banner

শনিবার, ০৪ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 214 বার পঠিত

 

বাসযাত্রীরাও শাহনাজের পরিবার

গত বছরের ৮ নভেম্বর ২০১৬, সন্ধ্যা ছয়টা। রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বর পার হয়ে পূবালী ফিলিং স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বাসটি। আর বাসের গেটে দাঁড়িয়ে একজন নারী অনবরত বলে চলছেন, ‘শুধু মহিলা! মিরপুর ১০, ১১, ১২, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া’।
এই কাজ যিনি করছেন, তিনি শাহনাজ পারভীন। পেশায় একজন বাস কন্ডাক্টর। আর বাসটি নারী যাত্রীদের জন্য। নারীদের যাতায়াত সেবা দিতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) ঢাকায় ১৫টি এবং চট্টগ্রামে ২টি বাস চালু রেখেছে। এই বাসগুলোর সব কন্ডাক্টরই নারী।
সাত বছর ধরে বিআরটিসির বাসে কন্ডাক্টরের কাজ করছেন শাহনাজ। যাত্রীদের বাসে ডেকে তোলা, নামানো, ভাড়া নেওয়া, চালককে সহায়তা করাসহ সব কাজই তাঁকে সামলাতে হয়। বিআরটিসি কর্তৃপক্ষ শুরুতেই তাঁকে তিন মাসের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। রবি থেকে বৃহস্পতি—সপ্তাহের পাঁচ দিন তিনি এখানে কাজ করেন। বাসটি সকাল সাড়ে সাতটায় মিরপুর ১২ থেকে এবং সন্ধ্যা সোয়া ছয়টায় মতিঝিল থেকে ছাড়ে।
যাত্রী ডাকার ফাঁকে ফাঁকেই শাহনাজের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। এর মধ্যেই এক-দুজন করে যাত্রী এসে বসতে শুরু করেন। শাহনাজ বলেন, ‘বিয়ের পরে স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় আসছি। একদিন আমার ভাই এসে বলে, বিআরটিসির মেয়েদের স্কুলবাসে চাকরি নিবি। আমি রাজি হই। সেই থেকে শুরু।’
বিআরটিসির মেয়েদের স্কুলবাসে পাঁচ বছর কাজ করার পর এখানে চাকরি নেন বরগুনার মেয়ে শাহনাজ। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ে হয় তাঁর। এরপর আর পড়ালেখা এগোয়নি। জীবন নিয়ে শাহনাজের কোনো স্বপ্নও ছিল না।
শাহনাজ নিজ থেকেই বলেন, ‘মহিলা হয়েও এই কাজে আসার সাহস কী করে হলো, নিজেও জানি না। তবে আমি কাউরে ডরাই না। বাসের সবাইকে ফ্যামিলি মনে করি। সবাইকে লাইক করি। সবাই আমাকেও লাইক করে।’
তাঁর কথার সত্যতা মিলল প্রত্যেক যাত্রীর সঙ্গে কুশল বিনিময়ের ধরন দেখে। বাসের যাত্রীদের বেশির ভাগই তাঁর পরিচিত। মূলত ব্যাংক ও ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করা নারীরাই এ বাসের যাত্রী। মিরপুর থেকে মতিঝিলের ভাড়া ২৫ টাকা।
শাহনাজ পারভীন l ছবি: খালেদ সরকাররাস্তায় তেমন কোনো সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় না শাহনাজকে। তিনি বলেন, প্রায়ই পুরুষ যাত্রী বাসে উঠে পড়েন। তাঁদের হেসে বলি, এটা শুধু মেয়েদের বাস। তখন তাঁরা সরি বলে নেমে যান। পুলিশও কোনো ঝামেলা করে না। মাঝেমধ্যে অবশ্য অন্য বাসের সহকারী বা রাস্তাঘাটে কিছু পুরুষের টিটকারি শুনতে হয়। এসব তিনি খুব একটা আমলে নেন না। শাহনাজ বলেন, ‘ইচ্ছা থাকলে যেকোনো কাজই করা যায়। কাজের আবার নারী-পুরুষ কী! অবশ্য মানুষের কথা কানে নেওয়া যাবে না।’
তিন বছর ধরে এই বাসে যাতায়াত করেন ব্যাংকার তহমিনা আক্তার। তিনি বলেন, ‘শাহনাজ আপা খুব সহযোগিতা করেন। তিনি যত্ন করে আমাদের নেওয়া-আনা করেন।’ এই বাসে নিয়মিত যাতায়াত করা সবার কাছে শাহনাজের মোবাইল নম্বর আছে। বাসটি কোথায় আছে জানতে তাঁরা যোগাযোগও করেন। অনেক সময় বাসটি দু-এক মিনিট যাত্রীদের জন্য দাঁড় করিয়েও রাখা হয়। রাস্তায় কোনো নারী যাত্রীকেই তিনি রেখে যেতে চান না। আবার অসুস্থ যাত্রীদের যত্নের সঙ্গে নামিয়ে দেন। নারীদের বাস হওয়ায় অনেক সময় স্বামী, ভাই বা বন্ধুকে রেখেই নারীকে বাসে তুলতে হয়। তখন একটু খারাপ লাগে শাহনাজের।
ফারজানা আলম নামের এক যাত্রী বলেন, ‘মেয়েদের জন্য সব সময় লক্কড়ঝক্কড় মার্কা বাস দেয়। মাঝেমধ্যেই গাড়ি নষ্ট হয়। তখন খুব ঝামেলা হয়।’ এর সঙ্গে সহমত পোষণ করেন অন্য যাত্রীরাও। এ কারণে আগের তুলনায় যাত্রী কিছুটা কমে গেছে বলে জানান শাহনাজ। সুফিয়া তরফদার বলেন, ‘নারীদের জন্য আরও বাস থাকা উচিত। এতে নারীরা নির্যাতনের হাত থেকে কিছুটা রেহাই পাবে।’
শাহনাজকে দেখা যায়, মজা করতে করতেই ভাড়া তুলছেন। যাত্রীরা তাঁদের খাবার দিচ্ছেন শাহনাজকে। বাসের ভেতরে মোটামুটি একটা পারিবারিক পরিবেশ। যানজটে কষ্ট হয় শাহনাজের। তিনি বলেন, ‘খালি মনে হয় আপাদের কখন বাসায় পৌঁছাই দেব।’
কাজ করলে প্রতিদিন ২০০ টাকা করে নির্ধারিত বেতন শাহনাজের। বেতন নিয়মিত নয়—অভিযোগ তাঁর। তিনি বলেন, ‘রোদ-বৃষ্টিতে ডিউটি করি, এখনো সাত-আট মাসের বেতন বকেয়া আছে।’ আর লাভ-লস যা-ই হোক, ভাড়া বাবদ দিন শেষে তাঁকে কর্তৃপক্ষকে জমা দিতে হয় ১ হাজার ৩০০ টাকা। এর বেশি আয় হলে তা শাহনাজের।
এ বিষয়ে বিআরটিসির চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান  বলেন, নারীদের যাতায়াত সেবা দিতে সাধারণ বাসের চেয়ে নারীদের বাস থেকে তুলনামূলক কম ভাড়া নেওয়া হয়।
৩৫ বছর বয়সী শাহনাজের প্রিয় নায়ক রঞ্জিত মল্লিক, সালমান খান। সাজগোজ করতে ভালোবাসেন। প্রিয় রং লাল। তাঁর দাদি আদর করে ডাকতেন লাল বুড়ি। ড্রাইভিং লাইসেন্স পেলেও আপাতত চালক হওয়ার ইচ্ছে নেই তাঁর।
শাহনাজের দুই ছেলে। বড় ছেলে উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষ আর ছোটটি চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। স্বামী ওমানপ্রবাসী। মিরপুরে স্বামীর ও নিজের জমানো টাকা দিয়ে একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। সেখানেই তিনি ছেলেদের নিয়ে থাকেন।
স্বামী ও ছেলেরা চান, তিনি কাজটি ছেড়ে দিন। কিন্তু তাঁর কথা, ‘এ গাড়ির যাত্রীরাও আমার পরিবার। তাঁদের না দেখে আমি থাকতে পারি না। আর আমি না থাকলে আপাদের কোনো সমস্যা হলে কে দেখবে!’ সব আপাকে ঘরে পৌঁছে দিয়েই তাঁর শান্তি। তাঁদের সেবা দেওয়ার মধ্যেই তাঁর সুখ।

Facebook Comments