banner

সোমবার, ০৬ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 278 বার পঠিত

 

ময়মনসিংহের মেয়েরা তৈরি হচ্ছে ক্রিকেটের জন্য

সপ্তম শ্রেণির চুমকি আক্তার ও অষ্টম শ্রেণির আফরিন আক্তার মুক্তাগাছা থেকে ময়মনসিংহ শহরে আসে শুধু ক্রিকেট অনুশীলন করার জন্য। বাসে করে সকাল সাতটায় এসে অনুশীলন শেষে আবার বাসে করে বাড়ি ফেরে তারা। আসা-যাওয়া করতে দেড় ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যায়। মুক্তাগাছা ফিরে তারপর তারা স্কুলে যায়। ছয় মাস ধরে তাদের এ রুটিন। পরিবারের সদস্যরা তাদের খেলার বিষয়টি মেনে নিলেও পাড়াপড়শিদের অনেকেই হাসাহাসি করে। তবে চুমকি ও আফরিন সেসব গায়ে মাখে না।

শুধু মুক্তাগাছা নয়, ত্রিশাল এবং অন্যান্য জায়গা থেকেও সকালে মেয়েরা শহরের জয়নুল আবেদিন পার্ক বা সার্কিট হাউস মাঠে জড়ো হয় ক্রিকেট চর্চার জন্য। কোনো কোনো দলে শুধু মেয়েরা, আবার কোনো কোনো দলে ছেলেমেয়ে একসঙ্গেই প্র্যাকটিস করে। শহরের সকালের এই দৃশ্য সবার কাছে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। তবে এখন পর্যন্ত মেয়ে ক্রিকেটারের সংখ্যা তেমন একটা বাড়েনি।

ময়মনসিংহে বিভিন্ন দলের কোচদের বক্তব্য হচ্ছে, মেয়েদের ক্রিকেটার হয়ে ওঠার সম্ভাবনা অনেক। পরিবারও আগের চেয়ে এ বিষয়ে উৎসাহী। এখন প্রশাসন থেকে কিছু উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। মেয়েদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো দরকার।

গত মাসে চুমকি ও আফরিনের সঙ্গে কথা হয় সার্কিট হাউসের মাঠে। প্র্যাকটিস শেষ করে বাড়ির পথে পা বাড়ানোর আগে কথা বলে তারা। অনুপ্রেরণা স্পোর্টস একাডেমির কোচ এস এম মুখলেছুর রহমান চুমকি-আফরিনসহ ২০ জন মেয়েকে নিয়ে একটি নারী ক্রিকেট দল তৈরি করেছেন।

কোচ জানালেন, তাঁর দলের নিগার সুলতানা বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের উইকেটকিপার। শেরপুরের ১৬ জন মেয়ে ঢাকায় খেলছে। বড় বড় দল থেকে মেয়েরা ডাক পাচ্ছে। তবে এই মেয়েদের তৈরি করার জন্য প্র্যাকটিসের কোনো জায়গা পাওয়া যায় না। ড্রেসিং রুম এমনকি কোনো ওয়াশরুমও নেই।

ময়মনসিংহের জয়নুল আবেদিন পার্কে গিয়ে দেখা গেল, মোহামেডান একাডেমির কোচ গোলাম কিবরিয়ার কাছে ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে প্র্যাকটিস করছে। এই একাডেমির খেলোয়াড় জুনায়েদ জাহানের মতে, প্র্যাকটিস করার সময় কে ছেলে আর কে মেয়ে তা মাথায় থাকে না। তবে নতুন কেউ খেলতে এসে প্রথম দিকে খানিকটা বিব্রতবোধ করে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নারী খেলোয়াড়ের মতে, ছেলেমেয়ে একসঙ্গে প্র্যাকটিস করলে তুলনামূলকভাবে নারীরা একটু পিছিয়েই থাকে। অনেক সময় মেয়ে ও তার পরিবারও একসঙ্গে প্র্যাকটিস করার বিষয়টি মেনে নিতে পারে না। কোচ গোলাম কিবরিয়া বললেন, ময়মনসিংহে মেয়েদের মধ্যে সম্ভাবনা অনেক। তবে তারা সেভাবে সুযোগ পাচ্ছে না। মেয়েদের জন্য নেই আলাদা কোনো বাজেট। এই একাডেমিতে ছেলে ৬০ জন আর মেয়ে মাত্র ৫ জন।

মোহামেডান একাডেমিতে কামরুন নাহার খেলছেন গত চার বছর ধরে। বর্তমানে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে খেলেন। তিনি বলেন, প্র্যাকটিস করার সময় আশপাশ দিয়ে যাঁরা হেঁটে যান, অনেকেই অনেক সময় মন্তব্য করেন। একজন একদিন বললেন, ‘শুধু শুধু খেলতাছে, অ কি আর বড় প্লিয়ার হইব নাকি?’

শামসুন নাহার খান ছোটবেলা থেকে খেলছেন বিষয়টি তেমন নয়। স্নাতক শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি মাঠের মধ্যে ছেলেমেয়েদের একসঙ্গে প্র্যাকটিস করতে দেখেন। তা  দেখেই চিন্তা করেন অন্য মেয়েরা পারলে তিনি কেন খেলতে পারবেন না।

অভিভাবক মেহেরুল হক, সুপ্রীতি দাস, রোজী আক্তার পার্কে বসে ছেলেমেয়েদের প্র্যাকটিস দেখছিলেন। মেহেরুল হক বললেন, ছেলেমেয়েদের জন্য সকালে আসতে হচ্ছে। এখানে এসে অভিভাবকেরা হাঁটাহাঁটি করেন। তারপর একসঙ্গে বাসায় ফেরেন। মোহামেডান একাডেমিতে শৃঙ্খলাবোধ ভালো। তাই ছেলেমেয়ে একসঙ্গে প্র্যাকটিস করছে, তা আলাদা কিছু মনে হয় না।

ক্রিকেটসহ যেকোনো খেলার ক্ষেত্রেই পুষ্টিকর খাবার দরকার হয়। খেলার উপকরণ কিনতে হয়। এগুলো অনেক ব্যয়বহুল। অনেক পরিবারের ইচ্ছা থাকলেও ছেলে বিশেষ করে মেয়েদের কিনে দিতে চান না বাড়তি খরচ মনে করে। তাই নারী খেলোয়াড়দের বড় ক্ষোভ জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। তাদের অভিযোগ, কর্তৃপক্ষ চাইলেই মেয়েরা সংস্থার মাঠে প্র্যাকটিস করতে পারে। পেতে পারে অন্য সুযোগ-সুবিধা।

অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেল লোহার মরচে ধরা সংস্থার গেট খুলে ভেতরে ঢুকে। কমপ্লেক্সের মাঠে বড় বড় গাছ গজিয়েছে। মাঠে গরু-ছাগল ঘাস খাচ্ছে। কমপ্লেক্সে কাজ করছেন এবং সরকারের অন্যান্য বিভাগের কর্মচারীরা ক্রীড়া কমপ্লেক্সের ভেতরে বাড়িঘর তৈরি করে থাকছেন।

জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক শামসুন্নাহার প্রথম আলোকে বলেন, সংস্থার জন্য সরকারের বার্ষিক অনুদানের পরিমাণ ১ লাখ ২০ হাজার টাকা মাত্র। এ অনুদানের মধ্য থেকে বিদ্যুৎ বিল, কর্মচারীর বেতনসহ সবকিছুই দিতে হয়। মেয়েদের হ্যান্ডবলসহ কিছু খেলায় সংস্থার পক্ষ থেকে সাহায্য-সহায়তা করা সম্ভব হলেও মেয়েদের ক্রিকেটের জন্য কোনো বাজেট বা সুযোগ-সুবিধা নেই। সংস্থার মাঠে ক্রিকেটের জন্য একটি পিচ তৈরি করে দিতে পারলে মেয়েদের আর বাইরে ছেলেদের সঙ্গে প্র্যাকটিস করতে হয় না। কিন্তু সে সামর্থ্য নেই।

‘মেয়েদের ঘর থেকে বের করাই এখন পর্যন্ত বড় সমস্যা। সে জায়গায় তারা ক্রিকেটের মতো খেলা খেলছে। তাদের একটু সহযোগিতা করতে পারলে তারা অনেক ভালো করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’ এমনই আশা শামসুন্নাহারের।

Facebook Comments