banner

বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 547 বার পঠিত

 

‘আমাদের অপরাধ, সন্তানদের পরিণতি’ -নাঈমা জান্নাত

মা শব্দটি সবার কাছেই অতি প্রিয়। সেই সাথে বাবাও। খুবই অল্প দৈর্ঘ্যের এই শব্দ দু’টির গভীরতা অনেক বেশি। আমাদের মনে ও জীবনে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে শৈশব থেকে কৈশোরে পা ফেলার সময় এমন কী ঘটে, যার খাতিরে আমরা নৈতিক বিষয়গুলো অনেক সময় ভুলতে শুরু করি। যৌবন প্রাপ্তির স্বল্প পথ চলাটুকুতে বাবা-মা বা পরিবারের কী এমন অসতর্কতা থাকে, যার কারণে ছেলেমেয়েরা মানবিকতার নিয়মকানুন ভুলে অপাত্রে পরিণত হয়?

এখন সবারই একটাই জানার আকুতি। সেটা হলো- কেন এই অত্যাচার শিশুদের ওপর, নারীদের ওপর? কখনও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী, কখনও তিন বছরের শিশু, কখনও গৃহকর্মী, কখনও বিবাহিতা স্ত্রী। শিশু থেকে বৃদ্ধ, রেহাই পাচ্ছে না কেউই। কোথা থেকে এলো এই বর্বরতা, কিভাবে জন্ম নিলো তা। তবে কি গোড়াতেই গলদ রয়েছে আমাদের? তবুও যদি আমরা কিছু বিষয়ে সচেতন হই, সমস্যা অনেকটা কমে আসতে পারে।

সবার আগে মায়ের সচেতনতা সবচেয়ে কাম্য। একজন মা-ই পারেন, সন্তানকে নতুন করে ভাবাতে, নতুন করে পথ চলা শেখাতে। কারণ আমাদের সমাজে মা-ই শিশুর সার্বিক যত্নের গুরুদায়িত্ব পালন করে থাকেন। সেক্ষেত্রে মায়ের দৃঢ় বিশ্বাস থাকা জরুরি যে, নারী বলেই সে দুর্বল নয় এবং তাকে দিয়েই সন্তানের সুন্দর ও নির্মল ভবিষ্যৎ তৈরি করা সম্ভব।

আমরা আমাদের সমস্যাগুলোকে যদি ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে দেখি, তাহলে আমাদের সামনে বেশ পরিষ্কার চিত্র ফুটে উঠবে।

১. বাবা-মা নিজের অজান্তেই ছেলে মেয়েকে মিথ্যা বলতে আয়ত্ব করাচ্ছি। ছোট বেলায় তাদের কল্পনার গল্পগুলোকে মিথ্যা বলে আখ্যা দিচ্ছি। আবার অনেক সময় তাদের সামনে স্বামী-স্ত্রী একজন আরেকজনের কাছে মিথ্যা বলছি। অথবা প্রতিবেশির কাছে বা মোবাইল ফোনে। ঘরে বসেই বলছি রাস্তায় আছি। বিশ্রামের সময় বলছি, ব্যস্ত আছি।

২. একদিকে ছেলেমেয়েকে বলছি, ঘুষ নেয়া বা দেয়া একটি সামাজিক ব্যাধি। অন্যদিকে ভালো চাকরির জন্য যত ধরনের তদবির লাগে, তা করছি। জেনে বুঝেই এই অপরাধ করছি।

৩. অপসংস্কৃতির বেড়াজাল থেকে সন্তানদের দূরে থাকার পরামর্শ দিচ্ছি। আবার বাবা-মা নিজেই হয়তো কর্মক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতনকে খুশি করার চেষ্টায় বা বন্ধু মহলে আনন্দ উদযাপনে অপসংস্কৃতিকে আগলে রাখছি।

৪. একদিকে শ্লোগান দিচ্ছি, যৌতুক একটি সামাজিক অপরাধ। অন্যদিকে উপহারের নামে নতুন বিবাহিত দম্পতিকে যৌতুকের জন্য প্রতিনিয়ত চাপ দিচ্ছি।

৫. একদিকে বলছি, পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করো না। অন্যদিকে সন্তানের পরীক্ষার আগের দিন প্রশ্নপত্র ফাঁসের আশায় রাত জেগে বসে আছি।

৬. ছেলেমেয়েকে শেখাচ্ছি, বাবা-মায়ের কাছে কিছুই গোপন করতে নেই। অন্যদিকে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের কাছে প্রতিনিয়ত নানা বিষয় লুকিয়ে রাখছি।

৭. একদিকে বলছি, বড়দের সম্মান করো, ছোটদের স্নেহ কর। অন্যদিকে বাসার গৃহকর্মীকে সন্তানের সামনেই নানাভাবে অত্যাচার অপমান করছি।

৮. সমস্যা মোকাবেলার ক্ষেত্রে ছেলে মেয়েদের  ধৈর্য্য ধারণ করার কথা বলছি। বাসাকে পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখার কথা বলছি। আবার সেই বাবা-মা-ই বাসের লাইন থেকে শুরু করে ব্যাংক পর্যন্ত যে কোন নিয়ম ভাঙার ক্ষেত্রে উৎসাহ যোগাচ্ছি।

৯. একদিকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কথা বললেও অন্যদিকে বাবা মায়েরা রাস্তায় ময়লা ফেলা থেকে শুরু করে কথাবার্তায় পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখছি না।

১০. ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাকে শেখাচ্ছি, না বলে কারো জিনিস নিও না। অন্যদিকে আমরাই অন্যের সম্পদ লুটপাটের মহোৎসবে ব্যস্ত আছি।

১১. বাসায় একটি শিশু প্রতিনিয়তই দেখছে, তার মাকে বাসায় বয়স্ক, নারী বা পুরুষ যে কেউ নানাভাবে অপদস্থ করছে। তবে আমরা কি আশা রাখতে পারি যে, পরবর্তীতে ঐ শিশুর আচরণে নারীর প্রতি সম্মান প্রতিফলিত হবে?

১২. একদিকে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন, আরেকদিকে সিগারেটের ধোঁয়ায় অসংখ্য জীবনের ক্ষতি করছি, যত্রতত্র দাঁড়িয়ে বা চলার পথে দেদারসে ধূমপান করছি। নিকোটিনের ধোঁয়া উড়িয়ে নিজেকে স্মার্ট সাজাচ্ছি। আসলে ধোঁয়ায় কি কোন আত্মবিশ্বাস আনে?

আমরা কি রুখতে পারি, আমাদের নিজেদের ছোট ছোট অস্বাভাবিকতাকে? ছোট ছোট অস্বাভাকিতা থেকেই বড় অপরাধের জন্ম। একজন মা যখন নিজেই দুর্বল, সে কি পারবে অপরাধ প্রবণতা রুখতে? এতকিছুর পরও সমাজে অনেক উল্টো চিত্রও আছে। আমাদের বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা করলেই আমরা বুঝতে পারি, সে সংখ্যা কত হতে পারে। একজন মাকে গড়ে উঠতে হবে আত্মবিশ্বাস নিয়ে। সব ধরনের অপরাধ, কুরুচিকে না বলার ক্ষমতা নিয়ে। যে কোন অশোভনীয় আচরণকে একজন মা যখন দৃঢ় কণ্ঠে না বলতে পারবেন, তখনই কেবল শিশুরা অগ্রগামী সৈনিকের মতো একদিন সব অস্বাভাবিকতা নির্মূল করতে পারবে। নেপোলিয়ন ঠিকই বুঝেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত ও সভ্য জাতি দেব’।

তারপরও অনেক শঙ্কা, উৎকণ্ঠা, অনেক প্রশ্ন মনে নাড়া দিয়ে যায়। এ ধরনের সামাজিক অপরাধ ঠেকাতে কি আইনের যথাযথ প্রয়োগ নাকি আচরণের পরিমিতি আর চিন্তার পরিচ্ছন্নতা একান্ত কাম্য?

লেখক :  ফ্রিল্যান্স সাইকোলজিস্ট ও এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সুত্র:জাগোনিউজ২৪

Facebook Comments