banner

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

Daily Archives: April 23, 2024

 

আমার শরীর, আমার অংশ, আমার স্বপ্ন!

ডা.সংগীতা হালদার রায়


ছোট খাট কিছু কম্পলিকেশন ছিল , ছিল মিস ক্যারিজের হিস্টরী, আর বাবুর মাথাও বেকে ছিল । তাই নরম্যাল ডেলিভারির আশা ছেড়ে দিয়ে সিজারিয়ান সেকশনের জন্যে চলে গেলাম CMH এ নির্ধারিত দিনের আগের দিনই।

মস্তিষ্কের একটা স্বাভাবিক প্রবণতা হল খুব চাপের সময়ে সে অন্য কোন পুরাতন স্মৃতি মনে করিয়ে দেয় বা অন্য কোন কিছু চিন্তাতে নিউরনগুলোকে কাজে লাগিয়ে ফেলে।

তাই ভর্তির সময়ে যখন আমার চিন্তিত বা আশংকিত হবার কথা ছিল পরদিন কি হবে বা সব কিছু ঠিক ভাবে হবে কিনা তখন আমি প্যালেস্টাইনি এক রোগীনির ভর্তি হবার পুরো প্রক্রিয়াতে মনোনিবেশ করে ফেললাম।

বেচারা ভীনদেশে বাবা হতে গিয়ে প্রচন্ড ভীত, ইন্টার্ন ডাক্তারদের কিছুতেই রোগীনিকে পরীক্ষা করতে দেবেন না , বলছেন ‘ আই ওয়ান্ত অনলি র‌্যাঙ্ক দক্তর’ । হিস্টরী নিয়ে রোগীকে রেডি করে সিনিয়রকে ডাকাই ইন্টার্নদের প্রথম দায়িত্ব, সে বেচারারা ভেবাচেকা খেয়ে একবার উনাকে বুঝাচ্ছিল, একবার রোগীকে বুঝাবার চেষতা করছিল, আরেকবার সিনিয়র নার্সকে জিজ্ঞেস করছিল সিনিয়র ডাক্তারকে ডাকা ঠিক হবে কিনা।

মহিলার প্রতিক্রিয়া দেখতে গিয়ে দেখি ছিপছিপে লম্বা ভদ্রমহিলা কিঞ্চিত দুশ্চিন্তা নিয়ে স্বামীর কান্ড দেখছেন কিন্তু কিছু বলতে চেয়েও পারছেন না। মহিলা এতোই ছিপছিপে ছিলেন যে নিজের বিশাল পেটের দিকে তাকিয়ে মনে হল, ” আরে আমার বাচ্চাটা কি পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে আর ইনারটা এটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নাকি? ”

ভেবেই আনমনে ফিক করে হেসে দিয়েছিলাম, মহিলা তো আর জানতেন না যে আমি ঐ অবস্থায় এরকম বিচিত্র কথা ভেবে হাসছিলাম; কাজেই উনি সৌজন্য বিনিময়ের হাসি ফেরত দিলেন আমায়। আমি সংযত হয়ে বসলাম লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে।যাহোক নিজের ক্যাবিনে এলাম। ঘর , বাথ্রুম , বারান্দা দেখে মোটামুটি সন্তুষ্ট হয়ে পরদিন কি পরে ওটিতে যাব , বাচ্চা কি পরবে, কোন কাঁথায় তাকে বরণ করা হবে সব কিছু একবার মা আরেকবার স্বামীকে বুঝিয়ে দিলাম ।

বুঝতে পারছিলাম অস্থিরতা কাজ করছিল ওর মাঝে, ছেড়ে যেতে চাইছিল না আমায়, কারণ আমার মায়ের কোমরে ফ্যাকচার আছে, হঠাত করে হাসপাতালের চিকন বেড থেকে ভারি শরীর নিয়ে ওঠা নামা করা ইত্যাদি কাজে অসুবিধার আশংকা করছিল সে। কিন্তু CMH এর নিয়ম ওটাই, কিছু করার ছিল না। বলে গেল ঘুমাতে আর সাথে দিয়ে গেল গল্পের বই, খুবই পরস্পরবিরোধী সিদ্ধান্তের কাজ ছিল সেটা কিন্তু আমার স্নায়ুকে শুধু বই-ই শান্ত রাখতে পারে , অগত্যা!মা কিছুক্ষণ ঘুমাতে বলে ঘুমিয়ে গেল , আমি গল্পের বইতেও মনযোগ দিতে পারছিলাম না আর অস্থিরতায় ঘুমও আসছিলনা। পেটে হাত দিয়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম অনাগত সন্তানের কথা ভেবে, কথা বললাম বাবুটার সাথে খানিক্ষণ , অতঃপর ঘুমিয়ে গেলাম।

কিন্তু নতুন জায়গায় চিকন বেডে ছাড়া ছাড়া ঘুম হচ্ছিল, বার বার ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছিল । বেড়ালের ডাকে, গাড়ির চাকার শব্দে, এমনকি ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকেও । আবার ঘুমাবার চেষ্টা করছিলাম , নিজেকে বোঝাচ্ছিলাম যে আমার ব্লাড প্রেশার স্বাভাবিক রাখার জন্যে আমার ঘুমাতে হবে। আমার বাবুকে সুস্থ রাখতে আমাকে ঘুমাতে হবে।পরদিন ঘুম ভাংলো অনেক ভোরে সকালে উঠে দেখি মা স্নান সেরে নিজে নিয়ে আসা স্যাভলন দিয়ে ঘর , বারান্দা , এমনকি বাথরুমও মুছে ফেলেছে। আমি উঠতেই সাত তাড়াতাড়ি করে নিজের ফ্যাকচারড কোমর নিয়েই বেড থেকে নেমে এলো আমায় ব্যালান্স করে নামাতে । ধীরে ধীরে নেমে বাথরুমে গিয়ে মুখ ধোবার সময়ে নিজের চিন্তাক্লিস্ট চেহারাটা আয়নায় দেখে নিজেরই কেমন যেন লাগল । মনে হল আমার বাচ্চাটা প্রথমবার এমন ভাবে দেখবে আমায়!
বেড়িয়ে এসে সুন্দর করে নিজের চিল আচড়ে দুইটা বেনি করলাম। হালকা করে বিবি ক্রিম , পাউডার কাজল , হাতে পায়ের নখে নেইল পলিশ লাগালাম। তবুও দেখি সময় কাটেনা, স্বামীও আসেনা। মা তখন গীতা পড়ে যাচ্ছে মন দিয়ে। মাকে খেয়ে নিতে বলে আমার নিজের গীতাটা খুললাম । সাড়ে সাতটার দিকে আয়ারা চলে এলো আমাদের রুম মুছে দিতে আর আমাকে রেডি করে নিয়ে যেতে । আমার চুলের রাবার ব্যান্ড খুলে গজ ফিতা দিয়ে আবার বেঁধে দিল, কেন কে জানে ! আমার মনে হচ্ছিল যে ওদের করার কিছু নেই বলেই হয়তো অমন করেছিল। কারণ ঘর মোছা আর আমায় হালকা সাজুগুজু দেখে ওরা দুজন গা টেপাটেপি করে হেসেছিল।যখন নিয়ে যেতে চাইলো মা তখন ভয় পেয়ে গিয়েছিল একটু, কারণ বাবা বা তার জামাই কেউই তখনো আসেনি। এদিকে ‘ম্যাডাম বলেছে’ বলে ওরা আমাদের আটকে ফেলেছে । ফ্যামিলি ওয়ার্ড থেকে ওটিতে যাবার জন্যে এম্বুলেন্সে আরো তিন বা চারজন হবু-মা শুকনো মুখে উঠে বসে আছেন , তাড়া দিচ্ছিল ওরা তাই। হেসে মাকে প্রনাম করে যখন গাড়িতে উঠলাম তখন শুকনো চোখেও ঝাপসা দেখছিলাম দুশ্চিন্তায়, সামনের কারো চেহারা দেখি নি আমি । গাড়ির পেছনের কাঁচে মাকে দেখছিলাম ব্যস্ত হয়ে মোবাইল চাপতে।

ওটির কাছে পৌঁছে দেখি মা আর স্বামী দুজনেই এসে গিয়েছে। ওয়েটিং রুমে কিছুক্ষণ বসানো হল আমায়। জানতে পারলাম বাবা নাকি অনেক আগেই পৌঁছে কোন ওটিতে অপারেশন হবে , কে করবেন তাদের সাথে কথা বলতে গিয়েছে।

নিজের প্রাক্তন কাজের জায়গাতে মেয়ের কোন অসুবিধা হবেনা এমনটাই আশা ছিল তার। ফোনে শাশুড়িমা- শশুরের কাছে আশীর্বাদ চেয়ে বিদায় নিলাম ওটিতে ঢুকে যাবার আগে । মা আর স্বামী দুজনেই চিন্তিত মুখে আর ছলছল চোখে বিদায় জানালো আমায়।

হেঁটে যেতে শুরুতেই আমার জুতো খুলে নিতে বললো কিন্তু অন্য কোন জুতো দেয়া হলনা। হাসপাতালের ময়লা জীবাণু কল্পনা করে খুবই অস্বস্তি হচ্ছিল , ডাস্ট এলার্জির জন্যে খালি পায়ে হাঁটতে আমার ভালোও লাগছিলনা আর ঐ ভারী শরীরে হাঁটতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল । হাঁপাচ্ছিলাম, ঘেমে গিয়েছিলাম আর অনুরোধ করছিলাম একটা ট্রলিতে নিতে। কিন্তু আয়া ‘এইতো আরেকটু’ বলে বলে নিয়ে যাচ্ছিল তো যাচ্ছিলই। দোতলায় উঠে অন্য একটা ওটির বাইরের ট্রলি পাওয়া গেল অবশেষে একটা।ওটিতে নিয়ে ক্যানুলা করিয়ে যখন ক্যাথেটেরাইজড করানো হচ্ছিল , প্রথমবার বুঝতে পারলাম আমার রোগীনিদের কেন অত অস্বস্তি লাগতো । সব সময় রোগীদের কাউকে নরম স্বরে আর কাউকে গরম হয়ে বলতাম “শুনেন আমরা প্রতিদিন ২০/২৫ জনকে এভাবে ক্যাথেটার পরাই, কাজটা ভালোভাবে করার চেষ্টা করি তখন। রোগীর দিকে কেউ অন্য চোখে তাকায় না”।

একই কথা আমার বেলায়ও প্রযোজ্য ছিল, কিন্তু মন মানছিলনা কিছুতেই ।ওটি বেডে শোয়ানোর পরে এনেস্থেটিস্ট আমাকে বলতে শুরু করলেন তিনি আমাকে ছোটবেলায় কবে কখন দেখেছেন, বাড়িয়ে দিলেন আমার অস্বস্তি । বাবাকে নিয়মের দোহাই দিয়ে চলে যেতে বললেন, আমি বাবার দিকে তাকিয়ে হেসে সাহস দিলাম যে আমার অসুবিধে হবেনা । এনেস্থেসিয়া হবার পরে যখন অপারেশন শুরু হল, মনে হচ্ছিল আমি সবই হাল্কা হাল্কা টের পাচ্ছিলাম , নিজের confusion দূর করতে একবার জিজ্ঞাসাও করে ফেললাম ‘ আঙ্গকেল আমি তো সবই বুঝতে পারছি মনে হচ্ছে, এমনই কি হয়?’ , উনি বললেন ‘তোমার মনের ভুল এটা’।

এক পর্যায়ে পাশে তাকিয়ে দেখি ওটি দরজার চৌকো কাঁচে বাবার মুখ দেখা যাচ্ছে। সেই মুখ হঠাত হেসে উঠতেই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ৯।৪৫ মিনিট বাজছে । মাথার কাছে এনেস্থেটিস্ট আংকেল হেসে বললেন তোমার মেয়ে হয়েছে, এখুনি মুছিয়ে নিয়ে আসবে।আমি বারবার তাকাচ্ছিলাম যেদিকে মোছাতে নিয়ে গেল সেদিকে , চিন্তা করছিলাম ওরা কি আমার পছন্দের জামাটা মেয়ের পরাবার জন্যে দিতে পেরেছে? কাঁথাটা দিতে পেরেছে তো? তোয়ালে দিয়েছে? আমি তো একটাই কাঁথা রেখে এসেছিলাম, যদি আরো লাগে ওরা সবাই পারবে তো দিতে?

ভাবতে ভাবতেই আমার সবুজ শাড়ির কাঁথায় মোড়ানো লাল টুকটুকে জামা পরা একটা ছোট্ট পুতুলকে পাশে নিয়ে এলো আয়া। শুনেছিলাম হাসপাতালে বাচ্চা বদলে যায় , খুব ভাল করে দেখে চিনে রাখার চেষ্টা করলাম মেয়েকে যেন বদলে না দেয়।

“আপনার ধর্মে আলহামদুলিল্লাহ’র মত যেইটা আছে সেইটা বলেন” বলে আয়া আমার গালে ছুঁইয়ে দিলো আমার সন্তানের গাল । আমার ডান গালে হালকা ঠান্ডা নরম স্পর্শে তখন অনেক বিস্ময় আর অনেক অনেক আনন্দ ! আমার শরীরের অংশ , আমার স্বপ্নের টুকরা আমার আমার চোখের সামনে ।

বিশ্বাস হচ্ছিল না যেন এই বাচ্চাটাই আমার শরীরে ছিল ! সত্যিই এ-ই ছিল তো (যদিও চিকন চোখ আর চাপা নাকে মেয়ের বাবার চেহারার আদলে সন্দেহ করবার মত আদৌ কিছু ছিলনা) । মায়া , ভালোবাসা, প্রতীক্ষা শেষের খুশী নেমে আসছিল চোখ বেয়ে !এরপরেও ঐ ওটিতেই আবারো কাঁদতে হয়েছিল, কাঁদতে কাঁদতে ঘামতে হয়েছিল এনেস্থেশিয়ার ঔষধের কার্যকারীতা শেষ হয়ে যাওয়ায় । কিন্তু সারাক্ষণ ঈশ্বরের কাছে বাঁচিয়ে রাখবার প্রার্থনা করছিলাম শুধু মেয়ের কাছেই ফিরে আসবার আকাংক্ষায়। প্রথম দেখায় কিংবা দেখারও আগে যাকে ভালবেসে ফেলেছিলাম তাকে এরো একবার দেখবার আকাংক্ষায়।

ফরমাল লেকচারার
শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ, ঢাকা

 

ঝড়ের দিন: পর্ব-৪

তানজীল আহমদ সিদ্দিকী


গাঁয়ে মিলিটারি ঢোকার পর থেকে সন্ধ্যা হলেই পুরো গ্রাম শ্মশানঘাটের মতো নিস্তব্ধ হয়ে যায়। কিছু কিছু বাড়ি থেকে মিটিমিটি কূপির আলো দেখা যায়, বাকি বাকিগুলোতে তাও চোখে পড়ে না। জীবিত মানুষগুলো বেঁচে থাকার তাগিদে মৃতের ছদ্মবেশ ধরে। সময়টাই এমন। আলোতেও ভয় কাটে না বরং চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে। মিলিটারিরা যদি আলো দেখে বাড়িতে এসে কড়া নাড়ে? তাই পুরো বাড়ি অন্ধকার করে রেখে মানুষগুলো একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁপে। প্রার্থনা করে আরেকটা সূর্যোদয়ের।
সন্ধ্যে হয়ে গেছে। চারদিকে লালচে অন্ধকার। আকাশের দিকে তাকালে একটা দুটো তারা চোখে পড়ছে। খেয়াঘাটে কেউ নেই। শুধু দুটো নৌকা দুলকি চালে ভাসছে। খুঁটির সাথে বাঁধা সেগুলো। ভোর হলে পরে মাঝিরা এসে ভাসাবে। শুধুমাত্র একটা নৌকা খুব ধীরে আলতানগরের দিকে এগিয়ে আসছে। দূর থেকে তাকালে শুধু দাঁড় বাইতে থাকা মাঝিকে দেখা যাবে। ঘুণাক্ষরেও কেউ টের পাবে না যে নৌকার পাটাতনের নিচে আরো তিনটে মানুষ লুকিয়ে আছে। এরা হলো আসাদ, দীপক আর শেবু। একটা সশস্ত্র গেরিলা দলের রেকি টীম তারা। আজ রাতে আলতানগরে একটা গেরিলা এট্যাক হবে। রেকি দলের কাজ হলো শেষবারের মতো সবকিছু দেখে গিয়ে রিপোর্ট করা। নদীর ওপারেই বাকি যোদ্ধারা অপেক্ষা করে আছে। আসাদ আস্তে করে পাটাতন থেকে বেরিয়ে এলো। সুমন মাঝি অভ্যস্ত হাতে দাঁড় বাইছে। এই নদী তার নিজের হাতের তালুর মতো চেনা। রাতের অন্ধকারেও চোখ বন্ধ করে খেয়াঘাটে নৌকা ভেড়াতে পারে সে। আসাদ ছইয়ের ভেতরে ঢুকে পড়লো। পাড় থেকে কেউ লক্ষ রাখলে মাঝি ছাড়া আর কাউকে দেখবে না। তারপর সেখান থেকেই কথা বলতে লাগলো সুমনের সাথে।
‘ সুমন ভাই, গ্রামের অবস্থা কিরাম? ‘
‘ ভালা নারে ভাই। পাকিস্তানি বেজন্মাগুলা মশামাছির মতো মানুষ মারে। বাড়ি থেকে মেয়েদের উঠায়া ক্যাম্পে নিয়া যায়। নজর কুত্তাটায় হেগোরে পথ দেখায়। নজর আর মিলিটারির ভয়ে গেরামের মানুষ ঘর থিইকানই বাইর হয় না। দিনে যাও বা বাইর হয়, রাইতে তো পুরা গেরাম শ্মশান হয়া যায়। এশার ওয়াক্তে মসজিদে এক কাতার মানুষও হয় না! ‘
বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আসাদ। ছমাস আগে যখন ঘর ছেড়েছিলো তখন মুসেগুলেও পরিস্থিতি এমনই ছিলো। বরঞ্চ আরো খারাপ ছিলো। শুক্রবার হাট বেলায় মুসেগুল বাজারে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলো পশুগুলো। তখন বাবার সাথে বাজারেই ছিলো আসাদ। হঠাৎ করে ‘ আগুন লাইগা গেসেরে ‘ চিৎকার শুনে আর সবার মতো সেও দৌঁড়েছিলো রুদ্ধশ্বাসে। পেছনে ব্রাশ ফায়ারের আওয়াজ। দাউ দাউ করে জ্বলছে দোকানপাট। মানুষজন চেঁচাতে চেঁচাতে দৌঁড়ুচ্ছে। এদিন যেন নরক নেমে এসেছিলো সেখানে। দৌড়ুতে দৌড়ুতে কখন যে বাজার থেকে বহুদূরে চলে এসেছে খেয়াল করতে পারেনি আসাদ। আব্বা কোথায় গেলেন! সাথে সাথে দৌড়ে বাজারে ফিরেছিলো সে। জন্মদাতা পিতার অর্ধদগ্ধ লাশটা পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার করে উঠতে গিয়েও থেমে গিয়েছিলো আসাদ। পিতার অর্ধদগ্ধ লাশটা কাঁধে তুলে নিয়ে চুপচাপ হাঁটা দিয়েছিলো সে। যত্রতত্র পড়ে থাকা দগ্ধ, অর্ধদগ্ধ, ব্রাশফায়ারে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া লাশগুলো টলাতে পারেনি তাকে। শত মানুষের হাহাজারিতে ভারি বাতাসে খুব অল্প অল্প করে কিছু দীর্ঘশ্বাস পড়ছিলো তার। সেই দীর্ঘশ্বাসগুলোর সাথে বেরিয়ে যাচ্ছিলো সব আবেগ। শুধু রয়ে গেছিলো বুকভর্তি ঘৃণা। নিজ হাতে বাবাকে দাফন করে বাড়ি ফিরেছিলো আসাদ। শোকে কাতর মা আর ছোট ভাই-বোন দুটোকে নিজে পৌঁছে দিয়ে এসেছিলো মামাবাড়িতে। তারপর কদিনের ভেতরেই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে চলে গিয়েছিলো ইন্ডিয়া। দু সপ্তাহ হলো সেখান থেকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে একজন প্রশিক্ষিত গেরিলা হিসেবে আবার নিজ জন্মভূমিতে ফিরেছে আসাদ। তার পিতার মতো এমন হাজারো পিতার মৃত্যুর বদলা নিতে হবে তাকে। সন্তানহারা হাজারো মায়ের চোখের পানির বিনিময়ে স্বাধীনতার রক্তলাল সূর্যটা ছিনিয়ে আনতেই হবে।
সুমন মাঝি অভিজ্ঞ হাতে নৌকা ভিড়ালো ঘাটে। আসাদ আস্তে করে ডাক দিলো বাকি দুজনকে। দীপক আর শিবু তাদের স্টেনগান হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো। মাঝিকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে আসাদ তার দুই সঙ্গীকে নিয়ে সামনের বাঁশঝাড়ে ঢুকে গেলো। ঘন বাঁশঝাড়ে বসে তারা আরেকটু রাত হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলো। আসাদ চুপচাপ পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে। শিবু একটা বিড়ি ধরিয়ে অন্য হাতে ধরে রাখা স্টেনগানটার দিকে তাকিয়ে রইলো। নির্লিপ্ত মানুষ সে। কখনো মুখ দেখে তার মনের ভাব ধরতে পারা যায় না। আসাদ বুঝতে পারে না এই মানুষটাকে। নিজের সম্পর্কে কাউকে কিছু বলে না শিবু। শুধু নির্লিপ্ততার মূর্তিমান উদাহরণ হয়ে অস্ত্র কাঁধে হেঁটে বেড়ায় যতদূর শত্রুপক্ষের সীমানা কাঁটাতার দিয়ে আলাদা করে দেওয়া। দীপক কিছুক্ষণ থেকেই কেমন উশখুশ করছে। নৌকায় শিবুর সাথে বসে থাকার দরূণ কথা বলার সুযোগ পায়নি বেচারা। এখন কথা বলার একটা ছুঁতো খুঁজছে। দীপক দলের সবচেয়ে কনিষ্ঠতম সদস্য। তার কৈশোরসুলভ চঞ্চলতায় পুরো মুক্তি ক্যাম্প মাতিয়ে রাখে সে। আসাদ ব্যাপারটা খেয়াল করে জানতে চাইলো, ‘ দীপক, কিছু বলবা? ‘
‘ আমরা রওনা হমু কখন? ‘
‘ আরেকটু অন্ধকার নামুক, তারপর। ‘
দীপক কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলো। মায়ের সাথে একবার দেখা করে আসতে মন টানছে তার। মুখ ফুটে সেকথা কি করে বলে! আরেকটু বাদেই তাদের মিশন। আসাদ বুঝতে পারলো। সব আবেগ সেদিন চলে যায়নি তার। দু, আপনজনের অনুপস্থিতির বেদনা সবই পোড়ায় তাকে। আসাদ কোমল স্বরে দীপককে বললো, ‘ মায়ের লাইগা মন টানে? ‘
দীপক মাথা নিচু করে আস্তে করে শুধু ঘাড়টা উপর-নিচ করলো। আসাদ তাকে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে দিলো। তবে শর্ত দিয়ে দিলো যে খুব সাবধানে থাকতে হবে এবং এক ঘণ্টার ভেতরেই চলে আসতে হবে। খুশিতে দীপকের মুখটা চিকচিক করে উঠলো। তারপর স্টেনগানটা শালের ভেতরে রেখে বেরিয়ে এলো বাঁশঝাড় থেকে। সতর্ক পায়ে হাঁটা দিলো বাড়ির দিকে। হতভাগিনী মা তার পথ চেয়ে আছেন।
দীপক যাওয়ার ঘণ্টাদেড়েক হয়ে গেছে। এখনো আসার নামগন্ধ নেই। আসাদ অধৈর্য হয়ে পড়লো। ধরা পড়ে গেলো না তো ছেলেটা? সে শিবুকে জানালো তার আশংকার কথা। শিবু নির্লিপ্ত মুখে বললো, ‘ আমারো তাই মনে হইতেসে। ‘ সদা নির্লিপ্ত শিমুর কণ্ঠে শংকার আওয়াজ পেয়ে আসাদের ভয় লেগে উঠলো। সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো সে। দীপকের বাড়ি পর্যন্ত যাবে তারা, গিয়ে দেখবে দীপকের আসতে এত দেরি হচ্ছে কেন। আসাদ প্রথমে সুমন মাঝিকে গিয়ে জানালো যে, যদি ঘণ্টাখাকের মধ্যে তারা কেউ না ফিরে তবে যেন সে ওপারে গিয়ে কমান্ডারকে খবরটা দেয়। তখন তিনি যা ভালো বুঝবেন তা করবেন। তারপর শিবুকে সাথে নিয়ে ঝোঁপঝাড় ঘেষে দীপকের বাড়ির দিকে হাঁটা দিলো আসাদ। ছেলেটার কিছু হয়ে গেলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না সে।
দীপকের মা তার বুকের মানিককে কাছে পেয়ে আনন্দে একদম আত্মহারা হয়ে গেলেন। একবার হাসতে হাসতে ছেলের সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দেন, তো আরেকবার বুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদেন। ছেলে বেঁচে আছে এটাই যেন তাঁর বিশ্বাস হচ্ছে না। দীপক অনেক কষ্টে তার মা-কে শান্ত করলো। বুঝিয়ে বললো যে আজ রাতে তাদের একটা মিশন আছে। তাই হাতে একদমই সময় নেই। বিচলিত মা শান্ত হলেন। ছেলের জন্য গরম গরম ভাত রাঁধতে বসে গেলেন। দীপক মায়ের পাশে বসে তার গেরিলা দলের গল্প করতে লাগলো। এমন সময় বাইরে কে যেন কড়া নাড়লো। সাথে সাথে দীপক স্টেনগান বের করে ফেললো। ফিসফিস করে তার মা কে বললো, ‘ আমি খাটের নিচে লুকাইতেসি। তুমি বাইর হয়া কও কেউ নাই ঘরে। ‘ পুত্রের বিপদের আশংকায় কাতর মা দরজা ঠেলে বাইরে বের হলেন। নজর আলি আর বেশ কজন মিলিটারি দাঁড়িয়ে আছে!
‘ ঘরে কে? ‘
দীপকের মা ঘোমটার আড়াল থেকে জবাব দিলেন, ‘ কেউ নাই। আমি একলা।’
নজর আলির কাছে খবর এসেছে গ্রামে মুক্তি ঢুকেছে। আর গ্রামের যেসব ছেলের নাম মুক্তি সন্দেহে লিস্টে তোলা আছে, সেখানে দীপকের নামও আছে। তাই নজর আলি দীপকের মায়ের কথা বিশ্বাস করলেন। তিনি ইশারা করতেই দুজন সৈন্য সামনে এগিয়ে এলো। তারপর বন্দুকের বাঁট দিয়ে এক বাড়ি মেরে মাটিতে শুইয়ে দিলো। মহিলা আর্তচিৎকার করে উঠলেন। নজর আলি তার বুকে একটা লাথি দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ দীপক কুত্তার ছাওটা কই? ‘
মহিলা মুখ ভর্তি থুতু ছুড়ে মারলেন নজর আলির মুখে। ক্ষেপে গিয়ে নজর আলি আরেকটা লাথি মারলেন বৃদ্ধাকে। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠলেন মহিলা। আর সহ্য করতে পারলো না দীপক। স্টেনগান হাতে দৌড়ে চলে আসলো বাইরে। ‘ বেজন্মার বাচ্চা ‘ বলে স্টেনগান দিয়ে বাড়ি মেরে দিলো নজর আলি। নজর আলি বাড়ি খেয়ে পড়ে যেতে যেতে চিৎকার করে উঠলেন, ‘ গোলি মাত করো। জিন্দা পাকড়াও ইসে। ‘ পাক সৈন্যরা ঘিরে ফেললো দীপককে। নজর আলি মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থায় চিৎকার করে বললেন, ‘ একদম নড়বি না, দীপক। নইলে তোর মা রে মাইরা ফালামু। ‘ কথাটা শুনে দীপক তার হাতের স্টেনগান ফেলে দিলো। সাথে সাথে এক সৈন্য বন্দুকের বাঁট দিয়ে বাড়ি মেরে দিলো দীপকের মাথায়। অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো দীপক। তারপর সেই অজ্ঞান দেহকেই মরা কুকুরের মতো টেঁনে হিঁচড়ে ক্যাম্পের দিকে নিয়ে চললো। সবার আগে নজর আলি। স্টেনগানের আঘাতে মাথার চামড়া কেটে রক্ত পড়ছে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তার। গ্রামে মুক্তি ঢুকেছে! তিনি এতদিন শুধু শুনেছেন দেশের বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিরা গেরিলা হামলা চালাচ্ছে। আলতানগরেও যে মুক্তি ঢুকবে স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি তিনি। এই বেজন্মাটার থেকে সব কথা বের করতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতে জোর পদক্ষেপে হাঁটতে লাগলেন নজর আলি। দীপকের বাড়ির সামনে তার বৃদ্ধা মা তখন ফ্যালফ্যাল করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। উপরে বোধহয় ভগবান বলে কেউ নেই। নইলে তার সৃষ্ট মর্ত্যে পিশাচেরা হাসিমুখে হেঁটে বেড়ায় কি করে? বাঁশঝাড়ে শনশন করে বাতাসের ফিসফিসানি উঠে। এক অসহায় মায়ের বোবা কান্না ধীরে ধীরে ঘুরপাক খায় পিশাচের রাজত্বে।(চলবে)

এইচ এস সি শিক্ষার্থী
চট্টগ্রাম