banner

শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 199 বার পঠিত

 

সেঁজুতি মানে সন্ধ্যাপ্রদীপ

১৯৯৩ সালের এক সন্ধ্যায় মেয়েটি পৃথিবীকে দেখল প্রথম। মায়াবী আলোয় মাখামাখি ফুলের মতো একটি মুখ। মা-বাবা তার নাম রাখল সেঁজুতি চৌধুরী। সেঁজুতি মানে সন্ধ্যাপ্রদীপ। কিন্তু তখন কি আর বোঝা গেছে নিজের মধ্যে সন্ধ্যার এক টুকরো অন্ধকারও সে বয়ে এনেছে!
ওর বয়স ছয় বা সাত মাস পেরোতেই সেটি বোঝা গেল। ডাক দিলে শোনে না। জোরে চিৎকার করলে শোনে না! পাশে সশব্দে মিউজিক প্লেয়ারে গান বাজলে, জোরে টিভি চললে মেয়েটির মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না। মা জয়শ্রী চৌধুরীর বুকটা কেঁপে ওঠে। সংগোপনে চোখ মোছেন, তবে কি মেয়েটা মূক ও বধির হয়ে জন্মাল? চিকিৎসককে দেখালে ওটাই চরম এক সত্যি হয়ে ধরা পড়ল। ডাক্তার বললেন, প্রায় বিকল শ্রবণেন্দ্রিয় নিয়ে জন্মেছে মেয়েটি। তবে কথা বলতে পারবে। তবে সে জন্যও পাড়ি দিতে হবে অনেক চড়াই-উতরাই। সরকারি চাকরির সুবাদে বাবা সুপ্রীতি চৌধুরী থাকতেন বগুড়ায়। সেখান থেকেই চিকিৎসার শুরু। তারপর কলকাতা, চেন্নাই, ঢাকা। ফুটফুটে মেয়েটিকে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থেকে একটু স্বাভাবিক করে তুলতে কী প্রাণান্ত চেষ্টা!
মা জয়শ্রী চৌধুরী, বাবা সুপ্রীতি চৌধুরী, কাকা সজল চৌধুরী বা গোটা পরিবারের শ্রম-ঘাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা আজ সার্থক। সেঁজুতি আজ পার নওগাঁর চৌধুরী পরিবারের গর্ব। ২০১১ সালে ঢাকার প্রিপারেটরি গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে জিপিএ ৫ পেয়ে উত্তীর্ণ সে মাধ্যমিক পরীক্ষায়, ২০১৩ সালে হলিক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে জিপিএ ৫ পেয়ে উচ্চমাধ্যমিক। ইচ্ছে ছিল প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। বাক, শ্রবণ বা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের নেওয়া হয় না—প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নোটিশটা দেখে ওর মন খারাপ হয়ে যায়। মেধার মূল্যায়ন কেন করবে না দেশের শীর্ষ সারির এই শিক্ষায়তন? ও প্রতিজ্ঞা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার। ওই বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হয় ফার্মেসি বিভাগে। এখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। মেধার স্বাক্ষর রেখে এগিয়ে চলেছে দৃপ্ত পায়ে।
ঢাকার সোসাইটি ফর অ্যাসিস্ট্যান্স টু হিয়ারিং ইম্পেয়ার্ড চিলড্রেন (সাহিক) থেকেই কথা বলা শেখানো হয়েছে তাকে। তবু কথা বলে খুব ধীরে। সে কথা শুনতেও কাছের লোকদের কষ্ট কম হয় না। দেড় বছর বয়স থেকেই কানে উঠেছে শ্রবণযন্ত্র। প্রায় দেড়-দুই লাখ টাকা দামের যন্ত্র কানে লাগিয়ে চলতে হয়। গান তার ভীষণ প্রিয়। কিন্তু শুনতে তো পারে না, টেলিভিশন বা সরাসরি কোনো অনুষ্ঠানে শিল্পীদের ঠোঁটের ভাষা পড়ে বুঝে নেয়। নাচতে পারে। সুন্দর ছবি আঁকে। সবচেয়ে ভালো সে লেখাপড়ায়। সব প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে সেটির প্রমাণ সেঁজুতি দিয়ে চলেছে নিরন্তর। ওর ক্লাসের বন্ধুরা ওকে দেখে বিস্মিত হয়, গৌরব বোধ করে—শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে এগিয়ে চলা একজন তাঁদের সহপাঠী! ক্লাসে বসে একেবারে সামনের বেঞ্চে। তবুও কথা শুনতে পারে না। শিক্ষকদের নোট তুলে নেয় খাতায়। বাসায় নিয়ে আসে অডিও ক্লিপিংস। তাতেই সেরা ছাত্রদের একজন। ওর বন্ধু ফ্লোরা, অন্তরা, ঐশী, তিথি, তুলতুল ওকে তো একেবারে চোখে হারায়। আর শিক্ষকেরা? ফার্মেসি অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম, অন্যান্য শিক্ষক যেমন সামিউল স্যার, সীতেশ চন্দ্র বাছার স্যারদের কাছে খুব প্রিয় ছাত্রী সেঁজুতি। এই তো কিছুদিন আগে সামিউল স্যার এক গবেষণার কাজে ২৫ জন ছাত্রের মধ্যে নির্বাচিত করেছেন ওকে। একমাত্র ছোট ভাইটি ভর্তি হয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরিবারে গর্ব আর আনন্দ জড়াজড়ি করে থাকে।
কিন্তু পেছনের দিনগুলোর কথা ভাবতে গেলেই সেঁজুতির মা জয়শ্রী একটু বিহ্বল হয়ে পড়েন। জীবনের ওপর দিয়ে কী ঝড়টাই না বয়ে গেছে। নিজের ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন মেয়েকে সমাজের আর দশটি প্রতিভাবান মেয়ের মতো বড় করে তুলবেন, তিনি পেরেছেন। আর এই লড়াইয়ে জয়শ্রী সবচেয়ে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন সাহিকের শিক্ষক মমতাজ খানমকে। নিজে একবার সাহিক নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ মায়ের খেতাব পেয়েছেন, তবু বলেন, ‘মমতাজ আপা না থাকলে সেঁজুতিকে মানুষ করতে পারতাম না।’
একদিন সেঁজুতিদের বাসায় গিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। কথা তো নয়, খাতার পাতায় লিপি বিনিময়। ভবিষ্যতে তুমি কী করবে সেঁজুতি? মুক্তোর মতো হস্তাক্ষরে সে লিখে জানায়, ‘ফার্মাসিস্ট হতে চাই। আর যদি সুযোগ পাই, কাজ করব গবেষক হিসেবে। উচ্চতর শিক্ষা নিতে যাব বিদেশে।’
সেঁজুতির এই ইচ্ছে যে পূরণ হবে, সেই বিশ্বাস আছে ওর মা-বাবার। আছে ওর ক্লাসের বন্ধু আর শিক্ষকদের। নাম সন্ধ্যাপ্রদীপ, আঁধারে আলো জ্বালানোই যে তার কাজ!

Facebook Comments