banner

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 810 বার পঠিত

 

একা একা ঘুরি

কৈশোরে তিন গোয়েন্দা পড়ার সময় হয়তো মন ছুটে গিয়েছিল পাহাড়ে, সাগরের নীলে আর বনে। বাস্তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বনভোজনে যাওয়ার অনুমতিও মেলে না অনেক মেয়ের। একই পরিবারের ছেলেটি যে রাতে মাঝনদীতে নৌকায় বসে জ্যোৎস্না দেখে মুগ্ধ হয়—মেয়েটি হয়তো সেই সময় ঘরের জানালা দিয়ে ইট-সিমেন্টের জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে জ্যোৎস্না দেখার চেষ্টা করছে।
আজকাল অনেক নারী পরিবর্তন আনছেন। নিয়ম ভাঙার চেষ্টা করছেন। তাঁরা ব্যাকপ্যাক নিয়ে একাই বেরিয়ে পড়ছেন ভ্রমণে।
নাজিয়া সরণি পেশায় প্রকৌশলী। শুরুটা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষ থেকে। এরপরে ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশ-বিদেশের অনেক স্থানে। ছোটবেলায় মানচিত্রে খুঁজে বেড়াতেন নতুন নতুন জায়গার নাম। তবে তাঁর ভ্রমণের নেশা কাগজের মানচিত্রে সীমাবদ্ধ থাকেনি। নাজিয়া পেরেছেন। তবে এখনো আর্থিক সংগতি এবং ভ্রমণের প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেক নারী পারছেন না। কেন?
নাজিয়ার মতে, এ দেশে বেশির ভাগ বাবা-মা বন্ধুদের সঙ্গেই ঘুরতে যেতে অনুমতি দেন না, সেখানে একলা বেড়ানো তো দূরের কথা। আবার অনেক সময়ই অভিভাবকদের বলতে শোনা যায়, ‘বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে ঘুরতে যেও, তার আগে না।’ এমন প্রতিকূল পরিবেশে নারীরাও আত্মবিশ্বাস নিয়ে কোথাও বেরিয়ে পড়তে পারেন না।

‘শুরু করাটাই জরুরি। এখন সময় এসেছে অভিভাবকদের বুঝতে হবে তাঁরা মেয়ের নিরাপত্তার খাতিরে যেন তার সহজাত আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়ে এমন কিছু না করেন। আবার মেয়েদেরও নিজেকে রক্ষা করার কৌশল জানতে হবে।’
নারীদের নিরাপত্তা নেই কোথাও—এই নিরাপত্তার অজুহাত নারীদের একলা ভ্রমণের ইচ্ছায় বাদ সাধে। আসলেই কি নিরাপত্তা প্রধান সমস্যা, নাকি আজ অবধি সমাজে নারীদের নিজেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে মেনে নেওয়া হয় না?
একটি টেলিভিশন চ্যানেলে কর্মরত সাংবাদিক কাজী শাহরীন হক। সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন দেশ-বিদেশ ভ্রমণে। কখনো বন্ধুদের সঙ্গে, কখনো একাই। ‘যাত্রা শুরুর পথটা এতটা মসৃণ ছিল না। নারীদের কোনো কিছু আসলে হাতে তুলে দেওয়া হয়নি; বরং অর্জন করে নিতে হয়েছে। আমার এই হুট করে ঘুরতে চলে যাওয়া নিয়ে অনেকেই নেতিবাচক কথা বলেছে। নারীদের স্বাধীন চলাফেরায় বাধা আসবেই। সে বাধার সঙ্গে লড়াই করে জয়ী হওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে।’ ভ্রমণের সময় নিরাপত্তার ব্যাপারটি ছেলে বা মেয়ে উভয়ের জন্যই জরুরি। অথচ এই নিরাপত্তার বিষয়টি কেবল নারীদের বেলায় একটা প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দাঁড় করানো হয়। বাড়ির ছেলেটিকে তো নিরাপত্তার অজুহাত দিয়ে আটকে রাখা হচ্ছে না।
আসিতা সুলতানা চৌধুরী ঘুরেছেন ইতালি, সুইডেন, নেপাল, যুক্তরাজ্যসহ পৃথিবীর ১৩টি দেশে। প্যারাগ্লাইডিং, হাইকিং, ট্রেকিং—সব রোমাঞ্চের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কাছে যেকোনো ভ্রমণে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি।
হোটেল বুকিং দেওয়ার আগে শুধু ইন্টারনেটের ওপর ভরসা না করে ফোন করে যাচাই করা, পরিচিত কারও মাধ্যমে গাইড ঠিক করা, দেশে কাউকে সব তথ্য দিয়ে যাওয়া, ভ্রমণের সময় ব্যাগে অবশ্যই পরিচিত কারও নাম, ফোন নম্বর আর ঠিকানা রাখা, ঘুরতে যাওয়ার আগে সেই স্থান নিয়ে ইন্টারনেটে ভালোমতো পড়াশোনা করা—এ বিষয়গুলো ঠিকমতো খেয়াল রাখলে বিপত্তির আশঙ্কা অনেক কমে যায়। এমন পরামর্শ দেন আসিতা।
ভ্রমণ শুধু বিলাসিতা নয়। প্রকৃতিসঙ্গ একজন মানুষের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। নাজিয়া সরণির জীবনে যেমন হয়েছিল। তিন বছর আগে ভারতের গোয়াহাটি গিয়ে পরিচয় হয় একজন অস্ট্রিয়ার একলা মায়ের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে পাঁচ ঘণ্টা ট্রেকিং করে দেখতে গিয়েছিলেন পৃথিবীর একমাত্র ‘লিভিং রুট ব্রিজ’। তখন অনেক খারাপ সময় পার করেছিলেন জীবনে, হঠাৎই এভাবে নিজেকে আবার খুঁজে পান নাজিয়া।
ঘুরতে পছন্দ করেন ক্রীড়াবিদ জোবেরা রহমান লিনু। তাঁর মতে, একা একা ঘোরে এমন নারীর সংখ্যা কম। সামাজিক নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেক পরিবার থেকে অনুমতি মেলে না। কিন্তু সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে অনেক নারী যখন একা ঘুরতে যাবে, তখন নিশ্চয় নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও জোরদার হবে। কোন বয়সে মেয়েটি ঘুরতে যাচ্ছে সেটা একটা বিষয়। বয়ঃসন্ধিকালের কোনো সন্তানকে অনুমতি হয়তো দেবে না, কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েটি তো যেতে পারে। আরেকটি বিষয় হলো, মেয়েটির একা ঘোরার ও নিজের নিরাপত্তা বিষয়ে আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে। এমনকি পরিবারের আস্থাও থাকতে হবে তার ওপর।
অনেক নারী হয়তো নিয়ম ভাঙবেন। ভ্রমণ অনেক নারীর জীবনের বেঁচে থাকার রসদ জোগাতে পারে। ভ্রমণের নেশা কেবল বই, টেলিভিশন আর ইন্টারনেটে মেটাবেন না। বেরিয়ে পড়বেন ব্যাকপ্যাক নিয়ে বিশ্বভ্রমণের পথে।

Facebook Comments