banner

সোমবার, ২০ মে ২০২৪ ইং, ,

Monthly Archives: May 2024

নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা

 

আজকাল পত্র- পত্রিকা খুললেই চোখে পড়ে নারী নির্যাতনের চিত্র। ঘরে- বাইরে কোথাও নারী নিরাপদ নয়। সভ্য মানুষের মুখোশের আড়ালে পাশবিকতায় বেশি দৃশ্যমান। অহরহ ঘটে চলেছে যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ, গুম, খুন, হত্যার মতো বিভৎস ঘটনা। নারীর নিরাপত্তা যেন অকল্পনীয় কিছু! কিন্তু যেই নারীরা সমাজের স্তম্ভ, প্রকৃতির মতো লালন- পালন করার ক্ষমতা যাদের ওপর প্রদত্ত তারাই নির্যাতন – নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। নারীদের এই হীন দশা আধুনিক যুগে এসেও একই। বলা চলে বর্তমান সময়ে যুগের সঙ্গে নারী নির্যাতনের পথগুলো আরও সহজ হয়েছে পাশবিক মানুষদের কাছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে, ঘরে- বাইরে সর্বত্রই নারী এক গভীর সমুদ্রে তলিয়ে যাচ্ছে। তবে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা গেলে জাতি মুখ থুবড়ে পড়বে। নারী এবং পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি সুস্থ, সুন্দর সমাজ গড়ে ওঠে। তাই নারীর নিরাপত্তা এখন সময়ের দাবি।

হত্যা, ধর্ষণ, গুম, খুন, নির্যাতনের মতো সহিংস অপরাধের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভিকটিম পূর্ব পরিচিত বা এলাকার লোকজনের দ্বারা পাশবিকতার শিকার! কন্যা শিশু, তরুণী বা নারী যদি পূর্ব পরিচিতদের কাছেও নিরাপদ না হয় তাহলে নারীর নিরাপত্তা সত্যিই কোথায়? মানুষের নগ্নরূপ থেকে কিভাবে পরিত্রাণ মিলবে নারীদের?

সাম্প্রতিককালে নারী নিপীড়ন বহুগুণে বেড়েছে। যারা দৈনক পত্র – পত্রিকায় চোখ রাখেন তারা বাড়ির কন্যা সন্তান বা নারী সদস্যকে নিয়ে বলতে গেলে অনেকটাই ভীতির মধ্যে দিনযাপন করেন। সন্তানের চিন্তায় পিতা- মাতার স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হচ্ছে। এদিকে শুধু অল্প বয়সী তরুণীই নয় বর্তমানে শিশু থেকে প্রবীণ সব বয়সী নারীরা সমাজে অনিরাপদ। ভয়াবহ এক অশরীরী সময়ে বসবাস করছি যেন আমরা। কোথা দিয়ে কখন নারী কোন সর্বনাশের মধ্যে পড়ে যাবে সেই ভয় নারীকে সবসময় আচ্ছন্ন রাখছে! এই ভীতি আর কতদিন? নারীর জীবনকে কেন নিরাপদ করা যাচ্ছে না? এর দায় কার?

ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের ঘটনাগুলোতে বেশিরভাগ সময় লক্ষ করা যায়, অভিভাবকের অনুপস্থিতির সুযোগই গ্রহণ করে নিপীড়নকারী। অভিভাবক চাকরিজীবী হলে সেক্ষেত্রে সন্তানকে পরিচিত কারো কাছে রেখে যাচ্ছেন। এবং পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে এই সন্তান ঠিক শতভাগ নিরাপদ নয় তাদের কাছেও! কখনও কখনও তাদের দ্বারাও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে কন্যা শিশু। তাহলে সত্যিকার অর্থে কন্যা শিশুর নিরাপত্তা কে দেবে? এক্ষেত্রে শুধু শিশুই নয় নারীরাই অনিরাপদ থাকছে ক্ষেত্রবিশেষে! নারীকে নিরাপদ করতে হলে সমাজকে মানসিকভাবে সুস্থ হতে হবে।

ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটার পিছনে অন্যতম কারণ প্রতারণামূলক উপায়ে প্রলুব্ধ বা জোরপূর্বক অপহরণ করে ধর্ষণ চেষ্টা। রাস্তা-ঘাটে নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে অহরহ। ভুল বুঝিয়ে বা কোন সমস্যা সৃষ্টি করে নারীকে বোকা বানিয়ে তার সর্বস্ব লুট করে নেওয়ার পাশাপাশি নারী জোর পূর্বক ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। ধর্ষণের আরও একটি কারণ হিসেবে দেখা যায়, ভিকটিমের একাকী অবস্থান। কুচক্রী মহল নারীর একা থাকাকে কেন্দ্র করে সুযোগ গ্রহণ করে। কিন্তু নারীর নিরাপত্তার চাদর হয়ে কে বা কারা সবসময় সঙ্গে থাকবে? তাহলে কী এ সমাজে নারী একা চলাচল করতে পারবে না?

বর্তমান সময়ে নারীর ধর্ষণের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে প্রেমের নামে প্রতারণা। ছল-চাতুরি করে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে একসময় শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে বাধ্য করা হচ্ছে । আর এই সুযোগে নারীকে বশে এনে নারীর সম্ভ্রম নিয়ে মেতে উঠছে কুচক্রী মহল। অনেক সময় নারীরা সরলতা, বিশ্বাসের জেরেও ফাঁদে পা দিচ্ছে। শিশুদের ধর্ষণের ক্ষেত্রে পাষণ্ডরা ব্যবহার করে চলেছে শিশুর অবুঝ মনকে। খাবার, খেলানা সামগ্রীর প্রলোভন দেখিয়ে তাদের কব্জা করে শারীরিক নিপীড়ন করা হচ্ছে। শিশু ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিশুরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে বেশি কাছের মানুষ বা পূর্ব পরিচিত কারো দ্বারা। এক্ষেত্রে ধর্ষক শিশুর সারল্যকে পুঁজি করে এই নোংরা খেলায় মেতে উঠছে। কারণ শিশুরা অভিযোগ করতে পারে না। বা বোঝেই না তাদের সঙ্গে কত নোংরা পাশবিকতা ঘটে গেছে! ফলে কুরুচিপূর্ণ মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তি শিশুদের সারল্য, অসহায়ত্বকে কাজে লাগিয়ে কুপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করছে! এ ব্যাপারে অভিভাবকদের সর্বোচ্চ সচেতনতা জরুরি। সন্তানকে কার কাছে রাখছেন, কতটা ভরসা করা যায় সেদিকে নজর দিতে হবে।

বিয়ের আশ্বাস গ্রহণের মাধ্যমেও নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে! প্রেম এবং বিয়ের আশ্বাসে নারীর বিশ্বাসের সুযোগে তাকে ধর্ষণের শিকার করে তুলছে একশ্রেণির মানুষ। বর্তমান সময়ে এই ঘটনা খুব একটা বিরল নয় যে, বিয়ের দাবিতে প্রেমিকের বাড়িতে অনশন। নারীরা তাদের অসহায়ত্বকে সুযোগে পরিণত করে দেয় নিপীড়নকারীর। আবার অনেক সময় ধারালো অস্ত্র বা বন্দুকের মুখে রেখেও নারীর প্রতি পাশবিক অত্যাচার চালাচ্ছে! নারীরা কোথাও নিরাপদ নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নারীদের তোপের মুখে ফেলতে মানসিকভাবে বিকৃত রুচিসম্পন্ন মানুষ নামের পশুরা
অভিনব ফন্দি, কৌশল ব্যবহার করে চলেছে।

ইন্টারনেটের যুগে সবার হাতেই প্রায় স্মার্টফোন। আর এই ফোনের মাধ্যমেই একে অপরের সঙ্গে আলাপ- পরিচয় ঘটছে। কিন্তু ভালোমতো চেনা- পরিচয় না ঘটলেও নারীরা অনেক সময় ব্যক্তিগত ছবি, গোপন ভিডিও আদান-প্রদানের মাধ্যমে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলছে। সম্পর্কের অবনতি, দ্বন্দ্ব, টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ধান্দায় ব্লাকমেইলিং করে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলাও খুব সাধারণ ঘটনা বর্তমানে। তাই সমাজে ঘটে চলা এসব সমস্যা থেকে নারীদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। সচেতন হতে হবে পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে।

নারীরা নিজেদের স্বাবলম্বী করে তুলতে গিয়েও অনেক সময় ফাঁদে পা দিয়ে ফেলছেন। বিভিন্ন ধরনের চাকরির প্রলোভন, অভিনেত্রী হওয়া, পরীক্ষায় ভালো ফলের আশায় শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। এক্ষেত্রে নারীর অসতর্কতা, সারল্য, ভয়, সম্মানহানি, প্রলোভন সবই দায়ী। অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে নারীকে ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন সমাজে ঘটেই চলেছে। নারীকে সচেতন হতে হবে। কর্মক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হলে আইনের আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে।

সবচেয়ে ভীতিপ্রদ অবস্থা গণপরিবহনে চলাচল। বর্তমানে নারীরা ঘরে- বাইরে সমানভাবে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করছে। আর এই সুযোগে এক শ্রেণির বখাটে, লম্পট, মদ্যপ, বিকৃত রুচিসম্পন্ন মানুষ নারীদের ভোগ্য পণ্য মনে করে চলেছে। এবং গণপরিবহন, রাস্তা-ঘাটে ইভটিজিং, যৌন হয়রানি, ধর্ষণ করছে। চলন্ত বাসে নারী সংঘবদ্ধ ধর্ষণ জাতির নির্লজ্জ চিত্র আমাদের সামনে উপস্থাপন করে। মানুষের রুচি কতটা নিচে নেমে গেলে নারীর সঙ্গে এরূপ বিভৎস আচরণ করে মানুষরূপী পশু। কাজের সূত্রে ঘরে ফিরতে দেরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু একলা নারীর পথ চলা সমাজে নিরাপদ নয় আজও। গণপরিবহনে অন্য নারী যাত্রী না থাকলে ভয়ে ভয়ে নারীকে তার গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়। এই পরিস্থিতির পরিত্রাণ কবে ঘটবে?

এর বাইরে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ বা ক্ষোভ থেকে অপরাধীর প্রতিশোধপরায়ণতা তো আছেই। পারিবারিক দ্বন্দ্ব সংঘাত, জমিজামা সংক্রান্ত সমস্যা, প্রেম, দাম্পত্য সংকট প্রভৃতি কারণেও নারীরা ধর্ষিত হচ্ছে। মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা, বিকৃত চিন্তা-ভাবনা, জৈবিক চাহিদা, ক্ষমতা প্রদর্শন, রাজনৈতিক কারণ, পরকীয়া, পূর্ব শত্রুতা, মাদকাসক্তি, অপরিচিত স্থানে ভ্রমণ প্রভৃতি বহুকারণে নারীরা ধর্ষিত হচ্ছে। কোন কারণকেই ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। নারীদের প্রতি অসম্মান – অশ্রদ্ধা, অবহেলিত বস্তু সদৃশ ভাবনা যতদিন সমাজে বিরাজ করবে ততদিন নারী এ সমাজে নিরাপদ নয়। নারীদের অবরুদ্ধ দেখতেই যেন এ জাতি অভ্যস্ত ফলে পুরুষতান্ত্রিক কদর্য মানসিকতা নারীদের জন্য ফাঁদ পেতে রেখেছে। নারীর জন্য স্বাভাবিকভাবে সুস্থ পরিবেশ অকল্পনীয়।

নারীরা শুধু কুরুচিপূর্ণ মানসিকতার মানুষ দ্বারা ধর্ষণের শিকারই হচ্ছে না। রাষ্ট্র কর্তৃক নারীর জন্য গড়ে তোলা হয়েছে প্রহসন! কোন নারী ধর্ষণের শিকার হলে বিচারের আশায় যাওয়া নারীকেই সন্দেহ করা হয়। একজন ভুক্তভোগী নারী যখন অভিযোগ তোলেন তখন উল্টো তাকেই জেরার মুখে পড়তে হয়। যা ধর্ষণকে আরও একবার জীবিত করে তোলে! ফলে ধর্ষিত নারী একবার নয় এ সমাজ, রাষ্ট্র কর্তৃক বারবার ধর্ষণের শিকার হয়! আইনের এই হীন চিত্রের মুক্ষাপেক্ষী নারীরা তাই সঠিক বিচারের আশা না করে অনেক সময় নিজের ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেন। আত্মহত্যা করেন। এর দায় কী সমাজ, রাষ্ট্রের নয়?

আইনের আশ্রয়প্রার্থী নারীকে ডিএনএ টেস্টে জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগ করলে একরকম সন্দেহের তীর তার দিকে থাকে তেমনই কালক্ষেপণ করলেও নারীকে জটিলতায় পড়তে হয়। তদন্ত প্রক্রিয়ার নামে নারীকে অস্বস্তি, বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। বিচারের নামে চলে প্রহসন! এমনকি এ সমাজ নারীর চরিত্র নিয়েই প্রশ্ন তোলে। ভুক্তভোগী নারী বিচারের আশায় আইনের আশ্রয় নিলে ঘরে- বাইরে তাকে নির্যাতিত হতে হয়। পরিবারের সম্মান, সমাজের কদর্য কথা নারীকে হজম করতে হয়। ঘরের বাইরে না বেরুলেই নারীরা পারেন, রাত- বিরাত এত বাইরে থাকা কিসের, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে এত মেলামেশা কিসের, গণপরিবহনেই বা নারী কেন যাতায়াত করবে প্রভৃতি অসংখ্য মন্তব্য নারীকে রক্তাক্ত করা হয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর জন্য যে শেকল তৈরি করেছে সেই শেকলে নারী কেন বন্দি নয়! নারীর প্রতি হওয়া অন্যায়- অবিচার রুখে দিতে এখনই তৎপর ভূমিকা পালন করতে হবে। নারী ধর্ষণ, নির্যাতনের শিকার হলে তার দায় নারীর নয় বরং যারা নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি আজও তাদের ওপর বর্তায়।

নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। তদন্তের নামে দীর্ঘসূত্রিতা বন্ধ করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া সঠিক বিচারের পথে ভুক্তভোগীর ধৈর্য্যচুত্যি ঘটায়। ফলে নারীর প্রতি সহিংসতা কমিয়ে আনতে আইনের শ্লথগতি আগে পরিহার করতে হবে। বর্তমান সময়টা স্মার্টফোনের যুগ, ইন্টারনেটের যুগ। ফলে নারীদের উচিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপরিচিত কোন ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে না তোলা। ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিও আদান-প্রদান থেকে বিরত থাকা। আস্থা, বিশ্বাসের সুযোগে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে না পড়া।

ধর্ষণের জন্য বিশেষভাবে দায়ী পর্ণগ্রাফির সহজলভ্যতা। উঠতি বয়সী ছেলে- মেয়েরা পর্ণগ্রাফির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নিজেদের জীবনেও এ ধরনের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে গিয়ে ডেকে আনছে সর্বনাশ। ভালো- মন্দ বোঝার আগেই জীবনে অঘটন ঘটিয়ে ফেলছে। অবাধ মেলামেশার সুযোগেও ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলো ঘটছে৷ তাই সরকারের উচিত পর্ণগ্রাফির ওপর নিয়ন্ত্রণ আনা। পারিবারিকভাবে সন্তানকে ভালো- মন্দের শিক্ষা দিতে হবে। নারী- পুরুষ লিঙ্গভেদে আলাদা হলেও কেউ কারো অশ্রদ্ধার নয়। পরিবার থেকে সন্তানদের মধ্যে মূল্যবোধ, মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত করতে হবে। শিশুদের ক্ষেত্রে গুড টাচ, ব্যাড ট্যাচের শিক্ষা দিতে হবে।

একা সরকারের পক্ষ সমাজ থেকে ধর্ষণকে প্রতিহত করা সম্ভব নয়। এরজন্য কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি প্রত্যেক জনগণকে সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে নারীদের নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অপরিচিত, অর্ধপরিচিত এমনকি পরিচিত কোন ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে যাওয়ার আগে মানসিকতাকে আগে বুঝতে হবে। পারতপক্ষে ব্যক্তিগত তথ্য আদান-প্রদানে সতর্ক হতে হবে। কতটুকু পর্যন্ত জীবনের জন্য পরবর্তী সময়ে সমস্যার সৃষ্টি করবে না সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। সামজিকভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

ধর্ষণকে রুখে দিতে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে সভা, সেমিনার করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এ বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে। জনসচেতনতামূলক ভিডিও ক্লিপ, পথ নাটক, লিফলেট বিতরণের মাধ্যমে সমাজে সবাইকে এর কদর্য দিক সম্পর্কে বোঝাতে হবে। সচেতন করতে হবে জীবনের নিরাপত্তা, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে।

সুস্থ ধারার বিনোদন, সংস্কৃতি চর্চা, সন্তানের বই পড়ার অভ্যেস গড়ে তুলতে হবে। একটি ভালো বই, সুস্থ সংস্কৃতি মানুষের বোধকে জাগ্রত করতে সহয়তা করে ফলে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিশ্চয়তা বিধান অভিভাবকমণ্ডলীর অবশ্যই তার মানস গঠনে ভূমিকা রাখতে হবে। অবসর সময়ে খেলাধুলা, ব্যায়াম, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ গড়ে তুলতে হবে।

বন্ধু নির্বাচনে সতর্ক হওয়া বেশ জরুরি। অনেক সময় দেখা যায় বাজে বন্ধুদের পাল্লায় পড়েও সন্তান বিপথে যায়। ধর্ষণের মতো জঘন্য নৃশংস কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। মাদকাসক্তি, ধূমপান, অসৎসঙ্গ থেকে পরিত্রাণ করতে সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। সরকারের একার পক্ষে যেমন নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয় তেমনই নারীর সচেতনতায় শুধু তাকে নিরাপদ করার জন্য যথেষ্ট নয়। সমাজের সবার একযোগে এ লক্ষে কাজ করতে হবে। পশু বৃত্তির পরিত্রাণ ঘটাতে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে নারীদের। নারী সমাজের বাইরের কেউ নয়। একজন পূর্ণ মানুষ ফলে নারীর প্রতি কৌতুহল বন্ধ করতে হবে। ছেলে- মেয়েদের কো এ্যাডুকেশন তাদের মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ গড়ে তুলতে সহয়তা করবে। ফলে মেয়ে- ছেলে লিঙ্গ বৈষম্য করে একে অপরের প্রতি প্রতিযোগিতাপূর্ণ মনোভাব গড়ে না তোলা। পরিবার, সমাজ গঠনে নারীর যেমন অংশগ্রহণ জরুরি পুরুষেরও সমান অংশগ্রহণ জরুরি। কেউ কারো প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। সহোযোগী।

নারীরা যুগের পর যুগ ধরে সমাজে নিপীড়নের শিকার। নারীকে সুস্থ পরিবেশ দিতে নারীর প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান খুবই জরুরি। নারী-পুরুষের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ অনেকাংশেই নিপীড়নের হাত থেকে নারীকে রক্ষা করতে সক্ষম। নারীকে দূরদর্শী হতে হবে। হঠাৎ আবেগে গা ভাসিয়ে না দিয়ে নিজের সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। গড়ে উঠুক বৈষম্যহীন, নিরাপদ, সুস্থ, স্বাভাবিক, কল্যাণময় পৃথিবী। যেখানে নারী মুক্ত বিহঙ্গের মতো বিচরণ করতে পারবে।

 

শীতে রান্নাঘরের কাজ সহজ করার কয়েকটি টিপস

 

শীতের সময়টা খুব অলস লাগে কাজ করতে সবারই। এই সময়টায় আমার মতো আপনারও রান্নাঘরের কাজ করা কঠিন মনে হতে পারে। বিশেষ করে ঠান্ডা জলে হাত দিয়ে কাজ, রান্না, ঘন্টার পর ঘন্টা রান্নাঘরে থাকা, বাসনপত্র ধোয়া, পরিষ্কার করা সহজ নয়। মাঝে মাঝে মনে হয় সারাদিন কম্বল মুড়ি দিয়ে দিনটা কেটে যাক। কিন্
কাজ তো করতেই হবে, কিন্তু যদি শীতকালে যদি দ্রুত রান্নাবান্নার কাজ সেরে ফেলা যায় তাহলে মন্দ হয় না। চলুন আজ আপনাদের সাথে শীতকালে রান্নাঘরের কাজ সহজ করার টিপস শেয়ার করে নেওয়া যাক। এই ছোট্ট হ্যাকগুলো আমাদের কাজকে অনেক সহজ করে দিতে পারে এবং এগুলোর সাহায্যে আমরা শীতে আমাদের সময় বাঁচাতে পারি।

১. ঠাণ্ডা জলের হাত থেকে বাঁচাঃ
শীতের সকালে সবচেয়ে আলস্য লাগে বাসনপত্র ধুতে। ঠাণ্ডা জলে হাত দেওয়ার ভয়ে সকালে আমার মত যাদের কান্না পায়, তারা এই সহজ উপায় অবলম্বন করে দেখতে পারেন। সকালে উঠে চা ও জলখাবারের জন্য যেটুকু বাসন ধুতে লাগবে তা জল একটু গরম করে ধুয়ে নিন। বাকি বাসন একটু বেলার দিকে পরিষ্কার করুন। ততক্ষণে রোদের জন্য পাইপের জল যথেষ্ট গরম হয়ে যায়। যাতে হাত দিতে কোন অসুবিধা হয় না।

২. আলু সেদ্ধ হতে অর্ধেক সময় লাগবেঃ
আলু সেদ্ধ করার আগে কাঁটা চামচের সাহায্যে কিছু গর্ত করে নিন। এই পদক্ষেপটি আপনার কাছে ছোট মনে হতে পারে, তবে এই একটি পদক্ষেপটি আলু সেদ্ধ করার সময়কে অর্ধেক করে দেবে। আলুতে দুপাশ থেকে গর্ত করে নিন, এতে আলু ভিতর থেকে ভালোভাবে সেদ্ধ হবে এবং রান্নার গ্যাসের সাথে সাথে আলু সেদ্ধ করার সময়ও বাঁচবে।

৩. রসুন এবং পেঁয়াজ পিলিং ট্রিকঃ
শীতকালে রসুন-পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোও বড় কাজের থেকে কম মনে হয় না। শীতকালে, হাত এমনিতেই ঠান্ডা থাকে এবং একে একে খোসা ছাড়ানো একটি ঝামেলার কাজ বলে মনে হয়। এই পরিস্থিতিতে, আপনি একটি ছোট পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন। গরম জলে রসুন এবং পেঁয়াজ ৩-৪ মিনিটের জন্য রেখে দিন। এর দুটি সুবিধা হবে, প্রথমত, এটি খুব সহজে খোসা ছাড়বে এবং দ্বিতীয়ত, এটি একটু নরম হয়ে থাকবে এবং এর কারণে রান্নার সময় অনেকটাই কমে যাবে।

৪. আগাম সবজি মসলা তৈরি করুনঃ
আপনি সহজেই সবজি মসলা আগে থেকে প্রস্তুত করতে পারেন, যা প্রতিদিন সবজি মসলা ভাজার জন্য সময় বাঁচাবে। আপনার যখনই সময় থাকবে তখনই এটি তৈরি করুন এবং তারপরে ১০-১৫ দিনের জন্য প্রতিদিন এটি ব্যবহার করুন।

৪-৫টি টমেটো
৪টি পেঁয়াজ
৩-৪টি কাঁচা লঙ্কা
১০-১২টি রসুনের কোয়া
১/২ ইঞ্চি আদা টুকরো (আপনার স্বাদ অনুযায়ী বাড়াতে পারেন)
বড় লাল লঙ্কা (ঐচ্ছিক)
এই সব জিনিস ভাল করে পিষে নিন প্রথমে। তারপর এতে তেল যোগ করুন। একটি প্যানে ২০-২৫ মিনিটের জন্য ভাজুন। এই মুহুর্তে আপনার মনে হতে পারে যে ২০-২৫ মিনিট অনেক, কিন্তু ১০-১২ দিনের রান্নার সময় বিবেচনা করলে তা খুব কম। মনে রাখবেন তেল বেশি লাগে কারণ অনেক দিন চালাতে হয়। ঠাণ্ডা হলে তা বয়ামে ভরে ফ্রিজে রেখে দিন। প্রতিদিন রান্নার আগে বের করে এর থেকে ব্যবহার করুন।

৫. দুধ ফুটাতে ব্যবহৃত পাত্র নোংরা হবে নাঃ
শীতকালে দেখা যায় সবচেয়ে বড় সমস্যা হল থালা-বাসন ধোয়ার ক্ষেত্রে অলসতা। এমন অবস্থায় যদি পাত্রে ময়লা বেশি থাকে তাহলে দেখতে খুব খারাপ লাগবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুধের পাত্রের নীচে দুধের ক্রিমের মতো কিছু জমে থাকে। এটি ঘষা নিজেই একটি বড় কাজ এবং অনেক সময় এটি পরিষ্কার করা একটি ঝামেলা হয়ে দাঁড়ায়।এটি যাতে জমে না যায় সেজন্য, প্রথমে দুধের পাত্রে কিছু জল রেখে তার উপর দুধ ঢেলেফোটান। এইটুকুই আপনাকে করতে হবে আর কিছুই নয়। এতে করে দুধ গরম করার পাত্র বেশি নোংরা হবে না।

অনেক সময় এমন হয় যে দুধ গ্যাসে রাখতে ভুলে গেলে তা ফুটে যায় এবং নিচে পড়ে যায়। এটি একটি খুব ঝামেলার কাজ এবং এটি পরিষ্কার করাও খুব কঠিন। এমন পরিস্থিতিতে, শুধুমাত্র একটি ছোট কৌশল দিয়ে এটি বন্ধ করা যেতে পারে যাতে আপনাকে শীতে অতিরিক্ত কাজ করতে না হয়। দুধের পাত্রের উপরে একটি হাতা রাখুন। কাঠের হাতা রাখতে পারেন বা স্টিলের। এটি আপনার দুধকে উথলে পড়ে যাওয়ার থেকে আটকাবে।

৬. কুকারে ডাল এভাবে রান্না করুনঃ
শীতকালে কুকার পরিষ্কার করা একটি কঠিন কাজ বলে মনে হতে পারে। মসুর ডাল কুকারের ঢাকনায় লেগে থাকলে আরও কঠিন হবে। এমন পরিস্থিতিতে ডাল সিদ্ধ করার সময় দুই থেকে তিন ফোঁটা উদ্ভিজ্জ তেল যোগ করাই সবচেয়ে ভালো উপায়। এতে করে আপনার ডাল কুকারের ঢাকনা থেকে বের হবে না। এই পদ্ধতিটিও সহজ এবং সাথে সাথে আপনার কাজ হয়ে যাবে।

৭. দ্রুত ৫ মিনিটের ব্রেকফাস্ট রেসিপিঃ
শীতকালে সকালের নাস্তা করা খুব কঠিন। তাহলে কেন নাস্তা তৈরিতে ডিম পোচ ব্যবহার করবেন না। আপনি নিশ্চয়ই হাফ ফ্রাই ডিম বা অমলেট বানিয়েছেন অনেকবার, কিন্তু আপনি যদি মাত্র ৫ মিনিটের মধ্যে নিখুঁত স্টিমড ডিম চান তবে এই রেসিপিটি আপনার জন্য খুব কার্যকর হবে।

একটি মাইক্রোওয়েভ সেফ কাপ বা মাফিন ট্রেতে ১ চা চামচ জল ঢেলে তার উপর একটি ডিম ফাটিয়ে দিন। আপনি চাইলে এর উপরে লবণ ও গোলমরিচ যোগ করতে পারেন অথবা রান্নার পর যোগ করতে পারেন। এবার মাইক্রোওয়েভে ৫ মিনিট বেক করুন। মনে রাখবেন মাইক্রোওয়েভ প্রিহিটেড রাখুন এবং এর তাপমাত্রাও যেন বেশি থাকে।

৮. একবারে দুবেলার রান্না করে রাখুনঃ
শীতের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল খাবার নস্ত হয় না। আর এক দু দিনের জন্য বেশি রান্না করলে তা ফ্রিজেও রাখতে হয় না। তাই রোজ সকালে এবেলা আর ওবেলার রান্না সেরে নিন। এতে করে সময় বাঁচবে আর ঠাণ্ডায় দুবার জল ঘাটার চান্স থাকবে না বেশি। ভাত বা রুটি বাদে বাকি রান্না একবারে করে রেখে দিন। চাইলে ভাত রুটি করে রাখতে পারেন। খাওয়ার আগে সব গরম করে নিলেই ঝামেলা শেষ।

 

শীতে সুস্থ থাকতে সাজিয়ে নিন সারাদিনের ব্যস্ত রুটিন

 

প্রতিদিনের কাজের মাঝে শরীরের প্রয়োজন পর্যাপ্ত যত্ন ও মানসিক প্রশান্তি। তাই আপনার সারাদিনের ব্যস্ত রুটিনকে সাজিয়ে নিন সাস্থ্যকর কিছু ধাপে। আসুন জেনে নেই দৈনন্দিন কাজের মাঝেও এই শীতে যেভাবে নিজের যত্ন নিবেন।

শীতের ভোরে সহজে কেউ ব্যায়াম করতে চায় না বা হাঁটাহাঁটি করতে চায় না। ফলে ওজন বেড়ে যেতে পারে। তাই খাবার গ্রহণের সময় ব্যালেন্স করে খাবার গ্রহণ করতে হবে। যেমন আগের দিন উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত খাবার খেলে পরেরদিন কম ক্যালোরিযুক্ত খাবার খান। আবার অনেকেই যারা স্বাস্থ্য সচেতন তারা এই সময় কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার কম খেলে, নানান ধরনের সবজি খেয়ে খাবার গ্রহণের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেন।

শীতের মিষ্টি রোদ আপনাকে ভিটামিন ডি’র যোগান দেবে, তাই শীতকালে অন্তত ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট অবশ্যই নিজের শরীরে রোদ লাগান। এতে আপনার শরীরের ব্যথা দূর হবে।

শীতকালে জলবায়ু রুক্ষ ও শুষ্ক হওয়ায় আমাদের ত্বক ফাটতে থাকে। তাই ত্বক ভালো রাখতে প্রচুর পরিমাণে পানি খেতে হবে। পর্যাপ্ত পানি পান না করলে হতে পারে ডিহাইড্রেশন, বলিরেখা, এবং মুখে দাগের মতো নানা ধরণের সমস্যা। যার ফলে ক্লান্তি বাড়ে এবং যে কাউকে বয়স্ক দেখাতে পারে। কনকনে শীতে শরীর চাঙা রাখতে অত্যন্ত উপকারী ও উপাদেয় একটি খাবার হলো স্যুপ। বিভিন্ন ধরনের সবজি ও মাংস দিয়ে তৈরি স্যুপ শরীরের পুষ্টির ঘাটতিও পূরণ করবে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় নরম পাতলা খিচুড়ি, লেবু চা, আদা চা, গরম দুধ ইত্যাদি খাবার খেলে ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা থেকেও নিজেকে দূরে রাখতে পারবেন এবং দূর হবে পানির ঘাটতি।

প্রতিদিন আমরা কী খাচ্ছি তার উপরই নির্ভর করে আমাদের ভালো থাকা ও সুস্বাস্থ্য। খাবারের উপরেই নির্ভর করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। নিজেকে ফিট রাখতে শীতে খাদ্যতালিকায় কিছু কিছু খাবার অপরিহার্য। শীতে সতেজ থাকতে খাদ্য তালিকায় রাখতে পারেন কমলা, গাজর, ডিম, আদা, কাঠবাদাম, মাশরুম, রসুন, মধু, সবুজ পাতার সবজী গ্রিন টি, সাইট্রাস ফল, মিষ্টি আলু ও অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার।

 

নারীদের গৃহস্থালী কাজের বার্ষিক মূল্য ৫৩০ কোটি টাকা

 

বাংলাদেশের নারীরা নিজ বাড়িতে যেসব কাজ করে থাকে তার বার্ষিক মূল্য ৫৩০ কোটি ৭০ লাখ টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের ১৪.৮ শতাংশ। ৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) বার্ষিক গবেষণা সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
রাজধানীর একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে ‘নারীর অবৈতনিক ও অ-বিপণন কাজ’ শীর্ষক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সংস্থাটির মহাপরিচালক বিনায়ক সেন। মূলত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুরোর ‘টাইম ইউজ সার্ভের’ প্রাথমিক প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে প্রতিবেদনটি করা হয়।

গবেষণা সম্মেলনে বলা হয়, করোনার কারণে নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়ে ২.৮ মিলিয়ন বা ২৮ লাখ মানুষ। ২০২২ সালের হিসাবে দারিদ্র্য বৃদ্ধিতে প্রধান ভূমিকা রেখেছে করোনা। একই বছর মন্দার কারণে বাড়তি ৫০ হাজার মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমেছে। আগামী বছরের শুরুতে বাংলাদেশে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কাও করেন গবেষকরা।

এমন যেকোনো নিষেধাজ্ঞা দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। এদিন ছয়টি অধিবেশনে প্রায় ৯টি পেপার ও দুটি পাবলিক লেকচার অনুষ্ঠিত হয়েছে। দিনব্যাপী বিভিন্ন অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান।
বিনায়ক সেন বলেন, শ্রীলঙ্কার নারীদের অবৈতনিক গৃহকর্মের বার্ষিক মূল্য তাদের জিডিপির ১৫ শতাংশ আর ২০১৯ সালের হিসাবে ভারতে তা ১৪ শতাংশ।
বিআইডিএসের এ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গৃহস্থালির কাজের বিনিময়ে ৭৫ শতাংশ পারিশ্রমিক ধরা হলেও জিডিপিতে আরো ১৩ শতাংশ অবদান যুক্ত হতে পারে, যেখানে নারীদের অবদান থাকছে ১১ শতাংশ ও পুরুষের অবদান ২ শতাংশ। এমনকি ৫০ শতাংশ পারিশ্রমিক দিলেও জিডিপিতে আরো ৮.৮ শতাংশ অবদান বাড়ত।

 

বেগম রোকেয়া দিবস আজ

আজ ৯ ডিসেম্বর, বেগম রোকেয়া দিবস। নারীর ক্ষমতায়ন ও শিক্ষা, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, অধিকার ও সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় বেগম রোকেয়ার অবদান ও নারী জাগরণের অগ্রযাত্রায় অন্তহীন প্রেরণার উৎস হিসেবে প্রতিবছর এই দিবসটি পালন করা হয়।

দিবসটি উপলক্ষে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই দিবসটি উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আজ বেগম রোকেয়া দিবস ও বেগম রোকেয়া পদক ২০২৩ প্রদান উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। নারী জাগরণে উদ্বুদ্ধকরণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ও গৌরাবোজ্জ্বল ভূমিকা রাখায় এ বছর পাঁচজন বিশিষ্ট নারীকে বেগম রোকেয়া পদক দেওয়া হচ্ছে।

পদকপ্রাপ্ত পাঁচজন বিশিষ্ট নারী ও তাদের অবদানের ক্ষেত্রগুলো হলো—নারী শিক্ষায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী উপাচার্য খালেদা একরাম, মরণোত্তর (ঢাকা জেলা), নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় ডা. হালিদা হানুম আখতার (রংপুর জেলা), নারীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কামরুন্নেছা আশরাফ দিনা, মরণোত্তর (নেত্রকোনা জেলা), নারী জাগরণে উদ্বুদ্ধকরণে নিশাত মজুমদার (লক্ষীপুর জেলা) এবং পল্লী উন্নয়নে রনিতা বালা (ঠাকুরগাঁও জেলা)।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে পদক প্রদান করবেন।

বেগম রোকেয়া দিবস উপলক্ষে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সংবাদপত্রে বিশেষ ক্রোড়পত্র ও স্মরণিকা প্রকাশ করা হবে। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতারসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম এই উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার ও নিবন্ধ প্রকাশ করবে। নারী শিক্ষা, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার লাগানো ও লিফলেট বিতরণ করা হবে।

 

অক্টোপাশের থাবা: সুমাইয়্যা সিদ্দিকা

 

১.
চোখ খুলতেই গাঢ় অন্ধকারে ডুবে গেল নাসর। ধোঁয়ার গন্ধে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তার। তবুও উঠে বসার চেষ্টা করলো সে। মাথাটা মনে হচ্ছে কয়েক টন ওজনের। চুপচাপ পড়ে রইলো খানিকক্ষণ। বেশ খানিকটা সময় কেটে গেল। কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করলো সে। হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো।

: শিহাদাহ… হান্না… শামআহ… কিন্তু কন্ঠনালী থেকে ঘরঘরে আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই বের হলো না ওর। অন্ধকারেরই বাচ্চাদের মতো চারপায়ে হামাগুড়ি দিয়ে খানিকটা এগোলে সে।

হঠাৎ পায়ে কি যেন ঠেকলো। অনুমানে হাত বাড়িয়ে দিতেই ছোট্ট একটা শরীরে হাতে ঠেকলো ওর। ঘোরগ্রস্ত লোকের মতো সামনে এগোলো। তারপর উন্মত্তের মতো বুকে চেপে ধরলো শরীরটাকে। কাঁধ ছড়ানো এক রাশ চুলে ভরা মাথাটা কেমন আঠালো পানীয়তে ভরে রয়েছে অনুভব হতেই চোখ বেয়ে এক সমুদ্র যন্ত্রণা ঝরে পড়তে লাগলো নাসরের । মেয়ের খানিক দূরেই নাজের নিথর দেহ।

: হানা.. আমার ছোট্ট পাখি! অন্ধকারেই মেয়েকে বুকে চেপে টলতে টলতে এলোমেলো পদজোড়া নিয়ে এগোতে লাগলো।

: আহ.. হঠাৎ দেয়ালের ভাঙা ইটের টুকরোতে ধাক্কা খেলো সে। কোনমতে পতন ঠেকাতে ঠেকাতে রুমের বাইরে এলো সে। অন্ধকারেই অন্য রুমে এসে পৌঁছালো সে। পা বাড়াতেই কঁকিয়ে উঠলো কেউ।

:শিহাদাহ… ছোট ছেলের কন্ঠ চিনতে মূহুর্তও লাগলো না তার।

মেয়েকে পাশে নামিয়ে ছেলেকে উঠাতে এগিয়ে গেল। শিহাদাহর গায়ের উপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে কে যেন! মাথার পাগড়িতে হাত লাগতেই বড় ছেলেকে চিনতে এতটুকুও ভুল হলো না নাসরের। তার হাফেজ ছেলেটা! ছোট ভাইকে বাঁচাতে নিশ্চয়ই নিজেকে ঢাল বানিয়েছিল সে। কষ্টে কাঁদতেও ভুলে গেল সে। বড় ছেলের গায়ের নিচে চাপা পড়া শিহাদাহকে বের করলো। পড়নের জোব্বাটা সম্পূর্ণ ভেজা। ওকে তুলতেই চিৎকার করে উঠলো।
ছেলের অমন চিৎকারে আতংকিত হলো সে। মনে হলো কোথাও ভেঙে গিয়েছে হয়তো বা।

: আব্বু….. কান্নার গমকে হারিয়ে গেল বাকি কথাগুলো।

২.
অক্টোবরের সন্ধ্যা। শীত আসি আসি করছে। শীতকাল বড্ড পছন্দ এখানকার বাসিন্দাদের। তবে এবারের সময়টা একেবারে অন্যরকম।

:আবু হানা! বাচ্চাদের নিয়ে খেতে আসুন। ভর সন্ধ্যাতেই টেবিল সাজিয়ে ফেলেছে নাজওয়া।

গরম গরম মাকলৌবা, দই, সালাদ, মাফতুউল, আখরোট, খুরমা। টেবিলের মাঝ বরাবর রূপার মোমদানিতে টিম টিম জ্বলছে মোমবাতি।

বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন গত দু’দিন যাবত। মোমবাতির স্টকও ফুরিয়ে আসছে। তাই তাড়াহুড়ো করে কাজ শেষ করছে নাজওয়া।

স্ত্রীর ডাকে বাচ্চাদের নিয়ে টেবিলে আসে নাসর। এ সময়ে ওরা কেউ বাসায় থাকে। সন্ধ্যার পরও মাদরাসাতে ক্লাস থাকে। নাসরেরও ফিরতে যথেষ্ট দেরী হয়। কিন্তু এখন দৃশ্যপট অন্য।

গত তিন-চারদিন যাবত আবারো উত্তপ্ত শহর। তবে এবারের পরিবেশ একবারে ভিন্ন।

সবাই এসে বসতেই গরম গমে মাকলৌবা বেড়ে দিতে থাকে নাজওয়া। হানার জন্য একবাটি মাফতুউল (সুপ্য জাতীয় খাবার) বেড়ে নেয়। চামচে করে খাইয়ে দিতে থাকে মেয়েকে।
: আব্বিজান! আমি ইয়াসিন ভাইয়ের সাথে যেতে চাই। দেমিরও গতকাল চলে গেল। সভয়ে বাবার উদ্দেশ্যে বলে শামআহ।

খাওয়া থামিয়ে ছেলের দিকে তাকায় নাসর। পরিবারকে নিরাপদ স্থানে রেখে ছত্রীসেনাদের সাথে যোগ দেওয়ার কথা ভাবছিলো সে নিজেও।

: অবশ্য যাবে বেটা। আমিও যাবো। তবে তোমার মা ও ভাই-বোনদের জন্য একটা নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে আগে।
বাবার কথা শুনে খুশী হয় শামআহ।

গত কয়েকদিন ধরে বৃষ্টির মত সমানে ফসফরাস বোমা ফেলছে শত্রু বাহিনী। জয়তুন বাগান, আঙুরের খেত, বসবাসের বাড়ী-ঘর সব গুড়িয়ে দিচ্ছে তারা। আকাশ পথের হামলা শেষ হওয়ার আগেই বাড়ী বাড়ী এসে হাজির হয় ওরা। প্রতিবারই এমন করে।

তবে এবার গাজাবাসীও চুপ করে নেই। প্যারাসুটের ডানায় ভর করে আবাবিলের মতো প্রিয়ভূমিকে রাহু মুক্ত করতে আকাশসীমা ছুঁয়েছে তারা। খেজুর গাছের শাখাগুলোও ডানা নেড়ে ওদেরকে সমর্থন জানিয়েছে। প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্ববাসী ছত্রীসেনাদের উড়ার দৃশ্যে চমৎকৃত। আর ওদিকে সেনাদের অতর্কিত হামলায় দিশেহারা তেল আবিব।

হঠাৎ দ্রুম দ্রুম শব্দে কেঁপে উঠলো পুরো এলাকা। সমানে বোমা পড়ছে।

: লা হাওলা ওলা কুয়াতা…

:বাচ্চারা দ্রুত করো। শেল্টার নিতে হবে। চিৎকার করে বলে নাসর।

বোম্ব শেল্টারে যাওয়ার সুযোগও পায় না তারা। আধ খাওয়া খাবারের প্লেট টেবিলেই পড়ে থাকে। এলোমেলো।

৩.
ধসে পড়া বাড়ী থেকে অতিকষ্ঠে বের হয় নাসর। বুকের সাথে মেয়ে আর পিঠে বড় ছেলে আর স্ত্রীকে কাপড় দিয়ে শক্ত করে বাঁধে। মনের কোণে ক্ষীণ আশা। চিকিৎসা পেলে হয়তো কথা বলবে ওরা।
তারপর ছোট ছেলেকে কাঁধে তুলে নিয়ে পথে নামে। ধুকতে ধুকতে বাড়ী থেকে মাইল তিনেক দূরে আশ-শিফা হাসপাতাল পানে ছুটতে শুরু করে।

আলোহীন সমগ্র শহর। অন্ধকার যেন গিলে খাচ্ছে পুরো শহর। ভয়ানক এক মৃত্যুপুরী যেন! ধ্বংসস্তুপে পরিণত হতে চলেছে। কয়েক দশক ধরে শহরটাকে অক্টোপাশের থাবার মতো জীবন্ত কারাগারের পরিণত করে রেখেছে ওরা। চাইলেও কোথাও যাওয়ার জো নেই এখানকার অধিবাসীদের।

:পরিত্যক্ত হয়ে যাবে কি শহরটা!
নাকি ভূ-মধ্যসাগরের পানিতে মিশে যাবে!
বুকের ভেতর প্রচন্ড এক ভয় জাগে নাসরের।

চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে ওর। পূর্বপুরুষের বাসভূমি কোন আগুন্তকের জন্য একচুলও ছাড়বে না সে। হঠাৎই অজানা সাহসে ভরে ওঠে ওর হৃদয়।

হয়তোবা হাসপাতালে এখনও জেনারেটর চালু রয়েছে। ডাক্তার সালেহী ও তার টিমেরাও আছে। প্রতিনিয়ত নিরাপধ মানুষের প্রতি নিষ্ঠুর হামলার সাক্ষী হচ্ছে যারা।

আশা-নিরাশার দোলাচলে দুলতে দুলতে নিশ্চিদ্র অন্ধকারে ইসরাঈলী হিংসার আগুনে পোড়া রুটির মতো ঝলসানো গাজার সড়ক বেয়ে গন্তব্য পানে এগিয়ে যেতে থাকে নাসর।

লেখক পরিচিতি: শিক্ষক ও সাহিত্যিক

 

রোকেয়া রচনাবলীই রোকেয়া র পরিচিতি: নূরুন্নাহার নীরু

 

‘যদি সমাজের কাজ করিতে চাও, তবে গায়ের চামড়াকে এতখানি পুরু করিয়া লইতে হইবে যেন নিন্দা-গ্লানি, উপেক্ষা-অপমান কিছুতেই তাহাকে আঘাত করিতে না পারে;মাথার খুলিকে এমন মজবুত করিয়া লইতে হইবে যেন ঝড়-ঝঞ্ঝা, বজ্র-বিদ্যুৎ সকলই তাহাতে প্রতিহত হইয়া ফিরিয়া আসে৷’ — এমনি ক্ষুরধার আহব্বান নিয়ে যে নারীর আত্মপ্রকাশ তিনিই রোকেয়া নামের সেই মহিয়সী রমনী যিনি এই উপমহাদেশের নারী জাগরণের পথিকৃৎ সম প্রদীপ ৷ যে প্রদীপের আলো আজও সমুজ্জল৷
১৮৮০ সালের ৯ডিসেম্বর রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ম এবং ১৯৩২ সালের ঠিক এই দিনেই মাত্র ৫২ বছর বয়সে আবার তাঁর তিরোধানও ঘটে ৷ বুঝ হওয়াকাল থেকেই এই মহীয়সী নারী তৎকালীন অন্ধকারাচ্ছন্ন নারী সমাজের মুক্তির লক্ষ্যে জেগে উঠেন আপন সত্তায় জাগ্রত হয়ে৷ ফলে দেখা যায় বিশেষভাবে লেখনীর মাধ্যমে সমাজকে নাড়া দিতে গিয়ে প্রথমেই তিনি ১৯০২ সালে ‘পিপাসা’ নামক প্রবন্ধ লিখে তাঁর আন্দোলন শুরু করেন এবং ১৯৩২ সালে মৃত্যুর আগে আগে তার অসমাপ্ত লেখনী ‘নারীর অধিকার’ নামক প্রবন্ধের মাধ্যমে তাঁর আন্দোলনের পরিণতি ঘটান ৷
ইদানীং সাহিত্য জগতে বা রাজনৈতিক অঙ্গনে নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে (১৮৮০-১৯৩২) অনেকেই চাচ্ছেন নারীবাদী বলে মূল্যায়ন করতে৷ কিংবা পুরুষ বিদ্বেষী বলে পরিচিত করতে৷ কিন্তু আমি বলবো তাঁর রচনাবলীই তাঁর পরিচয় বহন করছে৷ কেননা দেখা যাচ্ছে বেগম রোকেয়ার লেখালেখি, বক্তব্য, কর্মময় জীবন থেকে অবিসংবাদিতভাবে প্রমানিত যে, তিনি ধর্ম বিদ্বেষীও ছিলেন না কিংবা তিনি পুরুষ বিদ্বেষীও ছিলেন না- যা নারীবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য৷ তিনি যুদ্ধ করেছেন প্রচলিত প্রথা বা প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যাবস্থার বিরুদ্ধে -আর সেটি যেহেতু পুরুষ দ্বারাই পরিচালিত সেহেতু তীরটাতো ওদিকে যাবেই কিছুটা কিন্তু সেটি ছিলো গঠনমুখী৷ মূলতঃ তৎকালীন কুসংস্কারে আচ্ছন্ন সমাজের কর্ণধারগণ স্বীয় প্রতাপ প্রতিষ্ঠিত রাখতে ধর্মের দোহাই দিয়ে স্বঘোষিত আইনকানুন প্রয়োগে লিপ্ত ছিলেন যা বেগম রোকেয়া তাঁর দূরদর্শীতা দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন ৷ ফলে সোচ্চার প্রতিবাদী ভূমিকা রেখে গিয়েছেন৷ তাঁর উপলব্দিগত বক্তব্য ছিল এরূপঃ “আমরা সমাজের অর্ধাঙ্গ; আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কিরূপে? কোনো ব্যক্তি এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ আর আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে৷ তাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা আমাদের লক্ষ্যও তাহাই৷” তিনি আরো বলেছেন ,”দেহের দুটিচক্ষু স্বরূপ নারী-পুরুষ; মানুষের সব রকমের কাজ কর্মের প্রয়োজনে দুটি চক্ষুর গুরুত্ব সমান ৷” মতিচূর প্রবন্ধে রূপকার্থে বলেছেন;” যে শকটেরএক চক্র বড়(পতি) এবংএক চক্র ছোট হয়(পত্নী) সে শকট অধিকদূর অগ্রসরর হইতে পারেনা৷সে কেবল একই স্থানে ( গেহকোনে) ঘুরিতে থাকিবে৷ তাই ভারতবাসী উন্নতির পথে অগ্রসর হইতে পারিতেছেনা৷”
বরং তিনি পুরুষদের সমালোচনা না করে প্রতিকারের জন্য নারীদের সক্ষমতা অর্জনের পরামর্শ দিয়েছেন তার লেখনীতে৷ যেমন তিনি তাঁর ‘রানী ভিখারীনি ‘ প্রবন্ধে নারীদেরে উদ্দেশ্য করে বলেছেনঃ “অযোগ্য বলার জন্য রাগ না করিয়া যোগ্য হইবার চেষ্টা করাই শ্রেয় ৷” — এমনি যাঁর আহবান তাঁকে আমরা পুরুষ বিদ্বেষী নারীবাদী বলি কি করে?

আবার দেখা যায়, যে ধর্ম (ইসলাম) নারীর শিক্ষা, অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার সেই ধর্মের অনুসরণে তিনি তাঁর স্বীকৃতি স্বরূপ ‘নারী শিক্ষা সমিতি’ প্রবন্ধে বলেছেনঃ “পৃথিবীর যিনি সর্বপ্রথম পুরুষ-স্ত্রীলোককে সমভাবে সুশিক্ষা দান করা কর্তব্য বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন তিনি আমাদের রাসূল মকবুল (সাঃ) ৷” আরো বলেছেন, “শিক্ষা লাভ করা সব নারীর অবশ্য কর্তব্য৷ কিন্তু আমাদের সমাজ সর্বদা তাহা অন্যায় করিয়াছে—মেয়েদের এমন শিক্ষায় শিক্ষিত করিয়া তুলিতে হইবে যাহাতে তাহারা ভবিষ্যত জীবনের আদর্শ গৃহিনী, আদর্শ জননী এবং আদর্শ নারী রূপে পরিচিত হইতে পারে ৷”
তৎকালীন বঙ্গীয় মুসলিম সমাজের করুণ দশা দেখে তাঁর মুক্তিকামী হৃদয় জেগে উঠেছিলো অধিকার চেতনায়৷ তারই আন্দোলনের ছাপ তাঁর লেখনীর ছত্রে ছত্রে নিবদ্ধ৷ শিক্ষা তথা উপযুক্ত শিক্ষার অভাব ই তৎকালীন অজ্ঞতায় নিমজ্জিত নারী সমাজের দুঃখ-দূর্দশার মূল কারণ ৷ এই বাস্তবতা হেতু উল্লেখ করে ‘বঙ্গীয় নারী শিক্ষা সমিতির’ সভার অভিভাষণে তিনি বলেন, ” মোছলমানদের যাবতীয় দৈন্য-দূর্দশার একমাত্র কারণ স্ত্রী শিক্ষার ঔদাস্য৷” প্রকৃতঃঅর্থেই তাই৷ সে সময় নারী এমনকি একটি শিশু বালিকাকেও এতটাই ঘরের কোনে বন্ধী রাখতে সচেষ্ট ছিল সে সমাজ যে, বিদ্যাশিক্ষাতো দূরে বাইরের আলো বাতাস ও দেখার স্বাধীনতা ছিলনা তাদের ৷ পর্দার নামে এমনই কঠোরতা বিরাজমান ছিলো যে, অচেনা-বেগানা নারীদের সামনেও শিশু বয়স থেকেই যাতায়াত নিষিদ্ধ ছিল৷ এভাবে একসময় নারী জাতি নিজেই নিজের উপর একটা শৃঙ্খলিত আভরণ পরিয়ে নিয়েছিল যা তাঁর ‘অবরোধ বাসিনী’ বইতে প্রচ্ছন্ন৷ ৷
নারীকূলের এমন ঔদাসীন্যতার জন্য তিনি ‘আমাদের অবনতি’ প্রবন্ধে লিখেছেনঃ “আমরা আলস্যের, প্রকারান্তরে পুরুষের দাসী হইয়াছি৷ ক্রমশঃ আমাদের মন পর্যন্ত দাস হইয়া গিয়াছে৷ এবং আমরা বহুকাল দাসীপনা করিতে করিতে দাসত্বে অভ্যস্থ হইয়া পড়িয়াছি৷ এইরূপে আমাদের স্বাবলম্বন, সাহস প্রভৃতি মানসিক উচ্চবিত্ত গুলো অনুশীলনের অভাবে বার বার অঙ্কুরে বিনাশ হওয়ায় এখন আর বোধ হয় অঙ্কুরিত হয় না৷” তাইতো তিনি বলেছেন; “ভগিনীরা! চুল রগড়াইয়া জাগিয়া উঠুন, অগ্রসরর হউন৷ মাথা ঠুকিয়া বলো মা! আমরা পশু নই৷ বলো ভগিনী আমরা আসবাব নই৷ বলো কন্যা! আমরা জড়োয়া অলঙ্কার রূপে লোহার সিন্ধুকে আবদ্ধ থাকিবার বস্তু নই৷ সকলে সমস্বরে বলো— আমরা মানুষ!”
তাঁর এই চেতনার প্রকাশ্য রূপই ১৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা ৷ অনেক বাঁধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে বাঙালি মুসলিম নারী সমাজের শিক্ষা বিস্তারে এ প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সে সময়ে৷ এছাড়া তিনি ১৯১৬ সালে ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুসলিম নারী সমাজকে সংঘবদ্ধ করেছেন- যা ছিলো তাঁর নারী অধিকার আন্দোলনের প্রকৃষ্ট উদাহারণ৷ ১৯০৪ সালে তিনি ‘ নবনূর’ পত্রিকায় লিখেনঃ “আমরা উচ্চ শিক্ষা প্রাপ্ত না হইলে সমাজও উন্নত হইবে না৷—- তাই আমাদিগকে সকল প্রকার জ্ঞান চর্চা করিতে হইবে৷ প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে তিনি নারীকে তাঁদের অলঙ্কারে সজ্জিত থাকার চেয়ে জ্ঞানঅর্জনে ভূষিত হবার প্রাধান্য দিয়েছেন বেশী৷ এজন্য তিনি শেকল তূল্য অলঙ্কার ছেড়ে জ্ঞানচর্চার আহবান জানিয়ে ‘বোরকা’ প্রবন্ধে লিখেছেনঃ ” নারীর শোভন অলংকার ছাড়িয়া জ্ঞানভূষণ লাভের জন্য ললনাদের আগ্রহ বৃদ্ধি হওয়া বাঞ্ছনীয়৷” অন্যত্র বলেছেন, “না জাগিলে ভারত ললনা এ ভারত জাগিবেনা” ৷”” আরো বলেন;কন্যারা জাগ্রত না হওয়া পর্যন্ত দেশ মাতৃকার মুক্তি অসম্ভব৷”
ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীশিক্ষা বিদ্বেষী কথিত আলেমদের বিরুদ্ধাচারণ করে তিনি স্বীকৃতি দেন যে , ইসলামই প্রথম উদ্যোগ নেয় নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় আর এর পথিকৃৎ হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)৷ যা তিনি অকপটে প্রচার করেন এবং আরো দাবী করেন যে, “মোছলমান বালিকাদের প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে কোরান শিক্ষাদান করা সর্বাপেক্ষা অধিক প্রয়োজন৷ ” এ দাবীর ব্যাখ্যায় তিনি আরো বলেন যে, ” আপনারা কেহ মনে করিবেন না যে , প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে কোরান শিক্ষা দিতে বলিয়া আমি গোঁড়ামীর পরিচয় দিলাম৷ তাহা নহে,আমি গোঁড়ামী হইতে বহু দূরে৷ প্রকৃত কথা এই যে, প্রাথমিক শিক্ষা বলিতে যাহা কিছু শিক্ষা দেয়া হয়, সে সমস্ত ব্যবস্থাই কোরানে পাও যায় ” -তাঁর এ বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় তিনি ধর্ম বিদ্বেষী নন বরং ধর্মের অপব্যবহার, ধর্মের নামে গোঁড়ামীতা, কুসংস্কার ইত্যাদির বিরুদ্ধে তাঁর আন্দোলন গড়ে তোলেন ক্ষুরধার ‘মসি’ চালিয়ে৷ তিনি তাঁর ‘আমাদের অবনতি’ প্রবন্ধে লিখেছেনঃ ” আমরা সমাজেরই অর্ধাঙ্গ৷ আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কিরূপে? কোনো ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষদের স্বার্থ আর আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে, একই৷”
যে সময়ে নারী জাতিকে জড়বস্তুতূল্য ভাবা হতো, কোনো কোনো ধর্মে নারীদেহে প্রাণ আছে বলেও ভাবা হতোনা সে সমাজের চিত্র তাঁকে কাঁপিয়ে তোলে নারীর অধঃপতনের দৃশ্যকল্পে৷ তাইতো তিনি বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত , নারীমুক্তির পথিকৃৎ হযরত রাসূলে মকবুলের সাঃ ভূমিকাকে প্রাধান্য দিয়ে তাঁর ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেনঃ” আরবে স্ত্রী জাতির প্রতি অধিক অত্যাচার হইতেছিলো৷ আরববাসীগণ কন্যা হত্যা করিতেছিলো তখন হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) কন্যা কূলের রক্ষক স্বরূপ দন্ডায়মান হইয়াছিলেন৷ তিনি কেবল বিধি ব্যবস্থা দিয়াই ক্ষান্ত থাকেন নাই৷ স্বয়ং কন্যা লালন করিয়া আদর্শ দেখাইয়াছেন৷” – এই চেতনা থেকেই উদ্বুদ্ধ হয়ে বেগম রোকেয়া ইসলামী বিধান অনুযায়ী নারীর মর্যাদা ও অধিকার আদায়ের আহব্বান জানিয়েছেন৷ তিনি তৎকালীন পর্দা নামের অবরোধ প্রথার বিরোধিতা করে শরিয়াত সম্মত পর্দা করতে আগ্রহী হয়ে ‘বোরকা’ প্রবন্ধে বলেনঃ “আমরা অন্যায় পর্দা ছাড়িয়া আবশ্যকীয় পর্দা রাখিবো ৷ প্রয়োজন হইলে অবগুণ্ঠনসহ মাঠে বেড়াইতে আমাদের আপত্তি নাই৷” — বেগম রোকেয়ার এসকল উক্তি প্রমান করে যে তিনি ধর্ম বিদ্বেষী তো ননই পুরুষ বিদ্বেষীও নন বরং ইসলামের অনুসরণেই ‘নারী মুক্তি সংগ্রামে’ নিবেদিত প্রাণ ছিলেন তিনি ৷ সুতরাং তাঁকে ‘নারীবাদী’ বলে অপব্যাখ্যায় না নিয়ে আমরা বলবোঃ বেগম রোকেয়া নারী মুক্তি আন্দোলনের পথিকৃৎ৷
পরিশেষে বলবো, শিশু কাল থেকে বেগম রোকেয়াকে প্রজ্জলিত করতে, সমাজের বুকে এগিয়ে নিতে, প্রতিকূল পরিবেশেও বলিষ্ঠতার সাথে প্রতিষ্ঠিত হতে যাঁদের অবদান তাঁর পেছনে ভূমিকা রেখেছিলো তাঁরা আর কেউ নন; সেই পুরুষ জাতই ৷ বিশেষ ভাবে তাঁর বড় ভাই, তাঁর স্বামীর নাম উল্লেখযোগ্য৷
এক্ষণে মনে পড়ে যায় বিদ্রোহী কবির সেই যুগান্তকারী চরণঃ ‘এ বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যানকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর৷”— এটা চিরন্তন সত্য যে একটি সুস্থ-সুষ্ঠু সমাজ গড়ে তুলতে শুধু নারীর একলা পদচারণা নয় বরং অবশ্যই পুরুষের নির্ভরযোগ্য, বলিষ্ঠ হাতের একাত্মতার প্রয়োজন আছে তাই আমরা স্বতঃই বলতে পারি; ধর্মবিদ্বেষী ,পুরুষ বিদ্বেষী নারীবাদিতার স্লোগানে নয় বরঞ্চ বেগম রোকেয়ার স্বপ্নকে বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে নিতে হবে “নারী অধিকার আন্দোলনের ” স্লোগানে৷ যা তাঁর রচনাতেই প্রমানিত৷

সহায়ক গ্রন্থঃ রোকেয়া রচনাবলী
লেখিকাঃ কবি ও লেখক৷ ( অবঃ প্রঃ শিঃ ৷ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর, ঢাকা৷) সাহিত্যসংস্কৃতি বিভাগ প্রধানঃ সামাজিক সংগঠন “নারী অধিকার আন্দোলন৷”

 

সৌদি আরবের প্রথম নারী নভোচারী রায়ানাহ বার্নাবি

 

সৌদি আরবের ইতিহাসে প্রথম নারী নভোচারী ৩৩ বছর বয়সী সৌদি নাগরিক  রায়ানাহ বার্নাবি। সৌদি আরবের ভিশন-২০৩০ পূরণের জন্য এএক্স টু মহাকাশ মিশনে যোগ দেয় এ দেশটি।

বার্নাবি বায়োমেডিকেল সায়েন্সে দুটি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি নিউজিল্যান্ডের ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই বিষয়ে স্নাতক এবং আলফাইসাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন।

এ ছাড়া গবেষণাগার বিশেষজ্ঞ হিসেবে বেশ খ্যাতি রয়েছে তার। ক্যান্সার স্টেম সেল গবেষণায় প্রায় এক দশকের মতো কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন রায়ানাহ।

আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের (আইএসএস) মিশনে সৌদি পুরুষ নভোচারী আলি আল-কারনির সঙ্গে যোগ দেন রায়ানাহ বার্নাবি।

উল্লেখ্য, প্রথম আরব দেশ হিসেবে ২০১৯ সালে নিজেদের এক নাগরিককে মহাকাশে পাঠিয়েছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত।সেসময় সংযুক্ত আরব আমিরাতের নভোচারী হাজ্জা আল-মানসুরি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে ৮ দিন অবস্থান করেছিলেন।

তথ্যসূত্র: এএফপি, রিপাবলিক ওয়ার্ল্ড