banner

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 673 বার পঠিত

কেঁচো চাষে মেতেছেন ফুলছড়ির নারীরা

NEWS--

 

 

অপরাজিতাবিডি ডটকম, গাইবান্ধা : বাজেতেলকুপি গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার একটি গ্রাম। এ গ্রামের ফুয়ারা বেগম আয়ের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছেন কেঁচো চাষ বা ভার্মি কম্পোস্ট। নিজ বাড়িতে কেঁচো উৎপাদন করে মাত্র ছয় মাসে অর্ধলক্ষ টাকা আয় করেছেন তিনি। শুধু ফুয়ারা বেগম নন, এলাকার আরও অর্ধশতাধিক নারী এ কাজে সম্পৃক্ত। তাদের কেঁচো চাষ শুধু অর্থ উপার্জন নয়, পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষায় অবদান রাখছে।

 

ফুয়ারা বেগম বলেন, ‘বন্যা ও নদীভাঙ্গনে কয়েক দফা বাড়ি-ঘর ভেঙ্গে নিঃস্ব হয়ে বাজেতেলকুপি গ্রামে আশ্রয় নিই। এরপর গণউন্নয়ন কেন্দ্রের (জিইউকে) সঙ্গে সম্পৃক্ত হই। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখি। বন্যামুক্ত করতে বসতবাড়ি উঁচুও করতে সহায়তা করে সংস্থাটি। তাদের মাধ্যমে সাড়ে ১৪ হাজার টাকা অনুদান নিয়ে ৪ হাজার কেঁচো কিনে চাষ শুরু করি। তিনমাস শেষে অন্যান্য গ্রামের নারীদের কাছে ৩০ হাজার কেঁচো ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করি।’

 

কেঁচো চাষের বৈচিত্রময় দিক নিয়ে বলেন, ‘কেঁচো থেকে উৎপাদিত কয়েক মণ জৈবসার বিক্রি ছাড়াও নিজের সবজি ক্ষেতে ব্যবহার করেছি। বাড়িতে উৎপাদিত লাউ, করলা ও শিম বিক্রি করে চলতি মৌসুমে ১০ হাজার টাকা আয় করেছি। এ ছাড়া বাড়ির পেছনে ১০ হাত জায়গায় গর্ত করে বিদেশি মাগুর চাষ করে ৭ হাজার টাকা আয় করেছি। বর্তমানে আরও ১৫০টি মাগুর ও ৬টি হাঁস রয়েছে। আশা করছি এখান থেকে আয় হবে ১৫ হাজার টাকা। বর্তমানে বাড়িতে ৫টি রিংস্লাবে ৫০ হাজার কেঁচো রয়েছে। এগুলোর সংখ্যা প্রতিনিয়তও বৃদ্ধি পাচ্ছে। হাতে থাকা কেঁচো ও জৈবসারের মূল্য প্রায় ৪০ হাজার টাকা।’

 

NEWS-1

 

 

অতীতের কথা স্মরণ করে কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘দুইবছর আগের অসহায়ত্বের কথা মনে হলে শিউরে উঠি। শুধু স্বামীর একার আয়ে সন্তানদের নিয়ে কত রাতই না উপোষ থাকতে হয়েছে। কিন্তু সে দিন এখন আর নেই। সংসারেও বিবাদ নেই। ছেলে-মেয়েদের স্কুলে দিয়েছি।’

 

এ উদ্যোগের পেছনে রয়েছে উত্তরাঞ্চলভিত্তিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণউন্নয়ন কেন্দ্র (জিইউকে)। ২০১০ সালে দাতা সংস্থা ক্রিশ্চিয়ান এইডের অর্থায়নে সংস্থাটি ফুলছড়ির ফজলুপুর এবং নদী ও চরাঞ্চলের অতিদরিদ্র দুই হাজারের বেশি পরিবার নিয়ে কৃষিভিক্তিক টেকসই জীবনযাত্রার উন্নয়নে কার্যক্রম শুরু করে। এতে ৪৫০টি পরিবারকে সরাসরি অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহায়তা দেওয়া যাচ্ছে। সংস্থার কৃষিভিত্তিক সহযোগিতার অন্যতম কর্মসূচি কেঁচোর মাধ্যমে জৈব সার উৎপাদন। ছয় মাস আগে ফজলুপুর, বাজেতেলকুপি, উজানডাঙ্গা, কোচখালী, চন্দনশ্বর ও পূর্বখাটিয়ামারী গ্রামের ৬০ জন নারী কেঁচো চাষে সম্পৃক্ত হন। তবে চাষীর সংখ্যা এখন অনেক বেশি।

 

এ চরের আরেক নারী রহিমা বেগম। কেঁচোর তৈরি জৈবসার দিয়ে দেড় বিঘা জমিতে মরিচ ও এক বিঘা জমিতে গম চাষ করেছেন। তিনি বলেন, ‘যারা রাসায়নিক সার দিয়ে মরিচ চাষ করেছে তাদের চেয়ে আমার মরিচ অনেক ভালো হয়েছে। প্রথম দিকে জৈবসার উৎপাদনের প্রতি এলাকা অন্যদের একটু অনীহা থাকলেও এখন অনেকে কেঁচো চাষ করছেন।’

 

জিইউকে রিভার প্রকল্পের ম্যানেজার প্রতিমা চক্রবর্তী জানান, বাড়িতে একটি গরু থাকলে কেঁচোর মাধ্যমে ৪৫ দিনে ৬০ কেজি জৈবসার উৎপাদন করা যায়। একজন নারী যদি ২ হাজার কেঁচো চাষ করে তাহলে মাসে ৬০ কেজি জৈবসার উৎপাদন করতে পারবে। এ ছাড়াও ২ হাজার কেঁচো থেকে বছরে ৮০ হাজার কেঁচো পাওয়া যায়। সংসারের অন্যান্য কাজের পাশাপাশি একজন নারী শুধু কেঁচো চাষ থেকে মাসে অনায়াসে ৪ হাজার আয় করছেন।

 

তিনি আরও জানান, কেঁচো বা ভার্মি কম্পোস্টের চাহিদা চরাঞ্চলে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ সার চরে কেজি প্রতি ১২ থেকে ১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রাসায়নিক সারের চেয়ে জৈবসারে অন্ততপক্ষে ৫০ ভাগ অর্থ সাশ্রয় হয়। উৎপাদনও হয় অনেক বেশি। তবে এ সারের মার্কেটিং এখন সেভাবে হয়নি। এ জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে এগিয়ে আসতে হবে।

 

NEWS-2_1

 

জিইউকে এর প্রোগ্রাম ম্যানেজার রোকনুজ্জামান জিল্লু জানান, গণউন্নয়ন কেন্দ্র দুর্যোগের সঙ্গে বসবাসরত নারীদের আয়মুখী কাজে সারাবছরই সম্পৃক্ত রাখতে রিভার প্রকল্প গ্রহণ করে। এ সব মানুষের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নিজেদের অবস্থার উন্নয়ন এবং জলবায়ুর হুমকি মোকাবেলায় এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

সংস্থার নির্বাহী প্রধান এম. আবদুস সালাম বলেন, ‘জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চরাঞ্চলের নারীরা। এ জন্য কেঁচো চাষের মতো ভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চরের নারীরা মৌসুমভিত্তিক বহুমুখী আয়ে সম্পৃক্ত থাকলে দরিদ্রতা থেকে মুক্ত হতে পারবে; তা না হলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাদের জীবনযাত্রার স্বাভাবিক গতিকে বাধাগ্রস্ত করবে।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মীর আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘কৃষিতেও নারীরা সম্পৃক্ত হচ্ছেন। কেঁচো চাষের মাধ্যমে জৈবসার তৈরিতে নারীদের অসাধারণ অবদান অবশ্যই মূল্যায়নযোগ্য। এর মাধ্যমে তারা যেমন অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হচ্ছেন তেমনি মাটি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন।’

এ ছাড়াও এ সব নারীরা বসতবাড়িতে নানা ধরনের সবজি ও মাছ চাষ এবং গরু-ছাগল, হাঁস-কবুতর পালনের সঙ্গে যুক্ত আছেন।

 

অপরাজিতাবিডি ডটকম/আরএ/এ/০৯ মে ২০১৪.

Facebook Comments