banner

বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 726 বার পঠিত

 

শৈশব কথন

সার্জিন খান


ছোটবেলায় আমার এক ধরণের অদ্ভুত খেলা ছিল। ছাদ থেকে লাফ দেওয়া। প্রথম প্র‍্যাক্টিস করতাম বাসার একতলা ছাদ থেকে লাফ দিয়ে। দেখতাম ব্যাথা পাই কি না! প্রথম প্রথম ভুল পজিশনে লাফ দেওয়ায় পা মচকে যেত। এরপর ব্যাথা পেতে পেতে ঠিকমতো লাফ দেওয়াটা শিখে ফেলেছিলাম।
তারপর দোতলা থেকে লাফ দেওয়ারও চেষ্টা করেছিলাম, এবং যথারীতি সেখানেও প্র‍্যাক্টিসের বদৌলতে সফল হয়েছিলাম।

আমাদের বাসাটা ছিল একতলা। তাই এলাকার বিভিন্ন দোতলা, তিনতলা বাসার ছাদে ভর দুপুরে যখন এলাকা নিশ্চুপ তখন চুপিচুপি উঠে লাফ দিতাম। তিনতলা থেকে মাত্র দুইবারই লাফ দিয়েছিলাম, প্রথম বার লাফ দিয়ে পায়ে সামান্য ব্যাথা পেয়েছিলাম, আর দ্বিতীয়বার ঠিকমতোই লাফ দিয়েছিলাম। তবে সেসময় বাবা দেখে ফেলেছিলেন।
আমি কাজটা করতাম বিকেলে। আমার কিছু বন্ধুরা যেদিন আমার সঙ্গে খেলতো না ঐসময় আমি একা একা এই কাজটা করতাম। বাসায় কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতাম, খেলতে গিয়েছি।

সেদিন বাবা অফিস শেষ করেই বাসায় চলে এসেছিলেন, আমাদের ব্যবসার শো-রুমে যাননি। অফিসের পর শো-রুম বন্ধ করে আসতে আসতে বাবার রাত হয়ে যেত। ঐদিন বাবা অসুস্থ ছিলেন। শরীরে জ্বর নিয়ে রিক্সা দিয়ে যখন এলাকায় ঢুকছেন, তখন দেখেন আমি তিনতলা একটা বাসার ছাদ থেকে লাফ দিচ্ছি। এরপর পরই দেখলেন আমি দৌড়ে জোড়পুকুরের দিকে(আমাদের জয়দেবপুরে শৈশবের বাড়ির ঠিকানা) ছুটে যাচ্ছি। তিনি এমনিতেই প্রেশারের রোগী। আমার এই অবস্থা দেখে তাঁর হার্টবিট বেড়ে গিয়েছিল। তিনি যে পুরো ব্যাপারটা দেখেছিলেন এবং আমি যে তাকে দেখিইনি এই ব্যাপারটা আমি জানতাম না। আমাকে কিচ্ছু না বলে তিনি সোজা বাসা চলে আসলেন।

বাসায় এসে সবুজ চিকন কাঁচা বাশের কঞ্চি পেছনে রেখে বসে ছিলেন। আমি অন্যান্য খেলা শেষ করে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে সন্ধ্যা নেমে গেল। তিনি চেয়ারে বসে ছিলেন। কোন কথা না বলেই সমানে শক্ত মার দেওয়া শুরু করলেন। তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। বলা যায় একেবারে বাচ্চা মানুষই। ছাদ থেকে লাফ দিলে যে মানুষ মারা যায় এই সামান্য বোধটাও ছিল না। কেন যেন আমার ভয় লাগতো না। তাই বাবা কেন মারছিলেন সেটা ঠিক বুঝতেই পারিনি। বরং তখন বাবাকে ভিলেনের মতোই লাগছিলো। ছাদ থেকে লাফ দিলে কাউকে মারতে হয় নাকি? আশ্চর্য্য!

তখন দাদী ছুটে এলেন আমাকে বাঁচাতে। আমাকে জড়িয়ে ধরে বাবাকে বকতে শুরু করলেন। বাবা তখনও রাগে ফুঁসছেন। এরপর কিছু না বলে চুপচাপ সরে গেলেন নিজের ঘরে। সে রাতেই তাঁর জ্বর আরো ঝেঁকে এলো। আমারও জ্বর এলো। তাঁর এসেছিল আগে থেকেই, আমার এসেছিলো মার খেয়ে। মা বাবাকে আর আমাকে পাশাপাশি শুইয়ে দুইজনের সেবা করতে থাকলেন।

কিছুক্ষণ থাকতে থাকতে আমি ঘুমিয়ে গেলাম। অনেকক্ষণ পরে যখন ঘুম ভাঙলো তখন দেখি বাবা পাশে নেই। আমি অন্য বিছানায়। একটু নড়তেই খেয়াল করলাম পলিথিনের প্যাকেটের কিছু মচমচ শব্দ। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে বুঝতে পারছিলাম চকলেটের কোন প্যাকেট হবে।

বারান্দা দিয়ে লাইটের আলো আসছিলো। আধো আলো আদো আঁধারের মাঝে দেখে নিশ্চিতই হলাম যে এগুলো চকলেটেরই প্যাকেট। কোকোলা চকলেট জেমস আর মিমি চকলেট।
অনেকক্ষণ কারোর আসার শব্দ না পেয়ে আমি চকলেটগুলো খুলে কাঁথার তলে বসে একটার পর একটা খেতে থাকলাম। কিভাবে এগুলো আসলো, কে দিলো এসব কিছুই তখন মাথায় আসেনি।
কিছুক্ষণ পর বাবা-মায়ের গলা আবিষ্কার করলাম। খেতে বসেছিলেন। আমাদের বাসাটা ছিল একদম ছোট, এক রুমের মাঝে আরেক রুমের কথা শুনতে পেতাম।
– ছেলের সাহস দেখছো? কত বড় বিল্ডিং থেকে লাফ দেয়! কত্ত বড় কলিজা!
মা কোন কথা বলছিলেন না। চুপ করে ছিলেন।

এরপর কেটে গেল কতগুলো বছর। দাদী মারা গেলেন, বাবা-মা বৃদ্ধ হলেন। বাসা ভর্তি তাদের নাতি-নাত্নি এলো। আমার ছেলে পৃথিবীতে এলো। যেই আমি আগে এক থেকে দুইতলা, দুই থেকে তিনতলা; ঐদিন ধরা না খেলে হয়তো বা আরো উঁচু বাসার ছাদ থেকে লাফ দিতে পারতাম। সেই আমি জীবনের ট্র‍্যাজেডিতে পরে শরীরের সব অঙ্গকে কোনমতে ওষুধের বদৌলতে টিকিয়ে রেখে স্বপ্ন দেখে যাচ্ছি আমার ছেলের ভবিষ্যৎকে গুছিয়ে রাখার।
তবুও মাঝে মাঝে মনে হয় আহা রে! কি দিনই না ছিল। আজকাল যখন দুরন্ত কোন শিশুদের দেখি মনের মাঝে উঁকি দেয় অতীতগুলো।

যখন দেখি কোন শিশুকে শাসণ করতে তখন যেন মনে হয় আহা রে! বাচ্চাটার মনে কি ঝড়টাই না যাচ্ছে, বাবা-মাদের বুকটা কতই না ফেটে যাচ্ছে।
অতীত স্মৃতির মাঝেও অনেকেই নিজেকে খুঁজে পায়। কিন্তু সেই অতীতগুলোকে ঘিরে থাকা সেই স্থানগুলোকে বদলে যেতে দেখলে কেন যেন মন চায় না। স্বার্থপরের মতো তখন মনে হয় দুনিয়া বদলে যাক, আমার শৈশবের ঘরবাড়িগুলো আগের মতোই থাকুক।
আজকে হঠাৎ করে আমাদের জোড়পুকুর পাড়ের সেই বাড়িটাকে অসম্ভব মিস করছি। আমার দুরন্ত শৈশবের পুরোটাই কেটেছে সেখানে। আজকে নিজেদের বাড়ি হয়েছে, কিন্তু এরপরেও প্রায়ই স্বপ্নে সেই বাড়িটাকে স্বপ্নে দেখি, আমার শৈশবকে স্বপ্নে দেখি।

লেখক পরিচিতি:
লেখক/প্রকাশক/সম্পাদক/সংগঠক।

Facebook Comments