banner

শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 935 বার পঠিত

 

নিজেদের বাচ্চাদের ফার্মের মুরগী বানাবেন না -ডা. ফাতেমা তুজ জোহরা

ফাইয়াজ হবার পর প্রথম প্রথম আমার সবকিছুতে খুব বেশি চিন্তা হত। ঠিক মত ফাইয়াজের কাথা পরিষ্কার হল কিনা,বার বার নিজের হাত সাবান দিয়ে ধুতাম যেন আমার থেকে ফাইয়াজের ইনফেকশান না হয়। এমনকি বাইরে থেকে কেউ আসলেও তাদের সহজে ফাইয়াজকে কোলে নিতে দিতাম না। তাদের হেক্সিসল দিয়ে হাত এন্টিসেপটিক করে নিয়ে ফাইয়াজ কে আদর করতে দিতাম।
প্রথম মা বলে সবকিছুতে অতিরিক্ত চিন্তা। এমনকি ফাইয়াজের স্বাভাবিক সর্দি,কাশিতেও আমার চিন্তায় ঘুম আসতনা। সাথে সাথে স্টেথো দিয়ে ওর ফুসফুস চেক করতাম, শ্বাস প্রশ্বাস এর গতি মাপতাম, হার্ট বিট দেখতাম। যখন দেখতাম সবকিছুই নরমাল রেইঞ্জের মধ্যে তখন একটু স্বস্তিতে থাকতাম।
দুইদিন পরপরই বেড শিট চেইঞ্জ করতাম, স্যাভলন দিয়ে সবকিছু ওয়াশ করতে দিতাম। আর কেউ যদি আমার সামনে ফাইয়াজ কে চট করে হাত না ধুয়ে আদর করত সাথে সাথে বিভিন্ন ছুতায় ফাইয়াজকে নিজের কাছে নিয়ে নিতাম।
একদিন দেখি ফাইয়াজের হাতে মশার কামড়ে জায়গাটা লাল হয়ে গেছে। সেটা দেখেই তো ভয় পেয়ে গেলাম। অজানা আশংকায় রোগ পূর্ববর্তি ইনকিউবেশান পিরিয়ড কাউন্ট করতে লাগলাম,যখন দেখলাম দশ-বার দিন পার হয়ে গেছে কিন্তু ফাইয়াজের কিছুই হয়নি তখন মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ বলতাম।
এরকম মোটামুটি দুই থেকে আড়াই মাস পর আমার অতিরিক্ত সচেতনতা কিছুটা কমল।
ছয় মাসের সময় থেকে যখন ওকে বাইরের খাবার দেয়া শুরু করলাম তখন ওর পেট খারাপ হল একবার, প্রচুর পাতলা পায়খানা।সাথে বমি। হাসপাতালে ডিউটি সত্বেও যেতাম না, ফোনে সি.এর কাছে ছুটি চেয়ে নিতাম।ভাবতাম ফাইয়াজের প্রতি কেউ খেয়াল করছেনা তাই নিজেই সারাদিন ফাইয়াজের টেইক কেয়ার করতাম।
ফাইয়াজের ফিডার দিনে চৌদ্দবার গরম পানিতে ফুটাতাম। আমার অবস্থা তখন এমন ছিল পারলে সব কিছু অটোক্লেভ করতাম।
এরপর যখন পেডিয়াট্রিকসে ডিউটি পড়ল তখন হাসপাতালে বাচ্চাদের অবস্থা দেখে রীতিমত শিউরে উঠতাম। সরকারি হাসপাতাল। খুব গরীব গরীব রোগীদের আবাস।
একটা ছয় মাসের বাচ্চার নিউমোনিয়া,সাথে মায়ের কোলে দেড় বছরের বাচ্চা। সেই মা একইসাথে দুইটারেই সামলাচ্ছে। রোগ জীবানুর মধ্যেই বাচ্চাগুলা থাকছে। ঠিকমত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা মেইনটেইন হচ্ছেনা। যে হাতে মা একজনের ভেজা কাথা ধরছে, আবার সেই একই হাত দিয়ে অন্যজনকে দুধ খাওয়াচ্ছে।
এরকম দৃশ্য দেখে সি.এ কে বলতাম, ভাইয়া এসবের মধ্যে বাচ্চারা কেমন করে চিকিৎসা পায়? ভাইয়া হেসে বলত, এসব বাচ্চাদেরই ইমিউনিটি বেশি। ওরা এখনের ধকল গুলা সামলালেই পরে একেবারে সুস্থ হয়ে বেড়ে উঠবে।
ততদিনে নিজের বাচ্চার প্রতি আমার আদিখ্যেতা কিছুটা হলেও কমেছে। আর এখন তো পুরাই ছেড়ে দিয়েছি।
আমার আম্মা সবসময় বলে যে বাচ্চাদের ছেড়ে দিলে ওদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি হয়। এখন বুঝি সেটার মর্ম।
যদিও আগেই জানতাম, কিন্তু ইদানিং ব্যাপারটা খুব লিটারেলি পালন করছি।
হাইজিন হাইপোথিসিস বলে, যেসব বাচ্চারা ছোটবেলা থেকে জীবানুর সাথে যুদ্ধ করে বড় হয় তাদের অটোইমিউন রোগ,ক্যান্সার এসব হবার সম্ভাবনা কমে যায়।
এখন আমাদের ইমিউন সিস্টেম,রোগ বালাই নিয়ে যত পড়াশুনা করি তত ব্যাপারটা ক্লিয়ার হয়।
আমাদের বাসায় ফাইয়াজের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হল ঘরের চিপা চাপা জায়গা গুলা। দরজার পিছনে, খাটের নিচে, টেবিলের তলে।সেদিন দেখলাম ওর পুরা জামা তে ধুলা বালি, ঝুল ময়লা লেগে আছে, আর সে সেগুলা চেটে চেটে খাচ্ছে। এমনকি জানালার গ্রিল ধরেও সে জিহবা দিয়ে চাটতে থাকে। এসব দেখে এখন আর ভয় পাইনা। খুব স্বাভাবিক ভাবে জামা কাপড় চেইঞ্জ করে, হাত পা সাবান দিয়ে ধুয়ে আবার খেলার জন্য ছেড়ে দেই। সে আবার পূর্ণ উদ্যমে ধুলা বালির সাথে খেলায় মেতে উঠে।
সাদিয়া আপুর ওয়ালে দেখলাম যায়নাব কে কাদার মধ্যে ছেড়ে দিয়েছে, আর সে ইচ্ছা মত কাদাতে লাফালাফি করছে। অস্ট্রেলিয়ার মত দেশে আপু যে তাকে এত ইউনিক ভাবে ইমিউন সিস্টেম ম্যাচিউর করতে পারছে এটা তো বিশাল ব্যাপার।
আমি নিজে দেখেছি স্পুন ফিডিং কিছু বাচ্চার মায়েরা আছে তারা তাদের বাচ্চাকে নিয়ে এতই চিন্তিত থাকে যে দেশের বাইরে থেকে বাংলাদেশে আসলে বিদেশ থেকেই বাচ্চার খাবার দাবার এমনকি পানি পর্যন্ত প্রিসার্ভ করে নিয়ে আসে। বাংলাদেশের খাবার,পানি খেলে নাকি তাদের বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে যাবে।
আমি দেশে ও দেশের বাইরে থাকা এসব মেন্টালিটির মাদের বলব, প্লিজ আপনারা বাচ্চার ভাল চিন্তা করতে গিয়ে ওদের লং টার্ম ক্ষতির মধ্যে ফেলবেন না। ফার্মের মুরগি কিন্তু অনেক যত্নে পালিত হয় কিন্তু তাদের আয়ু খুবই কম। নিজেদের বাচ্চাকে এরকম ফার্মের মুরগি বানাবেন না।
জীবন যুদ্ধে যাবার পূর্বে ওদের নিজের ইমিউন সিস্টেমের সাথে যুদ্ধ করে ম্যাচিউর হতে দিন, প্লিজ।

বি.দ্র. বাচ্চার প্রথম ছয়মাসে ওদের ইমিউন সিস্টেম খুব নাজুক থাকে। এসময় সচেতন থাকা আদিখ্যেতা না। সচেতন থাকাটা বরং জরুরি।

Facebook Comments