banner

রবিবার, ০৪ মে ২০২৫ ইং, ,

Daily Archives: May 4, 2025

 

বিশ্বের যেসব নারী নেত্রী লড়ে যাচ্ছেন মানবাধিকার রক্ষার লক্ষ্যে

নেতৃত্বে নারীর অবদান অনেক আগে থেকেই। সেই প্রচীন কালে কৃষিকাজে, এরপর সংসার নামক প্রতিষ্ঠানে। মাঠে-ময়দানে, রাজনীতিতেও সে সমানে পা মিলিয়েছে পুরুষের সাথে। আসলে যারা সব শেকল ভেঙ্গে নিজের অধিকারের জন্য, গোষ্ঠীর অধিকারের জন্য সূর্যের নিচে প্লাকার্ড হাতে আন্দোলনে নেমেছেন তারা আর নিজেকে নারীত্বের গন্ডিতে বেঁধে রাখেন নি। তারা সেই সীমা পেরিয়ে মানুষ হয়ে দাড়িয়েছেন, নিজের মুক্তিই শুধু নয়, মুক্তির পথ করেছেন জাতির। তাই তো তারা নেতা। বিশ্বের এমন সব সাহসী নারীর কথা জানব।
 
শিরিন এবাদি
ইরানের মত একটি দেশে শিরিন এবাদি একজন সফল মানবাধিকার কর্মী। এই মৌলবাদি দেশেই তিনি তাঁর কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন। শুরুটা হয় ১৯৭৯ সালে। এবাদি ছিলেন একজন ইরানের প্রথম নারী বিচারক, কিন্তু কোর্টের একজন সাধারণ ক্লার্ক হিসেবে তাঁর ডিমোশন রিয়ে দেওয়া হয়। কারণ? কারণ তিনি একজন নারী। হতাশ হওয়ার বদলে, পিছিয়ে পড়াকে মেনে নেওয়ার বদলে তিনি নিজের প্রতি অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। সেই লড়াই-ই পরবর্তীতে তাঁকে মানবাধীকারের প্রশ্নে সোচ্চার করে। নিজের প্রতি হওয়া অন্যায় তাঁকে সকল অবিচারের প্রতি লড়তে উৎসাহী করে তোলে। একজন লইয়ার হিসেবে তিনি সহযোগিতা করেছেন অসহায় কিন্তু ন্যায়বিচার প্রত্যাশী মানুষদের। তাদের মধ্যে ছিল নারীরা, রাজনৈতিক বিপ্লবীরা। তিনি ইরানের বিবাহ সংক্রান্ত আইন সংশোধনেও অবদান রাখেন, বিশেষ করে তালাকের ক্ষেত্রে, সন্তানের দায়িত্ব কার কাছে যাবে সেসব বিষয়ে। পরিবর্তনের জন্য তাঁর এই লড়াই এর মূল্য তাঁকে দিতে হয় নিজের স্বাধীনতা দিয়ে। ৩ সপ্তাহ জেলে আটকে রাখা হয় তাঁকে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় যখন তাঁকে তাঁর পেশায় ৫ বছরের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এতসব চ্যালেঞ্জের মধ্যেও জয় হয় তাঁর। ২০০৩ সালে প্রথম মুসলিম নারী শিরিন এবাদি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। নিজের প্লার্টফর্মকে তিনি এখন স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক মানবাধীকার সচেতনতার কার্যক্রমে ব্যবহার করেন।
 
রানী রানিয়া
রানী রানিয়া আল-আব্দুল্লাহ জর্ডানের রানী হন ২৯ বছর বয়সে, যখন প্রিন্স ২য় আব্দুল্লাহ বিন আল-হুসেইন ১৯৯৯ সালে ক্ষমতায় বসেন। কিন্তু তিনি আর দশ জন ক্ষমতাবান সুন্দরী নারীদের মতই বিলাসী জীবনযাপন করেন নি। তিনি মানবাধীকারের জন্য কাজ করেছেন, সহায়তা দিয়েছেন নারী ও শিশুদের, আইনি পরামর্শ দিয়েছেন তাদের অধিকারের পক্ষে। তিনি জর্ডান মানবাধিকার কমিশনের প্রধান, ফ্যামিলি সেফটি কাউন্সিল এবং ইউনিসেফ গ্লোবাল লিডারশিপ ইনিশিয়েটিভের মেম্বার। তিনি মধ্যপ্রাচ্যের বৈষম্যমূলক আইন সংশোধনে কাজ করে যাচ্ছেন। মানবাধিকার এবং সাংস্কৃতিক সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। আইটি বিভাগকে সামনে নিয়ে আসতেও পছন্দ করেন তিনি। তিনি বিশ্বাস করেন শিক্ষা এবং সুযোগ মানুষের প্রতিভাকে তুলে ধরতে সাহায্য করে। তিনি ২০০২ সালে বিশ্ব ইকনোমিক ফোরামের বোর্ড মেম্বার হন। প্রতিষ্ঠা করেন ‘The Queen Rania Center for Entrepreneurship’। এই প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ দেন এবং যাবতীয় অর্থনৈতিক গন্ডি পেরিয়ে আসার জন্য সহায়তা দেন।
 
ওবিয়াগেলি এজেক্বেসিলি
২০১৪ সালে বোকো হারামের অধীনে চরমপন্থীরা মেয়েদের ডর্মে হামলা করে এবং ২০০ জন স্কুলছাত্রীকে অপরণ করে। এই ভয়ংকর ঘটনার প্রেক্ষিতে শুরু হয় #BringBackOurGirls ক্যাম্পেইন। এই ক্যাম্পাইনে মিশেল ওবামা, মালালা ইউসুফজাই, এমা ওয়াটসনের মত ব্যাক্তিত্বরা একই হ্যাশট্যাগ দিয়ে টুইট করে সমর্থন জানান। কিভাবে শুরু হয়েছিল এই আন্দোলনের? ওবিয়াগেলি মানবাধীকার কর্মী হওয়ার পাশাপাশি নাইজেরিয়ার শিক্ষা মন্ত্রী এবং বিশ্ব ব্যাংক আফিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিনি যোগাযোগ করেন সরকারি এজেন্সিগুলোর সাথে, টিভি স্টেশনে এবং রাজনৈতিক ব্যাক্তিবর্গের সাথে যাতে তাঁর মেয়েদের ফিরিয়ে আনা যায়। তিনি তাঁর সবরকম ক্ষমতা ব্যবহার করেন, শ্রম দেন এবং আরও ২ জন নাইজেরিয়ান নারীসহ বিশাল আন্দোলনটি দাঁড় করান। তিনি তাঁর ক্যাম্পাইন শুরু করেছিলেন নাইজেরিয়ার রাজধানী আজুবায়। এই টুইটার হ্যাশট্যাগ পরবর্তীতে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময় এবং সৃষ্টি করে অপ্রতিরোধ্য অনলাইন আন্দোলনের।
 
তাওয়াক্কুল কারমান
তিনি একজন বিস্ময়কর আত্মবিশ্বাসী নারী মানবাধীকারকর্মী। ইয়েমেন তাঁর দেশ, যে দেশ কিনা বিশ্ব ইকনোমিক ফোরাম দ্বারা নারীদের জন্য সবচেয়ে নিকৃষ্ট দেশ হিসেবে স্বীকৃত। ইয়েমেনে নারীকে থাকতে বলা হয় ঘরে, চাকরী তো দূরের কথা পড়াশোনা থেকেও দূরে রাখা হয় তাদের। ৮ বছর বয়স থেকেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় কন্যা শিশুদের। তালাকের ক্ষেত্রেও তারা হয় বৈষম্যের শিকার। শুধু নারী নয়, মৌলিক অধিকার অনেক ক্ষেত্রে পায় না পুরুষও। এমন একটি দেশে সম্পূর্ণ স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে গণমানুষের অধিকারের জন্য কাজ করেছেন কারমান। মানবাধীকার এখানে অনেক রকম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। সাংবাদিকদের লাবচিত করা হয়, তরুণ বিদ্রোহীদের মেরে পর্যন্ত ফেলা হয়। এমনই অন্ধকার সময়ে ‘mother of the revolution’ কারমান কাজ করে গেছেন। তিনি একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন, যার নাম Women Journalists without Chains (WJWC)। প্রতিষ্ঠানটি মিডিয়া কর্মীদের অধিকার এবং তাদের প্রতি হওয়া অবিচার নিয়ে কাজ করে। “Mother of the revolution” এর পাশাপাশি তাঁকে ‘Iron Woman’ ও বলা হয়। তাঁর কন্ঠস্বর তরুণ সমাজ সহ অধীকারের লড়াইয়ে সোচ্চার প্রতিটি মানুষকে। এজন্যে তাঁকে অনেকবার লাঞ্চিত হতে হয়েছে। জেলেও যেতে হয়েছে। ২০১১ সালে তিনি নোবেল শান্তি পুরষ্কার পান।

 

বর্তমান বাস্তবতায় চিরঞ্জীব রোকেয়া

আপনার ১৩৬তম জন্মদিনে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা জানাচ্ছি। আপনার সঙ্গে প্রথম পরোক্ষ পরিচয় ঘটেছিল ১৯৫৯ সালে। ঢাকার নারী শিক্ষা মন্দির স্কুলে নবম শ্রেণিতে দ্রুতপঠন হিসেবে পাঠ্য ছিল রোকেয়া জীবনী। আপনার পরম স্নেহের শামসুন্নাহার মাহমুদ লিখেছিলেন সেই জীবনী বইটি। নারী শিক্ষা মন্দির স্কুলের শুভানুধ্যায়ী পরিদর্শক ছিলেন আপনার অন্যতম স্নেহের ‘ফুলকবি’ সুফিয়া কামাল। সেই সময় আমার এবং সহপাঠী সকলের হৃদয়ে আপনি শিক্ষাব্রতী তপস্বী রূপে আরাধ্য হয়ে উঠলেন।

আপনাকে প্রত্যক্ষ জানলাম বাংলা একাডেমি, ঢাকা থেকে ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত রোকেয়া রচনাবলী পাঠ করে। পাতায়-পাতায় আপনার হৃৎস্পন্দন অনুভব করা সেই যে শুরু হলো, আজ অবধি তার বিরাম নেই। আপনার লেখাগুলোর মধ্যে দেশ-কাল-সময়ের সীমানা ছাড়িয়ে যুগ যুগ ধরে আপনার অস্তিত্ব প্রবহমান থাকবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

আপনার দুজন স্নেহভাজন ব্যক্তিত্ব, শামসুন্নাহার মাহমুদ (১৯০৮-৬৪) ও সুফিয়া কামাল (১৯১১-৯১) লিখেছেন স্মৃতিকথা। ১০০ বছর আগে আপনার প্রতিষ্ঠিত (১৯১৬) নারী সংগঠন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’-এর সদস্যদের অনেকেই এবং আপনার প্রতিষ্ঠিত ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল’ (১৬ মার্চ, ১৯১১)-এর ছাত্রীদের কয়েকজন আপনার লেখা ও কাজের কথা লিখেছেন তাঁদের স্মৃতিকথায়। সেসব কর্মকাণ্ড আপনি চালিয়েছেন অবিভক্ত ভারতবর্ষের কলকাতায়। জন্ম আপনার (৯ ডিসেম্বর, ১৮৮০) বাংলাদেশের তৎকালীন পূর্ববঙ্গের রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে। সেই গ্রামের জমিদার জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের ও রাহাতুন্নেসা সাবেরা দম্পতির পঞ্চম সন্তান ছিলেন আপনি। আপনার বড় ভাই আবোল আসাদ ইব্রাহিম সাবের এবং বড় বোন করিমুন্নেসা খানম আপনার ইংরেজি-বাংলা ভাষা সাহিত্য শিক্ষাচর্চার শিক্ষক ছিলেন। এসব তথ্য আপনার লেখা থেকে আমরা জানতে পারছি।
আপনার সময়কালে যাঁরা সরাসরি আপনার সঙ্গে কাজ করেছেন শিক্ষাকেন্দ্রে ও নারী সংগঠনে, তাঁরা এবং যাঁরা কলকাতায় পড়াশোনা করেছেন ১৯৪৭-এর আগে তাঁরা ১৯৪৭-এর দেশভাগের পরে পূর্ব বাংলায় ফিরে নারীশিক্ষার বিস্তারে ও নারী আন্দোলনে যুক্ত হতে শুরু করেন। তাঁদের এসব কর্মকাণ্ডের মূল প্রেরণাদাত্রী ছিলেন আপনি। আপনার আশৈশব চেনাজানা পূর্ববঙ্গের ঢাকায় আপনি ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বরের আগে কোনো একসময় বোনের মেয়ের (সম্ভবত) বিয়ে উপলক্ষে এসেছিলেন। দেশভাগের পর সেই পূর্ববঙ্গের মুসলিম নারী জাগরণের মধ্যমণি হয়ে উঠলেন আপনি।

ব্যাপকভাবে বাংলাদেশের নারী আন্দোলনে সামাজিক-রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপে ‘রোকেয়া চর্চা ও গবেষণার স্বর্ণযুগ’ উৎসারিত হয়েছিল ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে। শৈশব-কৈশোর থেকে আমরা এবং আমাদের পূর্বসূরি নারী ব্যক্তিত্বরা যারা আপনার জীবনসংগ্রাম থেকে নারীর অধিকার অর্জনের বিপ্লবী দীক্ষা পেয়েছিলাম তারা সকলে দলমত-নির্বিশেষে আপনাকে মধ্যমণি করে নারীশিক্ষা ও নারীর মানবাধিকার অর্জনের আন্দোলন গড়ে তুলেছি স্বাধীন বাংলাদেশে।

১৯৮০ সালে আপনার জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের স্বতঃস্ফূর্ত জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল নারী আন্দোলনের নেতৃত্বে। রাজনৈতিক বৈরিতা থাকা সত্ত্বেও সব বাধা ডিঙিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে আপনার নামে শতবর্ষ উপলক্ষে আপনার ছবিসহ একটি ডাকটিকিট প্রকাশে এবং বাংলাদেশের সব বিদ্যালয়ে ছুটির ঘোষণা (৯ ডিসেম্বর, ১৯৮০) দিতে বাংলাদেশের নারী সংগঠন আন্দোলনের দাবি বাস্তবায়িত হয়েছিল। সেই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও ঘোষণা থেমে গেছে। আপনার নাম প্রচার বা আপনার স্মৃতি অক্ষয় রাখার প্রচেষ্টামাত্র বলে আমরা সেসব উদ্যোগ অব্যাহত রাখার কথা ভাবিনি। এসব কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের নতুন ধরনের ‘অবরোধবাসিনী’দের মুক্তি অভিলাষ রূপেই আমরা অব্যাহত রাখতে চাই।
আপনি যত দূরেই থাকুন না কেন, আমরা প্রতিনিয়ত আপনার লেখা, চিন্তাধারা, জীবনচর্চা, নারী প্রগতির লক্ষ্যে আপনার প্রতিটি পদক্ষেপ, জীবনযুদ্ধ এবং সাফল্য থেকে আমাদের এই যুগের নারী আন্দোলনের শক্তি ও পথ তৈরি করে চলেছি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিচ্ছি। আপনার অমলিন হাসিমাখা মুখ দেখার জন্য মানসপটে যখন চোখ রাখছি তখন আপনার হাসি ও বেদনামিশ্রিত মুখ ভেসে উঠল। আপনি যেন আবারও বলে উঠলেন ‘আগুন লেগেছে ঘরে, আমি শুধু এনেছি সংবাদ! সুখ-নিদ্রা দিয়াছি ভাঙায়ে!

আপনি জানতেন এবং জীবনভর বলে গেছেন, এমনকি শেষনিশ্বাস ফেলার আগেও ‘নারী অধিকার’ (অসমাপ্ত) লেখাটিতে ‘তালাক’-এর বিষয়ে পুরুষের একতরফা অপ-অধিকার নিয়ে হাস্যরসের বয়ানে তীব্র কশাঘাত করেছেন সমাজ-রাষ্ট্র-আইনের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে। লিখেছেন: আমাদের ধর্মমতে বিবাহ হয় পাত্র-পাত্রীর সম্মতি দ্বারা। তাই খোদা না করুক, বিচ্ছেদ যদি আসে, তবে সেটা আসবে উভয়ের সম্মতিক্রমে। কিন্তু এটা কেন হয় একতরফা, অর্থাৎ শুধু স্বামী দ্বারা? (নারীর অধিকার, ৯ মার্চ, ১৯৩২)

বাংলাদেশের নারী আন্দোলন এই বিষয়ে তীব্র আন্দোলন চালিয়েছে, আন্তর্জাতিক সিডও সনদের সমর্থন পেয়েছে কিন্তু বাস্তবে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সরকার নারী-পুরুষের অসম বিবাহবিচ্ছেদের আইনের পক্ষেই স্থির থাকল, দিল ধর্মের দোহাই।

বাল্যবিবাহ বন্ধ বিষয়ে আপনার এবং রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরসহ বহু সমাজসংস্কারকের ইতিবাচক পদক্ষেপ অনুসরণ করে বাংলাদেশে ১৯৪৭ থেকে আজ অবধি ৬৯ বছর ধরে সকল জাতি-ধর্মনির্বিশেষে সর্বস্তরের নারী ও সামাজিক-মানবাধিকার-আইনজীবী সমিতিগুলোর দাবি উপেক্ষা করে সম্প্রতি সরকার দোদুল্যমান আইন তৈরি করার ঘোষণা দিয়েছে। বিস্তারিত জেনে নারী আন্দোলন সংগঠনগুলো বাল্যবিবাহ বিষয়ে সরকারের নেতিবাচক ঘোষণা ও আইনের পদক্ষেপবিরোধী কর্মসূচি নিচ্ছে।

এসব শুনে যেন আপনি আবারও বলে উঠলেন, ‘আমরা অকর্মণ্য পুতুল-জীবন বহন করিবার জন্য সৃষ্ট হই নাই, একথা নিশ্চিত।’ (স্ত্রী জাতির অবনতি)
আবারও বলছেন আপনি, ‘বর দুর্লভ হইয়াছে বলিয়া কন্যাদায়ে কাঁদিয়া মরি কেন? কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিত করিয়া কার্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজের অন্নবস্ত্র উপার্জন করুক।’ (স্ত্রী জাতির অবনতি)
যেন বলছেন, ‘আমাদের যথা সম্ভব অধঃপতন হওয়ার পর দাসত্বের বিরুদ্ধে কখনও মাথা তুলিতে পারি নাই; তাহার প্রধান কারণ এই বোধ হয়, যখনই কোন ভগ্নি মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনই ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন রূপ অস্ত্রাঘাতে তাহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে।’ (স্ত্রী জাতির অবনতি)
শেষে একটি জোর আহ্বান জানালেন আপনি, ‘অতএব জাগো, জাগো গো ভগিনি।’
আপনার প্রতিটি আহ্বানে আমরা এগিয়ে চলেছি। আজ বাংলাদেশে একদিকে সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-রাষ্ট্রীয় সাফল্যের পথ খুলেছে, নারীর অদম্য পদযাত্রা চলেছে। অন্যদিকে নারীর পারিবারিক, সামাজিক ও আইনগত অধিকারের পথগুলো বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। এই বাধাগুলো সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পারিবারিক, রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপটে নারী নির্যাতনের বহুবিধ অপরাধ ঘটিয়ে চলেছে। বলা যায়, নারীর বিরুদ্ধে পরিবার, সমাজ, সংস্কৃতি, প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্র একধরনের জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটাচ্ছে। প্রগতির পথ বন্ধ করছে। এই পরিস্থিতিতে আপনার জীবনসংগ্রাম এবং নারী আন্দোলনের বাস্তব পথনির্দেশ আমাদের নারী আন্দোলনের জন্য আজও যুগোপযোগী বলেই আমার বিশ্বাস।
আপনি বলেছেন যৌতুক প্রথার বিষময় পরিণতির বিষয়ে, বলেছেন দাম্পত্য সম্পর্ক বিষয়ে, পারিবারিক সম্পত্তিতে ভাই-বোন, নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা, আরও বলেছেন ‘স্বাধীনতা অর্থে পুরুষের ন্যায় উন্নত অবস্থা বুঝিতে হইবে।…পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব। যদি এখন স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করিলে স্বাধীনতা লাভ হয়, তবে তাহাই করিব।…যে পরিশ্রম আমরা স্বামীর গৃহকার্যে ব্যয় করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসা করিতে পারিব না?’
আমরা আপনার কথাগুলোই যেন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলে যাচ্ছি বছরের পর বছর নতুন যুগের পথ সন্ধানে। আপনি সেই ১৯০৪ সালে মতিচুর বইয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা সমাজেরই অর্ধঅঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কিরূপে? কোনো ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে?’ সেই লেখাতেই বলেছিলেন, ‘জগতের যে সকল সমাজের পুরুষেরা সঙ্গিনীসহ অগ্রসর হইতেছে, তাঁহারা উন্নতির চরম সীমায় উপনীত হইতে চলিয়াছেন।’
কী আশ্চর্য এবং দুঃখের কথা, আজ ১১২ বছর পরেও আমরা সেই কথাই বলে চলেছি। প্রগতিশীল পুরুষ সমাজও বলে চলেছে, আহ্বান জানাচ্ছে ‘নারীর পাশে পুরুষ’ স্লোগান নিয়ে। এগিয়ে চলতে চলতে, হোঁচট-বাধা-নির্যাতনের শিকার হতে হতে সেসবের প্রতিবাদে ধর্মমত-নির্বিশেষে বাংলাদেশের নিরক্ষর দরিদ্র, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, উপার্জনশীল, উচ্চবিত্ত শ্রেণির ও অবস্থার নারীরা একই সারিতে দাঁড়িয়ে মানববন্ধন করছেন।
আপনার জীবনী পাঠ্য হিসেবে বন্ধ হয়ে গেছে স্কুলে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর শিক্ষাকেন্দ্রে রোকেয়া পাঠ এখন ‘জেন্ডার সচেতনতা’ বৃদ্ধির লক্ষ্যে কার্যকর হয়েছে। আপনার রচনাবলি এখন বাংলাদেশের নারীবাদী তাত্ত্বিক হিসেবে আপনাকে বৈশ্বিক নারীবাদী তাত্ত্বিকদের সমপর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে। নারী আন্দোলনের এই সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জনের ক্ষেত্রে Sultana’s Dream বা সুলতানার স্বপ্ন সর্বশ্রেষ্ঠ দিশারি বললে ভুল হবে না। তবে আপনার সমগ্র রচনাবলি একই পথের দিশারি হয়ে আছে।
আপনার দেখানো পথ আরও প্রশস্ত হবে যুগে যুগে, এই বিশ্বাসই আমাদের এ বছরের রোকেয়া দিবসের বহু অর্জনকে সফল করবে বলে বিশ্বাস করি।