banner

বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 183 বার পঠিত

দরকার সবার সচেতনতা

 
১ অক্টোবর ২০১৪। ৩য় বারের মত পালিত হল বিশ্ব সেরিব্রাল পলসি দিবস। সেরিব্রাল পলসি এক ধরনের শারীরিক প্রতিবন্ধিতা। অনেক সময় লক্ষ্য করা যায় সচেতনতার অভাবে সেরিব্রাল পলসিকে অন্য প্রতিবন্ধিতার সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়, আমাদের সকলের ভুল ধারণা না হওয়ার লক্ষ্যে নিচে সেরিব্রাল পলসি কি এবং এর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করছি। মস্তিষ্কে বিশষত গুরুমষ্কি (সেরিব্রাল) অঞ্চলে কোন প্রকার পক্ষাঘাত বা প্যারালাইসিস হওয়াকে সেরিব্রাল পলসি (C.P.) বলে। মস্তিষ্কের গুরুমস্তিষ্কের মোটর অঞ্চলে অর্থাত্ যে অঞ্চলটি শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের নড়াচড়ার জন্য দায়ী, সেখানে কোন পক্ষাঘাত হলে ব্যক্তি সেরিব্রাল পলসি-তে আক্রান্ত হয়। দেখা যায় যে, শরীরিক প্রতিবন্ধীদের মধ্যে প্রায় ৩০-৪০% শিশুই সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত। 
রুদ্র (ছদ্মনাম) দশ বছরে পা দিয়েছে। সে সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত শিশু। আজকাল অনেক বেশি কান্নাকাটি, জেদ করে। যে ছেলেটি লক্স্মী, শান্ত প্রকৃতির ছিল সে হঠাত্ করেই কেন জানি বদলে যেতে শুরু করেছে। মা-বাবা তার নিজস্ব কর্মস্থলের দয়িত্ব, আরো একটি সন্তানের দেখভাল, সংসারিক কর্মকাণ্ড সবকিছু সামলাতে সামলাতে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন। আর তার সাথে যদি পরিবারে একজন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু থাকে তাহলে সেই পরিবারের প্রতিদিনকার চিত্র একটু ভিন্ন রকম হবে, এটাই স্বাভাবিক। রুদ্র প্রায় সময় কাঁদতে কাঁদতে বলে ‘আমার কিছু ভাল লাগে না, আমাকে তোমরা বোঝাও আমি কেন কাঁদছি? আমার কান্না করা ঠিক হচ্ছে না’ ইত্যাদি। রুদ্র নিজ থেকে বোঝে তার কান্না করা ঠিক নয়। অথচ আমাদের মতো তথাকথিত সুস্থ মানুষেরা ওর চাহিদা ও মনকে বুঝতে চেষ্টা করি না। আমরা বড়রা অনেক সময় মনের অজান্তে বলে ফেলি ‘তুমি যদি কান্না করো তাহলে তোমাকে রেখে আমি চলে যাব’ সামান্য এই কথাটায় অনেক সময় ওদের শিশু মনে ভয়ের সৃষ্টি করে ও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়। এ ধরনের অনেক ছোট ছোট ঘটনা আছে যা ওকে খুব পীড়া দেয় কিন্তু তা আমরা উপলব্ধি করি না বা বুঝতে চেষ্টা করি না, যার ফলশ্রুতিতে ওর সব কষ্টের বহিঃপ্রকাশ ঘটে কান্না, জেদের মাধ্যমে।
আমাদের দেশের সমাজ কাঠামো, পরিবেশ প্রতিবন্ধী বান্ধব নয়। প্রতিবন্ধী মানুষদের অধিকার রক্ষায় আইন হয়েছে কিন্তু তার সঠিক প্রয়োগ কখন হবে তা আমাদের সবার অজানা। আমাদের দেশের অধিকাংশ স্কুলগুলো সার্বিকভাবে প্রতিবন্ধী-বান্ধব নয়। কিছু সরকারি স্কুল আছে যেখানে Ramp আছে কিন্তু যে শিশু ৪/৫ ঘন্টা স্কুলে কাটাবে তার জন্যে কোন প্রতিবন্ধী-বান্ধব টয়লেটের সুব্যবস্থা সেখানে নেই। বাসে সংরক্ষিত আসন আছে কিন্তু Wheel Chair উঠানোর মত Accessible বাস নেই। অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরই সর্বস্তরে প্রবেশগম্যতা নেই, ফলে ৩/ ৪ তলায় ক্লাস করতে  হলে কষ্ট করে অন্যের উপর ভর করে উঁচু ভবনে উঠে ক্লাস করতে হয়। আমাদের দেশের অধিকাংশ ভবন সরকারের ইমারত বিধিমালা মান্য না করে গড়ে উঠা, সেসব ভবনে প্রবেশগম্যতা নেই।
সুতারাং যে সকল স্কুল এসব ভবনে পাঠ্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সে ব্যাপারেও সরকারের কোন যথাযথ তদারকী নেই। যে দেশে আপামর মানুষেরই মৌলিক অধিকারগুলো পেতে গলদঘর্ম হতে হয় সেখানে ওদের মত বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু যারা অনেক কাজেই অন্যের উপর নির্ভরশীল, সে সকল শিশুর ভবিষ্যতের কথা মনে হলে কষ্টে বুক ভারী হয়ে যায়। বিষণ্ন্নতায় ভরে উঠে মন। অন্তত একজন মা হিসাবে আমার সন্তান যাতে বাস্তবতার নিষ্ঠুুর রূপ দেখতে না পায় সেই চেষ্টা করে যাব সারা জীবন। আমার সন্তানকে এমনভাবে গড়ে তুলব যাতে সে বাস্তবতাকে নিজেই মোকাবেলা করতে পারে। প্রতিবন্ধিতা কোন দোষ, পাপ বা অভিশাপ নয়। সৃষ্টি কর্তার সৃষ্টিতে কোন ভেদাভেদ নেই। আমরা সবাই সৃষ্টি বৈচিত্র্যের অংশ। যে কেউই যে কোন সময় প্রতিবন্ধিতার শিকার হতে পারে। এক্ষেত্রে সচেতনতা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের কোন বিকল্প নেই। আমাদের সবাইকে এসব বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর কথা মনযোগের সহিত শুনতে হবে, তাদের প্রয়োজনীয়তা ও চাহিদাকে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষকসহ সকলকে সহানুভূতিশীল হতে হবে। নেতিবাচক  আচরণ ও মন-মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। প্রতিবন্ধী মানুষের সুপ্ত প্রতিভাকে সঠিত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও সুযোগের মাধ্যমে কাজে লাগাতে হবে।
সমাজের একটা বিরাট অংশকে আলাদা রেখে কোন রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়ন কখনই সম্ভব নয়। এসকল বিশেষ শিশু, কিশোর, ব্যক্তিদের সমাজের বোঝা না ভেবে তাদের উপযুক্ত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে সুযোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা রাষ্ট্রসহ সকলের দায়িত্ব। প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতিবন্ধিতা না দেখে তাদের সুপ্ত প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। তাদের প্রতি করুণা নয়, প্রয়োজন আমার-আপনার সকলের সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া। এ ক্ষেত্রে সকল ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া, বিভিন্ন উন্নয়নমূলক সংগঠনসহ বিশিষ্ট জনদের এক সাথে কাজ করতে হবে। আমার বিশ্বাস সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রুদ্র, নাবিলা আর জুয়েলসহ সকল প্রতিবন্ধী মানুষের বসবাস উপযোগী সার্বজনীন বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।
সূত্র- ইত্তেফাক।
Facebook Comments