banner

শনিবার, ০৪ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 260 বার পঠিত

 

পানির অপর নাম আনুরার জীবন

ক্লান্ত শহরটি নীরব-নিঝুম, সবাই তখন ঘুমের ঘোরে। এ রকম একটি সময়ে জেগে ওঠেন একজন নারী। সময়-সংসার তাঁকে যেন তাড়া করে। ঘুমিয়ে থাকলে চলে না তাঁর। তিনি মৌলভীবাজার শহরের পশ্চিম বাজার এলাকার আনুরা বেগম। বয়স কত! এটা বলা তাঁর কাছে কঠিন। তবু জানান পঞ্চাশ, হয়তোবা তার কাছাকাছি।

আনুরার শুধু এটুকু মনে আছে, ১৩ কি ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল একজন ইউনিয়ন পরিষদ কর্মচারীর সঙ্গে। মূল বাড়ি কিশোরগঞ্জের ভৈরবে। তবে বিয়ের পর থেকে মৌলভীবাজারেই বসবাস। সংসার চলছিল ভালোই। সংসারে দুই ছেলে ও এক মেয়েও এসে গেছে। কিন্তু হঠাৎ করেই ছেদ পড়ে। প্রায় ১৯ বছর আগে মারা যান স্বামী। এর এক-দুই বছর পর দ্বিতীয় বিয়ে করেন। দ্বিতীয় স্বামী শিক্ষক ছিলেন। এই সংসারে এল দুই কন্যা। কোনোভাবে ঠেলেঠুলে সন্তানদের নিয়ে সংসার চলছিল। ছেলেমেয়েরাও বড় হচ্ছিল। দ্বিতীয় স্বামীও একসময় অসুস্থ হয়ে পড়েন। এত দিন দুজনের শ্রমে, আয়-উপার্জনে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে যে সংসার চলছিল, সেই সংসারের পুরোটাই ঝুপ করে আনুরার কাঁধে এসে পড়ে।

ছেলেমেয়েদের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করা। ছোট মেয়ে দুটোকে লেখাপড়া করানো। কী করবেন, ভেবে কোনো দিশা মিলছিল না। একসময় চার দেয়ালের ভেতর আর তাঁর থাকা সম্ভব হলো না। দেয়াল তাঁকে ভাঙতেই হলো। হাতের কাছে যা পেলেন, তাই মনে হলো আকাশের চাঁদ। এটা প্রায় সাত বছর আগের কথা। শুরু করলেন মৌলভীবাজার শহরের পশ্চিমবাজার এলাকার কাঁচাবাজারের শাকসবজির দোকান ও আশপাশের ছোটখাটো হোটেল-রেস্তোরাঁয় পানি বিক্রি।

প্রথম দিকে বিভিন্ন জায়গা থেকে পানি এনে বিক্রি করতেন। পরে অনেকেই আর বিনি পয়সায় পানি দিতে চাইল না। এক জায়গা থেকে প্রতিদিন ১০০ টাকার পানি কিনতেন। সেই পানি ড্রামে করে দোকানে দোকানে পৌঁছে দিতেন। প্রতিদিন রোজগারের ১০০ টাকা চলে যাওয়ায় মনটা খচখচ করে। টাকাটা বাঁচানো গেলে সংসারের কাজে আসত। একদিন এলাকার কাউন্সিলর অলিউর রহমানকে বিষয়টি জানালেন। কাউন্সিলর দুই হাজার টাকা দিলে নিজের মতো করে পানি নেওয়ার একটা ব্যবস্থা করলেন।

প্রতিদিন রাত তিনটায় ঘুম থেকে জেগে ওঠেন। পরিবারের অন্য সদস্যরা তখনো ঘুমে। পানির লাইনের কাছে ছুটে যান। দু-একজন নৈশপ্রহরী ছাড়া আর কোনো জনমানুষ তখন থাকে না। এরপর একটা একটা করে ছোট-বড় ড্রাম ভরে তা রিকশাভ্যানে সাজিয়ে তোলেন। ড্রামগুলো পানিতে ভরে গেলে ভ্যান ঠেলে নিয়ে আসেন বাজারের কাছে। তখনো দোকানিরা আসেন না। আনুরা বেগম নির্দিষ্ট স্থানে রাখা পানির পাত্র ভরে রাখেন। সকাল নয়টা পর্যন্ত তাঁর এই পানি সরবরাহের কাজ চলে। সব কটি স্থানে পানি ভরা শেষ হলে তাঁর দিনের ছুটি। পানির পাত্র অনুযায়ী মেলে দাম। নিচে ৫ টাকা এবং ওপরে ৪০ টাকা। এতে প্রতিদিন তাঁর ৫০০ টাকার মতো আয় হয়। এই পানি বেঁচেই এখন তাঁর সংসার চলে। দুই মেয়ের একজন পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে, একজন সপ্তম শ্রেণিতে। এ থেকেই তাদের পড়ালেখার খরচ জোগান। বড় ছেলেটি অসুস্থ। তার ছেলেমেয়েকেও দেখাশোনা করতে হচ্ছে। দুই কাঁধে অনেক দায় তাঁর।

আনুরা বেগম বলেন, ‘সাত বছর ধরি এই কাজ করছি। মানুষের ছুটিছাটা আছে। আমার ঈদে-চান্দেও রেস্ট নাই। জীবনে তো কিচ্ছু নাই। কষ্ট করি বাইচ্চাইনতোরে পাড়াইতেছি। বাইচ্চাইনতর লাগিই এই কষ্ট কররাম। তবে এখন ব্যবসা নাই। দোকান কমে গেছে। আয়টাও তাই বাড়ছে না।’

রাতজাগা আর জলভেজা শীত-বর্ষার এই জীবন তাঁর চেহারায় ক্লান্তির ছাপ ফেলেই রেখেছে। কিন্তু কথা বলেন হেসেখেলেই। হয়তো তিনি ধরেই নিয়েছেন পানি চক্রের এই জীবন থেকে তাঁর বের হওয়ার কোনো রাস্তা নেই। এই পথ ধরেই যে তাঁকে বাকি জীবনের অনেকটা পথ যেতে হবে।

Facebook Comments