Daily Archives: May 1, 2025
ভিন্ন স্বাদের এই পুডিংটি আগে তৈরি করেছেন কি?
মিষ্টি খাবারের মধ্যে পুডিং খাবারটি বেশ জনপ্রিয়। ডিম, দুধ ও চিনির সংমিশ্রণে তৈরি এই খাবারটি খেতে পছন্দ করেন না, এমন মানুষ খুব কম আছেন। দুধ ডিম ছাড়াও পুডিং তৈরি করা সম্ভব! অবাক হচ্ছেন? অবাক হওয়ার কিছু নেই, দুধ ডিম ছাড়া সুজি দিয়ে তৈরি এই পুডিংটি তুরস্কে বেশ জনপ্রিয়। ভিন্ন স্বাদের এই পুডিংটি তৈরির রেসিপিটি আসুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক।
উপকরণ:
সিরাপ তৈরির জন্য
১.৫ কাপ চিনি
১.৫ কাপ পানি
সুজির পুডিং তৈরির জন্য
৪ কাপ দুধ (১ লিটার)
৩ টেবিলচামচ সুজি
৩ টেবিলচামচ ময়দা
২ টেবিলচামচ কর্ণ ফ্লাওয়ার
১ টেবিলচামচ মাখন
১ টেবিলচামচ ভ্যানিলা এসেন্স
১ কাপ চিনি
চকলেট পুডিং তৈরির জন্য
৪ কাপ দুধ
৪ টেবিলচামচ চিনি
১ টেবিলচামচ ময়দা
২ টেবিলচামচ কর্ণ ফ্লাওয়ার
১.৫ টেবিলচামচ কোকো পাউডার
৮০ গ্রাম ডার্ক চকলেট
টোস্ট বিস্কুট
প্রণালী:
১। প্রথমে প্যানে ক্যারামেল সিরা তৈরি করার জন্য চিনি দিন। চিনিগুলো বাদামী রং হয়ে আসলে এতে কিছুটা পানি দিয়ে দিন।
২। ক্যারামেল সিরা তৈরি হয়ে গেলে চুলা থেকে প্যান নামিয়ে ফেলুন।
৩। এরপর ওভেন ট্রেতে টোস্ট বিস্কুটগুলো সাজিয়ে রাখুন এবং তার উপর ক্যারামেল সিরা দিয়ে দিন।
৪। এখন আরেকটি পাত্রে সুজি, কর্ণ ফ্লাওয়ার, ময়দা এবং চিনি দিয়ে কিছুক্ষণ নাড়ুন।
৫। আস্তে আস্তে এর মধ্যে দুধ দিতে থাকুন এবং নাড়তে থাকুন।
৬। এটি ঘন হয়ে আসলে এতে মাখন এবং ভ্যানিলা এসেন্স দিয়ে দিন।
৭। মাখন গলে গেলে চুলা বন্ধ করে দিন।
৮। এবার বিস্কুটের উপর সুজির মিশ্রণটি ঢেলে দিন। ভাল করে বিস্কুটের উপর লাগিয়ে দিন। যেন একটি লেয়ার তৈরি হয়।
৯। একটি পাত্রে ময়দা, কর্ণ ফ্লাওয়ার, কোকো পাউডার, চিনি ভাল করে মেশান।
১০। তারপর এতে দুধ মিশিয়ে দিন। দুধ ভাল করে নাড়ুন। তারপর চুলায় জ্বাল হতে দিন।
১১। চুলায় দিয়ে বার বার নাড়তে থাকুন। ঘন হয়ে এলে এতে চকলেট দিয়ে দিন।
১২। চকলেট ঘন হয়ে এলে এটি বিস্কুট এবং সুজির উপর ঢেলে দিন।
১৩। ব্যস তৈরি হয় গেল মজাদার পুডিং টোস্টেড ব্রেড কেক।
টিপস:
আপনি চাইলে এটি কয়েক ঘন্টা ফ্রিজে রাখতে পারেন। ফ্রিজ থেকে বের করে পরিবেশন করতে পারেন।
উদ্যোগ ফেসবুকেই
চামড়ায় তৈরি ছেলেদের একটি স্যান্ডেলের ছবি। স্যান্ডেলের মাপ দেওয়া আছে। দাম দেওয়া আছে। ছবির নিচে অনেকেই স্যান্ডেলটি কেনার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছেন। অনেকে ছবির মাপের চেয়ে ছোট বা বড় স্যান্ডেল আছে কি না জানতে চেয়েছেন। একইভাবে মডেল বিভিন্ন ধাঁচের ব্যাগ হাতে, কাঁধে নিয়ে বসে আছেন, দাঁড়িয়ে আছেন। আগ্রহীরা নানান কিছু জানতে চেয়েছেন। তারপর যিনি কিনতে চান তাঁর কাছে পৌঁছে গেছে ব্যাগ বা স্যান্ডেলটি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক এবং ইন্টারনেটে ই-কমার্স অনলাইন প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করে নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসা এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে। নতুন অনেকেই ঝুঁকছেন এ পদ্ধতিতে ব্যবসা করার জন্য। চামড়াজাত পণ্যের ব্যবসার ক্ষেত্রে তানিয়া ওয়াহাবের নাম পরিচিত। প্রায় ১১ বছরের অভিজ্ঞতা। তবে এবারই প্রথম ঈদের আগে ফেসবুককে ব্যবহার করে নতুন আঙ্গিকে ব্যবসায় নেমেছেন বলে জানালেন ট্যানের স্বত্বাধিকারী তানিয়া ওয়াহাব। তিনি জানালেন ট্যানের ব্যাগ, ওয়ালেট, স্যান্ডেল, বেল্ট, টিস্যু বক্সসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রির জন্য কোনো শোরুম নেই। ফ্যাক্টরি থেকে সরাসরি পণ্যের ছবি আপ হচ্ছে ফেসবুকে। স্যান্ডেলের বেলায় অনেকে মাপ বলতে পারেন না। তাঁদের ফেসবুকের ইনবক্সে তাঁর পায়ের মাপ পাঠাতে বললে সে অনুযায়ী স্যান্ডেল কুরিয়ার করে পাঠানো হচ্ছে।
তানিয়া ওয়াহাব বলেন, এখন যানজটসহ বিভিন্ন কারণে এক এলাকার মানুষ শপিংয়ের জন্য অন্য এলাকায় যেতে চান না। সব এলাকার মানুষের কাছে পণ্য পৌঁছাতে হলে বিভিন্ন এলাকায় শোরুম থাকতে হবে। খরচ অনেক বেশি। ফেসবুকে সে ঝামেলা নেই। জামালপুর, সিলেটসহ বিভিন্ন এলাকার ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে ফেসবুকের কল্যাণে। লেদার নিয়ে নতুন নারী ব্যবসায়ীরা একটি সার্কেল বা দল করে ফেসবুকে প্রচার চালাচ্ছেন। টাকার বিনিময়ে ফেসবুকে পণ্যকে প্রমোট (ফেস বুস্ট) করার সুযোগ নিচ্ছেন অনেকে। তানিয়া ওয়াহাব কারিগরের একজন অংশীদার। আড়ংসহ বিভিন্ন জায়গায় কারিগরের পণ্য সাপ্লাই দেওয়া হচ্ছে।
তানিয়া ওয়াহাব বলেন, ‘কারিগরের পণ্য বিক্রি হচ্ছে। সুনামের সঙ্গেই কারিগর তার নাম ধরে রেখেছে। তবে নিজের পরিচিতির জন্য ট্যান চালু করেছি। ট্যানারির একটি অংশ হিসেবেই ট্যান নামটি নেওয়া হয়েছে।’
‘গুটিপা’ নিয়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলেছেন নারী উদ্যোক্তা তাসলিমা মিজি। চামড়ায় তৈরি ব্যাগের ব্যবসা। এর আগে তিনি কম্পিউটার হার্ডওয়্যারের ব্যবসা করেছেন আট বছর। তাসলিমা মিজি বলেন, দোকানভিত্তিক ব্যবসা বড় ব্যবসায়ীদের জন্য। কিন্তু বেশির ভাগ নারীর পুঁজি কম। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে লোন পেতে অনেক ঝামেলা। নারীর নিজস্ব সম্পদ বলতেও তেমন কিছু নেই। অনেক সময় পরিবারও চায় না নারী ঘরের বাইরে গিয়ে ব্যবসা করুক। এই এত সব সমস্যার সমাধান ই-কমার্স বিজনেস। বর্তমানে বেশির ভাগ মানুষেরই ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে বা ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। আধুনিক ক্যামেরা ও অন্যান্য প্রযুক্তির বদৌলতে ছবিতে একটি পণ্যের বলতে গেলে পুরোটাই তুলে ধরা সম্ভব হচ্ছে। বিভিন্ন ডিজিটাল এজেন্সি পণ্যটি দ্রুত সময়ে ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিচ্ছে।
তাসলিমা জানালেন মিরপুরে তাঁর কারখানা। বাসা এলিফ্যান্ট রোডে। সার্বক্ষণিক গৃহকর্মী না থাকায় সার্ভেন্ট রুমকে তিনি পণ্যের গুদাম হিসেবে ব্যবহার করছেন। পণ্য ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য একজন এবং আরেকজন ডিজিটাল মার্কেটিং ম্যানেজার নিয়েই চলছে তাঁর এ ব্যবসা। ফেসবুক এবং অন্যান্য ই–কমার্সের বিভিন্ন ওয়েবসাইটের মাধ্যমে চলছে পণ্যের প্রচার ও ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ। আর ব্যাগের মডেল হচ্ছেন তাঁর নিজেরই বন্ধুবান্ধব। তবে তাসলিমা মিজি হেসেই বললেন, ব্যাগের ক্রেতা বন্ধুবান্ধবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই।
ঘুরে দাঁড়িয়েছেন হনুফা
‘এমন সময় গ্যাছে, তিন-চাইর দিন ভাতের পাতিল পাহায় (চুলায়) বহাইতে পারি নাই। মাইনষের তোন চাইয়াচিন্তা পোলাপানরে খাওয়াইছি। মাছ-মুকরা (মুরগি) খাই নাই বচ্ছরের পর বচ্ছর। ঘর আছিল না। বিষ্টিতে ভিজজি, শীতে কোঁকড়া দিয়া রইছি। কী যে কষ্ট করছি হেই সময়।’
এভাবেই নিজের পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণা করেন ৫৫ বছর বয়সী হনুফা বিবি। তিনি মানুষের বাসাবাড়িতে কাজ করেন। আবার অনেক সময় কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতেও কাজ করেন। একসময় দুবেলা খাবার জোটাতে না পারলেও নিজ প্রচেষ্টায় হনুফা বিবি তাঁর ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন। এখন আর না খেয়ে থাকতে হয় না। এমনকি স্থায়ী একটি মাথা গোঁজার ঠাঁইও তৈরি করেছেন।
১২ বছর বয়সে আদেল খলিফার দ্বিতীয় স্ত্রী হয়ে শ্বশুরবাড়ি আসেন হনুফা বিবি। হনুফার শ্বশুরবাড়ি বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বোরাদী গরঙ্গল গ্রামে। বাবার বাড়ি পাশের গ্রাম কলাবাড়িয়ায়। শৈশব পেরোতেই শ্বশুরবাড়ি। আর শ্বশুরবাড়ি আসতে না-আসতেই হনুফাকে কাঁধে তুলে নিতে হয় স্বামীর আগের পক্ষের সন্তানের দায়িত্ব, সংসারের হাল। গত ৯ জুলাই বোরাদী গরঙ্গলের এক বাসায় কাজ করার ফাঁকে কথা হয় তাঁর সঙ্গে।
শুরু থেকেই সংসারে টানাপোড়েন। স্বামী কিছুদিন পরপরই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঠিকমতো কাজ করতে পারেন না। সে কারণে ঘরে চুলাও জ্বলে অনিয়মিত। ছেলেমেয়ে নিয়ে আধপেটা খেয়ে, কখনো না খেয়ে দিন কাটাতে হয়। এর মধ্যেই ধরা পড়ে স্বামীর ব্লাড ক্যানসার। হনুফা বলেন, ‘হ্যার ব্লাড ক্যানসার ধরা পড়ে। ডাক্তার দেহাইতে যাইয়া জাগা-জমিন হগল খুয়াইছি। হে ভালো অইল না। মইর্যাে গেল।’
স্বামীর মৃত্যুর সময় হনুফার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। মেয়ে বিবাহযোগ্য। নিজের ছেলে রোগা। কোনো কাজ করতে পারে না। স্বামীর আগের পক্ষের ছেলে খোঁজ নেয় না। এদিকে স্বামীর চিকিৎসায় বাড়ি, সম্পত্তি সব বিক্রি করে দিতে হয়েছে। এ অবস্থায় ছেলেমেয়ে নিয়ে কী করবেন, বুঝে উঠতে পারেন না। একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েন।
মাঝেমধ্যে অন্যের ফরমাশে কাঁথা সেলাই করলেও ঘরের বাইরে গিয়ে কাজ করতে হবে—কখনো ভাবেননি হনুফা বিবি। কিন্তু বেঁচে থাকার তাগিদে ঘরের বাইরে পা রাখতে হয় তাঁকে। বলেন, ‘তহন পরথম নগরে (হিন্দুপাড়া) আহি। মাইনষের বাড়ি কাম করা শুরু করি। যে যহন বোলায়, হ্যার কামই করি। এরম কাম কইর্যাুই পোলা-মাইয়ার মুহে খাওন দেই। আস্তে আস্তে বাঁচনের স্বপন দেহি।’
বছরের ৩৬৫ দিনই হনুফা বিবি কাজ করেন। বাদ যায় না ঈদের দিনও। বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে, তীব্র শীতেও তাঁকে কাজ করতে হয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করেন। পারিশ্রমিক তিনবেলা খাবার, সঙ্গে দুই শ টাকা। রাতের খাবারটা বাড়িতে নিয়ে যান। তবে অনেকেই পারিশ্রমিকের চেয়ে বেশি টাকা দেন বলে জানান তিনি।
বাইরে পা দিয়ে হনুফা বিবি কেবল খাবারের ব্যবস্থাই করেননি, ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবতে শুরু করেন তিনি। খেয়ে না-খেয়েই করতে থাকেন সঞ্চয়। টাকা জমিয়ে ছোট হলেও একটি টিনের ঘর তোলেন; যেখানে ছেলে-ছেলেবউ-নাতি নিয়ে বসবাস করছেন। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।
মানুষের বাসায় কাজ করতে গিয়েই পড়াশোনার গুরুত্ব বুঝতে পারেন হনুফা। তিনি বলেন, ‘কাম করতে যাইয়াই বুজি লেহাপড়ার কদর। কষ্ট কইর্যারও পোলা-মাইয়ারে লেহাপড়া করাইলে আয়ের এট্টা উপায় হইত। মাইনষের বাড়ি কাম করা লাগদো না।’ তাই নাতিদের পড়াশোনায় জোর দেন তিনি। তাঁর ছেলের ঘরের এক নাতি প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। আরেক নাতি পঞ্চম শ্রেণিতে, যার রোল নম্বর ১। নাতিদের লেখাপড়ার সব দায়িত্ব হনুফা বিবিই বহন করেন।
হনুফাকে ছাড়া এলাকার কোনো বিয়েবাড়ির কাজই হয় না। এতে তাঁর পারিশ্রমিকের সঙ্গে পাঁচ শ টাকা ও একটি শাড়ি বকশিশ হিসেবে নির্ধারিত। কেউ কেউ আবার বেশিও দেন। হনুফা বলেন, ‘হগলে আমারে ভালো পায়। কাম কইর্যাে যা পাওনের, হ্যার থিকা বেশি দেয়। না অইলে বাঁচতে পারতাম না।’
হনুফা বিবি কোনো রকমে নিজের নাম লিখতে পারলেও জীবনের বাস্তবতা ভালো বোঝেন। শেষ জীবনে কাজ করতে পারবেন না। বন্ধ হয়ে যাবে রোজগার। তবে এ সময় কারও কাছে বোঝা হতে চান না তিনি। এ জন্য ব্যাংকে ৬০ হাজার টাকার ফিক্সড ডিপোজিট করেছেন। তিনি বলেন, ‘যহন বুড়া অইয়া যামু, এই টাহায় চলমু। কারও কাছে হাত পাতমু না।’
বগুড়ার জলকন্যাদের গল্প
ভোরের আলো তখনো ফোটেনি। ট্রাকস্যুট পরে একদল কিশোরী ছুটছে উদ্যানের দিকে। সকালে হাঁটতে বেরোনো কেউ কেউ তাদের দিকে তাকাচ্ছেন বিস্ময় নিয়ে। লিকলিকে গড়ন সবার। মলিন চেহারা। বয়স ১২ থেকে ১৬। কৌতূহলী ফিসফাস—এই পাতলা শরীরেও ‘মর্নিং ওয়াক’! একটু পর ঘোর কাটে তাঁদের। কৌতূহলী চোখ যায় পার্কের পুকুরঘাটে। সাঁতারের পোশাক পরে তারা দল বেঁধে পুকুরে নামছে। পুকুরের এপার-ওপার আগে থেকেই সাঁতারের জন্য আড়াআড়ি শোলা দিয়ে লাইন টানা রয়েছে। এক পাশের লাইনে প্রস্তুত মেয়েরা। অন্য পাশে একদল কিশোর সাঁতারু। মাঝখানে কোচ মাসুদ রানা বাঁশিতে ফুঁ দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল মেয়েরা। অন্যের রেকর্ড ভাঙতে ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাঁতার শুরু করল তারা।
সকালে আর বিকেলে প্রত্যন্ত গ্রাম, শহরের পাড়া-মহল্লা থেকে আসা মেয়েদের এই সাঁতারচর্চার দৃশ্য দেখা যায় বগুড়া শহরের এডওয়ার্ড পার্কের পুকুরে। কোচ মাসুদ রানা বিনা পয়সায় প্রশিক্ষণ দেন সাঁতার শিখতে আসা মেয়েদের। গ্রাম-মহল্লা ঘুরে ঘুরে সাঁতারের জন্য মেয়েদের উৎসাহও দেন তিনি। সাঁতারের প্রতি আগ্রহ বাড়াতে প্রথম দিকে কাদা-মাটির তৈরি ক্রেস্ট দেওয়া হতো মেয়েদের। এখন মাটির ক্রেস্টের বদলে মেয়েদের ঘরে ‘সোনার পদক’। বয়সভিত্তিক সাঁতারে জাতীয় পর্যায়ে বেশ কয়েকজন সোনাজয়ী হয়েছে। সাফল্যের ঝুড়িতে কারও কারও এক থেকে দুই ডজন সোনার পদক। বাংলাদেশ আনসার ও নৌবাহিনীর হয়েও সাঁতরায় কেউ কেউ। এই বয়সেই মাস গেলে বেতন পাচ্ছে। সাঁতারের সুবাদে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে মেয়েরা।
সাঁতারপাগল কোচ মাসুদ রানার বয়স ৪০ পেরিয়েছে। বগুড়া শহরের সূত্রাপুরে শৈশব কেটেছে তাঁর। পড়তেন সেন্ট্রাল হাইস্কুলে। পড়াশোনার চেয়ে সাঁতারেই ঝোঁক ছিল তাঁর বেশি। বড় তিন ভাইয়ের মতো তিনিও সোনাজয়ী সাঁতারু ছিলেন। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে রেকর্ড গড়তে পারেননি। তবে সাঁতারের নেশা কাটেনি মাসুদ রানার। এখনো সাঁতার শেখাতে ছেলেমেয়েদের খুঁজে বেড়ান তিনি। কেউ আগ্রহ দেখালে শহরে এনে সাঁতার প্রশিক্ষণ দেন। বেশির ভাগ ছেলেমেয়ের শহরে থাকার মতো সামর্থ্য থাকে না। মাসুদ রানা থাকার ব্যবস্থাও করে দেন। বর্তমানে তাঁর কাছে ১৯ জন মেয়ে সাঁতার প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। এর মধ্যে সাতজনই একাধিক সোনা ও রুপার পদক জয় করেছে। মাসুদ রানা বলেন, ‘দেশসেরা সাঁতারু হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। এখন সাঁতারে বগুড়ার মেয়েরা বিশ্বজয় করবে বলে স্বপ্ন দেখছি।’
প্রশিক্ষণ নিচ্ছে বয়সভিত্তিক জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় ২৪টি সোনাজয়ী মরিয়ম আকতার এবং তার ছোট বোন তিনটি সোনাজয়ী রোকেয়া আকতার। এই দুই বোনের বাড়ি বগুড়ার গাবতলী উপজেলার বালিয়াদীঘি গ্রামে। বাবা ইউনুস আলীর অসচ্ছল সংসার। তিন মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে মরিয়ম আকতার সবার বড়। ২০০৭ সালে মরিয়ম তখন বাড়ির পাশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত। ইউনুস আলী বললেন, ‘হঠাৎ একদিন বাড়িতে হাজির মাসুদ রানা। নিজেকে সাঁতারের কোচ পরিচয় দিলেন। মরিয়মকে সাঁতার শেখাতে চান। আকাশ থেকে পড়লাম। গ্রামের মানুষ। আমার মেয়ে মানুষের সামনে ছোট পোশাক পরে পুকুরে সাঁতার কাটবে! প্রথমে রাজি ছিলাম না। কিন্তু মেয়েটার ইচ্ছার কারণে না করতে পারলাম না। মরিয়মকে শহরের ইশকুলে ভর্তি করালেন মাসুদ রানা। নিজের বাসায় তাঁর মেয়ের কাছে রেখে দিলেন। এরপর ঘরে সোনা আনতে থাকল মেয়েটা। বড়টার সাফল্যে ছোট মেয়েটাকেও পাঠালাম তাঁর বাসায়।’
মরিয়ম বলল, ‘বগুড়ায় সেন্ট্রাল উচ্চবিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হলাম। সকাল-বিকেলে পার্কের পুকুরে মাসুদ রানা স্যারের কাছে অনুশীলন করতাম। ২০০৯ সালে ছয়টি রৌপ্যপদক দিয়ে সাফল্যের খাতা খুললাম। ২০১০ সালে রৌপ্যসহ প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হলাম। ২০১১ সালে ১০০ মিটার সাঁতারে দুটি সোনা ও দুটি ব্রোঞ্জ এবং ২০০ মিটারে দুটি সোনা ও দুটি ব্রোঞ্জ পেয়ে বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতায় সেরা হলাম। ২০১২ সালে দুটি সোনা, ২০১৩ সালে আটটি সোনাসহ তিন বিভাগে রেকর্ডসহ চ্যাম্পিয়ন হলাম। ২০১৪ সালে ১০টি স্বর্ণসহ ছয়টিতে রেকর্ড গড়ে ফের চ্যাম্পিয়ন হলাম।’ ২০১৪ ও ২০১৫ সালে কাতার ও চীনে প্রশিক্ষণ নিয়েছে মরিয়ম আকতার। এখন মেয়েদের জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতার জন্য অনুশীলন করছে। পাশাপাশি বগুড়া মহিলা মহাবিদ্যালয়ে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর দলের সাঁতারু সে।
রোকেয়া আকতারও মাসুদ রানার বাসায় থেকে সাঁতার শিখছে। পড়াশোনা করছে সেন্ট্রাল উচ্চবিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে। ২০১৫ সালে জাতীয় বয়সভিত্তিক ২০০ মিটার বুকসাঁতারে ৩ মিনিট ৮ সেকেন্ড সময় নিয়ে দুটি স্বর্ণ জয় করেছে।
বগুড়ার সেউজগাড়ি মহল্লার ফলের দোকানি রহেদুল ইসলামের তিন মেয়ের মধ্যে সবার ছোট রাশেদা খাতুন সাত বছর বয়স থেকেই পুকুরে ভাসছে। সাঁতারের পোশাক পরে পুকুরে সাঁতার কাটতে পরিবারের বাধা ছিল। কিন্তু শেষমেশ সেই বাধা অতিক্রম করেছে রাশেদা। রাশেদা বয়সভিত্তিক সাঁতারে ১৪টি সোনার পদক জয় করেছে। সাঁতরায় আনসার বাহিনীর দলের হয়ে।
বগুড়া শহরের জামিলনগরের মেয়ে মিতু আকতার পড়ে বগুড়ার সরকারি মুজিবুর রহমান মহিলা কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে। বয়সভিত্তিক সাঁতারে এ পর্যন্ত ১৩টি স্বর্ণ জিতেছে মিতু।
তিনটি সোনাজয়ী বগুড়া সেন্ট্রাল হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী রুমি আকতারও এডওয়ার্ড পার্কের পুকুরে নিয়মিত অনুশীলনে আসে। ২০১২ সালে মহিলা গেমসে চ্যাম্পিয়ন ও পাঁচটি সোনাজয়ী শাহিনূর আকতারও কোচ মাসুদ রানার কাছে নিয়মিত সাঁতার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এ ছাড়া রৌপ্যজয়ী নিশি আকতার এখনো নিয়মিত সাঁতার শিখছেন।
কোচ মাসুদ রানা বলেন, ‘বগুড়ার মেয়েরা বিশ্ব সাঁতার প্রতিযোগিতায় যেদিন বাংলাদেশের লাল-সবুজের জয়ের পতাকা ওড়াবে, সেদিনই নিজেকে ধন্য মনে করব। ১৯ জন মেয়েকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। একজন দেশসেরা হলেও আমার প্রচেষ্টা সার্থক হবে। মেয়েদের পাশাপাশি নয়ন ইসলাম নামের এক কিশোর সাঁতারু এখন পর্যন্ত ১৯টি স্বর্ণ জয় করেছে।