জীবনের বেশিরভাগ সময় কৃষিকাজে কাটিয়েছেন বলজিৎ কৌর। ৫০ বছর বয়সী এ নারীর কাছে শস্য উৎপাদন আর জমির যত্নআত্তি যেন আশীর্বাদ। কৃষিকাজ শুধু পেশাই নয়, এটি তার রক্তে মিশে গেছে। আর দশটা সাধারণ দিনে হয়তো মাঠে কাজ করেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতেন বলজিৎ, কিন্তু আজ দিল্লির প্রবেশদ্বার তিকরি সীমান্তে ঘাঁটি গেঁড়ে বসেছেন তিনি। শত শত কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে হাজারও কৃষকের সঙ্গে নেমেছেন ‘কালো আইন’ বাতিলের আন্দোলনে।
বয়স্ক এ নারী আল জাজিরাকে বলেন, নরেন্দ্র মোদি যে কালো আইন করেছেন তার বিরুদ্ধে আমরা আমাদের জমির জন্য আন্দোলন করছি। বলজিতের ভয়, ভারতে পাস হওয়া নতুন কৃষি আইনে তাদের জমির মালিকানা ঝুঁকিতে পড়বে। কিন্তু দেহে প্রাণ থাকতে এটি তিনি কিছুতেই হতে দিতে পারেন না।
ভারতীয় কৃষকদের মতে, দেশটিতে পাস হওয়া নতুন আইনগুলোতে শস্যের সর্বনিম্ন মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া নেই। তাদের শঙ্কা, এর কারণে কৃষকদের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অধীনে চুক্তিভিত্তিক কাজ করতে বাধ্য করা হতে পারে, প্রতিষ্ঠানগুলোর কথামতোই তাদের শস্য উৎপাদন করতে হতে পারে। নতুন আইনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কৃষিজমি কেনা ও পণ্য মজুতের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞাও তুলে নেওয়া হয়েছে।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এসব আইনকে কৃষিখাত আধুনিকায়নের জন্য বলে দাবি করেছেন। তবে কৃষকদের বিশ্বাস, এর মাধ্যমে সংকটাপন্ন খাতটিতে চুক্তিভিত্তিক কাজের বিস্তার এবং ব্যাপক বেসরকারিকরণের দুয়ার খুলে দেওয়া হয়েছে।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ভারতে চলছে কৃষকদের এই আন্দোলন। দেশটির তিন কৃষিপ্রধান রাজ্য পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তর প্রদেশ থেকে লাখ লাখ কৃষক এসে জড়ো হয়েছেন ভারতীয় রাজধানীর প্রধান প্রবেশপথ সিংহু ও কিতরি সীমান্তে। সরকারপক্ষ আন্দোলন থামানোর চেষ্টা করলেও কৃষকদের এক কথা, এক দাবি, ‘ক্ষতিকর আইন বাতিল চাই’।
‘পুরুষের চেয়ে নারীর কাজ বেশি’
সারা ভারতেই পুরুষরা কৃষিকাজের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠলেও এক্ষেত্রে নারীদের অবদানও কম নয়। বরং, কাজের ক্ষেত্রে তো বটেই, নতুন আইনে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ারও শঙ্কা রয়েছে নারীদের। ভারতীয় সংগঠন মহিলা কিষাণ অধিকার মঞ্চের (মাকাম) হিসাবে, দেশটির ৭৫ শতাংশ কৃষিকাজ নারীরা করলেও ভূমির মালিকানায় তাদের অংশ মাত্র ১২ শতাংশ।
পাঞ্জাবের জালান্দর থেকে প্রায় ৬৪৫ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে তিকরি সীমান্তে এসেছেন কুলবিন্দর কৌর ও পরমিন্দর কৌর। আরও কয়েকজন নারীর সঙ্গে রাত কাটাচ্ছেন একটি ট্রাকের ওপর। সেখনেই তাদের সঙ্গে কথা হয় মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার।
সরকারের নতুন কৃষি আইনের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে কুলবিন্দর বলেন, যদি নির্ধারিত মূল্য বা বাজার না থাকে, আমরা সন্তানদের রুটি খাওয়াব কী করে? শস্য বিক্রি করব বা কী করে?
পরমিন্দর বলেন, কোনও কাজই সহজ নয়। খাবার জোগাতে আপনাকে কাজ করতে হবে। কিন্তু কাজ করার পরেও যদি আমরা খাবার না পাই, সেটাই হবে সমস্যা।
৬০ বছরের জীবনে প্রায় ৩০ বছরই কৃষিকাজে কাটিয়েছেন মুলকিৎ কৌর। তার দাবি, পাঞ্জাবে তার গ্রামে অনেক নারীই পুরুষের চেয়ে বেশি কাজ করেন। এমনকি এই আন্দোলনের মধ্যেও অনেক নারী কৃষককে পরিবারের দেখাশোনার জন্য বাড়িতে থেকে যেতে হয়েছে। তবে পুরোপুরি নিবৃত্ত হননি, সেখান থেকেই আন্দোলনে মূল্যবান সমর্থন দিচ্ছেন তারা।
আন্দোলনরত মুলকিৎ পরের দিন বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা থাকলেও এ বৃদ্ধা জানান, তিনি যাওয়ার পর পরিবারের কোনও সদস্য এসে তার জায়গা নেবেন। তিনি বলেন, আমরা এত দূর এসেছি। আশা করি, ঈশ্বর আমাদের ডাক শুনবেন।
‘শিশুরা কষ্ট পেলে বেঁচে থেকে লাভ কী?’
ভারতের অনেক বয়স্ক নারী কৃষকের কাছেই এই আন্দোলন শুধু জমির মালিকানা বা অর্থের ইস্যু নয়। তাদের কাছে কয়েক প্রজন্ম ধরে থাকা জমি পূর্বপুরুষদের চিহ্ন, তাদের সংস্কৃতির অংশ, সন্তানদের ভবিষ্যৎ।
বলজিৎ বলেন, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কী বলবে, আমরা আওয়াজ তুলিনি? এর জন্যই রাস্তায় বসে রয়েছি, আমাদের নাতি-নাতনিদের জমি রক্ষা করতে।
তিকরি সীমান্তে আরও দুই নারীর সঙ্গে মাটিতে বসে ছিলেন জসপাল কৌর। তার কথায়, নাতি-নাতনিদের সম্পদ চুরি ঠেকাতে এসেছেন তারা। ৫৮ বছর বয়সী এ নারী বলেন, আমাদের সন্তানরা যদি কষ্ট পায় তাহলে জীবনের আর কী দাম থাকল?
অবশ্য তার এই কথা শুধু মুখের বুলি নয়, এর গুরুত্ব অনেক। দরিদ্র্যতা আর ঋণে জর্জরিত হয়ে ২০১৯ সালে ভারতে ১০ হাজারের বেশি কৃষক আত্মহত্যা করেছেন।
জসপাল বলেন, আমরা পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যাব। তার কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছিল, এধরনের মানুষগুলো এত সহজে পিছপা হওয়ার পাত্র নয়।
যৌথ রান্নাঘর আর নিঃস্বার্থ সেবা
সরকারের নতুন আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনস্থলে একসঙ্গে নেচে, গেয়ে, অভিনয়ের মাধ্যমে চলছে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আন্দোলনকারীরা থাকছেন দলবেঁধে, রান্না-খাওয়া সবই করছেন একসঙ্গে।
স্বঘোষিত কৃষককন্যা জাসসি সাংহা বলেন, আন্দোলনের একাধিক স্থানে লঙ্গর (সাম্প্রদায়িক রান্নাঘর) খোলা হয়েছে। সেগুলো চলছে শিখদের স্বপ্রণোদিত সেবায়। বিক্ষোভকারীরা কয়েক সপ্তাহের খাবার নিয়ে এসেছেন। তারা এত খাবার এনেছেন যে স্থানীয়রাও তাদের সঙ্গে খাচ্ছেন।
পাঞ্জাবের অভিনেত্রী ও সমাজকর্মী সোনিয়া মানও যোগ দিয়েছেন কৃষকদের আন্দোলনে। তিনি বলেন, হরিয়ানা, রাজস্থানসহ অন্য রাজ্যের কৃষকরা এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। তারা সবাই একসঙ্গে এসেছেন এবং একসঙ্গে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। তারা সবাইকে সমম্মান করেন। হিন্দু, মুসলিম, শিখ- সবাই এখানে এসেছেন।
নিজে কৃষক আন্দোলনে যোগ দেয়ার কারণ প্রসঙ্গে সোনিয়া বলেন, আমি কৃষকের মেয়ে। আমার বাবা ছিলেন কৃষক ইউনিয়নের নেতা। তিনি কৃষকদের জন্য নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। এজন্য আমিও এখানে এসেছি।
টিয়ারগ্যাস ও জলকামান
ভারতে ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) আন্দোলনরত কৃষকদের ‘দেশবিরোধী’ বলে উল্লেখ করছে। এমনকি তাদের কিছু নেতা কৃষকদের ‘সন্ত্রাসী’ পর্যন্ত বলেছেন।
সোনিয়া বলেন, তারা (বিজেপি) আমাদের আন্দোলন নষ্ট করতে চায়। তার বিশ্বাস, সরকার ও গণমাধ্যম কৃষকদের আন্দোলনকে ধর্মীয় ও দেশবিরোধী প্রমাণের জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
এজন্য আন্দোলনরত কৃষকরা ক্ষুব্ধ ও রাগান্বিত হলেও একইসঙ্গে তারা যথেষ্ট ধৈর্য ও সতকর্তা অবলম্বন করছেন। কৃষকদের পক্ষে কে কী বলছেন, তা খুব সাবধানতার সঙ্গে খেয়াল রাখা হচ্ছে। আন্দোলনকারীদের কথায়, মাত্র একটিবার ‘খালিস্তান’ (শিখ বিদ্রোহীদের দাবি করা স্বাধীন রাষ্ট্র) শব্দের উচ্চারণ গণমাধ্যম ও সরকারের জন্য কৃষক আন্দোলন ধ্বংসের অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে।
আন্দোলনস্থলে দায়িত্বরত সাংবাদিক নিকিতা জেইন বলেন, মতামত থাকা মানেই সে দেশবিরোধী নয়। যে কৃষকরা সবচেয়ে বড় দেশপ্রেমিক, তাদেরই কীভাবে আপনারা দেশবিরোধী বলতে পারেন?
শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর টিয়ারগ্যাস ও জলকামান ব্যবহারের প্রতিবাদ জানিয়ে জাসসি বলেন, বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত ভারত। কিন্তু সেখানে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে যা হয়েছে, তা স্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন।
‘সরকারের ঘাড়ে পা আমাদের’
ভারতীয় পুলিশের তথ্যমতে, দেশটিতে কৃষক আন্দোলনে এপর্যন্ত অন্তত ২৫ জন মারা গেছেন। তাদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়া, হাইপোথারমিয়া ও সড়ক দুর্ঘটনার কথা বলা হয়েছে।
আন্দোলনকারী কৃষকদের অনেকেই রাতে তীব্র শীতের মধ্যে মাটিতে ঘুমাচ্ছেন, কেউ ঘুমাচ্ছেন ট্রাকের ওপর। টয়লেট ব্যবহার করছেন স্থানীয়দের সাহায্যের ওপর নির্ভর করে। এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও সনোবল হারাননি নারী কৃষকরা।
গত সপ্তাহে কৃষক ইউনিয়নের নেতা এবং সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে ষষ্ঠ আলোচনা বাতিল করা হয়েছে। দুই পক্ষই নিজ নিজ দাবিতে অনড়। কিন্তু কৃষকদের ইচ্ছাশক্তি প্রবল এবং তাদের পক্ষে ক্রমাগত জনসমর্থন বাড়ছে।
পরবিমন্দর ও কুলবিন্দর বলেন, আমরা যেখানে শুরু করেছিলাম, সেখানেই রয়েছি। আমরা এখানেই থাকব। কোনও সমস্যা নেই, আমাদের বাড়ির কথা মনে হচ্ছে না।
পরিবারের সদস্যরাও আন্দোলন চালিয়ে যেতে উৎসাহ দিচ্ছেন জানিয়ে কুলবিন্দর বলেন, তারা আমাদের ফোন করে বলছে, শক্ত থাকো, হাল ছেড়ো না।
আন্দোলনে সফল হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু জানতে চাইলে পরমিন্দর ও কুলমিন্দর দু’জনই জোর গলায় বলেন, আমরা যখন তাদের ঘাড়ে পা দিয়ে রেখেছি, তারা এটা (নতুন আইন) ফেরাবে না কেন?
জাসসির কথায়, জমি মায়ের মতো। আর ভারতের মা, মেয়ে, কন্যারাই এই আন্দোলনের মেরুদণ্ড।
দৃঢ়কণ্ঠে বলজিৎ বলেন, আমরা আওয়াজ তুলেছি। আমরা আমাদের অধিকার নেবোই।