banner

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 302 বার পঠিত

 

মুনমুনের বাস্তবতা, মুনমুনের স্বপ্ন

‘আমাগো মতো গরিবের স্বপ্ন দেখতে নাই। যে স্বপ্ন পূরণ হইব না, সেই স্বপ্ন না দেখনই ভালো। শুধু কষ্টই বাড়ে।’ সিনেমার সংলাপের মতো কথাগুলো ১৩ বছরের মুনমুন আক্তারের। বেদে সম্প্রদায়ের মেয়েটি হাত-মুখ নেড়ে নেড়ে কথা বলে। কথা বলার ঢঙে বাংলা সিনেমার প্রভাব স্পষ্ট।

গত ২৮ জুন শেষ বিকেলে মুনমুনের সঙ্গে কথা হয় বরিশালের গৌরনদী উপজেলার হেলিপ্যাডে বসে। মাস তিনেকের জন্য এখানে বসত গেড়েছে মুনমুনের পরিবার। বাড়ি ঢাকার বিক্রমপুরে। বছরের ছয় মাস বাড়িতে থাকে, বাকি ছয় মাস দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিজ সম্প্রদায়ের বহরের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। এই আয়েই মূলত তাদের সংসার চলে।

কিশোরী মুনমুনের কথায় বালখিল্যতা নেই, আছে বিচিত্র অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ পরিণত মানুষের সুর। ১০ বছর বয়স থেকে সে উপার্জন শুরু করেছে। শৈশবকালীন খেলাধুলার সুযোগ মেলেনি। চার ভাই আর বাবার সংসারে উপার্জনকারী সে আর মা।

প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষাই নেই মুনমুনের। এর পেছনের কারণ জিজ্ঞেস করার আগেই ঘাস ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলতে থাকে, ‘বছরের ছয় মাস বাড়ির বাইরে থাহি। আর পইড়্যাও কী হইতো। এই বাইদ্যার কামই করতে হইতো।’

গ্রামে ঘুরে ঘুরে শিঙা লাগিয়ে মানুষের ‘ব্যথা সারানো’, ‘দাঁতের পোকা’ ফেলা, ‘বাতের তেল’ বিক্রি করে উপার্জন করে মেয়েটি। তার রোগী মূলত গ্রামের বয়স্ক নারী-পুরুষ। মুনমুনের ভাষায়, ‘বাতের ব্যথা, চাবানি-কামড়ানি হলে শিঙা লাগাই। ঘা হলে পোকা বাইর করি।’ তবে শিশুদের ‘দাঁতের পোকা’ ফেলা আয়ের অন্যতম উৎস।

নিজেকে ‘চিকিৎসক’ হিসেবেই দাবি মুনমুনের। চিকিৎসার ক্ষেত্রে মন্ত্রই তার প্রধান হাতিয়ার; যদিও আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র তাদের এই চিকিৎসা পদ্ধতি সমর্থন করে না। মন্ত্রগুলো মুনমুন মা আলোমতি বেগমের কাছ থেকে শিখেছে। তার ওই চিকিৎসার কাজে গাছের শিকড়বাকড়, বিভিন্ন পশুপাখির তেল, গরু-মহিষের শিং, নানা জীবের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবহার করে। আর কাটা-ছেঁড়ার কাজ সারে ব্লেড ও কাকিলা মাছের দাঁত দিয়ে।

মুনমুন সকালে ঝুলি নিয়ে বের হয়, ফেরে পড়ন্ত বিকেলে। দুপুরের খাবারটা রুটি-কলা দিয়েই সেরে নেয়। শরীর খারাপ হলেও বিশ্রাম মেলে না। কারণ, পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস ১৩ বছরের এই মেয়ে। তবে দিনভর পরিশ্রম শেষে আয় মন্দ নয়। দিন শেষে ৫০০ থেকে ১২০০ টাকা কোঁচরে গুঁজে ঘরে ফেরে।

কাজ করতে গিয়ে কোনো সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় কি না জানতে চাইলে উত্তরে বলে, ‘এত বড় কইলজা কার, আমাগো কিছু কইবে? বিক্রমপুরের নাম শুনলেই ভয় পায়।’

কিছুক্ষণ গল্প করার পর ক্ষীণ স্বরে মেয়েটি জানায়, রাস্তাঘাটে প্রায়শই বাজে মন্তব্য শুনতে হয়। অনেকে বাজে ইঙ্গিতও করে। খারাপ লাগলে চুপ করে শোনে না, প্রতিবাদও করে। মুনমুনের কথা, ‘কাজ করালে করাবে, না করালে না। খারাপ কতা কইবে ক্যান?’

মাঠের মধ্যে বাঁশের চাটাইয়ে পলিথিন মুড়িয়ে তাদের অস্থায়ী ঘর। সেখানেই কয়েকটি থালাবাসন, কাপড়চোপড় রাখা। সেগুলো গোছগাছ করতে করতেই বলে, ‘এবার ঈদে ৫০০ টাকা দিয়া একটা শাড়ি লইছি। ছায়া-ব্লাউজও লইছি।’

মুনমুনের বিয়ে হয়েছে আট মাস। তবে এখনো বাবার পরিবারের সঙ্গেই থাকছে। দু-দিন ধরে মোবাইল নষ্ট। স্বামী রাহুল সরদারের সঙ্গে কথা বলতে না পারায় মনটা একটু ভার। ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ভাবি, একদিকে বাল্যবিবাহ ঠেকানোর সাহসী কাহিনি ছাপা হয় সংবাদপত্রের পাতায়, অন্যদিকের বাস্তবতা এই মুনমুনদের জীবন।

আলাপ শেষে মাটির দিকে তাকিয়ে চোখ দুটি নাচিয়ে মেয়েটি বলে, ‘জানেন আফা, আমার না একটা স্বপ্ন আছে। গোপন স্বপ্ন।’ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই লজ্জা মেশানো কণ্ঠে বলে, ‘খুইব মডেল হইতে মন চায়। টিভিতে দেইখ্যা নিজে নিজে মডেলিং শিখছিও।’

কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলে, ‘আমরা গরিব, শিক্ষা নাই। যে স্বপ্ন পূরণ হইবে না, সে স্বপ্ন না দেখাই ভালো। তাই না, আফা?’ এ কথা শেষ হতেই মুনমুনের চোখের দিকে তাকাই। দেখি সেখানে চিকচিক করছে মুনমুনের স্বপ্ন হারানোর কষ্ট।

Facebook Comments