স্বপ্ন দেখি সুন্দর পৃথিবীর…২
আফরোজা হাসান
মামণি বড় ফ্লাক্সে করে চা/কফি দুটাই দিয়ে দিয়েছিলেন। নিজে চা নেবার সময় এক কাপ আরভের সামনেও রাখলো। ওমা সাথে সাথে হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ উঠিয়ে নিলো আরভ। একেই মনেহয় বলে জাতে মাতাল তালে ঠিক। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে মোবাইল নিয়ে ম্যাসেজ করলো স্বাতি। “হ্যাপিনেস ব্যান্ডের চশমা দিলাম তোমায় উপহার। নাকের ডগায় বসিয়ে দেখো ছড়ানো আনন্দের বাহার। আনন্দকে খুঁজে পেতে যদিও দরকার হয় না দৃষ্টি। আনন্দ তো মনের ঘরে ঝুমঝুমান্তি রহমতের বৃষ্টি। আনন্দের সবচেয়ে বড় ম্যাজিকটা কি জানো? খুঁজে না পেলেও আনন্দকে মনেতে যায় জন্মানো।”
ম্যাসেজ দেখে সময় আরভের চেহারাতে চাপা হাসি ঝলকে উঠতে দেখলো স্বাতি। কিছুটা সাহস পেলো মনে। আবারো লিখলো, আচ্ছা আমরা কি অপরিচিতদের মত কথা বলতে পারি? সাথে সাথেই জবাব এলো, হুম! আনন্দে হুরররে… বলে চিৎকার দিতে ইচ্ছে করলেও চিৎকারটা গরম চায়ের সাথে গিলে ফেললো স্বাতি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, আচ্ছা তো আপনি লেখক?
চোখ তুলে তাকালো আরভ। মুখে হাসি টেনে বলল, শখের লেখক বলতে পারেন। জীবনে ঘটমান হৃদয়াস্পর্শিত কথাগুলোকে মনের সাথে সাথে ডায়েরীর পাতাতেও টুকে রাখার চেষ্টা করি।
এর সার্থকতা কি?
সার্থকতা কি সেটা তো ভেবে দেখনি। তবে কখনো যদি মন ভুলে যায় কোন সুন্দর মুহুর্ত। ডায়েরীর পাতার ভাঁজ থেকে সেটিকে সযতনে তুলে নেয়া যাবে।
এটাই তাহলে আপনার লেখক হবার পেছনের কারণ?
ইন্টারভিউ নিচ্ছেন নাকি?
নাহয় হলোই ইন্টারভিউ!
আমার আসলে লাভ স্টোরি পড়ার হবি আছে।
তো? এরসাথে লেখার কি সম্পর্ক?
আমি প্রথম লাভ স্টোরি পড়েছিলাম যখন আমার বয়স সাড়ে সাত বছর।
স্বাতি চোখ বড় বড় করে বলল, সত্যি?
অবশ্যই সত্যি। বানান করে করে পুরো লাভ স্টোরি পড়ে ফেলেছিলাম। এরপর থেকে নিয়মিত পড়তাম।
আপনার বাবা-মা ধোলাই দেয়নি?
উনারা আসলে বুঝতেনই না যে আমি কঠিন সব বই পড়তে পারছি। তাই উনাদের চোখের সামনে বসেই জীবনের প্রথম আট দশটা লাভ স্টোরি পড়ে ফেলেছিলাম।
স্বাতি হাসতে হাসতে বলল, শুধুই কি পড়েছিলেন নাকি কিছু মিছু বুঝেও ছিলেন?
আরভ ঠোঁট টিপে হাসি চেপে বলল, সিরিয়াসলি লাভ স্টোরি পড়া শুরু করেছিলাম হাই স্কুলে উঠার পর। তখন কিছু মিছু না বেশ ভালোই বুঝতাম। কিন্তু বেশির ভাগ লাভ স্টোরিই আমার পছন্দ হতো না। কিছু অংশ খুবই বাজে লাগতো। একটা লাভ স্টোরি খুব পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু শেষে গিয়ে নায়িকা মারা যায়। আমি এটা কিছুতেই মানতে পারছিলাম না। খুব কান্না করেছিলাম। একটা সময় মনে হলো যে, আমি বোকার মতো কান্না করছি কেন? তারচেয়ে গল্পের এন্ডিংটা বদলে দেই। সেদিন থেকে শুরু আমার গল্পের অপছন্দনীয় অংশগুলোকে নিজের মনের পছন্দ মত লেখার। এরপর থেকে যদি একটা লাইনও আমার অপছন্দ হতো কোন বইয়ের আমি সেটা কেটে দিয়ে নিজের পছন্দের লাইন বসিয়ে দিতাম নীচে।
স্বাতি হেসে বলল, শুনতেই অদ্ভুত রকম ভালো লাগছে। আমারো অবশ্য লেখার অভ্যাস আছে। আমার বয়স যখন সাত বছর তখন জীবনের প্রথম ডায়েরীটি উপহার পেয়েছিলাম। নতুন গল্পের বই মনেকরে মহা আনন্দে প্যাকেট খুলে যখন অক্ষর বিহীন সাদা পৃষ্ঠাতে ভরা ডায়েরীটা দেখেছিলাম বিস্ময় ভরা চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম,এটাতে তো কিছুই লিখা নেই। কি পড়বো আমি? বাবা কাছে টেনে নিয়ে হেসে বলেছিলেন,এটাতে কিছু লেখা নেই কেন জানো মা? প্রশ্ন ভরা চোখে তাকালে বাবা বললেন, কারণ এটাতে তুমি লিখবে। অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলাম,আমি কি লিখবো এটাতে? বাবা জবাব দিয়েছিলেন,তোমার যা মন চাইবে তাই লিখবে মা। যেমন ধরো,আজ ঘুম থেকে উঠে তুমি সবার প্রথমে কি করলে, মামণির তোমাকে কতটা আদর করলো,বাবা অফিস থেকে ফেরার সময় তোমার জন্য কি নিয়ে এলো, ভাইয়াদের কাছে কি কি শিখলে,তোমার ভাইবোনদের সাথে কি কি দুষ্টুমি করলে, স্কুলে কি কি হয়েছে এইসব কিছু লিখবে। কিছুক্ষণ চিন্তা করে জানতে চাইলাম,বাবা আমি এসব কেন লিখবো? বাবা হেসে বলল,কারণ এটা হবে তোমার জীবন গ্রন্থ। এটাতে তাই তোমাকেই লিখতে হবে। যাতে বড় হয়ে তুমি জানতে পারো কেমন ছিল তোমার ছোটবেলা। কেমন ছিলে তুমি জীবনের প্রতিটি ধাপে।
আপনার বাবার কনসেপ্ট সত্যিই মুগ্ধকর। স্যালুট উনাকে।
স্বাতি হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। এরপর থেকে গত দশ বছরে আমার জীবনে ঘটে যাওয়া সব কথা লিপিবদ্ধ আছে আমার ডায়েরীতে। জীবনের সব খুঁটিনাটি লিখতে গিয়ে আমার বর্তমান ডায়েরীর সংখ্যা তেইশটা। জীবন যখন যে রূপে আমার সামনে এসেছে চেষ্টা করেছি ফুটিয়ে তুলতে সেই প্রতিচ্ছবি। যখন যে রঙে আমার ভুবন সেজেছে,সেই রঙের একটি করে আঁচড় আমার গ্রন্থেও পড়ছে। জীবন সেতো আনন্দ-বেদনার কাব্য। আমার গ্রন্থখানিতেও তাই খুঁজে পাই জীবনের নানান রূপ, নানান রঙ। কখনো মনকে বিষণ্ণ করে ঘন কুয়াশার রঙহীন কাব্য, কখনো বা আনন্দে রিমঝিম ধ্বনি তোলে ঠাস বুনোটের ছন্দ। জীবন গ্রন্থের কিছু পাতা আছে যা শোনায় কল্পনার রংয়ে ভালোবাসার তুলিতে বোনা তুলিতে বোনা স্বপ্নকথন,কিছু পাতা জুড়ে বিরাজমান ধূসর বিবর্ণ নিয়তির অমোঘ লিখন। আছে জীবনের প্রতি বাঁকে বাঁকে মোড়ে মোড়ে স্পর্শ রেখে যাওয়া বর্ণিল সব স্মৃতির সমাহার। দেখতে পাই ক্ষুদ্র এই জীবনে প্রাপ্তির বিশাল সম্ভার। নানা পরীক্ষায় যখনই টালমাটাল হয় মন,প্রবৃত্তি সুযোগে করে দেয় অসন্তোষের বীজ বপন। নজর পড়লে গ্রন্থে কৃতজ্ঞতার অশ্রু হয় বর্ষণ,তখন অনুভব করি নেয়ামতে ঘেরা আমার ভুবন।
আলহামদুলিল্লাহ এবার তো আপনি আমার মনকে মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ করে দিলেন। লাইক ফাদার লাইক ডটার। মাশাআল্লাহ।
চলবে