banner

সোমবার, ০৫ মে ২০২৫ ইং, ,

Daily Archives: May 4, 2025

 

ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন শেলী

নেশাগ্রস্ত স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে প্রায় দুই বছর আগে স্বামীকে তালাক দিয়েছিলেন শেলী আক্তার। স্বপ্ন দেখেছিলেন, নিজেই রোজগার করে স্বাবলম্বী হবেন। মায়ের সঙ্গে মিলে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান দিয়েছিলেন। পুঁজি তেমন না থাকলেও কোনোভাবে কেটে যাচ্ছিল তাঁর জীবন। প্রতিহিংসাপরায়ণ সাবেক স্বামীর সেটি সহ্য হয়নি। গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর ভোরে অ্যাসিড ছুড়ে মারেন সাবেক স্বামী। তখন ঘুমিয়েছিলেন শেলী।  ছুড়ে দেওয়া ওই অ্যাসিডে দগ্ধ হয়েছিলেন পাশে ঘুমিয়ে থাকা মা হোসনে আরা বেগমও (৫৫)।

অ্যাসিডদগ্ধ অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছিল মা-মেয়েকে। অ্যাসিডে শেলীর মুখ, মাথার এক পাশসহ শরীরের ১৫ শতাংশ পুড়ে যায়। মায়ের পুড়ে যায় শরীরের ১০ শতাংশ অংশ। হাসপাতালে ভর্তির পর চিকিৎসা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে শেলীর পরিবার। এ সময় শেলীর পাশে দাঁড়ায় ট্রাস্ট। প্রায় দুই মাস হাসপাতালে চিকিৎসা চলে শেলীর। চিকিৎসা সহায়তা হিসেবে শেলীকে অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য  সহায়ক তহবিল থেকে ৬০ হাজার টাকা দেওয়া হয়।

সুস্থ হওয়ার পর শেলীর পুনর্বাসনেও এগিয়ে এসেছেট্রাস্ট। অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য সহায়ক তহবিল থেকে তাঁকে ৪০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। এ টাকা পেয়ে জীবনে ঘুরে দাঁড়ানোর সম্বল পান শেলী। এখন তাঁর স্বপ্ন, মর্যাদা নিয়ে বাঁচার। তিনি বলেন,  ট্রাস্টের কাছ থেকে অর্থসহায়তা পেয়ে নতুনভাবে স্বপ্ন দেখার সাহস পেয়েছি। এই টাকা দিয়ে দোকানের জন্য টুল, চায়ের কাপ ও খাদ্যপণ্য কিনেছি।’ জানালেন, দিন শেষে খেয়ে–পরে বাঁচার মতো আয় করতে পারছেন এখন।

অ্যাসিড ছোড়ার মামলায় পুলিশ ঘটনার তিন দিন পর শেলীর সাবেক স্বামী মো. জাহাঙ্গীরকে ঢাকার রূপনগর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। ওই মামলায় জাহাঙ্গীরকে একমাত্র আসামি করে পুলিশ অভিযোগপত্র দিয়েছে। মামলাটি বিচারাধীন। শেলীদের মূল বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগরে। তাঁরা চট্টগ্রাম নগরে অনেক বছর ধরে থাকছেন। অভাবের কারণে শেলীর পড়াশোনা করা হয়নি। শেলীরা তিন ভাই, তিন বোন। বড় দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। তাঁরা কুমিল্লায় থাকেন। বড় দুই ভাই ভ্যান চালান। ছোট ভাই স্কুলে পড়ে। পলোগ্রাউন্ড সিআরবি এলাকায় তাঁরা থাকেন। প্রায় ছয় বছর আগে শেলীর সঙ্গে জাহাঙ্গীরের বিয়ে হয়। জাহাঙ্গীরের মূল বাড়ি রংপুরে। তবে তিনিও পলোগ্রাউন্ড এলাকায় থাকতেন। শেলীর একটি ছেলে রয়েছে। বিবাহবিচ্ছেদের পর জাহাঙ্গীর ছেলেকে রংপুরে তাঁদের বাড়িতে রেখে আসেন। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পর ছেলেকে নিজের কাছে নিয়ে আসবেন—এখন সেই দিনটির অপেক্ষায় আছেন শেলী আক্তার।

 

দমে যাননি আনিলা

আনিলা বলেন, ‘প্রায় প্রত্যেক ধাপে কষ্ট করেছি। আমি কমার্সে পড়ি তখন। আর আমার শ্রুতলেখক দেওয়া হয় বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে এমন একজনকে। তাঁকে কীভাবে বোঝাব উত্তরটা কেমন করে লিখতে হবে। অ্যাকাউন্টিং প্রিয় বিষয় ছিল, তা বাদ দিলাম। বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার ইচ্ছা থাকলেও পড়তে পারিনি। সব মিলে আমার চারপাশের গণ্ডিটা ছোট হয়ে আসছে। বেশির ভাগ জায়গায় র‍্যাম্প নেই। বাবা আর ড্রাইভার চ্যাংদোলা করে আমাকে নিয়ে যান। খারাপ লাগে। অথচ বিভিন্ন জায়গার কর্তৃপক্ষ চাইলেই একটা করে র‍্যাম্প বানাতে পারে। এই তো সেদিন রাস্তায় গর্ত থাকায় বাবা ভারসাম্য রাখতে না পারায় হুইলচেয়ার নিয়ে পড়ে গেলাম। স্বাভাবিকভাবে পড়তে বা বেড়ে উঠতে আমার মতো অন্য শিশুদের যাতে কষ্ট করতে না হয়, তা নিয়ে কাজ করতে চাই।’

জন্মের পরপরই সেরিব্রাল পালসির কারণে শারীরিক সমস্যার বিষয়টি জানতে পারেন আনিলার বাবা ও মা। সঙ্গী হয় হুইলচেয়ার। এখন পর্যন্ত আনিলা দুই হাত ও দুই পা দিয়ে কিছু করতে পারেন না। সব কাজেই মায়ের সাহায্য নিতে হয়। হুইলচেয়ার কেউ টেনে না নিলে তিনি নড়তেও পারেন না। কথা বলতেও অনেক কষ্ট হয়। বই দেখে পড়তে কষ্ট হয় বলে একজন পড়ে শোনান। লিখতে পারেন না বলে শ্রুতলেখক লাগে সব পরীক্ষায়। কিন্তু আনিলার বুদ্ধিমত্তা সব প্রতিবন্ধকতাকে ম্লান করে দিয়েছে। হুইলচেয়ারে জীবনের গণ্ডি আটকে যাওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি আনিলার।

আনিলা গান শিখছেন। আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মূল বক্তা হিসেবে বক্তব্য দিয়েছেন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, সমাজসেবা অধিদপ্তরের বর্ষপঞ্জি, বুকলেটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আনিলার তোলা ছবি জায়গা করে নিয়েছে। আনিলা বললেন, ‘নিজে স্বপ্ন দেখতে ও অন্যকে স্বপ্ন দেখাতে চাই। পেছনের কথা ভুলে সামনে আগাতে চাই।’

মেয়ে আনিলাকে একটু ভালো রাখার জন্যই মা মারুফা হোসেন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন স্কুল ফর গিফটেড চিলড্রেন ও তরী ফাউন্ডেশন। বর্তমানে তিনি পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের নিয়ে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে সরকারের কাছ থেকে পেয়েছেন বিশেষ সম্মাননা। আর আনিলার বাবা আশফাক-উল কবীর চাকরি ছেড়ে মেয়েকে সময় দিচ্ছেন আর পাশাপাশি এ প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁরা স্বপ্ন দেখছেন, নিজের মেয়ে এবং এ ধরনের সমস্যায় যারা আছে তাদের জন্য একটি কমপ্লেক্স তৈরির। যেখানে আইনি সহায়তাসহ সব ধরনের সহায়তা পাওয়া যাবে।

বেশির ভাগ স্বাভাবিক স্কুল আনিলাকে ভর্তি করতে চায়নি। অজুহাত ছিল, আনিলাকে ভর্তি করলে অন্যান্য অভিভাবক তাঁদের সন্তানদের স্কুল থেকে নিয়ে যাবেন। কোনো কোনো স্কুল ভর্তি করলেও দোতলায় ক্লাস থাকায় পড়া সম্ভব হয়নি। কোনো কোনো স্কুলের চরম অসহযোগিতা আনিলা ও তাঁর বাবা–মায়ের যন্ত্রণাকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিত। একটি স্কুল নিচতলায় বসে ক্লাস করতে দিলেও আনিলার ঠাঁই হয়েছিল টয়লেটের পাশে। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো, স্কুলে পড়াশোনা বাদ। যে নামকরা স্কুল ভর্তি নেয়নি, সেই স্কুলই সানন্দে তাদের কোচিংয়ে ভর্তি করে। কোচিং আর বাসায় প্রাইভেট পড়েই আনিলা ‘ও লেভেল’ শেষ করেছেন।

আনিলা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিতে এ পর্যন্ত লন্ডন, ভারত, মালয়েশিয়া, ব্যাংকক ও ভুটানে ভ্রমণ করেছেন। আর বাবা–মায়ের সঙ্গে দেশের আনাচকানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কক্সবাজারের সমুদ্র খুব টানে। বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় হুইলচেয়ার নিয়ে সমুদ্রের একদম কাছ পর্যন্ত যাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। কক্সবাজারে কোনো ব্যবস্থা নেই, তাই মন খারাপ হয়। আনিলাকে পাহাড় ততটা টানে না। কেমন যেন শান্ত পরিবেশ।

মা মারুফা হোসেন বললেন, ‘আমি যা দেখব, যা উপভোগ করব, আমি চাই আমার মেয়েও তা দেখবে ও উপভোগ করবে। আমাদের মেয়ে যা দেখতে পারবে না, আমরাও তা দেখব না। একবার মনে হলো, মেয়ে তো নৌকায় ওঠেনি। তারপর মেয়েকে নিয়ে সিলেটের লালাখালে নিয়ে নৌকায় তুললাম। মেয়ে সেন্ট মার্টিন, ছেঁড়া দ্বীপের সৌন্দর্য উপভোগ করবে না, তা হতেই পারে না।’

কিন্তু তারপরও মায়ের মন খারাপ হয়। তিনি তাঁর ১৯ বছর বয়সে যা যা করতেন, তা তো মেয়ে করতে পারছে না। তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক বা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা না দিয়ে সময়টুকু দেন মেয়েকে। ছোটবেলা থেকেই মেয়ের সঙ্গে নানান গল্প করেন। সব তথ্য জানান। ইচ্ছে করেই বুয়া এলে কী বলতে হবে বা এ ধরনের নানান টুকিটাকি দায়িত্ব দেন মেয়ের ঘাড়ে, যাতে করে মেয়ে ক্ষমতায়িত হতে পারে। কেননা একদিন বাবা-মাকে ছাড়াই এ পৃথিবীতে মেয়েকে টিকে থাকতে হবে। সেই প্রস্তুতি চলছে মেয়ের ছোটবেলা থেকেই।

আনিলার মা বলেন, অনেকে ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে হুইলচেয়ার নিয়ে কথা আর হুইলচেয়ার দেখাতে থাকে। মেয়েকে অটিস্টিক বলে। মেয়ের যে অর্জন, তা কেউ জানতে চায় না। মা বললেন, মেয়েকে নিয়ে বের হলে মানুষজনও হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। সমুদ্র না দেখে মেয়েকে ঘুরেফিরে দেখতে থাকে। আনিলা যোগ করলেন, ‘একবার হাসপাতালে ভর্তি হলাম। একজন নার্স বললেন, এই ভাঙা হাতে কেমনে করে ইনজেকশন পুশ করব?’

আনিলা যখন শিশু তখন সেভ দ্য চিলড্রেনের ন্যাশনাল চিলড্রেন প্যানেলের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে হন গ্লোবাল চিলড্রেন প্যানেলের সদস্য। ২০১১ সালে লন্ডনে এ প্যানেলের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের শিশুদের প্রতিনিধিত্ব করেন। তরী ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে গ্রামে গিয়ে প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির কাজ করছেন। গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে নিয়েছেন ‘সুবর্ণ নাগরিক’–এর কার্ড।

আনিলার বাবা আশফাক-উল কবীর বলেন, ‘হুইলচেয়ার কোনো সমস্যা না, সমস্যা হলো আমাদের সমাজের নানান অব্যবস্থাপনা ও মনমানসিকতা। আনিলা আমাদের জন্য কোনো সমস্যা না। ওর মধ্যে অনেক সম্ভাবনা। আমরা চাই সম্ভাবনাটুকু কাজে লাগাতে।’

মা মারুফা জানালেন, আনিলাকে নিয়ে তাঁদের মধ্যে কোনো পারিবারিক বিরোধ তৈরি হয়নি। পরিবারে স্বামী ও অন্যরা সব সময় সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।