উঠেই, বলা হয়ে থাকে বিছানাতেই
শুকনো খাবার যেমন : টোস্ট, বিস্কিট, মুড়ি ইত্যাদি খেতে।
-প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার বেশি খেতে বলা হয়।
-অতিরিক্ত তেল-চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করতে হয়।
-একবারে বেশি খাবার না খেয়ে অল্প অল্প করে বারবার খান।

♦কোমর ব্যথা :
প্রতি ১০০ জনের প্রায় ৫০ জনেরই এ সমস্যা দেখা দেয়।
-অনেক বেশি ওজন বাড়িয়ে ফেলা পরিহার করতে হবে। পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে, মোট দশ ঘণ্টা।
-পা কিছুটা উঁচুতে রেখে যেমন : পায়ের নিচে একটা বা দুটো বালিশ রেখে বিশ্রাম নিন।
-শক্ত বিছানায় শোয়া ভালো।
-উঁচু হিলযুক্ত জুতো পরা যাবে না।
– কুঁজো হয়ে বসা বা কোনো জিনিস নিচ থেকে তোলা পরিহার করা শ্রেয়।
– দাঁড়ানোর সময় সোজা হয়ে দাঁড়াবেন।
– ভারী এবং পরিশ্রমের কাজ করবেন না।
– কোমরে ম্যাসাজ করতে পারেন।
– গরম বা ঠাণ্ডা কিছু দিয়ে স্যাঁক দিতে পারেন।

♦কোষ্ঠকাঠিন্য :
-প্রচুর পরিমাণে পানি খেতে হবে।
– আঁশজাতীয় খাবার যেমন : শাকসবজি এবং তাজা ফলমূল বেশি করে খেতে হবে।
-ইসপগুলের ভূষি খাওয়া যেতে পারে।
– চাপ এলে টয়লেটে যেতে বিলম্ব করা যাবে না।
– কিছুটা হাঁটাচলার অভ্যেস করা ভালো, দিনে ২০-৩০ মিনিট করে সপ্তাহে ৩ দিন হাঁটা যেতে পারে।

♦পায়ে খিল ধরা :
-পায়ে ম্যাসাজ করতে হবে।
– গরম স্যাঁক দিলে উপকার পাওয়া যায়।
-চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন সেবন করা যেতে পারে।
পায়ে পানি আসা/ পা ফোলা :
-বিশ্রাম নিন এবং পা দুটো একটা বা দুটো বালিশের ওপর রাখুন।
– একটানা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে বা বসে থাকবেন না।
-আরামদায়ক জুতো পরুন।
– বেশি করে পানি পান করুন।

♦বুক জ্বালাপোড়া, এসিডিটি :
-একসাথে অনেক বেশি খাবার খেয়ে ফেলা পরিহার করতে হবে।
– খাবার পরপরই বিছানায় শুতে চলে যাওয়া যাবে না।
– বিছানায় যাবার অনেকক্ষণ আগেই খাবার খেয়ে ফেলুন।
– উঁচু বালিশে শুলে আরাম পাওয়া যায়।
– এন্টাসিড জাতীয় ওষুধ খাওয়া যেতে পারে।
পায়ে আঁকাবাঁকা শিরা।

♦পাইলস :
-পায়ে আঁকাবাঁকা শিরার জন্যে ক্রেপ ব্যাণ্ডেজ ব্যবহার এবং বিশ্রামের সময় পা উঁচু করে রাখতে বলা হয়।
-পাইলসের জন্যে নিয়মিত টয়লেট সারা জরুরি; কোষ্ঠকাঠিন্য যেন না হয়ে যায় সেদিকে নজর রাখতে হবে। টয়লেট সারার সময় বেশি চাপ দেওয়া যাবে না। বাম কাত হয়ে শোয়া ভালো। গরম পানি দিয়ে গোসল করতে পারেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।

♦মাসিকের রাস্তায় সাদা স্রাব :
-ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এর প্রধান চিকিৎসা।
-নরম সূতি আন্ডারগার্মেন্টস ব্যবহার করা ভালো।
তবে সবকথার শেষকথা হচ্ছে প্রতিজন গর্ভবতী নারীরই নিয়মিতভাবে চিকিৎসকের কাছে ভিজিটে যেতে হবে, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হবে এবং তার প্রেস্ক্রাইব করা ওষুধপত্র নিয়মিত খেতে হবে।