banner

শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 1825 বার পঠিত

 

মাতৃকথন_৩

ফারিনা মাহমুদ


  • এতবার বললাম বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় লাউ আর কালিজিরা বাদে সব খাওয়া মানা । তারপরেও তুমি মাংস খাও কোন আক্কেলে? মা হওয়া এত্ত সোজা নাকি? এইজন্যই আজকে বাচ্চাটার মাসিপিসি উঠলো!
  • দেখতো, তুমি সরিষার তেল ডলে বাচ্চা রোদে রাখলে আজকে ওর ঠান্ডা লাগতো না !
  • কি গো, রাতে কান্দে ক্যানো ? নিশ্চই পেটে ব্যথা ! কতবার বললাম যে পেটে গরম স্যাক দাও !

বাচ্চা জন্মের পর আশেপাশের মানুষের দেখে মনে হয়, পৃথিবীতে এক মা ছাড়া বাকি সবাই সব জানে ! গোটা প্রেগন্যান্সি তো বটেই, বাচ্চা জন্মের পর সে কাঁদলে, নাভি দেরিতে পড়লে, গায়ে মাসিপিসি উঠলে, হালকা ঠান্ডা লাগলে, একটু বমি করলে, ২ বারের জায়গায় ৩ বার হাগু করলে বা স্বাস্থ্য একটু খারাপ হলে আর রক্ষা নাই । আশপাশ থেকে সমানে শুরু হয় মা-কে দোষারোপ!

এই গ্যাড়াকলে পড়ে পোস্ট ন্যাটাল ডিপ্রেশনে ভোগা (অল্প বিস্তর সবারই হয় এটা, হরমোনাল চেঞ্জের কারণে) মা টার নিশ্চই ইচ্ছে করে গঙ্গায় ডুবে মরতে ! এক একবার নিজেকে অপরাধী লাগে,মনে হয় আমার ভুলেই বাচ্চাটা কষ্ট পাচ্ছে !

পরো ক্ষণে যখন স্বামীও পাশে না দাঁড়িয়ে দোষারোপ করতে থাকে, তখন মনে হয়, মুগুর দিয়ে মাথায় বাড়ি দেই! কখনো রাগ গিয়ে পড়ে বাচ্চাটার উপর। নিজেকে খুব একা লাগে! অসহায় লাগে! মনে হয়, আমি কি আর কোনদিন ফিরতে পারবো স্বাভাবিক জীবনে ?

বাস্তবতা হচ্ছে আশেপাশের এসব মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে যেই মাতব্বরি গুলি করেন, সেইগুলি অনেক অভিজ্ঞতার আলোকে হলেও এর যুক্তিযুক্ত ভিত্তি সমসময় থাকে না । উপরন্তু, নতুন মাকে এই নাজুক সময়ে এ ধরনের অযথা দোষারোপ পরিস্থিতি জটিল ও দুর্বোধ্য করে তোলা ছাড়া আর কিছুই করে না !
তার অর্থ এই না যে সাহায্য বা উপদেশ দেয়া যাবে না।

যেটা করা উচিত না তা হচ্ছে আলগা মাতব্বরি, টিটকারী বা এমন কোনভাবে কিছু বলা, যাতে মা টা কষ্ট পায় । যে কোনো সদ্যজাত বাচ্চার মাকে “আলগা” উপদেশ দেবার আগে মাথায় রাখতে হবে

(১)শী ইস দি গড ড্যাম ওয়ান হু ক্যারিড দি চাইল্ড ফর নাইন মান্থস, প্রকৃতি বাচ্চা বহন করার ক্ষমতা যাকে দেয়, বাচ্চা পালার ক্ষমতাও তাকে দিয়ে দেয়। বাচ্চা পেটে থাকতে সে কি আপনার কাছে এসেছিলো আম্লিক্যাল কর্ড ধার করতে? আসে নাই! সে তার শরীরের নির্যাস দিয়ে পরিপূর্ণ একজন মানুষ যেহেতু পৃথিবীতে আনতে পেরেছে, আপনি ছাড়াও তার বাচ্চা বড় হবে, টেনশন নিয়েন না।

(২)একটা নতুন বাচ্চার সাথে মায়ের বন্ডিং টা গড়ে উঠা জরুরি। এই বন্ডিং গড়তে ২ টা জিনিস লাগে “সময়” ও “সহযোগিতা”।

উপদেশ দিয়ে এই বন্ডিং গড়া যায় না । কাজেই আশে পাশের মানুষের উচিত সময় এবং অনুপ্রেরণা দিয়ে সাহায্য করা।

বিজ্ঞান বলে নো টু হিউম্যান আর সেইম। জগতের আর সব মানুষের মতোই বাচ্চার ক্ষেত্রেও কিছু প্যাটার্ন থাকে। রিসার্চের পর রিসার্চ করে এই প্যাটার্ন গুলো তৈরী করেছেন গবেষকরা।
সময়ের প্রবাহে, যা টিকে গেছে, যাচ্ছে, তা নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। মনে রাখতে হবে, সব বাচ্চার বেলায় সব দাওয়াই খাটে না, পুরো ব্যাপারটি ট্রায়াল এন্ড এরর কেইস। জন্মের পর পর একটা বাচ্চার আনসেটেল্ড থাকা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।

যেই বাচ্চা পানির ভিতর ভাসতো, টুপ করে তাকে বাতাসের মধ্যে ছেড়ে দিলে তার চুপ করে থাকার কোনো কারণ নাই। আপনারে যদি আমি আতিক্যা ধাক্কা মেরে ডাঙ্গা থেকে পানিতে ফালায়ে দিয়ে বলি, এইটাই এখন থেকে তোর বাসা, আপনি কি করবেন?

মাত্র জন্মানো বাচ্চার কমিউনিকেশনের একটাই উপায়, চিল্লানো। তার এক্সপ্রেশন বলতে ওই চিল্লানো ছাড়া কিছু থাকে না। সুখ দুঃখ আলাদা এক্সপ্রেস করার ক্ষমতা তার নাই। কাজেই সে ট্যা ট্যা করে উঠলেই মনে করার কোনো কারণ নাই তার সর্বাঙ্গে ব্যাথা অথবা সে ক্ষুধায় কাতর। তারে কোলে উঠায়ে ও ও ও…করে ঝাঁকাঝাঁকি করার ও কোনো মানে নাই । অকারনে ঝাঁকাঝাঁকিতে বাচ্চা শুধু বিরক্তই হয় না, তার ক্ষতিও হতে পারে। কারণ ওদের ব্রেন খুব নরম থাকে এবং এই ঝাঁকি ব্রেনে হিট করে।

নতুন পরিস্থিতি, আলো, বাতাসের সাথে খাপ খাওয়াতে বাচ্চার সময় লাগে। এছাড়া বাচ্চার ডাইজেস্টিভ সিস্টেম অপরিপক্ক থাকে বলে ওদের হিকাপ, গ্যাস ইত্যাদি বেশি হয় । ধীরে ধীরে ওদের বড় হবার সাথে সাথে অর্গ্যানগুলোর ফাংশন স্ট্রং হয়।

এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে বাচ্চা বমি করে, কাঁদে, অস্বস্তিতে ভোগে । আদতে খুব বেশি কিছু করার নাই কারণ এই প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে জগতের সব মানুষই গেছে। একটু আধটু টামি টাইম দেয়া, খাওয়ার পরে বার্প তোলা ছাড়া তেমন কোনো বিজ্ঞান সম্মত সমাধান নাই এর । তাছাড়া নিউবর্ণ বাচ্চার হাগুর সংখ্যা ২৪ ঘন্টায় শূন্য(০) থেকে (১২) পর্যন্ত যে কোনো নম্বর ই হতে পারে ।

বরং ডাক্তারের কাছ থেকে জেনে নেয়া দরকার পানিশূন্যতার সিমটম কি, কারণ এইটা একটা ভয়ংকর জিনিস।

হরমোন রাশ বা বাংলায় মাসিপিসি:

হরমোন রাশ বা বাংলায় মাসিপিসি একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে মাতৃগর্ভ থেকে নিয়ে আসা অতিরিক্ত হরমোন বাচ্চা বের করে দেয়। এটাও সময়ের সাথে চলে যায় ।

হরমোন রাশ বা বাংলায় মাসিপিসি হলে কি করণীয়:

শিশুশাস্ত্র মতে, এই সময় তেল জাতীয় কিছু চামড়ায় দেয়া মানা কারণ তেল চামড়ার লোম কূপ বন্ধ করে দেয় এবং বিষয়টা আরো খারাপ হয় । এই সময় বাচ্চাকে পরিচ্ছন্ন রাখা, আরামের কাপড় পরানো, শরীর স্পঞ্জ করে দেয়া আর পারতপক্ষে কোনো লোশন পাউডার না দেয়াই ভালো । খুব প্রয়োজন পড়লে ওয়াটার বেইজ ময়েশ্চারাইজার দেয়া যায় সামান্য, তবে নন ফ্র্যগ্রান্ট হলে ভালো ।

উপরের একটা ব্যাপারের সাথেও মায়ের খাবার দাবারের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই । আমি সিনিয়র পিডিট্রিশিয়নের কাছ থেকে এবং একাধিক সিনিয়র ল্যাকটেশন কনসাল্টেন্ট এর ক্লাসে তাদেরকে প্রশ্ন করেছিলাম এই ব্যাপারে । উত্তরে তারা বলেছিলেন – নেচার ইস ভেরি ফরগিভিং মাই ডিয়ার। ফ্রম দি রিচেস্ট ওম্যান ইন দি প্যালেস আপটু দি পুওরেস্ট ওম্যান বিসাইড দি স্ট্রিট উইল প্রডিউস মিল্ক অফ সিমিলার নিউট্রিশন! ইউর ডায়েট হ্যাস অলমোস্ট নো কন্ট্রিবিউশন টু ইওর বেবি’স ডিস্কমফোর্ট !

তাহলে ব্যাপারগুলি কি শুধুই মিথ ? না, ব্যাপারগুলি অন্যভাবে কিছুটা সত্য । বলি কিভাবে । বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানো মায়ের প্রচুর পানি খাওয়া দরকার । ওই যে লাউ এর ঝোল, বা অন্য ঝোল ওয়ালা তরকারী খাওয়ার ব্যাপারটা ওখান থেকেই আসা । আর আফটার বার্থ কনস্টিপেশন থেকে মুক্তি পেতে ফাইবার সম্বৃদ্ধ খাবার খুব জরুরি । শুধু মাংশ খেয়ে বসে থাকলে সেই অর্থে বিপদ আছে।

কাজেই মা অবশ্যই বুঝে খাবেন, কিন্তু সেটা নিজের রিকভারির জন্য । বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছেন বলে বাড়তি পানি খাওয়া ছাড়া খুব কিছু করার নেই!

আর নতুন বাবা-রা, দয়া করে সব কিছুতে মাকে দোষ দেয়া বন্ধ করুন । যে কোনো বিষয় অথেন্টিক সোর্স থেকে জেনে নিন, পরিবার যখন অকারণে দোষ দিচ্ছে মা কে, আপনিই তখন এগিয়ে এসে তার হাত ধরে দাঁড়িয়ে যান । মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে বলে ফেলুন – হুদাই মন খারাপ করো না তো ! বাবু তো দিব্যি ভালো আছে । এখন বলো কি খাবা? চটপটি না ফুচকা? মরিচ কি বাড়ায়ে দিতে বলবো মামা রে?

সংযুক্তি: লেখাটির উদ্দেশ্য বাচ্চা পালনে ঠিক ভুলের সবক দেয়া না, বরং সাপোর্টিং পার্সন দের রোল কি হওয়া উচিত তা বোঝানো। আমি ডাক্তার নই। একা বাচ্চা বড় করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে আমি প্যারেন্টিং ক্লাস, আর্লি চাইল্ডহুড সেন্টার, ল্যাক্টেশন কনসালটেন্ট, পিডিয়েট্রিশিয়ানের কাছ থেকে এসব জেনেছি। আমার জানা বা বোঝায় ভুল থাকতেই পারে। যে কোনো সমস্যায় উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানুষের কাছ থেকে জেনে নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
‘হ্যাপি প্যারেন্ট হুড অল’!

Facebook Comments