banner

রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 1458 বার পঠিত

 

মানুষকে বিচার করার ক্ষমতা মানুষের কতটুকু

ডা. ফাতিমা খান


একজন মানুষের কথাবার্তা, আচার-আচরণ ও অভ্যাসগুলো তার শিশুকালের শিক্ষা, অভ্যাস, পারিপার্শ্বিকতা, তার পারিবারিক কালচার এবং নিজস্ব এলাকার সংস্কৃতি দিয়েই অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত হয়। অনেক বড় ডিগ্রীধারী কিংবা অনেক উচ্চস্তরের চাকুরীরত মানুষ গুলোও নিত্য দিনশেষে ঘরে ফিরে তার আদিম অভ্যাস গুলোর চর্চায় মেতে উঠে। তার নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা, খাওয়া, পরা, উঠা বসা, রসম রেওয়াজ সবকিছুতেই একটু “হাফ ছেড়ে বাচার” চেষ্টা করে। অনেকে চেষ্টা করেও, ভালটা জেনেও নিজের আদি অকৃত্রিম অভ্যাস বদলাতে পারে না।

এ ক্ষেত্রে আমরা কি সে মানুষটাকে আন- কালচার্ড বা ইনসেইন বলতে পারব? কিংবা বলা কি উচিৎ? বললে কাদের কে বলা যাবে?

লিখতে বসে ময়না খালার গল্প মনে পড়ল। ডেন্টাল কলেজে পড়ার সময় আমাদের হোস্টেলের মেয়েদের দেখাশোনা, ফুট ফরমায়েশ এর কাজ করত ময়না খালা। আমি তখন বিদেশ থেকে বাংলাদেশে গিয়ে একদম নতুন মানুষ। আমার অবস্থা প্রথমবার গ্রাম থেকে গাট্টি বোচকা নিয়ে আসা বেকুব মানুষটার মত যে ঢাকার রাস্তায় ডাবল-ডেকার বাসগুলো দেখে হা করে তাকিয়ে থাকে। সব কিছুতেই তখন আমার বিস্ময়, পুরা নতুন দুনিয়ায় আমি এক এলিয়েন। তো হোস্টেলে এই ময়না খালাকে দেখতাম গড়ে পড়তা সবাইকে ‘তুই’ করে সম্বোধন করে কথা বলে। ওই সময়ে আমার কাছে সবচেয়ে বড় বিস্ময় ছিল এই ময়না খালা। ব্যাপক কৌতুহল নিয়ে তাকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলাম।

একদিন শুনি ময়না খালা হাসপাতালের এক ডাক্তারকে স্নেহের স্বরে বলছে, ‘তোর জ্বর কমছে? ওষুধ খাইছিস?’ আর সেই ডাক্তারও অনেক সমীহ করে উত্তর দিল ‘ জ্বী খালা, দোয়া কইর’। আমি তব্দা খেয়ে গেলাম! কিন্তু দিনে দিনে আমার পর্যবেক্ষণের যে ফলাফল পেলাম, তা হল ময়না খালার দেশের বাড়ি পঞ্চগড়, যেখানে সম্বোধনের জন্য তারা ‘তুই’ টাকেই সবচেয়ে আপনজনদের জন্য ব্যবহার করে। ডেন্টাল কলেজের আমার চার বছরের অভিজ্ঞতায় সবচেয়ে স্নেহপ্রবণ আর মায়াবতী মহিলা ছিল এই ময়না খালা।

এবার হোস্টেলেরই এক সিনিয়র আপুর কথা বলি। তিনি হাসতে হাসতেই বন্ধুদের আদর করে ” বা***ত” বলে ডাকত। আমার কাছে এই ব্যাপারটা এতই অদ্ভুত আর অস্বস্তিকর মনে হত যে আমি তার থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলতাম, পাছে কবে আমি তার এই আদরের ডাকের শিকার হই! অন্যদের কাছ থেকে জানলাম তার বাবা নাকি তাদের গ্রামের চেয়ারম্যান, অনেক নামডাক আর দাপট তার ওই গ্রামে। সে যার মেয়েই হোক- চেয়ারম্যান, ব্যাটম্যান বা সুপারম্যান, আমার তাতে কিছুই আসে যায় না। আমার শুধু মনে হত, নিশ্চয়ই একদিন রোগীদেরকেও সে বলবে, “মুখ খোল বা***ত”।

এছাড়া আরো কিছু এপিক অভ্যাস দেখি তথাকথিত ভদ্র শিক্ষিত লোকদের মধ্যেও। যেমন ফাইভ স্টার হোটেলে গিয়েও হাতের কবজি ডুবিয়ে উইন্ডমিল এর মত বিশাল শব্দ করে খাওয়া, গন্ধওয়ালা মোজা খুলে ঝাড়া দিয়ে খাবার টেবিলের একপাশে লম্বা করে রেখে দেওয়া, খাওয়া শেষে প্লেটেই হাত মুখ ধুয়ে সেই পানিটা চুমুক দিয়ে খেয়ে ফেলা ( খাবার নষ্ট হলে আল্লাহ গুনাহ দিবে বলে শেষ অনু পরমানুটাও শেষ করা লাগবে), জনসমক্ষে নাকের ভেতর আঙুল ঢুকায়ে ঘুটানি মেরে বের করে আবার তাকিয়ে দেখা, যেখানে সেখানে দুনিয়া কাঁপানো হাসি, হাঁচি, কাশীসহ আরো অনেক কিছু ছেড়ে দেওয়া…. এগুলোর ব্যাপারে কি যে বলব! সত্যিই আমি মূক, অভিভূত!

এইবার আসি আমাদের নিত্যদিনের বন্ধু, নোমোফোবিয়া আক্রান্ত এই আমাদের প্রতি মুহুর্তের অক্সিজেন, সোসাল মিডিয়া ফেইসবুকে। এখানে এত ভ্যারাইটিস মানুষ আর তাদের কৃষ্টি কালচার কথাবার্তা উপভোগ করি যা ফেইসবুক ছাড়া একাকি এই জীবনে দেখা কোনদিন সম্ভব হত না। এখানে মোঘল আমলের বাদশাহ বাবর থেকে বাদশাহ আওরঙ্গজেব পর্যন্ত সবার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাবেন, তাদের অন্দরমহলের বেগম আর তাদের পরিচারিকা, পাইক পেয়াদা বরকন্দাজ কেউ বাদ যাবে না। তাদের একেক জনের কথাবার্তার ধরণও সেইরকম(?)। আমি তো তাদের রাজকীয় কথাবার্তার রকমফের দেখে ক্ষণে ক্ষণে অফিসে বসেও একাই হো হো করে হাসি আর আমার রোবটের মত নার্সটা ইতস্ততভাবে বলে ফেলে “আর ইউ অল রাইট ডক?”

শেষ গল্পটা বলি।
সেদিন একজন মিশরীয় রোগী এসেছে আমার কাছে। সে সাধারণ কথাই এতো বেশী উচুস্বরে বলছিল যে এডমিন থেকে আমাকে ফোন করে জিজ্ঞাস করল ” ইজ এভরিথিং অলরাইট ডক্টর? দা সিকিউরিটি ইজ জাস্ট আউটসাইড ইয়র ডোর “। আমি না হেসে পারলাম না। তাকিয়ে দেখি দরজায় আমাদের সুমো পালোয়ান এর মত হাট্টা গাট্টা সিকিউরিটি গার্ড উঁকি মেরে দেখছে। তাকে চলে যেতে বললাম।

রোগীর কথা শেষ হলে তাকে বললাম “আচ্ছা, তুমি এত উচ্চস্বরে কথা বল কেন?” সে কিছুটা লজ্জিত হয়েই বলল, ” আমি দুখিত ডক্টর, ছোটবেলার অভ্যাস। আমার বাবা সমুদ্রে জেলে ছিল। আমি তার কাজে সাহায্য করতাম। অনেক দূর থেকে জোরে জোরে কথা বলা লাগত। তাই অভ্যাস হয়ে গেছে।”

আমার মনে হয় মানুষকে বিচার করার কাজটা একটু সময় নিয়ে করা উচিত। একদম অমার্জনীয় অপরাধ বা অভ্যাসওয়ালা মানুষ ইন্সট্যান্টলি পরিত্যাজ্য। কিন্তু বাকীদের ব্যাপারে মানে যে দোষগুলো খুব সাংঘাতিক না সেগুলো ইগ্নোর করে সময় সুযোগ নিয়ে বুঝিয়ে বলাই ভাল। ক্ষতি তো নেই! এমনো হতে পারে তাকে কেউ কখনো ভালভাবে বুঝিয়ে বলেই নাই।

আল্লাহতায়ালা মানুষের বিচার করবেন তাদের শিক্ষা, সামর্থ্য আর জ্ঞানের গভীরতা অনুযায়ী। আমরা মানুষ হয়ে কেমন করে হুট করেই ফয়সালা শুনিয়ে দেই, বলেন!

লেখক কর্মরত: আল হিবা মেডিক্যাল গ্রুপ, জেদ্দা, সৌদি আরব।

Facebook Comments