banner

সোমবার, ০৬ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 431 বার পঠিত

 

বেগম রোকেয়া : নারী জাগরণের অগ্রদূত

ইয়ামিন আকন্দ

বাঙালি মুসলমান সমাজ যখন সামাজিক কুসংস্কার ও ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতায় আবদ্ধ ছিল; তৎকালীন নারী সমাজের শিক্ষার আলো নিয়ে এসেছিলেন নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া। বেগম রোকেয়ার জন্ম ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে।

আজ বাঙালি লেখক, শিক্ষাবিদ, নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়াকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। তার কর্ম ও আদর্শকে উদযাপনের লক্ষ্যে জন্ম ও মৃত্যুদিন ৯ ডিসেম্বরকে ‘বেগম রোকেয়া দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।

অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে তিনি হয়েছিলেন বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত। তার বাবা আবু আলী হায়দার সাবের বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শী হলেও মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে ছিলেন রক্ষণশীল। বড় দুই ভাই-বোনের সহযোগিতায় তিনি গোপনে শিক্ষালাভ ও সাহিত্যচর্চা করেন।

১৮৯৮ সালে বিহারের ভাগলপুরের সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন ছিলেন একজন উদার মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তি। স্বামীর সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কারণেই তার জ্ঞানচর্চার পরিধি বিস্তৃত হয়। ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি দেশ-বিদেশের লেখকদের রচনার সাথে পরিচিতি ঘটতে থাকে। ১৯০৯ সালে স্বামী মারা গেলে বেগম রোকেয়া নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন।

১৯০২ সালে নভপ্রভা পত্রিকায় ‘পিপাসা’ প্রকাশের মাধ্যমে সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতি পান। ১৯৫০ সালে মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য রচনা ‘সুলতানাস ড্রিম’ যার অনূদিত রূপ ‘সুলতানার স্বপ্ন’ প্রকাশের মাধ্যমে সর্বজন পরিচিত হয়ে ওঠেন। এটিকে বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যে একটি মাইলফলক ধরা হয়। তার অন্যান্য গ্রন্থ হলো- পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, মতিচুর। প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাসের মধ্যদিয়ে তিনি নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আর লিঙ্গসমতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। হাস্যরস আর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের সাহায্যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অসম অবস্থান ফুটিয়ে তোলেন।

২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা একটি জরিপের আয়োজন করে। ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ তিরিশ দিনের ওপর চালানো জরিপে শ্রোতাদের ভোটে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ ২০ জনের জীবন নিয়ে বিবিসি বাংলায় বেতার অনুষ্ঠান পরিচালিত হয়। সেই শ্রেষ্ঠ কুড়ি জনের তালিকায় ষষ্ঠ স্থানে ছিলেন আমাদের বেগম রোকেয়া।

বিবিসি বাংলার প্রথম তথ্যচিত্র নির্মাতা বাণী দত্ত জানান, কিভাবে কুসংস্কারের বেড়াজাল থেকে তিনি নারীদের শিক্ষাদানে ব্রতী হয়েছিলেন, কিভাবে নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ বিসর্জন দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুল। যেটি আজ কলকাতার লর্ড সিনহা রোডের প্রথম সারির স্কুল। বেগম রোকেয়ার সাংগঠনিক কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ততা ছিল। ১৯১৬ সালে তিনি আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম নামে একটি মহিলা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এটি নারীদের শিক্ষা এবং কর্মসংস্থান নিয়ে কাজ করতো।

বেগম রোকেয়ার অসামান্য অবদানের জন্য তিনি এখনো সর্বজন স্মরণীয় হয়ে আছেন। বেগম রোকেয়া ১৩৭তম জন্মদিনে গুগল তার নামে একটি ডুডল তৈরি করে। ২০০৮ সালের ৮ অক্টোবর রংপুর বিভাগের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। যা ২০০৯ সালে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে নামকরণ করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীদের জন্য আবাসিক হল বেগম রোকেয়ার নামে নির্মাণ করে। বাংলাদেশ সরকার বেগম রোকেয়া স্মরণে গণউন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে স্থাপন করা হয় বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র। যা বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে।

তিনি প্রথম নারীদের সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার কথা ভেবেছিলেন। বেগম রোকেয়া ছিলেন আত্মশক্তিতে বলীয়ান। অনেক দুঃখের বোঝা মাথায় নিয়েও নিজেকে কখনো অসহায় ভাবেননি। নারী শিক্ষার গুরুত্ব তিনি তার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝেছিলেন। তিনি কখনোই নারীতান্ত্রিক কিংবা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তুলতে চাননি।

তিনি চেয়েছিলেন, নারী ও পুরুষ উভয়ই যেন সমান মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে বাঁচেন। তিনি নারী-পুরুষকে একটি গাড়ির দুটি চাকার সঙ্গে তুলনা করেছেন। নারীকে জাগিয়ে তুলেছিলেন, নারীর পরাধীনতায় হয়েছিলেন সোচ্চার। বর্তমানে নারীদের ভোটাধিকার, শিক্ষার অধিকার, কর্মসংস্থানের সুযোগ হতো না। যদি কেউ নিজ থেকে উদ্যোগ না নিতেন। অথবা নারীশিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে না পারতেন।

বেগম রোকেয়া তার লেখনীর মাধ্যমে, সামাজিক কার্যক্রমের মাধ্যমে নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দকে বিসর্জন দিয়ে হাজার নারীর মাঝে তার চেতনা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তার অনুপ্রেরণামূলক কাজ বর্তমান নারীদের এতদূর নিয়ে এসেছে। নারীদের কাছে একজন অনুপ্রেরণীয় ব্যক্তিত্ব।

তাই তো ৯ ডিসেম্বরকে বেগম রোকেয়া দিবস হিসেবে পালন করা হয়। নারীদের শিক্ষা অর্জনের পথের কাঁটা সরাতে পেরেছিলেন বলেই আজ নারীদের সর্বক্ষেত্রে বিচরণ রয়েছে।

লেখক: শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

Facebook Comments