banner

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 309 বার পঠিত

 

প্রযুক্তির জালে বিপদের ফাঁদ

আমরা ঠিক যে সময়ে এসে মেয়েদের স্বনির্ভরতা, নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কিছুটা আশাবাদী হয়ে উঠেছি, ঠিক সেই সময়ে খবরের কাগজ ওলটালেই পড়তে হচ্ছে ধর্ষণের খবর। একটি-দুটি নয়, এ সংখ্যা যেন বেড়েই চলেছে। পড়াশোনা জানা-না জানা, ধনী-গরিব, শহর থেকে গ্রাম—যে কোনো পরিবারের সন্তানের ক্ষেত্রেই এ ঘটনা ঘটতে পারে। প্রশ্ন হলো, আমরা কি সামগ্রিকভাবে এগোচ্ছি, নাকি দিন দিন বর্বর যুগে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।

কেন এই পরিস্থিতি?

আমরা আমাদের সন্তানদের যথাযথ শিক্ষায় কি শিক্ষিত করতে পারছি না? এখানে আমি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চেয়েও পারিবারিক ও সামাজিক বিষয়গুলোর দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। সব ঘটনা যেন আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে, কিছু মিডিয়ায় খবর প্রকাশ আর আইনি তৎপরতার পর শুধু যে মেয়ের পরিবারে ঘটনাটি ঘটেছে, সেই পরিবার ছাড়া এটা নিয়ে কথা বলার বা সাহায্যের হাত বাড়ানোর জন্য কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায় না।

তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তার ছেলেমেয়ে উভয়ের জন্য অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে, এটা অনস্বীকার্য। সবকিছুরই ভালো ও মন্দ দুটি দিক থাকে। এটি তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রেও সত্যি। সামাজিক মূল্যবোধ আর পারিবারিক শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে কী করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ছেলেমেয়েরা যোগাযোগ করবে—সে জন্য প্রস্তুতি খুবই প্রয়োজন।

আমার মনে হয়, প্রথমে আমরা সচেতনতার অভাবের কথা বলে মেয়েদের তথ্যপ্রযুক্তি ও আধুনিক কর্মকাণ্ড এবং বিভিন্ন তথ্যপ্রাপ্তি—দুই জায়গা থেকেই দূরে রেখে এক অদ্ভুত পরিবেশে মানুষ করার চেষ্টা করি। এ জন্য একজন মেয়ে জীবনের শুরু থেকেই বেড়ে ওঠে খুব রক্ষণশীলভাবে। সে জানে এটা করা যাবে না, ওখানে একা যাওয়া যাবে না। কিন্তু কেন করা যাবে না, যদি করতে হয় কী ধরনের প্রস্তুতি প্রয়োজন অথবা যদি বিপদে পড়েই যায় কী করে নিজেকে রক্ষা করবে—পুরো বিষয় সম্পর্কে সে জানে না। আর কোনো দুর্ঘটনা যদি ঘটেই যায়, আইনি বিচার পেতে কী ধরনের প্রমাণ বা তথ্য উপস্থাপন করতে হবে—এসব নিয়ে যেন জানার কিছু নেই। এ বিষয়ে কখনো বাড়িতে কথা বলা, কারও কাছে জানতে চাওয়ার কালচার থেকে আমরা অনেক দূরে। ছেলেদের সঙ্গেও এই বিষয়গুলো নিয়ে পারিবারিক কোনো  আলোচনা হয় না।

আমার কাছে বিষয়টি এমন যে, আমরা জেনেশুনে চোখ বন্ধ করে রাখাটাকেই নিরাপদ মনে করছি। কিন্তু এই ইন্টারনেটের যুগে কাউকে এর বাইরে রাখার কোনো সুযোগ নেই। সঠিক জীবনদর্শন আর পথ নির্দেশনা এ জন্য খুবই প্রয়োজন। আমার সন্তানকে জানতে দিতেই হবে কোনটা ঠিক কোনটা ভুল। এর জন্য কথা বলতে হবে, আলোচনার পথ খোলা রাখতে হবে, যেন কিছু জানতে তার ভেতরে কোনো দ্বিধা কাজ না করে। সন্তানদের  জানতে দিন—এসবই জীবনেরই অংশ।  আমরা কতটুকু নেব? আমাদের প্রেক্ষাপট কোনটাকে ভালো বলে, কেন ভালো বলে আলোচনার মাধ্যমে সন্তানদের কাছে পৌঁছে দেওয়া পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং   সমাজের দায়িত্ব।

কোনো একটা জিনিস আমরা যদি অপছন্দ করি, তা কেন খারাপ, কেন আমরা চাই না অথবা কী করে এড়িয়ে চলা যায়—সব দিকের তথ্য জানানো প্রয়োজন। আজকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক মানুষের সঙ্গে সহজেই পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়েছে। এখন নিয়মিত কিংবা বলা যায় প্রতি মিনিটেই যোগাযোগ রাখা সম্ভব। নতুন বন্ধু বানানো তো এখন কোনো ব্যাপারই নয়। একটি ছেলে বা মেয়ের বাড়িতে না গিয়ে তার সামাজিক অবস্থান, রুচি, অর্থনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে ধারণা নেওয়া এখন দুই সেকেন্ডের বিষয়। কিন্তু এভাবে ফেসবুক প্রোফাইল ঘেঁটে তথ্য জানলেই কি একজন মানুষকে চেনা যায়?  সেই তথ্যকে বিশ্লেষণ করে যথাযথ ধারণা বের করার ক্ষমতা তৈরি করাও কিন্তু স্মার্টনেসের  অংশ।

এই ধারণাটা মেয়েদের পরিবার থেকেই দিতে হবে। মেয়েদের অনেক তথ্য জানাতে হবে, জানতে দিতে হবে। আর তাদের সচেতন করে গড়ে তুলতে হবে। এতে করে যেসব বিপদ পায়ে পায়ে রয়েছে, সেসব কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচিত একজনের সঙ্গে কতটুকু তথ্য আদান-প্রদান করা ঠিক কিংবা তার সঙ্গে যোগাযোগ কোন পর্যায় পর্যন্ত যেতে পারে, একটি অল্প পরিচিত ছেলের সঙ্গে দেখা করার প্রয়োজন হলে কোন ধরনের বিষয়গুলো মাথায় রাখা দরকার, তা জানা ও আলোচনার দাবিদার। বিশেষ করে, দেখা করার স্থান নির্বাচনের বিষয়ে অবশ্যই জানতে হবে, কথা বলতে হবে। যদিও অপরাধকে অন্য কোনো ব্যাখ্যা দিয়ে চাপা দেওয়ার সুযোগ নেই। তবুও নিজের িনরাপত্তার বিষয়ে মেয়েদেরকে সচেতনভাবে গড়ে তোলাও প্রয়োজন। তাহলে প্রতারণা এবং নানা বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে নিজেদের।

ইন্টারনেটে অনেক তথ্য থাকে—কোনটা সঠিক, কী করে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় বা কোন বিষয়টি নিশ্চিত করবে তথ্যের সত্যতা, তা বোঝা ও বের করতে পারতে হবে। অন্যদিকে ছেলেদের ব্যাপারেও পরিবারের ভূমিকা অনেক। মূল্যবোধ ও সামাজিক রীতিনীতি, নৈতিকতা ও তার ব্যবহার কী হবে, তার ধারণা ছেলেকে দিতে হবে।

সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার একটা প্রবণতা রয়েছে। মিথ্যা তথ্য প্রদান যে বাংলাদেশের আইনে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ, সেটা কি সবাই জানে? ইন্টারনেটের মাধ্যমে এমন করলে তা সাইবার আইনেও অপরাধ। এই আইনগুলো সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো, সঠিক প্রয়োগ—এমন অপরাধপ্রবণতা কমতে সহায়ক বলে আমি মনে করি। আইনের প্রচার আর খোলামেলা আলোচনার সুযোগই পারবে অনেককে ধর্ষণের মতো অপরাধ থেকে বিরত রাখতে।

প্রযুক্তির অপব্যবহার কমানোর জন্য সচেতনতার বিকল্প কিছু নেই। নয়তো প্রযুক্তির জালে আটকে পড়েই আসবে বিপদ।

Facebook Comments