banner

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 812 বার পঠিত

 

রূপান্তরের যাত্রা – পর্ব ৩

তাহনিয়া খান


বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

Rabbish rahli sadri wa yas-sir li amri wahloul uqdatam mil-lisaani yafqahu qawli.
O my Lord! expand me my breast; Ease my task for me; And remove the impediment from my speech, So they may understand what I say[20:25-28]

আমি হজ্জের উপর পড়ালেখা শুরু করলাম। আমাদের এজেন্সি আমাদের ট্রেনিং দিল। কিভাবে হজ্জ করবো, হজ্জের সময় কোথায় থাকবো, মক্কা মদিনায় অসুবিধা হলে কাকে কি জিজ্ঞেস করবো, হারিয়ে গেলে কোথায় যেতে হবে, যতরকম খুঁটিনাটি বিষয় আছে আমাদের মোয়াল্লেম দুদিন ধরে সেসব বুঝালেন। তখন অনেক কিছু না বুঝলেও শুনে রেখেছিলাম, যেটা পরবর্তীতে কাজে লেগেছিল।

মক্কা মদিনায় গিয়ে বুঝলাম যে, একটা ভালো এজেন্সির গুরুত্ব অনেক। এজেন্সির সার্ভিস পাওয়া যেমন গুরুত্বপূর্ন, তেমনি হজ্জ গ্রুপের যিনি মোয়াল্লেম হবেন, তাকে হতে হবে একজন আলেম। আল্লাহ্‌র স্পেশাল নেয়ামত হিসাবে আমরা একটা ভালো এজেন্সির মাধ্যমে যেতে পেরেছি। আর পেয়েছিলাম এমন একজন মোয়াল্লেম, যিনি শুধু আলেম না, একজন ভালো মনের মানুষ। হাজীদের খেদমতের জন্য উনি উনার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গিয়েছিলেন হাসি মুখে। একি প্রশ্ন হাজারবার করলেও উনাকে কখনো রাগ হতে দেখিনি।

সেখানে গিয়ে এমন অনেক মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে, যারা তাদের এজেন্সির বদনাম করতে করতে অস্থির। এমন অনেক লোক গিয়েছে যে হজ্জ তো দূরের কথা কিভাবে উমরা করতে হয় জানে না। তাদের এজেন্সি শুধু তাদের কে এনে ছেড়ে দিয়েছে। মোয়াল্লেমের কোন পাত্তা নেই।

যতই জেনে বুঝে আর পড়ালেখা করে যাই না কেনো , সেখানে গিয়ে একজন এক্সপার্ট সাথে থাকলে কাজের অনেক সুবিধা হয়, আর ভুল কম হয়। আমাদের মোয়াল্লেম গ্রুপ করে উমরা করিয়েছিলেন। প্রতিবার প্রতিটা গ্রুপের সাথে ছিলেন। একবার শিখে গেলেই আর সমস্যা হয় না।

এক মহিলার সাথে মক্কায় কথা হয়েছিল। উনার এজেন্সি উনাদের দুই দিন হোটেল দিতে পারেনি। তারা বাংলাদেশ হজ্জ মিশনের রাস্তার উপর ছিলেন। তারপর যখন হোটেল পেলেন, সেখান থেকে নামায পড়তে আসলেন। তখনো উমরা করেননি। জানেনও না কিভাবে উমরা করবেন। উনাকে শেখালাম কতক্ষন ধরে। একটু পরে দেখি উনার গ্রুপের এক মহিলা এসে উনাকে নিয়ে গেলেন উমরা করানোর জন্য।

যাই হোক আমি অফিস করি, বাসায় কাজ করি, বাচ্চাদের সামলাই, এর মাঝে পড়ালেখা করি। হজ্জের নিয়ম শিখি, মাসলা-মাসায়েল পড়ি, নেট সার্চ করি। আমার বাচ্চারা আমার পড়ালেখা দেখে, উত্তেজনা দেখে। বলে, ‘তুমি এত এক্সাইটেড কেনো, মা ?’

আমি আমার অনুভূতি প্রকাশ করতে পারিনা ঠিকমত। যতদিন বেঁচে থাকবো, আমি আসলে কোনদিন কাউকে এই অনুভূতি বুঝাতেও পারবো না। শুধু মনে হয় যে, আমি প্রস্তুত হচ্ছি। এমন এক জায়াগায় যাচ্ছি যেখানে নবীদের পায়ের ধুলো আছে। দুনিয়াকে পিছনে ফেলে এমন এক জায়গায় যাচ্ছি যেখান থেকে নাও ফিরে আসতে পারি। দুনিয়ার সবচেয়ে পুণ্যবান আর উৎকৃষ্ট জায়গায় আমি আল্লাহ্‌র মেহমান হয়ে যাচ্ছি। যখনি ভাবি আমার মত তুচ্ছ, পাপীকে আল্লাহ্‌ উনার বড়ত্ব দিয়ে, রহমত দিয়ে, আমাকে এত সম্মান দিতে চাচ্ছেন তখন আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনা।

যখন আমার যাওয়ার দিন স্থির হয়ে গেলো, আমি তখন আমার আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বান্ধব, কলিগদের জানালাম যে, আমি হজ্জে যাচ্ছি। দোওয়া চাইলাম সবার কাছে, যেনো ঠিকমত হজ্জ করে আসতে পারি। আমার খুশী, আমার আনন্দ তখন বিষাদে পরিনত হলো।

আমার হজ্জে যাওয়ার কথা শুনে সবাই জিজ্ঞেস করে কার সাথে যাচ্ছি। আমি উত্তরে বলি, আমার ছোট ভাই তাপসের সাথে। সবার তখন প্রায় একি ধরনের কথা, কেউ ইনিয়ে বিনিয়ে আকার ইঙ্গিতে অথবা সরাসরি বলে , কেন আমি আমার স্বামীর সাথে যাচ্ছি না। আর স্বামীর সাথে যখন যেতে পারছি না তাহলে তার যখন সময় হবে, তখন তার সাথে গেলেই তো হয়। হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ ছাড়া কেউ আমার হজ্জে যাওয়া নিয়ে খুশী না। কারণ একটাই, আমি আমার স্বামীর সাথে যাচ্ছি না।

আমি যখন বাসায় এহরামের কাপড় পরে এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠতে যাবো, তখনো হাতে ‘বেহেশতি জেওর’ নিয়ে হজ্জের মাসলা-মাসায়েলের পাতা বের করে একজন বললেন, হ্যা, তুমি তোমার স্বামী ছাড়া হজ্জে যেতে পারবে। আমি অবাক দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে গাড়িতে উঠেছিলাম।

আমরা এমন এক সমাজে বাস করি, যেখানে মানুষ তার ধর্মীয় কাজ সঠিক ভাবে করতে গেলে বাধা আসে। আর হাজারটা বেদাআত করে গেলে কোন মানা নেই। মানুষকে বুঝানোর পরেও মানুষ বুঝে না যে, নিজের ইচ্ছা দিয়ে ইসলাম চলে না, সমাজের ইচ্ছা দিয়ে ইসলাম চলে না। আল্লাহ্‌র নিয়ম দিয়েই ইসলাম চলবে।

হজ্জের প্রধান দুটো শর্ত হচ্ছে শারীরিক সুস্থতা আর অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা। মানুষের যখন এই দুটি জিনিস একসাথে থাকবে, তখনই তার হজ্জ ফরয হয়ে যাবে। তাছাড়া মুসলিম হওয়া, পাগল না হওয়া, স্বাধীন থাকাও হজ্জের শর্তের মধ্যে পরে। একবার হজ্জ ফরয হয়ে গেলে তখনই হজ্জ করে ফেলতে হবে। কারণ শারীরিক সক্ষমতা থাকলেও কারো অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা হারিয়ে যেতে পারে।
আবার অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা থাকলেও শারীরিক সক্ষমতা হারাতে পারে। তখন কি হবে ?

আমার স্বামী ভবিষ্যতে হজ্জে যেতে পারবে কি না আমি সেটা জানিনা। ইন শা আল্লাহ্‌ , যদি সে হজ্জে যায়,তখন আমার কোন অবস্থা হবে সেটাও আমি জানি না। আল্লাহ্‌ না করুক, সে যদি হজ্জে না যেতে পারে , তাহলে পরে আমি কার সাথে যাবো ? একটা মানুষও এর উত্তর দিতে পারে না, কিন্তু তারা আমার হজ্জে যাওয়া নিয়ে অখুশি।

এখানে একটা জিনিস উল্লেখ করি , সেটা হলো অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার মাপকাঠি কি ? হজ্জে যাওয়া আসার ভাড়া এবং সেখানে যতদিন থাকবো, ততদিন থাকার মত টাকা পয়সা হাতে থাকলেই মূলত অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার মাপকাঠি। এখন আপনি যদি বলেন আপনি হিল্টন হোটেলে থাকবেন আর তার ভাড়া দেওয়ার মত অবস্থা আপনার নেই, আর সেজন্য আপনার হজ্জ ফরয হয় নি। তাহলে আপনি ভুল করবেন। নুন্যতম থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারলেই হবে। ইদানিং অনেক হজ্জ এজেন্সি বিভিন্ন প্যাকেজ দিয়ে থাকে। সর্বনিম্ন প্যাকেজের টাকা হাতে থাকলে কিন্তু হজ্জ করতে হবে বলে মনে করি। যেহেতু আমি কোন আলেম না, তাই কোন ফতোয়া দিতে চাই না। প্রতিটা ব্যক্তির উচিৎ তার হজ্জ ফরয হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে আগ্রহ থাকা এবং সেই অনুসারে কোন আলেমের সাথে কথা বলে জেনে নেওয়া। এ ব্যাপারে একটা লিঙ্ক দিলাম । http://islamqa.info/en/ref/41957

যাই হোক, আমি নিজেও মনের কষ্টে ভুগছিলাম যে আমি আমার স্বামীর সাথে যেতে পারছি না। তার উপর মানুষের নেতিবাচক কথা আমার উপর প্রচণ্ড মানসিক চাপ সৃষ্টি করছিল। আল্লাহ্‌তায়ালা আমাকে সেই সব চাপ উপেক্ষা করতে সাহায্য করেছিলেন। জীবনে যা কিছু করবো, শুধু আল্লাহ্‌কে খুশী করার জন্যই করবো– এই নিয়ত আমার মনকে স্থির করেছিল।

মহা উৎসাহে আমি বাচ্চাদের নিয়ে, স্বামীকে নিয়ে, আম্মু আর ভাইদের নিয়ে হজ্জের জন্য কেনাকাটা করেছি, হজ্জ ক্যাম্পে গিয়েছি, মেডিক্যাল চেকআপ করিয়েছি।

হজ্জের তৃতীয় শিক্ষা—মানুষ যা কিছুই বলুক না কেন, সত্যের পথে থেকে আল্লাহ্‌র উপর ভরসা করলে আল্লাহ্‌ সঠিক পথ দেখিয়ে মানসিক প্রশান্তি দিয়ে দেন।

চলবে…

রূপান্তরের যাত্রা পর্ব-২

Facebook Comments