banner

সোমবার, ০৬ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 166 বার পঠিত

বেড়েই চলেছে আত্মহত্যা

অপরাজিতা ডেস্ক

 attohotta

 

রাজধানী ঢাকার খিলগাঁও, সি ব্লক বউবাজার এলাকার মোহাম্মদ আলমগীরের কন্যা ডা. আসমা সুলতানা (৩০)। ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সুদীর্ঘ ১০ বছর প্রেম করে ইঞ্জিনিয়ার স্বামী মাহাদী মাসুদকে দু’বছর আগে বিয়ে করেছিলেন। ৭ই ফেব্রুয়ারি শুক্রবার  কক্সবাজারের হোটেল মোটেল জোন কলাতলী সি-বিচ রিসোর্ট- এ ১১০ নম্বর কক্ষ থেকে সুইসাইড নোটসহ আসমার মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

 

গৃহবধূ বিউটি বেগম (২৫)। ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার পিরোজপুর গ্রামের শহিদুল ইসলামের কন্যা। একই উপজেলার আমবাগান গ্রামের মিঠু মিয়ার সঙ্গে তার বিয়ে হয় ২০১০ সালে। দু’বছর পর বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। স্বামী মিঠু মিয়া আবারও বিয়ের কথা বলে বিউটিকে কালীগঞ্জের কোলা গ্রামে নিয়ে যায়। সেখানে একটি কলাবাগানে তার সহযোগীদের নিয়ে শারীরিক নিপীড়ন করে। এর ভিডিওচিত্র ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়া হয়। হাতে হাতে পৌঁছে যায় এ ভিডিও চিত্র।  লজ্জা অপমান সইতে না পেরে ১৫ই ফেব্রুয়ারি  বিউটি বেগম তার নিজ বাড়িতে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।

 

কিশোরগঞ্জের ভৈরবের মুর্শিদ মুজিব উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী হাসি আক্তার জ্যোতি (১৫) স্থানীয় সুস্মিত সুলতান (২০) নামে এক যুবকের সঙ্গে পরিচয় থেকে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। তার কপট প্রেম বুঝতে পারেনি জ্যোতি। মনপ্রাণ উজাড় করে দেয় সুস্মিতকে। প্রেম গড়ায় শারীরিক সম্পর্কে। প্রতারক প্রেমিক সুস্মিত তাদের বিশেষ মুহূর্তের ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়। ফেসবুকে আপলোড করে। এরপরই  লজ্জায় অপমানে জ্যোতি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। প্ররোচনার অভিযোগে মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে সুস্মিত এখন কারাগারে। মামলা তুলে নেয়ার জন্য প্রভাবশালীরা চাপ দিচ্ছে জ্যোতির পরিবারকে। একদিকে মেয়ে হারানোর শোক, সামাজিক অসম্মান আর অন্যদিকে বিচার না পাওয়ার শঙ্কায় মুষড়ে পড়েছে জ্যোতির পরিবার।

 

এতো গেল আত্মত্যার খবর। পত্রিকার পাতা খুললেই প্রতিদিনই চোখে পরে নারী নির্যাতেনর প্রতিচ্ছবি। নারীদের আত্মহত্যার এমন প্রবণতা এবং নির্যাতন বাড়ছে দিন দিন। বিভিন্ন নারী সংগঠন ও বেসরকারি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী নারীদের আত্মহত্যার হার উদ্বেগজনক। নির্যাতন বা মর্যাদাহানির কারণে মেয়ের আত্মহত্যার অনেক খবর প্রকাশ হয় না বলে এর সঠিক পরিসংখ্যানও পাওয়া যায় না এসব সংস্থার দাবি। তবে সংস্থাগুলো বলছে, আত্মহত্যাকারীদের বেশির ভাগই বিভিন্ন বয়সী নারী।

 

নারী সংগঠনগুলোর অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রেমিক স্বামী কিংবা আপনজনের কাছ থেকে প্রতারিত ও ব্যর্থ হয়ে হতাশা, লজ্জা, ক্ষোভ, অপমান ও লোকলজ্জার ভয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে বিভিন্ন বয়সের নারীরা। এদের মধ্যে স্কুল, কলেজের ছাত্রী, গৃহবধূর সংখ্যাই বেশি। গ্রাম, শহর, পাড়া, মহল্লা সবখানেই উদ্বেগজনকভাবে এ সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

 

সহিংসতার মধ্যে রয়েছে ধর্ষণ, খুন, ধর্ষণ চেষ্টা, যৌন হয়রানি, এসিড নিক্ষেপ, যৌতুকের জন্য নির্যাতনসহ নানা ঘটনা। এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে আত্মহত্যা করেছেন প্রায় তিন হাজারের বেশি বিভিন্ন বয়সী নারী। নারী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বলছেন সরকার বা পুলিশ বিভাগের কাছে এর সঠিক পরিসংখ্যান নেই আর থাকলেও তারা তা প্রচার করতে অনিচ্ছুক। প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি।

 

গত ১২ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আইনি সংস্থা লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদ দেশে নারী নির্যাতন ও আত্মহত্যা সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ সংক্রান্ত তথ্য। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদে সংরক্ষিত ১৪টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এ পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়। তাতে দেখা যায়, ২০১৩ সালে বিভিন্ন বয়সী নারীদের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ৩৮৬টি। এর মধ্যে প্ররোচিত হয়ে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ৩৭টি।

 

 

বাংলাদেশ মহিলা পরিষেদর সভাপতি আয়শা খানম বলেন, এটা খুব অবক্ষয়ের ব্যাপার। এটা ঠিক না। তিনি মনে করেন আত্মহত্যা কোনো সমাধান না। এটা থেকে বের হয়ে আসার জন্য সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। আয়শা খানম আরো বলেন, হত্যা-নির্যাতনের প্রকৃতি এত ভয়াবহ ও নিষ্ঠুর রূপ লাভ করছে যে, ভাবতে অবাক লাগে। মানুষের সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক এত নির্মম রূপ পায়, যা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। তিন আরও বলেন, নারীরা সামাজিক আন্দোলনে রাজনৈতিক আন্দোলনে আসছে। বাংলাদেশে নারীদের ক্ষমতায়ন প্রতীকি ভাবে বাড়ছে । কিন্তু নারীর ক্ষমতায়নের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা এবং আইনি প্রদক্ষেপ নেয়ার দরকার বলেও মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, আমাদের দেশে যে নারীর ক্ষমতা বর্তমানে রয়েছ এটার ধারাবাহিক এবং স্থায়ীরুপ দিতে হবে। সমাজ এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে।

 

আত্মহত্যার তালিকায় বাসাবাড়ির গৃহপরিচারিকাও রয়েছেন। গৃহকর্তা বা গৃহকর্তীর মানসিক নিপীড়নে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে তারা। তাদের সংখ্যা ২৫। এছাড়া যৌন হয়রানির কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ২৪টি। বিভিন্ন কারণে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন ২২ জন নারী। এসব আত্মহত্যার নেপথ্যে থাকে প্রেমঘটিত প্রতারণা, বিশেষ মুহূর্তের গোপন ছবি ইন্টারনেটে প্রকাশ, ফেসবুক প্রতারণা, গোপন তথ্য ফাঁস হওয়া, জীবনসঙ্গীর পরকীয়া বা অন্য নারীর প্রতি আসক্তি, পারিবারিক মনোমালিন্য ও মানসিক নিপীড়ন, অভিভাবকদের অতিমাত্রায় শাসন, ইভটিজিং, যৌন হয়রানি, যৌতুক, প্রেমের সম্পর্কে জটিলতাসহ নানা কারণ। বিষয়টি খুবই উদ্বেগের বলে মনে করছেন আইন, মানবাধিকার ও নারী সংস্থার নের্তৃবৃন্দ।

 

খুশী কবির বলেন, নারীদের আত্মহত্যার প্রবণতা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। যদিও বিষয়টি অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে। বিশেষ ক্ষেত্রে আইন, সমাজের পাশাপাশি পরিবারও একজন নারীকে যথাযথ সমর্থন দেয়নি বা দেয় না। আর তখনি একজন নারী হতাশা, ক্ষোভ অভিমান নিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

 

খুশি কবির বলেন, যে পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছে প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। কখনও দেখা যায় হত্যার নামে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়া হয়। তাই নারীদের নিয়ে সমাজ ও পরিবারকে তার চিন্তাধারা বদলাতে হবে। এ দায়িত্বটি মূলত পুরুষদের। তাদের মানসিকতাও পরবির্তন করতে হবে। তিনি বলেন,  যতক্ষণ পর্যন্ত না মানসিকতার পরিবর্তন হবে ততক্ষণ এ অবস্থা চলতেই থাকবে। এক্ষেত্রে আইনের যথযথ প্রয়োগ, বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত একান্ত জরুরি।

 

নারী নেত্রী, মনোবিজ্ঞানী ও আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে সাধারণত নারীরাই আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন।

 

একজন সরকারি আইনজীবী (সহকারী  এটর্নি জেনারেল) এ বিষয়ে বলেন, নারীদের আত্মহত্যার প্ররোচনার জন্য বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে,  সেক্ষেত্রে মামলা হলেও শাস্তির নজির খুব একটা চোখে পড়ে না। এজন্য দায়ী আত্মহত্যার প্ররোচনার আইনগত সঠিক সংজ্ঞা না থাকা, মামলায় তথ্য, প্রমাণ, সাক্ষীর অভাব। যে কারণে নিম্ন ও উচ্চ আদালত থেকে আসামিরা সহজেই জামিন পেয়ে যায়।

 

সঙ্গত কারণে প্ররোচনাকারীদের আইন ও বিচারের মুখোমুখি করা যাচ্ছে না। নিম্ন ও উচ্চ আদালতের বেশ ক’জন আইনজীবী বলছেন বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩০৯ ধারায় আত্মহত্যা করার উদ্যোগ নেয়াও একধরনের অপরাধ। সেক্ষেত্রে এক বছরের কারাদণ্ড ও আর্থিক জরিমানার কথা বলা হলেও এই আইনের প্রয়োগ বর্তমানে নেই বললেই চলে।

 

উদ্বেগজনকভাবে নারীদের আত্মহত্যার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় সামাজিক অস্থিরতা, সহজলভ্য আকাশ সংস্কৃতি, ফেসবুক, ইন্টারনেটের সহজপ্রাপ্তি, মোবাইলের সহজলভ্যতাকেও দায়ী করছেন অনেকে। তারা বলছেন, এসব ক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের আরও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

 

 

 

বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রধান নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, ‘রাজনৈতিক অপরাধও বাড়ছে। থানায় কেস না নিতে চাওয়া এবং আইনের আওতায় এনে অপরাধীকে শাস্তি না দিতে পারায় অপরাধ বাড়ছে।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. তানিয়া হক বলেন, সমাজে নারীদের শারীরিক নির্যাতন আমাদের চোখে পড়লেও তাদের প্রতি মানসিক নির্যাতন ও নিপীড়ন চোখে পড়ে না। বলা হয়, নারীরা মুখ খুলতে চায় না।

 

এ জন্য তারা আত্মঘাতী পথ বেছে নেয়। তিনি বলেন, নারীরা এখনও কেন আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে তা বোধগম্য নয়। টিনএজ বা স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতার বিষয়ে ড. তানিয়া হক সরাসরি দায়ী করেন বিভিন্ন দেশের অপসংস্কৃতির আগ্রাসনকে। এ ছাড়া ফেসবুক, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোনের অপব্যবহার ও সহজলভ্যতাও এক্ষেত্রে দায়ী বলে মনে করেন তিনি। তথ্যসূত্র: ওয়েবসাইট

 

অপরাজিতাবিডিডটকম/আরএ/এ/৮মার্চ২০১৪

Facebook Comments