banner

বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫ ইং, ,

Daily Archives: May 13, 2025

 

আমার বই পড়া (তৃতীয় পর্ব)

রায়হান আতাহার


কিশোর বয়সে যে লেখকদের লেখা পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছি, তার মধ্যে মুহম্মদ জাফর ইকবালের নাম সবার আগে স্মরণ করতে হয়। স্যারের লেখা ‘কিশোর উপন্যাসসমগ্র ১’ আমার সংগ্রহে থাকা সেরা বইগুলোর মধ্যে অন্যতম। সমগ্রটিতে ছয়টি কিশোর উপন্যাস ছিলো- ‘হাতকাটা রবিন’, ‘দীপু নাম্বার টু’, ‘দুষ্টু ছেলের দল’, ‘আমার বন্ধু রাশেদ’, ‘টি-রেক্সের সন্ধানে’ ও ‘জারুল চৌধুরীর মানিকজোড়’। প্রতিটি উপন্যাস যেন এক একটি ভালোবাসার নাম। কতবার করে যে পড়েছি উপন্যাসগুলো!

সিনেমার পর্দায় ‘দীপু নাম্বার টু’ দেখার পর মুগ্ধতা যেন আরো বাড়লো। সেসময় ইটিভিতে ধারাবাহিকবাভাবে ‘হাতকাটা রবিন’-এর সিরিয়াল দেখাতো। চোখের সামনে ভাসে এখনো। ‘জারুল চৌধুরীর মানিকজোড়’-ও টিভিতে দেখাতো। আর ‘আমার বন্ধু রাশেদ’-এর চলচ্চিত্রায়ন তো এই সেদিনের কথা। ‘টি-রেক্সের সন্ধানে’ ও ‘দুষ্টু ছেলের দল’-কেও হয়তো কোন এক সময় টিভির পর্দায় দেখতে পাবো।

এরপর স্যারের যে বইটি হাতে এল তা হল ‘বেজি’। একই সাথে সাইন্স ফিকশন আর এডভেঞ্চার। সাইন্স ফিকশনের প্রতি আগ্রহ জন্মানোর জন্য এই একটি বই যথেষ্ট ছিলো আমার জন্য। এরপর সাইন্স ফিকশন সমগ্র কিনেছিলাম। দিন নেই, রাত নেই; সাইন্স ফিকশন নিয়ে পড়ে থাকতাম। পরবর্তীতে ম্যাথ অলম্পিয়াডে অংশগ্রহণের জন্য স্যারের গণিত নিয়ে লেখা বইগুলোও পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার আমার চাইল্ডহুড হিরো। তাঁর লেখাগুলো যেন ঠিক আমার মত মানুষদের জন্যই লেখা। কিশোর বয়সের মুগ্ধতা বজায় আছে এখনো। সুযোগ পেলেই তাঁর লেখা পড়ি। তাঁকে নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা আছে, সেদিকে যাবো না। আমার কিশোর বয়সকে রঙিন করার জন্য স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞ আমি।

জাফর ইকবাল স্যারের লেখার প্রতি ছোটবেলা থেকে যে ভালোলাগা ছিলো, হুমায়ূন আহমেদের লেখার প্রতি ততটা ভালোলাগা ছোট থেকে ছিলো না। হুমায়ূন আহমেদের লেখার সাথে পরিচয় হয়েছিলো ছোটবেলায় “বোতল ভূত” বইটির মাধ্যমে। বইটির অনেকগুলা গল্পের মাঝে একটি গল্পের চরিত্র ছিলো ‘পিপলী বেগম” নামের একটি পিঁপড়া – এখনো মনে আছে। এরপর কেন যেন তাঁর লেখা পড়া হয়নি ছোটবেলায়।

একটু বড় হয়ে (সম্ভবত নবম শ্রেণিতে) পড়লাম “হিমু রিমান্ডে”। এক অদ্ভুত নেশা পেয়ে বসলো এরপর থেকে। হুমায়ূন আহমেদের কতগুলো গল্প-উপন্যাস পড়েছি আমার নিজেরও জানা নেই। হার্ডকপিতো পড়েছি, সফটকপিও কম পড়িনি। তখন রিভিউ লেখার অভ্যাস ছিলো না বলে কাহিনীও ভুলে গেছি অনেকগুলোর।

“জোছনা ও জননীর গল্প”, “বহুব্রীহি”, “জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাইস্কুল”, “দেয়াল”, “তেতুল বনে জোছনা”সহ স্যারের অসংখ্য সৃষ্টি দাগ কেটে গেছে মনের ভেতর। তিনি অসংখ্য নাটক-সিনেমা উপহার দিয়েছেন। কিন্তু আমার কাছে লেখক হুমায়ূন আহমেদকেই বেশি ভালো লাগে। অতি সাধারণ জিনিসগুলোকেও অসাধারণ করে তোলার এক অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিলেন মানুষটি। হিমু, রূপা, মিসির আলী, শুভ্র, বাকের ভাইদের মাঝে তিনি বেঁচে আছেন এবং থাকবেন সবার মাঝে।

(চলবে)

Raihan Atahar
Postgraduate Researcher at Bernal Institute
Material and Metallurgical Engineering at BUET

 

গেমের নেশাকে ‘মানসিক রোগ’ বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

শিশু স্বাস্থ্য


কম্পিউটারে গেম খেলার প্রতি নেশাকে এই প্রথম একটি মানসিক রোগ হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে যাচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

১১তম ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজেস বা আইসিডি-তে এটিকে ‘গেমিং ডিজঅর্ডার’ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এ সংক্রান্ত খসড়া দলিলে এই গেমিং আসক্তিকে বর্ণনা করা হয়েছে এমন এক ধরণের আচরণ হিসেবে, যা জীবনের আর সব কিছুর আকর্ষণ থেকে একজনকে দূরে সরিয়ে নেয়।

বিশ্বের কিছু দেশে গেমিং আসক্তিকে ইতোমধ্যে একটি প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে চিহ্ণিত করা হয়েছে।

যুক্তরাজ্যসহ কিছু দেশে তো ইতোমধ্যে এর চিকিৎসার জন্য প্রাইভেট এডিকশন ক্লিনিক পর্যন্ত রয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯২ সালে সর্বশেষ ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজেস বা আইসিডি তৈরি করেছিল। নতুন গাইডলাইনটি প্রকাশিত হবে এ বছরই।

এই গাইডে বিভিন্ন রোগের কোড, লক্ষণ এবং উপসর্গ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য থাকে। চিকিৎসক এবং গবেষকরা এটির সঙ্গে মিলিয়ে রোগ নির্ণয়ের করার চেষ্টা করেন।

গেমিং আসক্তিকে কখন মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে বর্ণনা করা হবে, তার বিস্তারিত থাকছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই গাইডলাইনে।

এতে বলা হয়েছে, ১২ মাস সময় ধরে অস্বাভাবিক গেমিং আসক্তি বা আচরণ দেখা গেলে তা নির্ণয়ের পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে যদি অস্বাভাবিক আচরণের মাত্র অনেক বেশি তীব্র হয়, তখন ১২ মাস নয়, তার আগেই ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।

যেসব লক্ষণের কথা এতে উল্লেখ করা হয়েছে:

• গেমিং নিয়ে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা (বিশেষ করে কত ঘন ঘন, কতটা তীব্র এবং কত দীর্ঘ সময় ধরে গেমিং করছে, সে বিষয়ে)

• গেমিং-কেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়া

• নেতিবাচক প্রভাব সত্ত্বেও গেমিং অব্যাহত রাখা বা আরও বেশি গেমিং করা

লন্ডনের নাইটিংগেল হাসপাতালের টেকনোলজি এডিকশন স্পেশালিস্ট ড. রিচার্ড গ্রাহাম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন।

‘এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর ফলে আরও বিশেষায়িত চিকিৎসার সুযোগ তৈরি হবে। এতে করে এ ধরণের গেমিং আসক্তিকে লোকে আরও গুরুত্বের সঙ্গে নেবে।’

তবে যারা গেমিং আসক্তিকে একটি মানসিক ব্যাধি হিসেবে দেখার বিপক্ষে, তাদের প্রতিও তিনি সহানুভূতিশীল।

তিনি স্বীকার করছেন যে অনেক বাবা-মা এ নিয়ে বিভ্রান্ত হতে পারেন। কেবল গেমিং এ উৎসাহী বলে সন্তানদের তারা ‘অসুস্থ’ বলে ভাবতে পারেন।

ড. রিচার্ড গ্রাহাম জানান, বছরে তিনি ডিজিটাল আসক্তির প্রায় ৫০টির মতো কেস দেখেন। এই আসক্তির কারণে এদের ঘুম, খাওয়া-দাওয়া, সামাজিক মেলা-মেশা এবং শিক্ষার ওপর কি প্রভাব পড়ে, সেটার ওপর ভিত্তি করে আসক্তির সমস্যার মাত্রা বোঝার চেষ্টা করা হয়।

রোগী দেখার সময় একটা জিনিসকেই তিনি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন। এই গেমিং আসক্তি ‘নিউরোলজিক্যাল সিস্টেম’কে কতটা প্রভাবিত করছে। এটি চিন্তার ক্ষমতা বা নিবিষ্ট থাকার ক্ষমতার ওপর কি প্রভাব ফেলছে।

বিশ্বের অনেক দেশই গেমিং এর আসক্তি নিয়ে চিন্তিত। দক্ষিণ কোরিয়ায় তো সরকার এমন আইন করেছে যাতে ১৬ বছরের কম বয়সী শিশুরা মধ্যরাত হতে ভোর ছটা পর্যন্ত অনলাইন গেম খেলতেই না পারে।

জাপানে কেউ যদি একটি নির্দিষ্ট সময়ের বেশি গেম খেলে তাকে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়। চীনে সেখানকার সবচেয়ে বড় ইন্টারনেট প্রতিষ্ঠান টেনসেন্ট শিশুরা কতক্ষণ গেম খেলতে পারে তার সময় বেঁধে দিয়েছে।

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির এক সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হচ্ছে, শিশুরা যদিও প্রচুর সময় স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে কাটায়, কিন্তু তারা তাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে এই ডিজিটাল জগতকে ভালোই খাপ খাইয়ে নিতে পারে।

গবেষণায় দেখা গেছে, মেয়েদের তুলনায় ছেলেরাই ভিডিও গেম খেলায় বেশি সময় দেয়।

গবেষণক কিলিয়ান মুলান বলেন, ‘মানুষের ধারণা শিশুরা দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টা স্ক্রীনের সামনে বসে থাকছে, আর কিছু করছে না। আসলে তা নয়। আমাদের গবেষণায় আমরা দেখছি, তারা প্রযুক্তিকে নানা কাজে ব্যবহার করছে। এমনকি স্কুলের হোমওয়ার্ক করার জন্যও তারা প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।’

‘আমরা বড়রা যেভাবে করি, অনেকটা সেভাবে শিশুরাও আসলে তাদের ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারটা সারাদিন ধরেই অন্য অনেক কিছুর ফাঁকে ফাঁকে করছে, একবারে নয়।’ সুত্র: বিবিসি। সুত্র: নয়াদিগন্ত।

 

পথেঘাটে নারীদের নিরাপত্তা নেই

ডা. মিথিলা ফেরদৌস


সি এন জি বাপ ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে, ভাবলাম এক কিলো রাস্তা হেটেই যাই। সি এন জি থেকে নেমে, রিক্সা খুঁজলাম একটু, তারপর হেটেই রওনা দিলাম।

ঈদের পর রাস্তা পুরাই ফাঁকা। ফুটপাথ ধরে হেটে যাচ্ছি। ঘ্যাচ করে একটা মাইক্রো এসে পাশে দাঁড়ায় কয়,
:আপা কই যাইবেন?
আমি কোন কথা না বলে হন হন করে হাটতে থাকি।
কিছুক্ষন পর একটা মোটরসাইকেল পাশে এসে থামলো।
:কই যাবেন?
আমি কোন কথা বলিনা।
এরপর একটা ভাঙাচোরা প্রাইভেট কার বেশ কিছু সামনে এসে থেমে, গ্লাস নামাচ্ছিলো।
আমি কাছে আসতেই
:আপা কই যাবেন?
এবারও কথা বলিনা, কিন্তু গাড়িটা পাশে পাশে চলতেই থাকে। রাস্তায় দুই একজন লোক আছে দূরে দূরে। একটু ভয় ভয় করছে। আমি আরও জোরে হাটতে থাকি।মুখ ঘেমে টুপ টুপ করে পরছে। গাড়িটা চলে যায়।

আলতাফ বার বার বলতেছিলো, ওকে অফিসে নামায় ওই সি এন জি নিয়ে আসতে। পাত্তা দেইনি। ভাবলাম রাস্তা ফাঁকা, হাটা হয় না। একটু হাটি।

সামনেই পথ ঘুরে গেছে। ঠিক সেই জায়গায় একটা বেশ দামী প্রাইভেট কার এসে দাঁড়ালো। এইবার খুব ভয় হচ্ছিলো।এমন হচ্ছে কেন?
এইটাই কি স্বাভাবিক? রাস্তায় হাটলে কিছুক্ষন পর পর কি এমন প্রাইভেট কার, মাইক্রো, বাইক এসে দাঁড়ায়? আলতাফের সাথে যখন রাস্তায় চলি, কখনও এমন হয় নাই তো। এইবার আরও জোরে হাটতে থাকি, গাড়িটা রেখেছেও এমন জায়গায় যেদিক দিয়েই যাই, গাড়ির ঠিক পাশ দিয়ে যেতে হবে। ড্রাইভার মুখ বাড়িয়ে
:কি ম্যাডাম কই যাবেন?
গলায় স্বরেই বোঝা যায় টিজিং। ইচ্ছা করতেছিলো কষে দুই চড় দিই। সেইটা তো অসম্ভব। আমি জোরে জোরে হাটতে থাকি। গাড়ি স্লো আমার পাশে পাশে কিছুদুর চলে, এরপর জোরে চালায় চলে যায়।

হাসপাতালের কাছে, আসতেই ডাক্তারদের গাড়ি চোখে পরে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। এবার ধীরে ধীরে হাটি।
এইটুকু রাস্তায়, দিনের বেলায়ই আমার মত একজন মহিলার জন্যেই যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে অন্যদের জন্যে কি অবস্থা!

যদি আমার গাড়ি লাগতোই তাহলে আমি দাঁড়ায় ডেকে নিতাম, যদিও আমি বা যে কারো এমন কারো কাছে লিফট নেয়া কখনই উচিৎ না। একটা মানুষ হেটে যাচ্ছে মানেই হয়তো তার গন্তব্য কাছেই, তাকে লিফট দিতে চাওয়ার তো কোন কারণ দেখিনা।

যেহেতু আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এমন দুর্বল(আশে পাশে কোথাও কোন পুলিশ আমি দেখিনি।অথচ ভি আই পি রোড।প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের পাশ দিয়েই যাচ্ছিলাম।) সেহেতু আমাদের নিজেদের ব্যাপারে নিজেদের সচেতন হওয়া খুব জরুরী।
আমি বলছিনা, আমাকে যতজন লিফট দিতে চেয়েছে, তাদের সবার উদ্দেশ্যই খারাপ ছিলো। কিন্তু এই চারজনের সবার উদ্দেশ্যই কি ভাল ছিল? আমার কাছে লিফট নেয়ার ব্যাপারটা কখনওই ভাল মনে হয় না।
অনেক সময় এমন হয়, হাটতে হাটতে হয়রান হয়ে মনে হয়, কিছু একটা পেলেই উঠে যাবো, তখনও সাবধান হতে হবে।

একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, নিজেদের মধ্যেই একটা রিফ্ল্যাক্স আনতে হবে, কোনটা ভাল কোনটা মন্দ!নিজেদের নিরাপত্তার কথা নিজেকেই ভাবতে হবে, দেশ আপনার নিরাপত্তা না দিলেও, কোন ঝামেলায় পরলে, কিছু নেগেটিভ মানুষ আপনাকে নিয়ে কথা বলতে ছাড়বেনা। কিছু অঘটন ঘটলেই একদল ঝাঁপায় পরে, বিপদে পরা মেয়ের চারিত্রিক সনদপত্র বিতরণ করতে।

  • ডা. মিথিলা ফেরদৌস
    বিসিএস স্বাস্থ্য
    সাবেক শিক্ষার্থী, রংপুর মেডিকেল কলেজ।

 

ঈদ উৎসবে সৌদি আরব

ডা. ফাতিমা খান


সৌদি আরবে ঈদের আনন্দ শুরু হয়ে যায় রমজান শুরু হওয়ার আগে থেকে। আমার কাছে যে আরব দেশীয়রা চিকিৎসা নিতে আসে, তাদের মাঝে আমি এ ব্যাপারটা প্রত্যক্ষ করেছি। এদেশের সংস্কৃতি অনেকটা মিশ্র ধরনের। যুগ যুগ ধরে ইয়েমেনি, মিশরীয়, ফিলিস্তিনি, জর্ডানি, সিরিয়ানসহ ইন্ডিয়ানরা তাদের কিছু কিছু কালচার এদেশে প্রচলিত করে দিয়েছে। যার কারণে ওদের অভ্যাস আর কালচারের মাঝেও বিভিন্নতা দেখা যায়। অনেক গুলো বছর এদেশে কাটানোর পরও সৌদিদের সাথে খুব বেশী পারিবারিক ভাবে মেলামেশা বা সামাজিকতা রক্ষা করা হয়নি। তবে ওদের উৎসব বা আনুষ্ঠানিকতা সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা হয়ে গিয়েছে।

রমজানের সময় দেখতাম আমভাবে রোগীরা বিদায় নেয়ার সময় বলত, “কুল্লু আ’ম ওয়া আনতুম বি খায়ের” অথবা “কুল্লু সানা আনতুম তাইয়্যেবীন”। দুইটা বাক্যই হল একটা শুভকামনার প্রকাশ যার অর্থ হল “সারাবছর তোমরা ভাল থেকো”। এই একই কথা তারা ঈদের সময়ও বলে থাকে। সাথে যুক্ত হয় আরো কিছু দোয়ামূলক বাক্য, যেমন তাকাব্বাল মিন্না ওয়া মিনকুম (আল্লাহ আমাদের ও তোমাদের নেক আমলগুলোকে কবুল করুন) বা ঈদ সাঈদ ( আনন্দময় ঈদ) অথবা ঈদ মোবারাক।

রোজার মাসে এখানে সবাই রাতে জেগে ইবাদত করে , সেহরির পর ঘুমায়। দুপুরে যুহর নামাজের সময় তাদের দিন শুরু হয়। সেই অভ্যাসমত চাঁদ রাতেও নিদ্রাহীন ভাবে এখানে সবাই ঈদের দিনটার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত থাকে। মসজিদে তাকবীর শোনার পর সবার মাঝে ঈদের আমেজ শুরু হয়। পটাকা বা বাজী ফুটিয়ে, ঘরদোর সাজিয়ে, বাখুর ( সুগন্ধী কাঠের গুড়া বা টুকরা) জ্বালিয়ে, প্রতিবেশীদের চকলেট বা মিষ্টি জাতীয় খাবার পাঠিয়ে তারা চাঁদ রাতে ঈদেকে স্বাগতম জানায়। বাড়িতে আত্নীয় স্বজনদের সমাগম হয়। অন্দরমহলে চলে মেহেদী লাগানোর ধুম। ছোট থেকে বড় সবার ফ্যাশন, মেকাপ আর ড্রেসাপ এর জল্পনা কল্পনায় ঘরবাড়ি সরব হয়ে ওঠে। ঘরের মুরব্বীরা কনিষ্ঠদের জন্য সামর্থ অনুযায়ী ঈদের সেলামী বা মিনি গিফট প্যাক তৈরী করে। সুঘ্রানের এরাবিয়ান কফি বা “কাহওয়া” পান চলে সারারাত। সাথে থাকে “হালা” বা যেকোন মিষ্টিজাতীয় খাবার।

ঈদের সময় ওদের ঘরে যে সুসাদু মিষ্টি জাতীয় খাবারগুলো তৈরী হয় তারমধ্যে বাসবুসা, বাকলাভা, কুনাফা, কাতায়েফ, ফ্রুট ক্যারামেল, ক্ষীর, পুডিং, মাহালাবিয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এগুলো বেশীরভাগই ওভেন বেকড এবং দুগ্ধজাত। এর মধ্যে কয়েকটি লেবানিজ বা মিশরীয় কুস্যিন।

দান দখিনায় এদেশের ধনী ও ধার্মিক মানুষগুলোর জুড়ি নেই। একাজে তাদের অনেকেই নবী, রাসূল ও সাহাবাদের আদর্শের অন্ধ অনুসারী। ধনীর দৌলতের অংশ থেকে গরীবদের প্রাপ্তিটুকু বুঝে নিতে ঈদের আগের দিন বা ঈদের দিন পর্যন্ত সোমালি, হাবাশী, ইথিওপিয়ানসহ কিছু গরীব দেশের মানুষদের দেখা যায়, যারা যাকাত ফিতরা বা কিছু সাদাকা প্রাপ্তির আশায় অপেক্ষা করে।

ঈদগাহে মানুষের সমাগম হয় দেখার মত। বিশাল ঈদগাহ গুলোতে সব দেশের, সব বয়সের পুরুষ, মহিলা ও বাচ্চাতে জনাকীর্ণ হয়ে যায়।

দেশ, জাতি নির্বিশেষে নাড়ীর সাথে বাড়ীর সাথে মানুষের বন্ধন চিরন্তন। আমাদের দেশের মত এদেশেও ব্যস্ত কমার্শিয়াল শহরগুলোর একটা বড় অংশ ঈদের সময় ফাকা হয়ে যায়। সবার গন্তব্য থাকে যার যার গ্রামের বাড়ির দিকে। গ্রাম বা মফস্বল জাতীয় এলাকাগুলোকে তারা বলে ‘ক্বারিয়া’ (যদিও কোরআন শরীফে বিভিন্ন জায়গায় ‘ক্বারিয়া’ বলতে জনপদকে বোঝানো হয়েছে)।ঈদের কয়েকদিন আগে থেকেই তাদের আনন্দমিশ্রিত অস্থিরতা শুরু হয়ে যায় “ক্বারিয়া” গমনের জন্য। ঈদের দিন এখানকার পার্ক, সি-বীচ আর রিসোর্টগুলো থাকে ভিড়ে আকীর্ণ।

বাংলাদেশী পরিবারগুলো দেশী রীতি রেওয়াজ অনুযায়ী ঈদ উদযাপন করে। উপমহাদেশের অন্য দেশগুলোর প্রবাসীদের ঈদ যাপন অনেকটা আমাদের মতই। বাঙালি নারীদের ঐতিহ্যবাহী অভ্যাস হল ঈদের সারাটা দিন রসুইঘরে মুখরোচক রান্না করে কাটানো। নিজের পরিবার, মেহমান, পাড়া প্রতিবেশীদের আপ্যায়নের জন্য তাদের ঈদের দিন রীতিমত কোরবানী করার মাঝেই তাদের ঈদ আনন্দ। স্বামী সন্তানদের নতুন কাপড় পরিয়ে নিজের কাপড়খানা কোন অনুষ্ঠানে পরে যাওয়ার পরিকল্পনা করেই তারা খুশি থাকেন। অবশ্য কেউ কেউ ঈদের ছুটি কাটাতে অন্য কোন শহরে ঘুরতে যান পরিবারসহ। বিশেষ করে আমাদের মত চাকুরীজীবী মায়েরা কর্মব্যস্ততার ক্লান্তি দূর করতে ও বাচ্চাদের সাথে একটু আনন্দময় সময় কাটাতে দু একদিনের জন্য দূরে কোথাও বা প্রকৃতির কাছাকাছি কোথাও বেরিয়ে আসেতে পছন্দ করেন।

এখানকার প্রবাসী পরিবারগুলোর ঈদ আনন্দের আরেকটি বড় উৎস হল ঈদ পূনর্মিলনী অনুষ্ঠানগুলো। অনুষ্ঠানগুলোতে প্রত্যেক দেশের মানুষগুলো যার যার দেশীয় খাওয়া দাওয়া ও বিনোদনের আয়োজন করে থাকে। স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোতে স্বদেশের প্রচারিত অনুষ্ঠানমালা উপভোগ করতে অন্তত বাংলাদেশীদের ভুল হয়না।

ঈদকে পুরাপুরি উপভোগ করতে পারেননা প্রবাসী শ্রমিক গোছের মানুষগুলো। যারা পরিবার পরিজন রেখে এখানে একা থাকেন তাদের ঈদের দিনটা নিতান্ত মলিন। দেশে পরিবার পরিজনদেরকে নিজের সবটুকু উপার্জন আর উপহার পাঠানোর মাঝেই তারা আনন্দ খুঁজে নেন। তারপরও অনেকেই পরিবারের মন রক্ষা করতে পারেননা । ঈদের দিনেও তাদের কেউ কেউ ওভারটাইম করেন আরো কিছু বাড়তি অর্থের যোগান দিতে। ঈদের আনন্দঘন দিনটির সুশীতল আমেজ তাদের ঘর্মাক্ত দেহ আর ক্লান্ত মনকে একটু স্বস্তি দিতে পারেনা।

ডা. ফাতিমা খান
লেখিকা কর্মরত: আল হিবা মেডিক্যাল গ্রুপ, জেদ্দা, সৌদি আরব।